বেগম মেরী বিশ্বাস-বিমল মিত্র

অর্ধেকের বেশি পোকায় খাওয়া, খেরো খাতায় বাঁধানো নোনা ধরে যাওয়া বেশ ভারী একখানা পুঁথি খুঁজে পাওয়া গেল কলকাতার একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে।ছেড়াঁখোঁড়া তুলোট কাগজে গোটা গোটা ভুষোকালিতে লেখা তিনখানা অক্ষর- বেগম মেরী বিশ্বাস। অদ্ভুত নাম তো! মুসলমান বটে, খ্রিস্টানও বটে, আবার হিন্দুও বটে! কিন্তু কী আছে এই পুঁথিতে, কেই বা লিখেছে? পুঁথিখানা পড়তে গিয়ে চোখের সামনে যেন ভেসে এলো সবকিছু….মুর্শিদাবাদ, নবাব, চেহেল সুতুন, জেনানা, হাতিয়াগড়, ফিরিঙ্গি আরো কত কী!

মুর্শিদাবাদের নবাব বাংলা-বিহার উড়িষ্যার ভাগ্যবিধাতা সিরাজ-উ-দ্দৌলার নজর পড়লো হাতিয়াগড়ের জমিদার হিরণ্যনারায়ণ রায়ের ছোটোবউ রানিবিবির ওপর। সুতরাং হুকুম হলো রানিবিবিকে নবাবি হারেম চেহেল সুতুনে তুলে নিয়ে আসার। হিরণ্যনারায়ণ স্ত্রীকে প্রাণাধিক ভালোবাসতেন কিন্তু নবাবের হুকুম অমান্য করার দুঃসাহস কার আছে এ বাংলা মূলুকে?অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে জমিদারের নফরের একমাত্র মেয়ে মরালীবালা দাসীকে নবাবের হারেমে পাঠানো হলো রানিবিবির বদলা হিসেবে। কিন্তু নবাবের নিজামতের চর ঠিকই কিছু একটা আঁচ করতে পেরেছিল।

সময়টা অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি, ইংরেজ কোম্পানি করছে দস্তকের অপব্যবহার, নবাবের ইয়ারদোস্ত আমির ওমরাহ ডুবে আছে স্বেচ্ছাচারিতা আর নারীলোভে, মসনদের চারদিকে ষড়যন্ত্রের জাল। কী হলো এরপর? মরালীবালা আর রানিবিবির ভাগ্যে ঠিক কতটুকু বিপর্যয় এসেছিল? যে বিপর্যয় ঠাঁই পায় নি স্যার জর্জ ফরেস্ট থেকে শুরু করে মাইকেল এডওয়ার্ডের বই ‘ব্যাটল অব প্ল্যাসি’ তে, যে গল্প রয়ে গেছে অন্তরালে। সেই গল্পই উঠে এসেছে “বেগম মেরী বিশ্বাস” এ!

ইবনে বতুতা যে বঙ্গদেশকে বলেছিলেন দুজখস্ত পুর ই নি আমত অর্থাৎ সুখের নরক, যে দেশ গোয়ালভরা গরু, গোলাভরা ধান, পুকুরভরা মাছের আর যে দেশ ধর্মভীরু জাতের সেই দেশেরই আঠারো শতকের গল্প বেগম মেরী বিশ্বাস। মহাকাব্যের আদলে লেখা ঐতিহাসিক পটভূমির এ উপন্যাস অত্যন্ত চমৎকার বললেও বুঝি কম বলা হবে।

ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত তৈরি করেছিলেন যে রবার্ট ক্লাইভ, পরবর্তীতে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট তাঁকেই দিয়েছিল জালিয়াত আখ্যা। এদিকে ইতিহাসের চোখে পরাজিত নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলাকে যারা মসনদে আসীন করেছিল তারাই নবাবের মুখে থুতু ছেটাতে দুবার ভাবে নি। ইতিহাস সবসময় বিজয়ীদের কথা বলে কিন্তু বিমল মিত্র তা বলেন নি। নবাব এবং ক্লাইভের স্বপক্ষ সমর্থনে লেখক কথা বলেছেন, দেখিয়েছেন যুক্তি।
” সাধারণের চরিত্রগুণে রাজ্য হয় : সাধারণের চরিত্রদোষে রাজ্য যায়। রাজারা উপলক্ষমাত্র। সিরাজ-উ-দ্দৌলার দোষে রাজ্য যায় নাই। সে সময়ে সর্বগুণসম্পন্ন অন্য কেহ নবাব থাকিলেও সাধারণের চরিত্রদোষে রাজ্য যাইত। ”

১৯৫৬-১৯৬৬ সময়টার মাঝখানে লেখক বিমল মিত্র একটা পত্রিকায় “সখী সংবাদ” নাম দিয়ে ধারাবাহিকভাবে “বেগম মেরী বিশ্বাস” লিখতে শুরু করেছিলেন। বছরখানেক লেখার পর বন্ধ করে দেন। কিন্তু শেষ অব্দি লেখাটি শেষ না করে পারেন নি। আর পারেন নি বলেই “বেগম মেরী বিশ্বাস” এর মতন উপন্যাস বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করতে পেরেছিল। সর্বমোট ৫টি উপন্যাসের মাধ্যমে ভারতবর্ষের তিনশো বছরের ইতিহাসকে তুলে ধরেছিলেন বিমল মিত্র, তার প্রথমটিই “বেগম মেরী বিশ্বাস”। এর পরের খণ্ডগুলো “সাহেব বিবি গোলাম”, ” “কড়ি দিয়ে কিনলাম”, ” একক দশক শতক” ও “চলো কলকাতা”।

৭৭৪ পাতার উপন্যাস জুড়ে রয়েছে বিদ্রোহ, সংঘাত, অপ্রেম, ইতিহাস, অমোঘ সত্য আর বিশ্বাসঘাতকতা। ভারতবর্ষের ইতিহাসের চরমতম সময়কে এক নারীর জীবনের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলার লেখকের এ কৌশল অভিনব। নবাবি হারেম চেহেলসুতুনের অন্ধকার ঘুলঘুলাইয়ার পথে আমরা পাঠকরা আড়াইশো বছর পর ঢুকতে পেরেছি বেগম মেরী বিশ্বাসের বদৌলতে। টানা ১৫ দিন আমি ডুবে ছিলাম এ বইটিতে। আমার বাবার খুব প্রিয় লেখক ছিলেন বিমল মিত্র। বাবার সাজেশনেই উপন্যাসগুলো পড়তে বসা এবং খানিকটা চমকে যাওয়া। মাস্টারপিস বইগুলো এতদিন কেন আমি পড়িনি! তবে, বিমল মিত্রের লেখার যে বিষয়টি আমার কাছে বিরক্তিকর ঠেকে সেটি হচ্ছে অতি নাটকীয়তা এবং গল্পকে দীর্ঘায়িত করার প্রবণতা।

এক কথায়, “বেগম মেরী বিশ্বাস” একই সাথে বিমল মিত্রের এবং বাংলা সাহিত্যের এক অসাধারণ সৃষ্টি।আপনি যদি ঐতিহাসিক জনরা ভালোবেসে থাকেন, ইতিহাসকে জানার আগ্রহ যদি আপনার থেকে থাকে তবে অবশ্যই পড়বেন “বেগম মেরী বিশ্বাস।”

বইয়ের নাম : বেগম মেরী বিশ্বাস
লেখক : বিমল মিত্র
প্রকাশনী: আনন্দ

Leave a Reply 0

Your email address will not be published. Required fields are marked *