রিভিউ – বই শেষের কবিতা লেখক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

বইয়ের নামঃ শেষের কবিতা
লেখকঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
মোর লাগি করিও না শোক,
আমার রয়েছে কর্ম, আমার রয়েছে বিশ্বলোক ।
খুব অদ্ভুত এই লাইনগুলো তাই না? একদম নিউট্রাল ভাবে ভেবে দেখুন, এটা কিন্তু প্রতিটা মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে। প্রেমিক-প্রেমিকা কিংবা বন্ধুদের।
খুব চেনা একটা উপন্যাস। অমিত লাবণ্যের গল্প। যে বই জীবনে খুলেও দেখেনি, সেও এই অমিত লাবণ্য সাজে কিংবা ঘুরে বেড়ায় এই উপন্যাসের চরিত্র হয়ে। আজকে যেটা লিখব, সেটা বোধহয় প্রচলিত রিভিউ এর বাইরে হবে। কারণ আমি নিজে যেটা মনে করি সেটা লিখছি আজ। কোন সারসংক্ষেপ এর পরে পাঠপ্রতিক্রিয়া না। কাহিনীর সাথে সাথে আমার প্রতিক্রিয়া চলবে।
অমিট রায়ের বাবা ছিলেন প্রতিষ্ঠিত ব্যরিস্টার। বাবার পথে হেঁটে ছেলেও ব্যরিস্টার হল। বিলেত থেকে পড়াশোনা করে ফিরে এল দেশে।
আচার আচরণে, বেশ ভূষায় বেশ আধুনিক। আলাদা করে আর পাঁচ জনের থেকে চেনা যায়। কিছুটা অহংকার আছে। রবীন্দ্রনাথের গল্প উপন্যাস থেকে তৈরি বেশির ভাগ নাটকে আমরা যে ধরনের পোশাক দেখি, বলা যায় অমিতকেই অনুকরণ করে। আধুনিক লেখকদের ঠিক অতটা গুরুত্ব দেয় না অমিত। সবার থেকে আলাদা হতে চায় সব থেকে। নিজের দলের কেউ যা করেনা সেটা অমিত করে। আর সেই ধারা বজায় রাখতেই শিলং পাহাড়ে গেল।
অতিরিক্ত অহংকারী হবার কারণেই আমার নিজের অমিতকে কোনদিন পছন্দ হয়নি। এ নিয়ে বান্ধবীদের সাথে তর্কও চলেছে। নিজেকে সবার চাইতে সেরা ভাবাটা আমার কাছে ভালো লাগেনা। উপন্যাসের শুরু থেকেই এই কারণেই মনে হয় অমিতকে আমার পছন্দ হয়নি।
কলেকের শিক্ষকের মেয়ে লাবণ্য। শিক্ষিত আর স্নিগ্ধ এক রমনী। বহুদূর কোন এক শিলং পাহাড়ে। এক ছাত্রীকে পড়াচ্ছে। ঠিক কেন সে অত দূরে, কে জানে? লক্ষ্ণী প্রতিমার মত সেই মেয়ে। উপন্যাসে লাবণ্যের যে বর্ণনা আছে, সেই মত সাজতে যাওয়াও খুব সহজ না, যেমন সহজ না লাবণ্য হওয়া।
সেই শিলং পাহাড়ে, অমিত লাবণ্যের দেখা হল। ক্ষণিকের দেখা।
পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি,
আমরা দুজন চলতি হাওয়ার পন্থী
দুটো দু প্রান্তের মানুষ কিভাবে একে অন্যকে ভালো বেসে ফেলল সেটাই মস্ত রহস্য।
শোভনলাল, লাবণ্যের বাবার ছাত্র। পড়াশোনা, আচার-আচরণ সব দিক দিয়ে সেরা। মুখচোরা স্বভাব কেবল তাঁর, পিছিয়ে পড়ার কারণ। তাই সেই দীর্ঘকাল ধরে লাবণ্যকে ভালোবাসার পর ও মুখ ফুটে বলতে পারেনি। এই জন্য তাঁর মূল্য কিছুটা কমে গেছে। সে কখনই অন্য কোন মেয়ের দিকে তাকায় নি, একপ্রাণে লাবণ্যকেই ভালোবেসে গেছে। এর অনেক বড় পরিচয় আছে, সেটা নাহয় উপন্যাসেই রইল। পাঠক পড়ে নিবেন,যারা আজো পড়েননি।
কেটকী, খুব অল্প সময়ের জন্য আসা এই চরিত্র, তাকে একদিকে নেগেটিভ বানানো যায় আবার অন্যদিকে শ্রদ্ধাও জানাতে পারেন। তাঁর বিষয়ে আমি নিরপেক্ষ। একবার মনে হয় সে ভুল, অন্য সময় সে ঠিক বলেই মনে হয়।
হয়তো অমিত চাইলে পারত লাবণ্যের হাত ধরতে, আবার না ধরেই হয়তো ভালো করেছিল। পরিবেশ-পরিস্থিতি হয়তো এক হয়না। কিন্তু কাউকে দেয়া কথা ভুলে গিয়ে নতুন করে স্বপ্ন দেখা কি ঠিক? আসলে অধিকাংশ মানুষ যেখানে অমিত কে আদর্শ মানে, সেখানে স্রোতের বিপরীতে আমি গেলাম। এখন ও বলব, অমিতের চাইতে শোভনলাল আমার পছন্দের। কারণ? সে লাবণ্যকেই ভালোবেসেছে শেষ পর্যন্ত। এটা কি সত্যিকারের ভালোবাসা না?
নাকি অমিতের ভালোবাসা সত্যি ছিল? কার জন্য ছিল? লাবণ্যের জন্য? লিলির জন্য না কেটকির জন্য?
তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারি দান–
গ্রহণ করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়।
হে বন্ধু, বিদায় ।।
জানিনা, তবে লাবণ্যের সঙ্গে যদি কোনদিন দেখা হয় জিজ্ঞেস করব, এত অদ্ভুত সুন্দর একটা মানুষ কিভাবে হতে পারে? আদর্শ এক নারী, শান্ত, স্নিগ্ধ, আবার ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। নিজে শক্ত হাতে, শক্ত মনে যে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারাটা কিন্তু এত সহজ না তাই না?
১৯২৮ সালে প্রকাশিত এই উপন্যাসের প্রথম নাম ছিল মিতা। নির্মল্কুমারী মহলানবিশের “ কবির সঙ্গে দাক্ষিণাত্যে” এই উপন্যাসের লেখার ইতিহাস রয়েছে। গল্পটার সারমর্ম এই যে একটা অচেনা ফোনকল থেকে দুই জন মানুষের পরিচয় হয়। কেউ কাউকে চিনতইনা। অনেকদিন এভাবে পার হবার পরে সেই দুটো মানুষ আলাদা হয়ে যায়। কারণ ছেলেটা নাকি চলে যাবে বিদেশে। কিন্তু কিছু কাল পরে সেই দু’জনের দেখা হয় শিলং পাহাড়ে। কিন্তু কি যে সেই গল্প ছিল সেটা জানার বড্ড ইচ্ছে আমার, দেখা যাক মেলে কিনা।

Leave a Reply 0

Your email address will not be published. Required fields are marked *