সূর্য তুমি সাথী – আহমদ ছফা । surjo tumi shathi

  • বই: সূর্য তুমি সাথী
  • লেখক: আহমদ ছফা
  • প্রকাশক: মাওলা ব্রাদার্স (উপন্যাস সমগ্র)
  • মুদ্রিত মূল্য: ৫৫০/=
ছোটজাতের ছোটজাত হাসিম। পিতৃপ্রদত্ত নামখানা একরকম ভুলতে বসেছে। বান্যিয়ার পুত বলে ডাকে লোকে। তার এই নামকরণের পেছনে গভীর লজ্জা আর বেদনা লুকায়িত। পূর্বপুরুষ ছিল বনেদী হিন্দু। বাপ তার ভালবেসেছিল কাজী বাড়ির মেয়ে জরিনাকে। তার টানে উদাস হল, ঘর ছাড়ল, সবশেষে ধর্ম ত্যাগ করল। নগদ অর্থ আর স্বর্ণ তুলে দিল বাড়ির কাজের লোকের হাতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জরিনাকে পাওয়া হল না। পরিবর্তে বিয়ে হল ঐ বাড়িরই দাসীর সাথে। নির্মম মানসিক পীড়ায় পার করে দিল একটা জীবন। মরা মুখটা মাও দেখতে পেল না। মুসলমানের মরা দেখা যে পাপ। হোক না নিজের ছেলে।

বাবার উপর খুব ক্ষোভ জন্মে হাসিমের মনে। কি দরকার ছিল এসব করে? যন্ত্রণা তো শুধু নিজে ভোগ করল না। উত্তরাধিকার সূত্রে দিয়ে গেল হাসিমকে। আজ লোকের কাছে সে করুণার পাত্র, ঘৃণার পাত্র। দুমুঠো খাবারের ব্যবস্থা করতেই যেখানে শরীরের রক্ত পানি করতে হয় সেখানে সাধ, আহ্লাদ বা আবেগের মূল্য কোথায়? স্ত্রী সুফিয়াকে নিয়ে তার ছোট্ট পৃথিবী। চাওয়া-পাওয়ার বালাই নেই। তবে এতটুকু বেঁচে থাকাকে টেনে নিতেই সমাজ সংসারে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে হয়।

