শীর্ষেন্দুর একটা বই পড়েছিলাম, বেশ আগে। নামটা ছিল সম্ভবত দূরবীন

|| রুহ ||

এক.
শীর্ষেন্দুর একটা বই পড়েছিলাম, বেশ আগে। নামটা ছিল সম্ভবত দূরবীন। এই সম্ভাব্যতার ভিতরের অপর নামটি হলো মানবজমিন। স্মৃতি যদি প্রতারণা না করে, তাহলে এককভাবে শুধু দূরবীনের কথাও বলা যায়। ছয় সাতশো পৃষ্ঠার ঢাউস আকৃতির একটি উপন্যাস। কিনেছিলাম ফুটপাত থেকে। এই বইয়ের একদম শুরুর লাইনটিতেই দেখা যায় একজন বৃদ্ধ কূয়ার পাড়ে দাঁড়িয়ে আছেন এবং তার হাত থেকে রশি ছিঁড়ে ছোট বালতিটি কূয়ার ভিতরে পড়ে গেছে। আমি ভেবেছিলাম বৃদ্ধ মানুষটি এর কারণে বেশ একটু বিরক্তি প্রকাশ করে বালতিটি উদ্ধারকাজে লিপ্ত হবেন। কিন্তু তার মধ্যে সেসবের কোনো আলামত দেখা গেল না৷ তিনি বরং সেদিকে ভ্রুক্ষেপমাত্র না করে রশি ছিঁড়ে পড়াজনিত একধরনের দার্শনিক ভাবালুতায় মগ্ন হয়ে পড়েন, যেখানে তাঁর বয়স বৃদ্ধির বিষয়টি টের পাওয়া ও তা নিয়ে আক্ষেপ বা হাহাকারধর্মী ব্যাপার ছিল। যদ্দূর মনে পড়ছে, এই ভাবনার সূত্রেই বা আরও সামনে এগিয়ে একসময় তিনি প্রাণের অনুসন্ধান করেন। এই অনুসন্ধানের সূচনাতে তিনি সরলভাবে প্রশ্ন করেন, প্রাণ কী? কিন্তু প্রশ্নটি করার পরই বুঝতে পারেন যে, বেশ একটা মুশকিলে পতিত হয়েছেন; কারণ উত্তরটি কোনোভাবেই তিনি বুঝে উঠতে পারছিলেন না৷

এরপরই আমরা দেখি বৃদ্ধ মানুষটি বাস্তবে বা স্মৃতির আশ্রয়ে একটি গাড়ির ইঞ্জিনের কাছে গিয়ে হাজির হয়েছেন। অতঃপর শিশুর সরলতা নিয়ে ইঞ্জিনের সচলতার মূল শক্তিটি খুঁজতে লাগলেন। এখানে ছোট বড় বিভিন্ন অংশ বিশেষ একটি শৃঙ্খলায় যুক্ত হয়েছে—বিদ্যুতবাহী তার পরস্পরের নৈকট্যকে আরও নিবিড় ও গভীরতর করেছে, নলবাহিত হয়ে তেল পৌঁছে যাচ্ছে বিভিন্ন জায়গায়, তারপর বিশেষ প্রক্রিয়ায় একটি আগুন উৎপাদিত হয়ে সংযুক্ত সকল অংশকে সচকিত ও চঞ্চল করে তুলেছে, এরপর সকলের সম্মিলিত অংশগ্রহণে এখানে সৃষ্টি হয়েছে বৃহৎ একটি সক্ষমতা, যা গাড়িকে আন্দোলিত ও গতিশীল করতে পারে। বৃদ্ধ মানুষটি সকল কিছুকে স্বীকার করেও সবশেষে গিয়ে সবচেয়ে জটিল প্রশ্নটি তোলেন—সবার সম্মিলনে কী সৃষ্টি হলো? আমরা যে সক্ষমতাটির কথা বলছি এর অস্তিত্ব, বাস্তবতা ও প্রকৃতিটি আসলে কী?

