রাজকীয় উৎসর্গ – কেন পড়বেন? লেখক : আল কাফি নয়ন

স্পয়লার-ফ্রি রিভিউ ❛রাজকীয় উৎসর্গ❜

উৎসর্গ শব্দের মর্মার্থ ‘সৎ’ উদ্দেশ্য অর্পণের বিধান থাকলেও রাজকীয় উৎসর্গে সেই বিধানের বাস্তবতা কতটা জৌলুস নিয়ে জ্বলে উঠেছে; তা জানতে ঢুঁ মারতে হবে ❛রাজকীয় উৎসর্গ❜ উপন্যাসের ছয় রাজ্যের অন্তরালে।
  • বই : রাজকীয় উৎসর্গ
  • লেখক : আল কাফি নয়ন
  • জনরা : হাই/এপিক ফ্যান্টাসি
  • প্রথম প্রকাশ : জানুয়ারি ২০২২
  • নামলিপি • প্রচ্ছদ : সজল চৌধুরী
  • চিত্র অলংকরণ : ওয়াসিফ নূর
  • প্রকাশনা : ভূমিপ্রকাশ
  • মুদ্রিত মূল্য : ৫০০ টাকা মাত্র
  • পৃষ্ঠা : ৩২০
  • Review Credit 💕 Peal Roy Partha
রাজকীয় উৎসর্গ বইটি নিয়ে আলোচনার পূর্বে, কিছু কথা বলে নেওয়া ভালো। বাংলায় ইতোমধ্যে ফ্যান্টাসির দারুণ এক জোয়ার বইছে। নিরবিচ্ছিন্ন গতির এই ধারাকে উজ্জীবিত করার খুঁটি আরও আগ থেকে গেড়ে বসানো হলেও; পূর্ণত্বের ছোঁয়া ❛রাজকীয় উৎসর্গ❜ উপন্যাসের মাধ্যমে শুরু হয়েছে। আশা করছি এই ছোঁয়া সকল পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে যাবে দারুণ সব জগৎসৃষ্টির মাধ্যমে।
❛রাজকীয় উৎসর্গ❜ লেখকের এপিক ও হাই ফ্যান্টাসি জনরার বই। এখানে আছে নিজস্ব এক জগৎ, সেই জগতের চরিত্রদের মধ্যে দ্বন্দ্ব, কিছু রাজ্যের উত্থান-পতনের অতীত, রাজনৈতিক কলহ, ফিকটাস ওয়ার্ল্ড নামক জাদুর ব্যবহার, ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কূটকৌশলের উত্তম ব্যবহার এবং হাজার বছরের প্রথা মেনে আসা—রাজকীয় উৎসর্গ।
রাজকীয় উৎসর্গ অনুষ্ঠিত হয়ে ‘ডাবরি’ রাজ্যে। পার্বত্য ভূপ্রকৃতির সৌন্দর্য, ক্যান্তর তৈরির আঁতুড়ঘর, ফিকটাস ওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রিত এই রাজ্য মাতৃতন্ত্র। যেখানে রাজার চেয়েও রানি বেশি সম্মানিত। কিন্তু কোনো এক ঘটনাক্রমে বর্তমানে এই রাজ্যের শাসনকর্তা একজন পুরুষ! নাম দ্বিরেফ। প্রয়াত রানির পুত্র। ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ এবং সদ্য অবসরপ্রাপ্ত ক্যান্তর। পুরো ছয় রাজ্যের অর্থনৈতিক ও শক্তির দিক দিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ডাবরি রাজ্য।
প্রথম এবং অন্যান্য রাজ্যের হর্তাকর্তা হচ্ছে ‘সোনার নালী’। রাজ্য প্রধান আলফি পিলগ্রিম। ঠান্ডা মাথার অধিকারী, বুদ্ধিচাতুর্যে অভিন্ন। হাজার মানুষের রক্তে রঞ্জিত লালকুঠি এই রাজ্যের সবচেয়ে বড়ো স্থাপনা। স্বয়ং রাজার বসবাস যেখানে। এই রাজ্যের অভিজাত মানুষরা ফিকটাস ওয়ার্ল্ড ভ্রমণ করতে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে।
‘মুদ্রাক’ হচ্ছে জ্ঞানীদের রাজ্য। উক্ত জগতের যত ইতিহাস, গবেষণা সম্পর্কিত নথি সব এই রাজ্যে বহাল তবিয়তে আছে। শত্রু হামলা ব্যতীত এই রাজ্যের সবচেয়ে বড়ো ভীতির কারণ—মৃত্যু ও ভূমিকম্প! মুদ্রাক প্রধান ইখলাছ। বিচক্ষণ, দূরদর্শী ও সৌম্য-শান্ত চেহেরার মানুষটি ডাবরি রাজ্য দ্বিরেফের ঘনিষ্ঠ বন্ধুও বটে। বই পড়া যাদের নেশা; এই রাজ্য তাদের পছন্দের শীর্ষে না রেখে পারা যাবে না। অন্যান্য রাজ্য প্রধানদের নিয়ে সভা এবং অপরাধীর বিচার কার্য এই রাজ্যে হয়ে থাকে।
