- বই : মামলুক সালতানাতের ইতিহাস
- লেখক : মাহমুদ শাকের
- প্রকাশনী : মাকতাবাতুল হাসান
- বিষয় : ইসলামি ইতিহাস ও ঐতিহ্য
- অনুবাদক : ইহতিশামুল হক
- পৃষ্ঠা : 448
- ভাষা : বাংলা
মামলুক সালতানাত মধ্যযুগের একটি ইসলামি সালতানাত। মামলুক অর্থ হলো দাস। মামলুক সুলতানগণ কিপচাক ও সার্কাসিয়ান বংশোদ্ভূত দাস হওয়ায় তাদের শাসিত সালতানাত ‘মামলুক সালতানাত’ নামে পরিচিতি লাভ করে। ৬৪৮ হিজরি মোতাবেক ১২৫০ খ্রিষ্টাব্দে আইয়ুবি সাম্রাজ্যের ধ্বংসাবশেষের ওপর মিশরে এ সালতানাত প্রতিষ্ঠা লাভ করে। প্রায় ৩০০ বছর শাসন করার পর ৯২৩ হিজরি মোতাবেক ১৫১৭ খ্রিষ্টাব্দে রিদানিয়ার যুদ্ধে উসমানি সুলতান প্রথম সেলিমের হাতে এ সালতানাতের পতন হয়। বর্তমান মিশর, ইসরাইল, ফিলিস্তিন, জর্দান, লেবানন, লিবিয়া, সৌদি আরব, সুদান, সিরিয়া এবং তুরস্ক মামলুক সালতানাতেরই অংশ ছিল ।
তাতারিদের হাতে বাগদাদ পতনের মধ্য দিয়ে আব্বাসি খেলাফতের পতন ঘটলে মামলুক সুলতানগণ এগিয়ে আসেন এবং আব্বাসি খেলাফতের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। তারা অপরাজেয়খ্যাত তাতারিদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান এবং আইনে জালুতের যুদ্ধে পরাজিত করে তাদের দম্ভ ও অহংকার মাটির সাথে মিশিয়ে দেন।
একই সঙ্গে তাড়া করেছেন ক্রুসেডারদের, যারা ধর্মীয় উন্মত্ততা নিয়ে ক্ষুধার্ত নেকড়ের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুসলিম ভূখণ্ডের ওপর। তখন মামলুক বীর জাহের বাইবার্স ও সাইফুদ্দিন কালাউন তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেন। একে একে উদ্ধার করেন কার্ক, কায়সারিয়া, সাফাদ, জাফা, ত্রিপলি ও পূর্বের সকল অঞ্চল। এর মাধ্যমেই মুসলিমবিশ্ব পরিত্রাণ পায় ১৯৪ বছর ধরে চলে আসা ক্রুসেড যুদ্ধের বিভীষিকা থেকে।
বক্ষ্যমাণ গ্রন্থটিতে মামলুক সালতানাতের ইতিহাস বিধৃত হয়েছে। পাশাপাশি সামসময়িক অন্যান্য রাষ্ট্রগুলোর ওপরও অল্পবিস্তর আলোকপাত করা হয়েছে। মামলুক সালতানাতের উত্থান-পতন, প্রেক্ষাপট ও বিস্তৃতি, সম্পর্ক ও উন্নয়ন ইত্যাদি সকল বিষয় উঠে এসেছে গ্রন্থটিতে। অন্যান্য ইসলামি ও অনৈসলামি রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে তাদের সম্পর্ক কেমন ছিল সেসব বিষয় উঠে এসেছে।
লেখক মাহমুদ শাকের সিরিয়ার একজন বিখ্যাত ইতিহাসবিদ। তবে বক্ষ্যমাণ গ্রন্থটি লেখকের কোনো স্বতন্ত্র রচনা নয়। বরং, নামক দীর্ঘ ইতিহাস গ্রন্থের একটি অংশ। যাকে ‘মামলুক সালতানাতের ইতিহাস’ নামে বাংলাভাষী পাঠকের খেদমতে পেশ করা হচ্ছে।
যেহেতু মামলুক সুলতানগণ আব্বাসি খলিফাদেরকে নিজেদের পৃষ্ঠপোষকের আসনে অধিষ্ঠিত করেছিলেন এবং নামমাত্র হলেও তাদের ছত্রছায়ায় তারা শাসন পরিচালনা করতেন, তাই এ গ্রন্থে আব্বাসি খলিফাদের আলোচনার অধীনে মামলুক সুলতানদের ইতিহাস বিবৃত হয়েছে।
