যদ্যপি আমার গুরু : আহমদ ছফা – রিভিউ | Joddapi Amar Guru By Ahmed Sofa Books

  • বইয়ের নামঃ- যদ্যপি আমার গুরু
  • লেখকঃ- আহমদ ছফা
  • প্রকাশকঃ আহমেদ মাহমুদুল হক
  • প্রকাশনীঃ মাওলা ব্রাদার্স
  • প্রচ্ছদঃ কাইয়ুম চৌধুরী
  • মলাট মূল্যঃ ১৭৫৳
  • রিভিউদাতাঃ এম.এ.রানা

ফ্লাপ থেকেঃ

❝জাতীয় অধ্যাপক আবদুল রাজ্জাক কে চলমান বিশ্বকোষ বললে খুব একটা অত্যুক্তি করা হয় না।অর্থশাস্ত্র,রাষ্ট্রবিজ্ঞান,সমাজবিজ্ঞান,ইতিহাস,শিল্প-সাহিত্য,ধর্ম-সংস্কৃতি এই সবগুলো বিষয়ে তিনি বিশেষজ্ঞ মতো মতামত দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন।তার পান্ডিত্যের খ্যাতি সর্বজনবিদিত।সমকালীন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপীঠ সমুহের শ্রেষ্ঠ মনীষীদের অনেকেই একব্যাক্যে তার মেধা এবং ধী-শক্তির অনন্যাতা স্বীকার করে নিয়েছেন।এই নিভৃতচারী,অনাড়ম্বর জ্ঞানসাধক মানুষটি সারাজীবন কোন গ্রন্থ রচনা করেন নি।❞

 

👉বই থেকেঃ

❝১৯৭০ সাল। বাংলা একাডমী তিন বছরের ফেলোশিফ প্রোগ্রামে প্রার্থীদের কাছ থেকে আবেদন পত্র আহবান করে বিজ্ঞাপন প্রকাশ করলো। ঠিক তখনই বিখ্যাত লেখক ও সাহিত্যক আহমদ ছফা বন্ধুদের অনুরোধে দরখাস্ত করে বৃত্তিটা পেয়ে গেলো। এখন দরকার একজন অফিসিয়াল থিসিস সুপার ভাইজার। বন্ধুদের পরামর্শে অধ্যক্ষ আবদুর রাজ্জাকের বাড়ীতে আহমদ ছফা উপস্থিত হয়। এরপর থেকে দীর্ঘ সাতাশ বছর গুরু শিষ্যের আলোচনার ভিত্তিতে গড়ে উটেছে এই যদ্যপি আমার গুরু।যদ্যপি আমার গুরুর মুলই হচ্ছেন জাতীয় অধ্যাপক প্রফেসর আবদুর রাজ্জাক। জ্ঞানের সাধনায় তিনি ছিলেন মৃত্যু অবধি চির কুমার। সাধারণ জীবন যাপনে অভ্যস্ত ও অন্যের প্রতি ছিলেন পরোপকারী। আহমদ ছফা তার বইয়ের ভান্ডার দেখে অভিভূত হন।আহমদ ছফার মতে, দৃষ্টিভঙ্গির স্বচ্ছতা নির্মাণে,নিস্কাম জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে,প্রচলিত জনমত উপেক্ষা করে নিজের বিশ্বাসের প্রতি স্থিত থাকার ব্যাপারে প্রফেসর আবদুর রাজ্জাকের মতো আমাকে অন্য কোন জীবিত বা মৃত মানুষ অতটা প্রভাবিত করতে পারেনি।আর তার পান্ডিত্যের চম্বুকের মতো একটা আকর্ষণী শক্তি অবশ্যই আছে।আবার তাঁর চোখের দৃষ্টি অসাধারণ রকম তীক্ষ্ণ।দ্বিতীয়ত তিনি ঢাকাইয়া বুলি অবলীলায় কথা বলতেন ও তিনি নাকি আহমদ ছফাকে প্রথম দেখাতেই মৌলবি আহমদ ছফা বলে সম্বোধন করেন।