‘ভাঙন’ সম্ভবত এই জগতের সবচেয়ে অবহেলিত রাজ্য! অথচ ইতিহাসের দিকে তাকালে এই রাজ্যের শুরুটা এতটা তথৈবচ কখনও ছিল না। ভাঙনের ইতিহাস মহাকাব্যিক ইতিহাস। যে ইতিহাস কখনো কখনো রূপকথাকে হার মানায়। যে ভাঙনবাসী আজ ‘ক্যান্তর’ হওয়ার স্বপ্ন দেখে; অথচ এক সময় সাধারণ ভাঙনবাসীও ‘ফেলানর’ হওয়ার স্বপ্ন দেখত। ভাঙন একটি নদীর নাম। সুপ্রাচীন এই নদীর তীরে থেকে গোড়া পত্তন হয়েছিল এই সভ্যতার। বর্তমানে জাভিয়ার এই রাজ্যের প্রধান। অপবিদ্যা নিয়ে যার চর্চা।
‘দেবিদ্বার’ শান্তিপ্রিয় ও ঝুটঝামেলা এড়িয়ে চলা রাজ্য। নাচ-গান নিয়ে মেতে থাকা যাদের কাজ। এই রাজ্যের উপস্থিতি কাহিনিতে খুব অল্প সময়ের জন্য এসেছে; ঠিক যেমনটা এসেছে ‘কোয়ার্থ’ ও ‘হরকলি’ নিয়ে। ‘কোয়ার্থ’ রাজ্যকে দেখানো হয়েছে অন্ধকার ও বিভীষিকার রূপকে। যেখানে নির্বাসনে পাঠানো হয় অপরাধীদের। অপবিদ্য চর্চা ও অন্ধকারে থাকা মানুষরা এই রাজ্যে অন্তর্ভুক্ত।
‘বিরান ভূমি’ রহস্যে আবৃতে থাকলেও; ‘জিন্দাবন’ নিয়ে দারুণ মিথ রচয়িতা রয়েছে। মানব সৃষ্টির শুরুর দিকে কাহিনি। অন্যদিকে পুরো গল্পের অর্ধেক আকর্ষণ লুফে নিয়েছে ‘খের বাড়ি’র কার্যক্রম। সাধারণ মানুষ, মধ্যবিত্ত এবং অপরাধীদের জন্য এই জায়গা আদর্শ। গণিকালয় হলেও রহ্যসের অনেকাংশ দখল করে রয়েছে ‘সোনার নালী’ বিনিয়োগের অন্যতম কেন্দ্র এই খের বাড়ি।
❛রাজকীয় উৎসর্গ❜ উপন্যাসের ম্যাজিক সিস্টেম হচ্ছে ‘ফিকটাস ওয়ার্ল্ড’ তৈরি করে। এই ম্যাজিক টার্ম যারা ব্যবহার করে তাদের বলা হয় ‘ক্যান্তর’। উক্ত জগতে ফিকটাস ওয়ার্ল্ড একপ্রকার অনুমোদিত ‘বিদ্যা’ অন্য দিকে এর বিপরীতে রয়েছে অনুমোদনহীন ‘অপবিদ্যা’ অর্থাৎ ডার্ক ম্যাজিক। এই অপবিদ্যা যারা ব্যবহার করে তাদের বলে—মিমপি, মুরাকিব ও মুজারিব। অনুমোদিত বিদ্যা ক্যান্তর’রা ব্যবহারের পাশাপাশি ‘ফেলানর’ যারা; তারাও এই বিদ্যা প্রয়োগে পারদর্শী ভূমিকা পালন করে। এমনকি ফেলানরদের নিকটে এই ‘ক্যান্তর’রা শিশু মাত্র।
ফেলানরদের ক্ষমতা আছে ‘ক্ষৌণী’ সৃষ্টি করার। ফিকটাস ওয়ার্ল্ড কল্পনার অংশ হলেও ক্ষৌণী এই জগতের অংশ। বাস্তব। এমন কিছু অংশ যা লুকিয়ে রাখা হয় অপবিদ্যা চর্চাকারী মিমপিদের থেকে। মানুষের ভালোর এবং জগৎ নিরাপত্তার জন্য যে-কোনো মূল্যবান বস্তু পৃথক করে ক্ষৌণী তৈরি করা হয়। ফিকটাস ওয়ার্ল্ড দিয়ে যা করা যায় না ক্ষৌণী দিয়ে তা অনায়াসে করে ফেলা সম্ভব। তাই এই ক্ষৌণী গোপন রাখা কর্তব্য। প্রশ্ন হচ্ছে—কোনো ক্ষৌণী কি বর্তমানে অবশিষ্ট রয়েছে? থাকলেও তা নিয়ন্ত্রণ করার মতো কোনো ফেলানর জীবিত আছে কি?
রহস্য শুধু ক্ষৌণী কিংবা ফেলানর আছে কি নেই—তা নিয়ে নয়। এই ছয় রাজ্যের আড়ালে লুকিয়ে আছে এমন সব প্রশ্ন; যেগুলোর উত্তর খুঁজতে হলে ঢুঁ মারতে হবে ❛রাজকীয় উৎসর্গ❜ উপন্যাসে।

