সতীনাথ ভাদুড়ী সম্পর্কে আমার দুর্বলতা অত্যধিক -সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

সতীনাথ ভাদুড়ী সম্পর্কে আমার দুর্বলতা অত্যধিক। বিশেষত যত দিন যাচ্ছে ততই বাংলা ভাষার পাঠকদের মধ্যে সতীনাথ ভাদুড়ী সম্পর্কে বিস্মরণ এসে যাচ্ছে বলে আরও বেদনা বোধ করি। ইদানীংকালের অনেক নবীন পাঠক এঁর নামও শোনেননি, এঁর অনেক বই এখন ছাপা নেই। এই লেখকের স্মৃতিরক্ষার কোনও ব্যবস্থা হবে না। সতীনাথ ভাদুড়ী জীবিতকালে কলেজ স্ট্রিট পাড়ায় ঘোরাঘুরি করেননি কখনও, কাগজের সম্পাদকদের সঙ্গে দেখাশুনা করেননি বিশেষ, প্রায় সমস্ত লেখাই ডাকে পাঠাতেন। কোনওদিন সেরকম কোনও সভা সমিতিতে যাননি। তিনি শুধু লিখতেন। এবং তাঁর লেখার সঙ্গে অর্থোপার্জনের সম্পর্কটাও ছিল অপ্রত্যক্ষ। এবং এরকম লেখক বাংলা ভাষায় খুব বেশি জন্মায়নি। প্রথম বইটিতেই তিনি রবীন্দ্র পেয়েছিলেন। তাঁর পরের বইগুলিও। ভারতবর্ষের সব ক’টি পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য। যদি পুরস্কার অর্থে স্বীকৃতি ও সম্মান বোঝায়। সতীনাথ প্রত্যেকটি বই লিখতেন নতুন পরিকল্পনা ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। এবং এই একজন বিরলজাতের লেখক, যিনি নিজেকে সম্পূর্ণ গোপন করে রাখতে পেরেছেন নিজের রচনা থেকে।

তাঁর যে-কোনও বই পড়লেই বোঝা যায়, কী অসম্ভব শক্ত এই ধরনের বই লেখা। তাঁর রচনার গতি কোথাও দুর্বার নয়, বিন্দু বিন্দু রস চয়ন করে মৌচাক সৃষ্টির মতন। জাগরী ছাড়া তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বই আমার কাছে ‘ঢোঁড়াই চরিত মানস’ দুই খণ্ড, ‘অচিন রাগিণী’, ‘সত্যি ভ্রমণ কাহিনী’, ‘জলভ্রমি’ এবং ‘সঙ্কট”। ঢোঁড়াই চরিত মানসের কথা আমি বারবার নানা জায়গায় উল্লেখ করেছি। এরকম বিস্ময়কর বই যে-কোনও দেশের সাহিত্যে দুর্লভ। এই বইখানি বাংলার আধুনিক ক্লাসিক হিসেবে গণ্য হবার যোগা। রিক্ত সর্বহারাদের নিয়ে বাংলায় কিছুই লেখা হয়নি এই অভিযোগ যাঁরা করেন তাঁরা অনেকেই অবশ্য ঢোঁড়াই চরিত মানস পড়েননি। পড়লেও বোধহয় পছন্দ হবে না। কারণ বইখানি শেষ পর্যন্ত শাস্ত রসের। বস্তিবাসীর জোলো প্রেমকাহিনী যেমন এটা নয়, তেমনি এতে দাঙ্গা-হাঙ্গামার দিকটাও বড় করে দেখানো হয়নি। নিদারুণ অর্থনৈতিক নিষ্পেষণের কথা আছে— কিন্তু শেষ পর্যন্ত যে অধ্যাত্মরসে এখনও ভারতের লক্ষ লক্ষ সরল নিম্নবিত্ত মানুষ আশ্রয় ও সান্ত্বনা পেতে চায়, সতীনাথ ভাদুড়ী সেই জীবন-সত্যের কথাই বলেছেন। সাহিত্যের বিচারে বইটি আশ্চর্য সার্থক। বইটি সতীনাথ ভাদুড়ীর নিজেরও খুব প্রিয় ছিল; কারণ অন্য একটি লেখায় তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন, এই বইটি পাঠকদের সমাদর লাভ পায়নি। যদি পেত তিনি বইটার আবার পরিমার্জন করতেন, আরও এক খণ্ড লিখতেন। বাংলা সাহিত্য সেই লেখা থেকে বঞ্চিত হয়েছে।

সতীনাথ ভাদুড়ীর লেখার কথা ভাবলে বাংলাদেশের এই দুঃসময়ের কথাও মনে পড়ে। মনে হয় সত্যিকারের সৎ ও অকৃত্রিম সাহিত্যের আজ সমাদর নেই। এক একজন লেখকের মৃত্যুর পরই পাঠকরা তাঁদের ভুলে যায়—হঠাৎ কোনও হুজুগে তাঁদের পুনর্জীবিত করার ব্যবস্থা হলে তা হলে জীবিতকালে কে আর অমরত্বের সাধনায় সাহিত্য রচনা করতে চাইবে? তাৎক্ষণিক হাতে-গরম লেখার যুগই বুঝি কায়েম হয়ে গেল।

-সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

Leave a Reply 0

Your email address will not be published. Required fields are marked *