আজীবন অকৃতদার এই অধ্যাপক তার ছোট ভাইয়ের সংসারে থেকে নিয়মিত জ্ঞানচর্চা করতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেয়ার প্রতি তার খুুব একটা আগ্রহ ছিলো না। ক্লাসে পাঠ দেয়া ও আনুষ্ঠানিক বক্তব্য প্রদানে ছিলো তার অনীহা, কিন্তু তারপরও তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের মেধাবী শিক্ষার্থীদের চুম্বকের মতো আকর্ষণ করেছেন। হুকা টানা ও দাবা খেলার প্রতি ছিল তার বিশেষ দূর্বলতা। তবে সবচেয়ে বেশী দূর্বল ছিলেন তিনি বিলাস ভোজনে। এমনকি দেশের বাইরে গেলে সেখান থেকেও তিনি অন্তত একটা খাবার মেনু রান্না করা শিখতেন। আহমদ ছফা আর রাজ্জাক স্যারের কথোপকথন যতই আগে চলেছে ততই তাদের মধ্যে ভাবটা আরোও জমিয়ে উঠেছিল।তাদের মধ্যে আলোচনা হতে থাকে ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান,শাস্ত্রীয় সংগীত, ধর্ম,সমাজ,তৎকালীন রাজনীতি, সমাজব্যবস্থা,শিক্ষা ও শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে।বাংলা ভাষা ও এর বিকাশ, বাংলা সাহিত্য, বাংলা ব্যাকরণ নিয়েও তাদের মধ্যে দারুণ সব বিশ্লেষণ হয়। রাজ্জাক স্যার আলোচনা করতে থাকে তার জীবনের নানা অভিজ্ঞতা। তাদের গুরু শিষ্যর আলোচনার মাঝে উঠে এসেছে দেশ ভাগ ও মুক্তিযুদ্ধের আংশিক। আহমদ ছফার এক এক প্রশ্নের বিপরীতে রাজ্জাক স্যারের থেকে বেরিয়ে আসে দারুণ সব বিশ্লেষণ ও তার বিভিন্ন অভিজ্ঞতা।ফুটে এসেছে খাবারের প্রতি রাজ্জাক স্যারের অনুরাগ। তার উপর উঠে এসেছে বিখ্যাত সব ব্যাক্তিবর্গের সাথে রাজ্জাক স্যারের সখ্যতা। তার মধ্যে ছিলেন তৎকালীন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার, ভারতের হাই কমিশনার,ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, শেখ মুজিবুর রহমান, কবি জসীমউদ্দিন, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন, অজপাড়া গাঁয়ের থেকে এস এম সুলতানের বিখ্যাত চিত্রশিল্পী হয়ে উঠার অনন্য কথা।তবে রাজ্জাক স্যার জিন্নাহর প্রতি একটু দুর্বল ছিল। এই বইয়ে উঠে এসেছে বিখ্যাত সাহিত্যিক টলস্টয়, ও গোঁতোর অনন্য সব কীর্তি। আবার বিপরীতে উঠে এসেছে বিভিন্ন খ্যতনামা ব্যাক্তিবর্গের সমালোচনা তাতে স্থান পেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রাজা রামমোহন রায় সহ আরোও প্রমুখ গুণী ব্যাক্তিদের সমালোচনা করেন।তাদের আলোচনায় বঙালী মুসলমানদের প্রসঙ্গ আসায় রাজ্জাক স্যার বলেন, বাঙ্গালী মুসলিমদের একটা স্বতন্ত্র শিক্ষা, সংস্কৃতি, সাহিত্যের জগৎ সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা তিনি অনুভব করতেন। তিনি ইসলামকে মনে করতেন না পরকাল সর্বস্ব ধর্ম। পার্থিব – পরলৌকিক দুই দিকেই ইসলামে স্বীকৃত বলে তার ধারণা।এছাড়া তাদের আলোচনায় আরো বিভিন্ন গুরত্বপূর্ণ দিক উঠে এসেছে। দারুণ সব প্রশ্ন উত্তর ও বিশ্লেষণ বিভিন্ন স্মরণীয় সব ঘটনা জানার জন্য বইটা অতি শঘ্রীই সংগ্রহ করুন এবং পড়ে ফেলুন।❞

 