অনুবাদের ক্ষেত্রেও মূলানুগ অনুবাদের চেষ্টা করা হয়েছে। পাশাপাশি মূলের সারল্য যেন অক্ষুণ্ণ থাকে সেদিকেও লক্ষ্য রাখা হয়েছে। মোঙ্গল ও মামলুকদের আলোচনা করতে গিয়ে লেখক যে-সকল ব্যক্তি ও স্থানের নাম এনেছেন, সেগুলোর প্রচলিত উচ্চারণ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। আশা করি, পাঠক গ্রন্থটি পাঠ করে মামলুক সালতানাত সম্পর্কে সম্যক
ধারণা লাভ করতে সমর্থ হবেন। আল্লাহ তাআলার দরবারে দোয়া করি, এই গ্রন্থটি পাঠ করে বাংলাভাষী পাঠক যেন ইসলামি ইতিহাসকে উপলব্ধি করতে পারেন এবং ইতিহাসের
বার্তার আলোকে নিজেদের জীবন ও সমাজকে ঢেলে সাজাতে পারেন।
মুহাম্মাদ রাশেদ আবদুল্লাহ ঢাকা, ২১-৪-২০২২ খ্রি.
সকল প্রশংসা আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের জন্য নিবেদিত। শান্তি ও রহমত বর্ষিত হোক আমাদের সর্দার মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহর প্রতি, যিনি নবীগণের সর্দার, মুত্তাকিদের বাদশাহ। রহমত ও শান্তি বর্ষিত হোক তাঁর পরিবারবর্গের প্রতি, তাঁর সাহাবিগণের প্রতি, কেয়ামত পর্যন্ত তাঁর আদর্শ যারা প্রচার করবেন তাদের প্রতি।
বক্ষ্যমাণ গ্রন্থে মামলুক সালতানাত বলে ইতিহাসের যে অধ্যায়টিকে নির্দেশ করা হয়েছে, তা হলো ৬৫৮ থেকে ৯২৩ হিজরির মধ্যবর্তী সময়টি। যদিও এ সময়টিতে ইসলামি বিশ্বের অধিকাংশ অঞ্চলই তখনকার মামলুক সালতানাতের আওতাবহির্ভূত ছিল। বরং মামলুক সালতানাত তখন ছোট একটি ভূখণ্ডেরই শাসন করত। যার পরিধি ছিল মিশর, শাম (১) ও হিজাযকে
শাম : প্রাচীন শাম বা সিরিয়া একটি ঐতিহাসিক অঞ্চলের নাম। যার বিস্তৃতি ছিল ভূমধ্যসাগরের পূর্ব তীর থেকে মেসোপটেমিয়া অঞ্চল পর্যন্ত। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার সিরিয়া, লেবানন, জর্ডান, ঐতিহাসিক ফিলিস্তিন (ইসরাইল অধিকৃত অঞ্চল-সহ পশ্চিম তীর ও গাজা) এবং আধুনিক সৌদি আরবের আল-জাওফ প্রদেশ ও উত্তর সীমান্ত অঞ্চল ঐতিহাসিক শামের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এ ছাড়াও ১৯২১ সালে ফ্রান্স ও তুরস্কের মধ্যে স্বাক্ষরিত আংকারা চুক্তি অনুযায়ী বর্তমান দক্ষিণ পূর্ব তুরস্কের যেসব এলাকা তুরস্কের অন্তর্ভুক্ত হয়, সেগুলোও ঐতিহাসিক শামের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তুরস্কের সানজাকে ইস্কান্দার অঞ্চলও শামের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এ ছাড়াও আধুনিক মিশরের সিনাই উপদ্বীপ ও ইরাকের মসুল অঞ্চলের কিছু অংশও শাম অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
একদল ঐতিহাসিকের মতে পুরো সিনাই উপদ্বীপ ও সাইপ্রাস ও ঐতিহাসিক শামের অন্তর্ভুক্ত ছিল। অবশ্য খ্রিষ্টপূর্ব ৬৪ সালে রোমানরা শাম অধিকার করার বহু পূর্বে মেসোপটেমিয়া অঞ্চল শাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পারসিয়ান সাম্রাজ্যের অধিকারে চলে যায় এবং পরবর্তী সময়ে (পারসিয়ান সাম্রাজ্যের স্থলাভিষিক্ত) সাসানি সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। এর ফলে শামের আয়তনে পরিবর্তন ঘটে এবং শাম ভূমধ্যসাগরের তীর হতে ফুরাত নদীর তীর পর্যন্ত এলাকায় সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে।
