![](https://boiinfo.com/wp-content/uploads/2022/08/FB_IMG_1659794099575-360x202.jpg)
সোভিয়েত রাশিয়া ভাঙল কেন
বদরুল আলম খান
প্রথমা
বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। যা পুরো বিশ্বের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। অথচ তিন দশক আগেও দেশ দুইটি সোভিয়েত ইউনিয়ন এর অংশ ছিল। সেই সোভিয়েত রাশিয়া ভাঙার ইতিবৃত্ত এই বই। মাত্র ৭০ বছরের ব্যবধানে সমাজতন্ত্র আদর্শের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রটি ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। বইটিতে শুধু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেন নি লেখক; সোভিয়েত অঞ্চলে মানুষের বসবাস হতে শুরু করে তাদের বিকাশ, রাষ্ট্র গঠন, সংস্কৃতি-সাহিত্যের মিশ্রণ ও অবশেষে আলাদা হয়ে যাওয়ার পুরো ইতিহাসকে ধারাবাহিকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। ১৯৭২ সালে লেখক বুয়েটে মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ পড়ালেখা করতেন। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ হতে সোভিয়েত ইউনিয়ন এ স্কলারশিপ চালু করা হয়। লেখক স্কলারশিপ নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন এর রাশিয়াতে যান এবং সেখানে দীর্ঘ এগারো বছর অবস্থান করেন; সেই অভিজ্ঞতাও বইটি লিখতে লেখককে অনুপ্রেরণা দিয়েছে।
১৯১৭ সালে বলশেভিক বিপ্লবের মাধ্যমে রাশিয়ার জারতন্ত্রের অবসান ঘটে। ১৯২২ সালে একটি চুক্তির মাধ্যমে ১৫ টি প্রজাতন্ত্র নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন এর প্রতিষ্ঠা হয়। লেলিনের নেতৃত্বে সরকার গঠন হয়। তবে লেলিন বেশিদিন ক্ষমতায় থাকেন নি। লেলিনের মৃত্যুর পর স্তালিন ক্ষমতায় আসে। স্তালিনকে সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়েছেন অনেক গবেষক। স্তালিনের বিরুদ্ধে বহু নিবেদিতপ্রাণ কর্মীকে হত্যা ও নির্বাসনে পাঠানোর অভিযোগ রয়েছে। তবুও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সাহসিকতার সাথে দেশকে রক্ষার জন্য জীবদ্দশায় কোনো কঠোর বিরোধিতার মুখোমুখি হতে হয়নি তাকে।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল বৈচিত্রময় একটি রাষ্ট্র। প্রজাতন্ত্রগুলোর ছিল আলাদা আলাদা ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি ও জীবনব্যবস্থা। এত বৈচিত্রতার মাঝেও তারা নিজেদের সোভিয়েত ইউনিয়নের পতাকাতলে দেখতে চাইতো। চুক্তিতে উল্লেখ ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত প্রজাতন্ত্রগুলো স্বায়ত্তশাসন ভোগ করবে; কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল রাশিয়ার উপনিবেশে পরিণত হয়েছে অন্যরা। এই শোষনের প্রতিবাদে যখনই মানুষ রাস্তায় নেমেছে তাদের কঠোর হাতে দমন করেছে স্তালিন সরকার। সোভিয়েতের সকল অঞ্চলকে রুশীকরণের অংশ হিসেবে বহু নাগরিককে তাদের জন্মভূমি ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে যেতে হয়েছে, এমনকি মৃত্যু হয়েছে লাখ লাখ মানুষের।
সোভিয়েত ইউনিয়নের সাহিত্যের কদর সারা দুনিয়াজোড়া। লিও তলস্তয়কে বিশ্বসেরা সাহিত্যিক বলা হয়। তাঁর ওয়ার এন্ড পিস, আনা কারেনিনা, পুনরুত্থান উপন্যাসে বিপ্লবের চিত্র পাওয়া যায়। ফিওদর দস্তয়েভস্কি, আন্তন চেখভ, নিকোলাই গোগল, বরিস পাস্তেরনাক, মিখাইল শোলকভের লেখায় বারবার বিপ্লব ফিরে এসেছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের সাহিত্য ও সমাজতন্ত্রকে পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে তারা নিজ খরচে বিদেশি ভাষায় বই অনুবাদ শুরু করে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের কারণ হিসেবে লেখক তিনটি সমস্যাকে চিহ্নিত করেছেন। প্রথমত বিপ্লবের মাধ্যমে সামাজিক মুক্তি কিংবা সমাজের পুনর্গঠন সম্ভব নয় বা সম্ভব হলেও ফলাফল যৎসামান্য। দ্বিতীয়ত রুশ ইতিহাস হাজার বছরের পুরনো এবং রক্ষণশীল কিন্তু সোভিয়েত কর্তারা ইতিহাসের ধারাবাহিকতাকে উপেক্ষা করে চলেছেন। তৃতীয় কারণ হিসেবে সোভিয়েত সাম্রাজ্যের অতিমাত্রায় প্রসার এবং তার ফলে জন্ম নেওয়া জাতিগত সমস্যা সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনকে ত্বরান্বিত করে।
কমিউনিস্ট পার্টির অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে বহু নিবেদিতপ্রাণ কর্মী হত্যার শিকার হয়। এতে করে পার্টির ক্ষমতা অযোগ্য ব্যক্তিদের হাতে চলে যায়। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে জনগণের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। এত বড় একটা রাষ্ট্র অথচ বৈচিত্র্য অনুযায়ী পরিকল্পনা ছিল না। যার ফলে দুর্নীতি বেড়ে গিয়েছিল এবং দরিদ্রদের নিষ্পেষণ হচ্ছিল। আফগানিস্তানে সোভিয়েতদের পরাজয়, বার্লিন দেয়ালের পতন এবং গর্বাচভ-ইয়েলেৎসিন রাজনৈতিক অস্থিরতা সোভিয়েত ইউনিয়নের কফিনে শেষ পেরেক মেরে দেয়।
বইটি অনেক তথ্যবহুল। সোভিয়েত ইউনিয়নের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির পরিচয় পাওয়া যায়। ইতিহাসের পাশাপাশি তাত্ত্বিক আলোচনা রয়েছে। অনেকের হয়তো অনাগ্রহ লাগতে পারে, তবে ধৈর্য্য ধরে পুরো বইটা শেষ করতে পারলে মনে হবে পড়াটা সার্থক হয়েছে।