শীর্ষেন্দু ইঞ্জিনকে প্রতীক হিসেবে এনে এর ভিতর দিয়ে মানবপ্রাণের জাগতিক ব্যাখ্যাকেই হাজির করেছেন। কিন্তু এই ব্যাখ্যাকে তিনি শেষ কথা হিসেবে মানতে নারাজ। ফলে, বৃদ্ধের মধ্যস্থতায় সর্বশেষ এই গভীরতর প্রশ্নটি উত্থাপন করে বিষয়টিকে একটি অপার্থিব আধ্যাত্মিকতা দিয়ে পরিচিত করিয়েছেন—এমন যে, এ আমাদের বোধগম্য নয়; আমরা শুধু এর উপস্থিতিটুকু টের পেতে পারি। বেশ ছোটবেলায় পড়লেও শীর্ষেন্দুর এই ব্যাপারটি আমার খুব ভলো লেগেছিল।

বস্তুগত ব্যাখ্যার মধ্যে যে চালাকিটুকু থাকে, একে তিনি খুব জোরালোভাবে নাকচ করে মানবমনের স্বাভাবিক আধ্যাত্মকতাকে সামনে নিয়ে এসেছেন, যেখান থেকে মূলত আমাদের জ্ঞানের প্রকৃত অনুসন্ধান শুরু হয়।

দুই.
শেষ দিকের কথাটি বোধ করি একটু সংশোধন করা দরকার। কারণ, বস্তুগত ব্যাখ্যার মূল প্রকৃতির মধ্যে চালাকি বা ফাঁকির কোনো বিষয় নেই। বস্তু যেহেতু বিদ্যমান, তাই তার বস্তুগত একটা ব্যাখ্যাও অবশ্যই বিদ্যমান হবে। কেননা, পুরো জগতটিই বিশেষ একটি ধর্ম ও শৃঙ্খলার ভিতর দিয়ে সক্রিয় রয়েছে। তাহলে ফাঁকিটা কোথায়? ফাঁকিটা হলো একে মানুষ যখন সকল প্রশ্ন ও অনুসন্ধানের মীমাংসাকারী চূড়ান্ত বক্তব্য হিসেবে হাজির করে। অথচ, এর মধ্যে সে উপযুক্ততা কখনোই ছিল না। উদাহরণত, যদি জিজ্ঞেস করি আগুন পোড়ায় কেন? বলা হবে আগুন দ্রুত প্রজ্জ্বলনশীল পদার্থের রাসায়নিক বিক্রিয়াবিশেষ। এরপর এর পরিচয় সংশ্লিষ্ট ছোটবড় নানাদিকের বিবরণ দেওয়া হবে, দেখানো হবে এর প্রবণতা ও বৈশিষ্ট্যসমূহ। অতপর বলা হবে, আগুন এমন, তাই সে পোড়ায়।

আপাত দৃষ্টিতে মনে হবে—বেশ তো! পূর্ণ জবাবটিই তো পাওয়া গেল; অথচ, গভীরভাবে দেখলে এটি মূলত জবাব নয়; মূল প্রশ্নটিকেই আরেকটু বোধগম্য, জোরালো ও গভীর করেছে মাত্র। কারণ, এরপরই আমি প্রশ্ন করব—কোনো কিছু এমন হলেই পোড়াতে হবে কেন? এখানে এসে বস্তুগত ব্যাখ্যাকে যারা সন্তুষ্ট হওয়ার মতো চূড়ান্ত বক্তব্য হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছেন, তারা আমার দিকে বিস্ময়মাখা বিরক্তদৃষ্টিতে তাকিয়ে অনাগ্রহের সাথে জবাব দেবেন, বস্তুর ধর্মই যে এটি!

এ কথা বলে তারা মূল প্রশ্নটিকে এড়িয়ে যেতে চান কেন? তালাশ করে অনেক কারণই পাওয়া যাবে, তবে বিশেষ দুটো কারণ মনে হয় আমার কাছে: প্রথমত এই ব্যাখ্যার পর প্রকৃত জ্ঞানের পথে আমাদের যে আধ্যাত্মিক যাত্রার সূচনাটি হয়, এর ক্লান্তিটুকু তারা নিতে চান না; এবং দ্বিতীয়ত মানুষ নিজেকে মুর্খ ভাবতে পছন্দ করে না। ফলে, মূল প্রশ্নটিকে জায়গা দিয়ে নিজেদের অসম্পূর্ণ জ্ঞানের কল্পিত সম্পূর্ণতা ও নিশ্চয়তাকে নষ্ট করে অনিশ্চিতের পথে তারা হাঁটতে চান না৷ এমন লোকেরা একদিকে যেমন অসততায় লিপ্ত আছেন, অপর দিকে অসংগতভাবে অত্যধিক যুক্তিপ্রবণতায় আক্রান্ত হওয়ার কারণে তাদের হৃদয় হতে জীবন ও জগতের বিস্ময়গুলো হারিয়ে যায়। এ জন্যই অতি যুক্তিবাদিতা নিনন্দনীয়। এটি আমাদের মুগ্ধতাকে নষ্ট করে এবং আমাদের বিস্ময়াকুল মৌলিক প্রশ্নগুলোকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলে।