বর্তমান সৌদি আরবের আল-জাওফ প্রদেশের অন্তর্গত দুমাতুল জান্দাল ছিল তৎকালীন শামের দক্ষিণ সীমান্ত, আর উত্তর সীমান্ত ছিল দক্ষিণ তুরস্কের তোরোস পর্বতমালা। প্রাক-ইসলামি যুগ ও ইসলামি যুগে শাম বলে উল্লিখিত অঞ্চলকেই বোঝানো হতো। বলাবাহুল্য, প্রাচীন শাম বা সিরিয়াকে আধুনিক সিরিয়া রাষ্ট্রের পরিসরে সীমাবদ্ধ মনে করলে অনেক ক্ষেত্রেই দুর্বোধ্যতা ও জটিলতা সৃষ্টি হবে।-সম্পাদক
ঘিরে। কিন্তু ইতিহাসের এই পর্বটিকে যেন সহজেই চেনা যায়, সেজন্য এর একটি নাম নির্ধারণ করা আবশ্যক ছিল বলে আমরা উক্ত নামটি নির্বাচন করেছি। ইতিহাসের বিভিন্ন যুগ সাধারণত কোনো সাম্রাজ্যের নামে অথবা সে যুগের কোনো অনন্যসাধারণ বৈশিষ্ট্যে পরিচিত হয়ে থাকে। যেমন আব্বাসি খেলাফত, খেলাফতে রাশেদা ইত্যাদি। আমাদের আলোচ্য পর্বটিতে অর্থাৎ ৬৫৮ হিজরি থেকে ৯২৩ হিজরি পর্যন্ত সময়টিতে ইসলামি বিশ্বকে কয়েকটি সাম্রাজ্য শাসন করত। গুরুত্বের বিচারে সেগুলো প্রায় সমমানের ছিল। তবে মামলুক সালতানাত ছিল সেগুলো থেকে স্বতন্ত্র কিছু বৈশিষ্ট্যের অধিকারী, যে সকল বৈশিষ্ট্য অন্য সাম্ৰাজ্যগুলোয় ছিল অনুপস্থিত।
মামলুক সালতানাতকে খেলাফত বলা সঠিক নাকি ভুল, এ সালতানাত শরয়ি দৃষ্টিকোণ থেকে বৈধ ছিল নাকি অবৈধ সেটি একটি তর্কের বিষয় হলেও এ সালতানাত যে তৎকালীন খেলাফতের কেন্দ্র হিসাবে গণ্য হতো, তাতে কোনো সন্দেহ নাই। তৎকালীন অন্য ইসলামি সাম্রাজ্যগুলোও মামলুক সালতানাতের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করত। বিভিন্ন সুলতান ও বাদশাহগণ স্বদেশ পরিচালনায় মামলুক সুলতানদের শাসন অনুসরণ করতেন। অনেক সময় জনগণের সমর্থন লাভ বা শরয়ি বৈধতা অর্জন করার জন্যও অন্যান্য দেশের রাজাবাদশাগণ মামলুক সুলতানদের সমর্থন কামনা করতেন।
মামলুকদের শ্রেষ্ঠত্ব ও অবদান মুসলিমদের চোখে বড় হয়ে ধরা দেয় সেই বিশাল বিজয়টির পরে, যা তারা আইনে জালুতের প্রান্তরে মোঙ্গলদের বিরুদ্ধে লড়াই করে অর্জন করেছিল। মোঙ্গলরা তখন দুনিয়ার এক বিশাল-বিস্তৃত ভূখণ্ড শাসন করত।
তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় শির উঁচু করে দাঁড়াবে, চোখে চোখ রেখে তাদের মোকাবিলায় অবতীর্ণ হবে এমন হিম্মত তখন দুনিয়ার কোনো শক্তিরই ছিল না। অপরাজেয় এই মোঙ্গলদের বিরুদ্ধে প্রথম যারা অসি হস্তে এগিয়ে এসেছিলেন এবং যুদ্ধ করে তাদের থেকে বিজয় ছিনিয়ে এনেছিলেন, তারাই হলেন এই মামলুক সুলতানগণ। যারা মোঙ্গলদের তাড়াতে তাড়াতে শামের ভূমি থেকে বিদায় করেছিলেন।