👉ব্যক্তিগত মতামতঃ

❝ব্যক্তিগত ভাবেও বইটা ভীষণ ভলো লেগেছে।আমি বলবো বইটা না পড়লে আপনার অনেককিছুই অজানা রয়ে যাবে।জানার কৌতুহলে হলেও বইটা পড়ে ফেলুন।অধ্যাপক রাজ্জাককে নিয়ে শ্রেষ্ঠতম রচনা বলে বিবেচিত “যদ্যপি আমার গুরু।”যদ্যপি আমার গুরু সম্ভবত বাংলা জীবনী সাহিত্যেই তুলনাহীন একটা গ্রন্থ। অধ্যাপক রাজ্জাকের চিন্তার বৈচিত্র্য, গভীরতা আর স্বাতন্ত্র্যের পরিচয় আমরা গ্রন্থটিতে বারংবার পাবো।এমন নয় যে আপনি এসব সম্পর্কে বিস্তর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ পাবেন এ বইয়ে, কিন্তু জ্ঞানের নানা শাখার সূত্র ধরিয়ে দিতে অবশ্যই সক্ষম হবে বলে আশা রাখছি।❞

 

👉বইয়ে প্রফেসর আবদুর রাজ্জাকের জবানিতে কিছু প্রিয় বাক্যঃ

▪️❝একটা কথা খেয়াল রাখন খুব দরকার। যখন একটা নতুন জায়গায় যাবেন, দুইটা বিষয় পয়লা জানার চেষ্টা করবেন। অই জায়গার মানুষ কি খায় আর পড়ালেখা কী করে। কাঁচাবাজারে যাইবেন কি খায় হেইডা দেহনের লাইগ্যা। আর বইয়ের দোকানে যাইবেন পড়াশোনা কি করে হেইডা জাননের লাইগ্যা।কী খায় আর কী পড়ে এই দুইডা জিনিস না জানলে একটা জাতির কিছু জানন যায় না।❞

 

▪️❝পড়ার কাজটি অইল অন্যরকম। আপনে যখন মনে করলেন, কোনো বই পইড়্যা ফেলাইলেন, নিজেরে জিগাইবেন যে বইটা পড়ছেন, নিজের ভাষায় বইটা আবার লিখতে পারবেন কিনা। আপনার ভাষার জোর লেখকের মত শক্তিশালী না অইতে পারে, আপনের শব্দভান্ডার সামান্য অইতে পারে, তথাপি যদি মনে মনে আসল জিনিসটা রিপ্রোডিউস না করবার পারেন, ধইরা নিবেন, আপনের পড়া অয় নাই।❞

▪❝রবীন্দ্রনাথ বড় লেখক, কিন্তু মানুষ হিসাবে রবীন্দ্রনাথ, বিদ্যাসাগর কিংবা তাঁর মতো মানুষদের ধারে কাছেও আসতে পারেন না। বড় লেখক এবং বড় মানুষ এক নয়। বড় লেখকদের মধ্যে বড় মানুষের ছায়া থাকে। বড় মানুষরা আসলেই বড় মানুষ। লেখক কবিরা যা বলে সেরকম আচরণ না করলেও চলে। হের লাইগ্যা প্লেটো তার রিপাবলিক থ্যাইক্যা কবিগো নির্বাসনে পাঠাইবার কথা বলছিল।❞

👉বইয়ে আহমদ ছফার জবানিতেঃ

▪️❝রাজ্জাক সাহেব মনে-প্রাণে একজন খাঁটি সেক্যুলার মানুষ। কিন্তু বাঙালি মুসলমানসমাজের সেক্যুলারিজমের বিকাশের প্রক্রিয়াটি সমাজের ভেতর থেকে, বাঙালি মুসলমানের সামাজিক অভিজ্ঞতার স্তর থেকে বিকশিত করে তুলতে হবে, একথা তিনি মনে করেন।❞

লেখক পরিচিতিঃ

লেখক আহমদ ছফা।জন্ম ১৯৪৩ সাল চট্রগ্রামে।সাহিত্যের প্রায় প্রতিটি শাখায় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেনগল্প, উপন্যাস, কবিতা, গান, প্রবন্ধ, অনুবাদ, ইতিহাস, ভ্রমণকাহিনী,মিলিয়ে ৩০ টিরও অধিক গ্রন্থের প্রন্থের প্রণেতা

Leave a Reply 0

Your email address will not be published. Required fields are marked *