পাঠ প্রতিক্রিয়া ও পর্যালোচনা

❛রাজকীয় উৎসর্গ❜ গতিময় এবং দেশিয় আবহ মেশানো এক সহজ-সাবলীল সুন্দর এপিক/হাই ফ্যান্টাসি উপন্যাস। সত্যিকার অর্থে এতদিন ফ্যান্টাসি নিয়ে শোনা যত অভিযোগ আমার অথবা যাঁদের ছিল; এই উপন্যাস সেটা অনেকটাই কমিয়ে দিতে সক্ষম। কেন অন্যান্য মৌলিক ফ্যান্টাসি থেকে এই বইটি ব্যতিক্রম—কয়েকটি দিক তুলে ধরার প্রয়াস করছি। অবশ্যই তা আমার নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে।

সূত্রপাত

ধনীদের বিনোদনের জন্য ডাবরি রাজ্যে তৈরি করা হয় সুবিশাল ও সুনিরাপদ মাধ্যম ফিকটাস ওয়ার্ল্ড। আয়েদিস নামক এক বিশেষ কক্ষে এই ফিকটাস ওয়ার্ল্ড নির্মাণ করা হয়। বেশ নিরাপদ থাকা সত্ত্বেও এই ফিকটাস ওয়ার্ল্ড ভ্রমণে দুর্ঘটনায় শিকার হয় সোনার নালী থেকে আগত সম্ভ্রান্ত পরিবারের ত্রিশ সদস্য! পালিয়ে যায় দুই ক্যান্তর। কিন্ত কেন?
মুদ্রাকে জরুরি বৈঠক ডাকে ডাবরি রাজ্যের প্রধান দ্বিরেফ। উদ্দেশ্য ঘটমান দুর্ঘটনা নিয়ে আলোচনা ও করণীয়। সেই বৈঠকে হাজির হয় সোনার নালী প্রধান আলফি পিলগ্রিম এবং ভাঙন থেকে সদ্য রাজা হওয়া জাভিয়ার। উপস্থিত আছেন মুদ্রাক প্রধান ইখলাছও। কিন্তু সাহায্য চাইতে এসে সব  পরিকল্পনা দ্বিরেফের বিপরীতে চলে যাচ্ছে! হঠাৎ শুরু হলো তৃতীয় মাত্রার ভূমিকম্প! যে ভূমিকম্প থেকে বেঁচে ফেরার সাধ্য কারও নেই। মৃত্যু অনিবার্য!
অন্যদিকে পলাতক ক্যান্তরদের খোঁজে ‘খের বাড়ি’ ছুটে যায় ক্যান্তর আলকানতারা। পাবে কি অপরাধীদের? আলফি পিলগ্রিম কোন কূটনৈতিক চাল নিয়ে ব্যস্ত? দেবিদ্বার রাজ্যে উপস্থিত একজন মিমপির। কী খুঁজছে সে? দ্বিরেফের ছোটো বোন নৈঋতের অদ্ভুত এই ক্ষমতার রহস্য কী? রাজকীয় উৎসর্গ বা কেন প্রয়োজন?
লেখক শুরুতে পাঠকদের রাজ্য, চরিত্র এবং আসন্ন বিপদ সম্পর্কে পরিচিতির মাধ্যমে গল্পের প্রথম স্তর সহজগম্য করে দেয়। অর্থাৎ কাহিনি শুরু হওয়ার পরপরই বিনা সময় ব্যয়ে প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হওয়ার পাশাপাশি কী এবং কেন তা জানা নিয়ে আগ্রহ তৈরি করে ফেলে। খুব বেশি বিস্তারিত লেখক শুরুতে প্রয়োগ করে বসেননি। ছোটো ছোটো অধ্যায়ে সামান্য কাহিনি এবং চরিত্র পরিচিত নিয়ে পর্বগুলো লেখা হয়েছে। সবকিছুর বর্ণনা, লেখক যতটুকু দেওয়া প্রয়োজন মনে করেছেন—তা দ্রুত দিতে পেরেছেন বলেই ভালো লেগেছে।