হালাকু খান ও তার পরবর্তীদের নেতৃত্বে পরিচালিত মোঙ্গল হামলার বিরুদ্ধে যেমন তারা সোচ্চার ছিলেন, তেমনই তৈমুর লংয়ের নেতৃত্বে পরিচালিত তাতারি হামলার বিরুদ্ধেও ছিলেন তারা বজ্রকঠোর। এর চেয়েও বড় অবদান রাখেন তারা ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। শাম ও মিশর থেকে বিতাড়িত করে তাদেরকে তাড়া করেন সাইপ্রাস পর্যন্ত। তাদের হিংস্র থাবা থেকে সাইপ্রাস দ্বীপকে উদ্ধার করে রোডস দ্বীপ পর্যন্ত তাদের পশ্চাদ্ধাবন করেন। রোডস দ্বীপকেও তারা আপন সালতানাতভুক্ত করার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিলেন, যদি না ইউরোপ ক্রুসেডারদের সাহায্যে এগিয়ে আসত।
মামলুকদের প্রণিধানযোগ্য আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, হিজাযের মতো গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলের ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। হিজায ছিল মুসলিমদের ঐশী আবেগের কেন্দ্রভূমি। যেখানে রয়েছে আল্লাহর ঘর হারাম শরিফ ও তার রাসুলের প্রিয় শহর মদিনা। ওহি অবতরণের তীর্থভূমিও ছিল এই হিজায ছিল ইসলামি দাওয়াত ও পয়গামের লালনক্ষেত্র। তাই এ বিষয়টি মামলুকদের প্রতি মুসলিমদের সহানুভূতিকে আরেকটু বাড়িয়ে তোলে। এ ছাড়া আব্বাসি খেলাফতের পতনের পর মামলুক সালতানাত খেলাফতের পূনর্জীবন দানে যে ভূমিকা রাখে তাও ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত আব্বাসি খলিফা ও তাদের সন্তানদেরকে নিরাপত্তার বলয়ে আগলে রেখে তাদের মাঝে খেলাফতের ধারা চালু রাখার কৃতিত্বও মামলুক সুলতানদের ছিল। এর কারণে মামলুকদের প্রভাব-প্রতিপত্তি ও কেন্দ্রীয় শক্তিতেও সমৃদ্ধি আসে।
মামলুক সালতানাত ইসলামি বিশ্বের পূর্ব ও পশ্চিম দুটি প্রান্তের মধ্যখানে অবস্থিত ছিল। যার ফলে সালতানাতটি একটি কেন্দ্রীয় মর্যাদায় উন্নীত হয়। যা বিশ্বময় মুসলিমদের পারস্পরিক বোঝাপড়া ও যোগাযোগ (যা মুসলিমদের একটি ধর্মীয় অবশ্যবিধানও বটে) রক্ষার জন্য সহায়ক হয়। তেমনইভাবে ইসলামি দুনিয়ার পূর্ব-পশ্চিমকে যেকোনো ধরনের দাঙ্গাহাঙ্গামা থেকে বিরত রাখতেও সক্ষম ছিল এই মামলুক সালতানাত। আবার এই দুই প্রান্তের মাঝে বিবাদবিসংবাদের জন্ম দিতেও তারা রাখত পূর্ণ সক্ষমতা। আর মুসলিমদের মাঝে বিবাদবিসংবাদ তখনই জন্ম নেয় যখন তারা বিচ্ছিন্নতার পথ অবলম্বন করতে চায়, আর লঙ্ঘন করতে চায় খোদার এই অমোঘ বিধি যে, এক খেলাফতের অধীনেই ঐক্যবদ্ধ হয়ে যেন থাকে মুসলিম জাতি।
পর্তুগালে যখন সম্পূর্ণ নতুন উদ্যমে ক্রুসেড যুদ্ধ আরম্ভ হয়, তখন মামলুকরা মুসলিমবিশ্বকে রক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পর্তুগিজরা আরব দেশের দক্ষিণ প্রান্তে পৌছে নতুন ক্রুসেডের পতাকা উড্ডীন করে। তারা ক্রুসেড যুদ্ধের পরিবর্তে এর রূপক নাম দেয় ‘ইসতেমার’ বা উপনিবেশ স্থাপন। ফলে ক্রুসেড যুদ্ধই পরিচিত হয়ে যায় ইসতেমার (উপনিবেশ)
নামে। যা-ই হোক, ক্রুসেডারদের নৃশংসতার বিরুদ্ধে মামলুকদের বীরত্বব্যঞ্জক প্রতিরোধের কারণে তারা আরেকবার মুসলিম উম্মাহর মনোযোগ আকর্ষণে সক্ষম হয়। কিন্তু মামলুক সুলতানগণ মুসলিমদের সহানুভূতির সঠিক মূল্যায়ন করতে পারেনি। যেমন উসমানি সাম্রাজ্য তখন নীতিপথে অবিচল থাকার পরও মামলুক সুলতানগণ কর্তৃক তাদের বিরোধিতা করা।
