“জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাশের বাংলা ভাষার অভিধানে ‘কিংবদন্তী’ শব্দটির অর্থ এভাবে দেওয়া হয়েছে: লোক-পরম্পরায় কথিত ও শ্রুত বিষয়। তাহলে কারও পক্ষে কিংবদন্তীর বিষয়ে পরিণত হতে হলে লোকপরম্পরার একটি দীর্ঘ সময়ক্রম প্রয়োজন। কিন্তু সৈয়দ মুজতবা আলী যে তাঁর জীবদ্দশাতেই কিংবদন্তীর চরিত্রে পরিণত হলেন, সেটি কী প্রকারে? যাঁরা মুজতবা-সাহিত্য পড়েছেন, তাঁদের কাছে উত্তরটি সোজা—কিংবদন্তী শব্দের ভেতরে বদ্ বা বলার যে বিষয়টি আছে, সেই ‘বলা’ই তাঁকে এই মহিমা দিয়েছে। তিনি বলে গেছেন তাঁর গল্প-উপন্যাস-কাহিনিগুলো, তাঁর মতো করে; মানুষ তাঁকে নিয়ে বলে গেছে তাদের যা বলার তা; এবং এক (লোক) প্রজন্মে তিনি অর্জন করেছেন এক ঈর্ষণীয় উচ্চতা, যে উচ্চতায় কিংবদন্তীর চরিত্রেরা উড়ে বেড়ায়।”
-সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
“বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না” উক্তিটি বাংলাদেশের ছাত্রসমাজের কাছে বহুল পরিচিত। যতদূর মনে পড়ে ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণী অবধি এমন কোনো বছর বাদ পড়েনি যে বছরে এটির ভাব-সম্প্রসারন কোন ছাত্রকে করতে হয়নি।
সেই যাইহোক, মোট কথা হলো এই বিখ্যাত উক্তিসূত্রে আমাদের অনেকের সাথেই লেখক সৈয়দ মুজতবা আলীর পরিচয় কিংবা “রসগোল্লা” বা “বইকেনা” মতো সরস প্রবন্ধের মাধ্যমেও এই কিংবদন্তির হদিস আমরা পেয়ে থাকি।
ইংরেজীতে ERUDITION বলে একটি শব্দ রয়েছে যার অর্থ করলে দাঁড়ায় “The quality of having or showing great knowledge of learning”
প্রায় ১৫-১৬ টি ভাষায় অনর্গল কথা বলতে জানা এবং অসাধারন পাণ্ডিত্যের অধিকারী এই মহান লেখকের রচনাকর্মের রস আস্বাদনকালে “ERUDITION” শব্দটি খাটানো যায় নিঃসন্দেহে।
তার লেখা “পঞ্চতন্ত্র” বইটি মূলত তার প্রবন্ধ সংকলন। পড়াশোনার সুবাদে ঘুরেছেন বহুদেশ মিশেছেন বহু মানুষের সাথে। সুতরাং বলাই বাহুল্য তার অভিজ্ঞতার ঝুলিটিও বিরাট এবং কৌতুহল উদ্দীপক।
“পঞ্চতন্ত্র” সেইসব অভিজ্ঞতার সংকলন।
মহিলারোপ্য নগরের রাজা অমর শক্তির তিন ছেলে, অকাট মূর্খ ছেলে। ছেলে তিনটির বিদ্যাশিক্ষার জন্য বিদগ্ধ পন্ডিতজনের সমাগম ঘটিয়ে কোনো ফল লাভ না হওয়ায় ডাক পড়লো পন্ডিত বিষ্ণুশর্মার। এই পন্ডিত মাত্র ছয়মাসে অর্থশাস্ত্র, নীতিশাস্ত্রের মতো বিরাট কিছু শাস্ত্রের শিক্ষা দিয়েছিলেন স্রেফ গল্প বলে। এই গল্পে মোড়ানো নীতিসংকলনকে আমরা “পঞ্চতন্ত্র” বলে জানি।
সৈয়দ মুজতবা আলীর পঞ্চতন্ত্র এবং বিষ্ণুশর্মার পঞ্চতন্ত্রের সাথে দূর-দূরান্তে সম্পর্ক হয়তো নেই কিন্তু একটা জায়গায় মিল রয়েছে দুজনের। দুজনই যথাক্রমে পরোক্ষ এবং প্রত্যক্ষরুপে কিছু না কিছু নীতিশিক্ষা মানুষকে দেয়ার চেষ্টা করেছেন। সৈয়দ মুজতবা আলী যেহেতু পরোক্ষরুপে সেই কাজটি করতে চেয়েছেন সুতরাং প্রতিটি গল্পই মানুষের অনুধাবনের খোরাক। ইতিহাস, ভাষাতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব,ধর্ম,দর্শন,শিল্প,সাহিত্য, রাজনীতি,সমাজতত্ত্ব,অর্থবিদ্যা এবংবিজ্ঞানে সুপন্ডিত এই লেখক ‘পঞ্চতন্ত্র’ এর প্রায় প্রতিটি গল্পে তাঁর জীবন থেকে বিভিন্ন শিক্ষা ও মতামত জানানোর চেষ্টা করেছেন রম্যরসের মাধ্যমে। উত্তর-উপনিবেশিক , জাতীয়তাবাদ, দেশপ্রেম ইত্যাদি নানা দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষন করে দেখেছেন তার অভিজ্ঞতাগুলোকে যা এখনো আমাদের জীবনে প্রাসঙ্গিক।
বইটির দুটো পর্ব। প্রথম পর্বে আছে মোট ৩৫ টি এবং দ্বিতীয় পর্বে আছে ৩৪ টি প্রবন্ধ। সহজ সরল মজলিশি ঘরানায় লেখা প্রবন্ধগুলি পড়লে মনে হবে, লেখক বুঝি পাঠকের সাথে গল্প জুড়েছেন, চায়ের সাথে টা নিয়ে শুনিয়ে যাচ্ছেন একের পর এক অভিনব ঘটনা যা ঘরে বসেই পাঠককে ঘুরিয়ে আনছে বিদেশ-বিঁভুই।
অসাধারন রসবোধবাহী লেখাগুলি পাঠককুল পড়তে পড়তে লেখকের সাথে নিজের এক অন্তরের টান অনুভব করবেন।
অধিকাংশ প্রবন্ধই ত্রিশের দশকের ঘটনাবলী দ্বারা প্রভাবিত।
#পঞ্চতন্ত্র-সৈয়দ মুজতবা আলী