গল্প বুনট » লিখনপদ্ধতি » বর্ণনা শৈলী

লেখকের গল্প বুননের কৌশল পছন্দ হয়েছে। ছোটো ছোটো পর্বের লেখা কাহিনি বিন্যাসও চমকপ্রদ। সাধারণত ফ্যান্টাসি নিয়ে আমাদের সর্বপ্রথম অভিযোগ থাকে যে—মধ্যভাগ অথবা শেষ ভাগের বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা দিয়ে গল্পের সূত্রপাত করা হয়। কিছুটা নন-লিনিয়ার স্টাইলে। প্রায়ই ফ্যান্টাসি উপন্যাস এইভাবে লেখা হয়। তবে ❛রাজকীয় উৎসর্গ❜ উপন্যাসে লেখক এই দিকটি এড়িয়ে গেছেন সম্পূর্ণভাবে। বাহ্যিক বা অপ্রয়োজনীয় কোনো বর্ণনা দিয়ে অহেতুক সময় নষ্ট না করে মূল ঘটনা থেকে গল্প বুননের জাল বুনতে শুরু করে দেন।
এই বুনন কৌশলকে গতিশীল করতে সহযোগিতা করেছে লেখকের লিখনপদ্ধতি। দেশিয় আবহের কথা উল্লেখ করেছিলাম শুরুতে। এখানে সাহিত্যিক ধাঁচ বা সাহিত্য শব্দ নিয়ে ভেলকিবাজি খুব বেশি দেখা না গেলেও—কমবেশি অনেক রয়েছে। লেখকের নিজস্ব স্টাইলে তা সহজভাবে মিশেও গেছে গল্পের সাথে। মাঝে মাঝে লিখনপদ্ধতি কদাচিৎ দুর্বল মনে হলেও, ঘটনার ক্রমধারা অনুযায়ী তা আবার শক্ত সসৈন্যে মোড় নিয়েছে।
ফ্যান্টাসি উপন্যাসের মূল বিষয় হচ্ছে বর্ণনা শৈলী। একটি ঘটনাকে ঠিক কত সহজভাবে, পরিষ্কার লিখনপদ্ধতির মাধ্যমে পাঠকের মানসপটে ফুটিয়ে তোলা যায়। এই দিকটি রীতিমতো চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়ার মতো। বিশেষ করে কোনো রাজ্যের পারিপার্শ্বিক বর্ণনা, ফাইটিং সিকোয়েন্স, চরিত্রদের স্বকীয়তা নিয়ে বর্ণনা দিতে হয় জীবন্ত। না-হয় পাঠক ভাবনায় অপূর্ণতার রেশ থেকে যায়। ফলে কোনো কিছু বোধগম্য না হলে; সেটাকে নেগেটিভ পয়েন্ট হিসেবে মার্কিং করে রাখা হয়। তবে উক্ত উপন্যাসে এই দিকটি নিয়ে লেখক কোনো অভিযোগের অবকাশ রাখেননি। যে ফ্লো নিয়ে তিনি গল্প বলতে এবং গল্পের পারিপার্শ্বিক আবহের সাথে খাপ খাওয়াতে চেয়েছেন—সুন্দর ভাবে তা করতে পেরেছেন।
এখানে কয়েকটি কমতির কথা না বললে নয়। লেখকের বর্ণনায় দেশিয় ছাপ এত স্পষ্ট ছিল যে; তিনি মাঝেমধ্যে ঘটনার সাদৃশ্যতা দেখানোর জন্য আমাদের পৃথিবীর ‘গ্রামবাংলা’র কথা তুলে এনেছেন। যদি লেখকের সৃষ্ট জগতে সেই ‘গ্রামবাংলা’ নামক কোনো গ্রাম বা কোনোকিছুর ছায়াও দেখা যায়নি। এই দিকটি একান্ত ভুলে না-কি ইচ্ছাকৃত তা লেখকই ভালো বলতে পারবেন।