শীর্ষেন্দু সর্বশেষ প্রশ্নটির মাধ্যমে মানবমনের এই বিস্ময় ও গভীর অনুসন্ধানকেই সম্মানিত করেছেন।

তিন.
এই কদিন আগেমাত্র কথাপ্রসঙ্গে একজন জিজ্ঞেস করলেন—প্রাণ বলতে আপনি কী বোঝেন?
আমি বললাম, প্রাণের প্রকৃতি আমি জানি না; কিন্তু বাহ্যত আমরা যেটা অনুভব করি, সে জায়গা থেকে এটুকু বলতে পারি : ক্ষুদ্র ও বৃহৎ আকৃতির অসংখ্য অঙ্গ, বিশেষ একটি বিন্যাসে পরস্পরের সাথে সংযুক্ত হয়েছে, শিরা ও উপশিরাগুলো তাদের বন্ধনকে সুসংহত করেছে, রক্তের অবাধ সঞ্চালন পারস্পরিক যোগাযোগটিকে করেছে আরও গভীর ও অর্থবহ এবং সবগুলো অঙ্গ আপন সক্রিয়তার ভিতর দিয়ে একে অপরকে সমর্থন জুগিয়ে যখন একটি ঐক্য বিন্দুতে মিলিত হয়েছে, তখন সেখান থেকে উৎপন্ন হয়েছে বৃহৎ একটি সাড়া ও সক্রিয়তা।

কিন্তু এটুকু বলে যদি থেমে যাই, তাহলে মূলত একটি যাত্রার মাঝপথ হতে আমি ফিরে আসব। কারণ, এখানেও সেই প্রশ্নটি আসে—সক্রিয়তা বলতে আমি যা বুঝাচ্ছি, তা কী? মানে, এর বাস্তবতাটা কী আসলে? এবং এ সক্রিয়তাটা আসেই বা কেন? আমি জানি না এবং এই প্রশ্নটির মুখোমুখি হওয়ার পর আমি খুবই বিস্মিত। এই যে ‘জানি না’ বলে সীমাহীন বিস্ময়ের সাথে স্তব্ধ হয়ে রইলাম, এই যে বিস্ময় ও অক্ষমতা, প্রজাতিগতভাবে দুর্বল একজন মানুষ হিসেবে এটিই আমার যাত্রার আপাত সমাপ্তি। ফলে, প্রাণ আমার কাছে অজানা রহস্যময় এক বস্তু। এই রহস্যঘোরের ভিতরে থেকেই আমি শুনতে পাই আল্লাহ তাআলা বলছেন—বলুন, রুহ হলো আমার রবের একটি নির্দেশ।

এবং আরও বেশ কিছু আয়াত ও হাদিসে দেখতে পাই রুহ বা প্রাণ অস্তিত্বহীন নিছক একটি সক্রিয়তা নয়। প্রাণীসমূহের দেহে এর আলাদা অস্তিত্ব আছে। মৃত্যুর ফেরেশতাগণ এসে একে দেহের বাইরে বের করে নিয়ে যান; এবং এটি মৃত্যুপরবর্তী সময়ে বিভিন্ন অবস্থার ভিতর দিয়ে যায়। প্রাণ বলতে আমি এই সবটুকুকে বুঝি।

প্রাণ আমার কাছে অচেনা, বিস্ময়কর, রহস্যপূর্ণ একটি খোদায়ি নির্দেশ, যা অস্তিত্বশীল। আপনি চাইলে আমি নিজের জীবন ও অভিজ্ঞতা তালাশ করে, কুরআন ও হাদিস ঘেঁটে রুহ বা প্রাণ সম্পর্কে অনেক তথ্য হাজির করতে পারব, কিন্তু সেই যে মূল প্রশ্নটি, এর কোনো জবাব আমি দিতে পারব না। চেষ্টা যে করিনি, তা নয়; বরং একে সচেতনভাবে বুঝবার জন্য নিজের ভিতরে তাকিয়ে থেকেছি সুদীর্ঘ সময়৷ চিন্তাকে তীক্ষ্ম করেছি, অনুভবকে করেছি সুতীব্র; তবু এর বাইরে আর কোনো জবাব আমার পক্ষে পাওয়া সম্ভব হয়নি। প্রাণ এমনই—অবোধ্য; টের পাওয়া যায় শুধু।

– সাবের চৌধুরী
আলেম ও সাহিত্যিক

Leave a Reply 0

Your email address will not be published. Required fields are marked *