যখন উসমানিরা সাফাবি শিয়াগোষ্ঠীর (যারা মুসলিমদের বিরুদ্ধে পর্তুগিজদের সঙ্গে সন্ধি করেছিল) ভয়াবহতাকে উপলব্ধি করে ইউরোপের যুদ্ধ মুলতবি করে তাদের দমন করার জন্য এগিয়ে আসে, তখন উসমানিদের সাহায্য করার পরিবর্তে মামলুকরা নিরপেক্ষতার আশ্রয় নেয়। অথচ এই সাফাবিরা শুধু উসমানিদের জন্যই হুমকি ছিল না বরং মামলুকদের জন্যও বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। উসমানিরা যথারীতি সাফাবিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাদের শক্তি খর্ব করে দিয়ে যখন তাদের রাজধানীতে প্রবেশ করে, মামলুকরা তখন তাদের ভাষায় নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ করে। আর নিরপেক্ষতা আদতে জালেমের জন্য আশীর্বাদ এবং দুর্বলের বিরুদ্ধে সহযোগিতা হয়ে থাকে।
শুধু নিরপেক্ষ নয়, বরং মামলুকদের একটি দল যারা যুল কাদির রাজ্যে বাস করত, উসমানি-সাফাবি যুদ্ধে তারা তো রীতিমতো উসমানিদের বিরুদ্ধেই অবস্থান গ্রহণ করে, যার বিবরণ ইতিহাসের পাতা থেকে কখনো মুছে যাওয়ার নয়। এমনইভাবে ইতিহাস স্মরণ রাখবে মামলুকদের সেই উপাখ্যান, যা রচিত হয় উসমানি-পর্তুগিজ যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে। দক্ষিণ আরবে আগ্রাসি পর্তুগিজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য উসমানিরা মামলুকদের ভূমি ব্যবহার করতে বাধ্য ছিল। কিন্তু মামলুকগণ তাদের সেই সুযোগটি প্রদান করতে একেবারেই সম্মত ছিল না।
অথচ উসমানিদের এ যুদ্ধের উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম উম্মাহকে রক্ষা করা ও তাদের পবিত্র ভূমিসমূহ রক্ষা করা। উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম উম্মাহর তৎকালীন সবচেয়ে বড় হুমকি পর্তুগিজদের উচিত শিক্ষা দেওয়া। কিন্তু মামলুকরা এই পথে তাদের সহযোগী হতে অসম্মত ছিল। উসমানিদের বিরুদ্ধে গৃহীত মামলুকদের উপরিউক্ত দুটি প্রমাদপূর্ণ সিদ্ধান্তই মূলত তাদের পতনের দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়।
ইসলামি ইতিহাসের যে পর্বের ইতিহাস নিয়ে এই গ্রন্থের অবতারণা সেই পর্বটির একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস যেন পূর্ণ গোচরে চলে আসে, সেজন্য মামলুক সালতানাতের পাশাপাশি আরব ও ভারতীয় রাজ্যসমূহ, মোঙ্গল ও তাতারদের রাজ্যসমূহ এবং মরক্কো ও আন্দালুসের রাজ্যসমূহ নিয়েও আলোকপাত করেছি। প্রত্যেকটি অঞ্চলের আলোচনার ওপর স্বতন্ত্র অধ্যায় এবং প্রত্যেকটি রাজ্যের আলোচনায় ভিন্ন ভিন্ন পরিচ্ছেদ কায়েম করেছি। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, নির্ভুল পথ, তাঁর তাফিক, সাহায্য ও সমর্থন। তিনি উত্তম মনিব ও উত্তম সাহায্যকারী। পরকথা হলো, সকল প্রশংসা মহান আল্লাহর জন্য নিবেদিত।