ভাষা নিয়ে স্বকীয়তা খুঁজে পাইনি। একটু খুলে বলি। একটি জগতের ছয়টি রাজ্য। সেই রাজ্যের মধ্যকার যে স্বভাবচরিত্র, পোশাক অর্থাৎ যেসব দিকগুলো দিয়ে এক জাতি থেকে অন্য জাতিকে পার্থক্য করা যাবে—সেই দিকটি একেবারেই মিসিং ছিল। সবচেয়ে অবাক লেগেছে যাতায়াত ব্যবস্থা নিয়ে কোনো যানবাহনের দেখা না পেয়ে। এক রাজ্য থেকে যে অন্য রাজ্যে যাওয়া-আসা করবে সে-জন্য রাস্তাঘাট যেমন প্রয়োজন তেমন সেই জগৎ অনুযায়ী যানবাহনেরও প্রয়োজন। অন্তত ঘোড়া জাতীয় কোনো প্রাণীর অস্তিত্ব তো থাকার কথা। কিন্তু এই দিকটি নিয়ে লেখককে কোনো বর্ণনা দিতে দেখেনি। ভাষাগত পার্থক্য তেমন একটা চোখে পড়েনি। যেহেতু ট্রিলজির প্রথম বই; সেই অনুযায়ী এই বইয়ে সেই দিকটি বিল্ডাপ করার প্রয়োজনীয়তা ছিল।
যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং দূরত্ব নিয়েও বিশেষ কিছু চোখে পড়েনি। অর্থাৎ এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে যেতে কত দিন খরচ হয়, দূরত্ব কতটুকু। দ্রুত কোনো সংবাদ দিতে হলে কী ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন; এ-রকম ছোটোখাটো দিকগুলোতে আরেকটু সুদৃষ্টি দেওয়ার দরকার ছিল।
দিনের হিসাব বাদ দিয়ে চরিত্রদের বিরতিহীন পদচারণ। শুধুমাত্র একদিনের ঘটনা নিয়ে লেখক প্রথম ১৫০+ পৃষ্ঠা লেখে ফেলেন! তিনি চাইলে বিরতি দিয়ে এই কাজটি করতে পারতেন। যদিও এই দিকটি নিয়ে বলাটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। তবে ফ্যান্টাসি হলেও বাস্তবতা বজায় রাখতে কিছুটা সময় তিনি ধাপে ধাপে ব্যয় করতে পারতেন। কাকতাল ঘটানোর উদ্দেশে সব ঘটনাগুলো একদিনে না ঘটিয়ে ভিন্ন ভিন্ন দিনে ঘটালে আরও ভালো হতো বলে মনে করছি। যোগাযোগ আর দূরত্বের বিষয়গুলো এই দিকটির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
আশা করছি ট্রিলজির দ্বিতীয় বইয়ে এই দিকটি আরও বিশদভাবে ফুটে উঠবে। ঘটনাপ্রবাহের পাশাপাশি এই ছোটোখাটো দিকগুলো গণনায় রাখা উচিত। এতে গল্পের খুঁটি আরও শক্ত হয়।