সমাজের উঁচুতলার মানুষেরা যেন হাসিমদের কৃপা করে ধন্য করে। তারা কাজ- কর্জ না দিলে চলবে কি করে তাদের? খলু ব্যাপারী, কাদের, কানা আফজলদের তো আর খাবার নিয়ে ভাবতে হয় না। তিন চার বছরের চিকন চাল মজুদ করে সালিশ আর দাঙ্গা হাঙ্গামা করে বাড়ায় সম্পত্তির পরিধি। খলু ব্যাপারীর হাতিয়ার ভাতিজি জোহরা। তাকে দুবার বিয়ে দিয়ে ছাড়িয়ে এনেছে। আর তার খোরপোষের বাহানায় জমি আদায় করে নিয়েছে পাত্রপক্ষ থেকে। এখন আবার খেলছে নতুন চাল। কাদিরও কম যায় না। আর সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে কানা অাফজল। এক সময়কার ফরমায়েশ খাটা লোকটি আজ গণ্যমান্য ব্যক্তি। তাদের সাথে সুদখোর অধরবাবুদেরও খাতির বিস্তর। ধর্মের সীমারেখা তাদের বেলায় অকেজো।
ধর্মের দোহাই দিয়ে বড়মানুষেরা প্রতিনিয়ত ছোটলোকদের অবহেলা করে। তাদের পাপ- পুণ্যের হিসাব করে। হাসিম বাঁদীর ছেলে একথা তাকে ভুলতে দেয় না। বুড়ি দাদী রক্তের টানে লুকিয়ে চুরিয়ে নাতিকে দেখতে আসে। সে কেন ধর্ম কর্ম করে না এ নিয়ে মুরুব্বী গোছের লোক দু’কথা শুনিয়ে দেয়। জীবনের গঞ্জনা তাকে বিষিয়ে তোলে।
এর মধ্যেই তার সাথে পরিচয় ঘটে অসাধারণ কিছু মানুষের সাথে। যাদের কাছে তার সামাজিক অবস্থান নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই। জাত-ধর্ম নিয়ে কোন বাছ-বিচার নেই। ওলাওঠায় গ্রাম যখন মৃত্যুপুরীতে পরিণত হবার পথে তখন তারা ঘুরে ঘুরে তাদের সেবা করে। মুসলমানদের কবর দেয়। হিন্দুদের সৎকার করে। নিজেকে নতুন করে চেনে হাসিম। মানুষের সবচেয়ে বড় পরিচয় সে মানুষ। জীবনের আলোকিত পথ কি তাকে আলিঙ্গন করবে না সে আবার অন্ধ সমাজের অতল গহ্বরে হারিয়ে যাবে?
সামাজিক উপন্যাস পড়লাম অনেকদিন পর। পড়তে গিয়ে মানিক বন্দোপাধ্যায়ের পদ্মানদীর মাঝি, পুতুল নাচের ইতিকথা, জসীম উদদীনের বোবাকাহিনী আর জহির রায়হানের হাজার বছর ধরে-এর চেনা স্বাদ পেলাম।
সাম্প্রদায়িকতার বেড়াজালে বন্দী সমাজে মানুষ বড় অসহায়। ধর্মের দোহাই দিয়ে প্রতি মূহুর্তে তাদের সত্তাকে খুন করা হয়, মনুষ্যত্বকে চাপা দেয়া হয়। নিজ স্বার্থ হাসিলে ধর্মের ভোলকেও পাল্টে দিতে পারে ক্ষমতার দাপটে। ছোটলোকদের রক্ত চুষে নিঃশেষ করে ফুলে-ফেঁপে ওঠে। মোটা চালের ভাতের জন্য জীবন বাজি রাখা লোকগুলোকে পায়ের তলায় পিষে ফেলা যায় ঘরের তিন চার বছরের চিকন চাল মজুদ রেখে।
ধর্ম-অধর্ম নিয়ে ধার্মিকদের চিন্তার শেষ নেই। সারাজীবন মিথ্যা সাক্ষী দিয়েও মোল্লা হওয়া যায়। সম্পত্তি উদ্ধারে পুরুত ঠাকুর মুসলমানের উঠানে পা রাখতে পারে। দাঙ্গা বাঁধিয়ে খুনোখুনি করা যায়। লাশের দাম ধরা যায় তিন কানি জমি। দারোগাকে খুশি করতে টাকাই যথেষ্ট নয়। তার জৈবিক চাহিদাও মেটাতে হয়। অর্থের মোহে নিজ রক্তকেও বিসর্জন দিতে দ্বিধা করে না খলু ব্যাপারী। জোহরা নির্মম অত্যাচারের শিকার হয়েও সমাজের চোখে অপরাধী, চরিত্রহীন। ছোট্ট ছেলে তার মুসলমান বন্ধুর মৃতদেহ দেখতে যেতে অনুমতি পায় না। তাতে অধর্ম হয়। মুসলমানের সুদের টাকা খেলে অধর্ম হয় না। মোল্লারা দু’খানা দর্শন ঝেড়ে ভালো-মন্দ খায়, ভদ্রলোকের মন যুগিয়ে চলে। তাদের ইচ্ছেমত ফতোয়া দেয়। এতে পাপ হয় না।
পাপ যত ছোটলোকদের। জন্মই তাদের আজন্ম পাপ। তাদের কাঠের পুতুলের মত নাচানো যায়। যখন-তখন ছুঁড়ে ফেলা যায়। বিধাতাও যেন বড়মানুষদেরই। এতশত অন্যায় করেও তাদের কোন বিকার নেই। দুঃখ যন্ত্রণা নেই।
আবহমানকালের চিরায়ত সুখ-দুঃখ, পাপ-পুণ্যের গল্প বলে সূর্য তুমি সাথী। হাজার বছরের সূর্য যেভাবে পুড়ছে, পুড়িয়ে চলছে সেভাবেই পুড়ছে মানব জীবন। এ যাত্রার কোন শেষ নেই। সময়ের পালাবদলে শুধু মানুষগুলো বদলে যায়। চরিত্রগুলো একই থাকে। সাদা চোখে ধর্মের ছকে মানুষকে আলাদা করলেও আসল বিভক্তিটা ধর্মের নয়। বিভাজনটা নির্যাতক আর নির্যাতিতদের।
লেখকের লেখা নিয়ে সমালোচনা করা একরকম দুঃসাহসিকতা। লেখার পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে অদ্ভূত মায়া। চরিত্রগুলোকে অনুভব করা যায়। ধর্ম নিয়ে অযথা বিতর্ক সৃষ্টি না করে বাকপটুতার গুণে সমাজের প্রকৃত চিত্র অঙ্কন করেছেন। মানব মনের সাধারণ অনুভূতিকে অসাধারণভাবে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। জীবনকে অনুভব করেছেন মন দিয়ে। চোখ দিয়ে নয়। ঘুণে ধরা মনুষ্যত্বকে চোখে আঙ্গুল তুলে দেখিয়েছেন। নির্যাতিতরা তো সমাজের চোখে আজন্ম অপরাধী। যারা তাদের পাশে দাঁড়ায় তারা আরও বেশি অপরাধী। এই চরম সত্যকে উন্মোচন করেছেন নিপুণভাবে।
চরিত্রদের সংলাপ বলা হয়েছে চিটাগাংয়ের আঞ্চলিক ভাষায়। দুর্বোধ্য হওয়ায় পাশাপাশি তার শুদ্ধ বাংলাটাও দেয়া হয়েছে। তবে কিছু জায়গায় আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহৃত হলেও তা সকলের বোধগম্য। ঐ সব ক্ষেত্রে তর্জমার প্রয়োজন ছিল না।
প্রকাশনীর বাইন্ডিং এবং মূল্যমান সন্তোষজনক। তেমন কোন ভুল দৃষ্টিগোচর হয় নি।
অগোচরে ভুলত্রুটি হয়ে থাকলে ক্ষমাপ্রার্থী।
Leave a Reply 0

Your email address will not be published. Required fields are marked *