চরিত্রায়ন

ফ্যান্টাসি গল্প অনুযায়ী চরিত্র থাকার কথা অগণিত। সৌভাগ্যক্রমে উক্ত উপন্যাসে ছয় রাজ্য মিলিয়ে সম্ভবত ত্রিশ-এর বেশি চরিত্রের দেখা পাওয়া যায়নি। প্রথম বই হিসেবে চরিত্র গঠনে লেখকের অনেকটা সময় কেটে যায়। শুরুর দিকে প্রধান চরিত্রগুলো প্রাধান্য পেলেও গল্প আগানোর সাথে সাথে নতুন অনেক চরিত্রের দেখা মিলতে থাকে। শেষের দিকে প্রায়ই চরিত্র স্বতন্ত্র ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হয়।
কাহিনিতে বৃহৎ যুদ্ধ দেখা না গেলেও, যে কয়েকটি ফাইটিং সিকোয়েন্স রয়েছে তার চেয়েও চরিত্রদের মনস্তাত্ত্বিক দিক এবং একে অন্যকে টেক্কা দেওয়ার ক্ষমতা আমার নজর কেড়েছে। বিশেষ করে ডাবরি রাজ্যের দ্বিরেফের ছোটো বোন নৈঋতের কথা না বললেই নয়। অন্য দিকে মুদ্রাকের ইখলাস ও ক্যান্তর আলকানতারাকেও পছন্দ হয়েছে। এ-ছাড়া কোয়ার্থ থেকে আগত সানভিও আলাদা একটা ক্রেজ বজায় রাখার চেষ্টা করেছে। শেষ অবধি নৈঋত আর সানভির মধ্যকার লড়াই দেখার সমূহ সম্ভবনা থাকলেও কাহিনির শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। মোদ্দা কথা, উপন্যাসের নারী চরিত্রগুলো পুরুষদের থেকেও শক্তপোক্ত লেগেছে।

অবসান

গল্পের শেষটা প্রথম বই অনুযায়ী ভালোই মনে হলো; যদিও ঘটনা মাত্র শুরু। ডালপালা যা মেলে দেওয়ার লেখক মেলে দিয়েছেন প্রথম বইতে। থিউরি অনুযায়ী অনেক কিছুর মিল-অমিল রয়ে গেলেও—ট্রিলজির প্রথম খণ্ড হিসেবে সন্তুষ্ট করেছে। অন্তত পড়ে আরাম পাওয়া গেছে।
যারা মৌলিক ফ্যান্টাসি পড়তে পছন্দ করেন না অথবা সহজ কোনো ফ্যান্টাসি বই দিয়ে পড়া শুরু করতে ইচ্ছুক—তাঁদের জন্য এই বইটি রেকোমেন্ডে অবশ্যই করব।

লেখক নিয়ে কিছু কথা

লেখকের প্রথম কোনো লেখা এবং বই দুই-ই পড়া। পূর্বে লেখকের লেখা পড়ার অভিজ্ঞতা না থাকলেও; বইয়ের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ছোটো ছোটো পোস্টের অংশগুলো থেকে লিখনপদ্ধতি নিয়ে অনেকটা ধারণা পেয়ে যায়। একটি বিষয়কে সহজ বর্ণনায় প্রকাশ করার যে প্রচেষ্টা তা উপন্যাসের পাতায়ও ভালোভাবে ফুটে উঠেছে।
লেখকের নিজস্ব যে স্বকীয়তা এবং গল্প বলার ঢং দুটোই ভালো লেগেছে। আশা করছি আগামী বইগুলোতে এই দিকটি আরও উন্নত এবং শক্তিশালী হবে। গল্প বলার পাশাপাশি অন্যান্য খুঁটিনাটি বিষয়ে লক্ষ রাখার পূর্ণ পরামর্শ দিব। আশা করছি লেখক উপকৃত হবেন। আগামীর জন্য শুভকামনা রইল।

সম্পাদনা ও বানান

বইয়ে বানান ভুল নেহাত ছিল না। প্রচলিত ও অপ্রচলিত দুই ক্যাটাগরির-ই দু’রকম বানানের প্যাটার্ন (যেমন—ফেনিলকে লেখা ফেলিন) দেখা গিয়েছে।
৫১ পৃ: প্রথম লাইনে ডাবরি প্রধান না লিখে, ভাঙন প্রধান লেখা হয়েছে। এ-রকম টুকটাক কিছু ত্রুটি আছে। তবে দূরত্ব, ভাষাগত পার্থক্য, দিনের হিসাব; এই নিয়ে আরেকটু কাজ করা যেত বলে মনে করছি।

প্রচ্ছদ » অলংকরণ » নামলিপি

বইয়ের মতোই রাজকীয় প্রচ্ছদ। নামলিপি থেকে শুরু করে পুরো প্রচ্ছদ ভাবনা সবকিছু আকৃষ্ট করার মতো। সজল ভাইয়ের আরও একটি অসাধারণ কাজের মধ্যে অন্যতম এটি।
ওয়াসিফ নূর ভাইয়ের অলংকার সব সময়ের মতো সুন্দর। বিশেষ করে ডাবরির আর্টওয়ার্কটি। প্রথমটিতে যে ক্যান্তর ভয়ে ভীত অবস্থায় রয়েছে; তাকে কেন যেন বাঙালি মধ্যবয়স্ক কোনো আঙ্কেলের রূপ দান করা হয়েছে। পরনে আবার পাঞ্জাবি মনে হলো! লেখক কি এইভাবে চরিত্রটিকে দেখাতে চেয়েছেন?

মলাট » বাঁধাই » পৃষ্ঠা

পুরাই মাখন প্রোডাকশন। কাগজের মান, কমফোর্টেবল বাঁধাই। খুলে আরাম করে পড়ার মতো। ঠিক যে-রকমটা আমি চাই। এইরকম বই হাতে নিয়ে পড়ে প্রিমিয়াম ফিল পাওয়া যায়।
[sc_fs_faq html=”true” headline=”h2″ img=”” question=”রাজকীয় উৎসর্গ বই পরিচিতি?” img_alt=”” css_class=””] বই : রাজকীয় উৎসর্গ  লেখক : আল কাফি নয়ন জনরা : হাই/এপিক ফ্যান্টাসি প্রথম প্রকাশ : জানুয়ারি ২০২২ নামলিপি • প্রচ্ছদ : সজল চৌধুরী  চিত্র অলংকরণ : ওয়াসিফ নূর প্রকাশনা : ভূমিপ্রকাশ  মুদ্রিত মূল্য : ৫০০ টাকা মাত্র পৃষ্ঠা : ৩২০ [/sc_fs_faq]
Leave a Reply 0

Your email address will not be published. Required fields are marked *