বই: চিলেকোঠার ঘর
লেখক: রাস্কিন বন্ড
অনুবাদ: পার্থ প্রতিম দাস
প্রকাশক: বুকফার্ম
মুদ্রিত মূল্য: ২৪৯/= (ভারতীয় রুপি)
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ১৬০
প্রচ্ছদ: শান্তনু মিত্র
রাস্টি। নিজেকে খুঁজে ফেরা এক অভিমানী কিশোর। যার জীবন ধারণের উপকরণের কোনো কমতি নেই। স্বাচ্ছন্দ্যের আড়ম্বরেই বরং তার হৃদয় মুক্তির জন্য হাহাকার করে। নিজের মা বাবাকে হারিয়েছে বহু আগেই। তাদের পরিচয়ও তার কাছে ধোঁয়াশা। দেহারাতে মিস্টার হ্যারিসনের তত্ত্বাবধায়নে বেড়ে উঠছে সে।
জীবনে বৈচিত্র্য বলতে তেমন কিছু নেই। আভিজাত্যের দোহাই দিয়ে কারো সাথে তাকে মিশতে দেয়া হয় না। সে গ্রামের কৃষক পরিবারের ছেলে হোক বা মেথরের ছেলে। এমনকি সামনের বাজারটাও তার জন্য নিষিদ্ধ। এসব আর ভালো লাগে না তার। এই জীবন থেকে সে মুক্তি চায়।
এক হোলি উৎসব আকস্মিকভাবে তাকে সে সুযোগ এনে দিল। বলা ভালো, তার অপকর্মের বদৌলতে সে অভিভাবকের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেল। একঘেয়ে জীবন আর মিশনারী বউয়ের বকবকানির বদলে তার জীবনে এল শমি, রনবীর আর সুরি৷ এত সহজেও কাউকে আপন করা যায়? এদের না দেখলে আসলে বিশ্বাস করা মুশকিল। বাজারের চাটের দোকান হয়ে যায় তাদের আড্ডাস্থল।
এত বিলাসী জীবন ছেড়ে সে মুক্তির স্বাদ পেয়েছে ঠিকই। কিন্তু নূন্যতম জীবনধারণের জন্য তো কিছু করা চাই। নইলে তো অস্তিত্ব সংকটে পড়তে হবে। এবারও সমাধান দিল বন্ধু শমি। এক সময়ের অবস্থাপন্ন লোক মিস্টার কাপুরের ছেলে কিষেণকে পড়ানোর দায়িত্ব পেল সে। নতুন জায়গা হল তাদের চিলেকোঠায়। কিষেণের পড়ায় মন না থাকলেও রাস্টির সাথে তার বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়। কিষেণ বিশ্বাস করে রাস্টি একদিন লিখে নাম করবে।
চিলেকোঠার এই জগতটা তার একান্তই নিজস্ব। এখানে সে স্বাধীন৷ কিষেণকে নিয়ন্ত্রণ করা যতই কষ্টসাধ্য হোক, চিলেকোঠার ঘর তাকে মুক্ত বাতাসের স্বাদ দিয়েছে। বাড়ির কর্তা কাপুর লোকটা মাতাল হলেও মানুষ হিসেবে খারাপ না। আর কর্ত্রী মীনা তো এক কথায় অসাধারণ! সময় চলতে লাগল হাওয়ায় ভর করে। আর নিত্যনতুন স্বপ্ন বোনা হতে লাগল চিলেকোঠার সেই ঘরে।
কিন্তু বসন্ত তো আর চিরকাল স্থায়ী না। এক সময় ঝড় এল। সেই ঝড়ে ভেসে গেল একটি পরিবারের স্বপ্ন, একটি ছেলে হয়ে গেল দাগী অপরাধী আর চিলেকোঠা পড়ে রইল অনেক পেছনে। স্বপ্নভঙ্গের পালা শেষে সে মরিয়া হয়ে ওঠে ইংল্যান্ড যাওয়ার জন্য।
যাওয়ার আগে শেষবারের মত দেখা করতে চায় কিষেণের সঙ্গে। কিন্তু এই যাত্রাই তার জীবনের গতিপথ আরেকবার বদলে দেয়। ইংল্যান্ড যাওয়ার ইচ্ছের চেয়ে বড় হয়ে ওঠে হঠাৎ তৈরি হওয়া এক অদ্ভুত মায়ার বন্ধন। সে চারপাশে নিজের মানুষ খোঁজে, নিজেকে খোঁজে।
রাস্কিন বন্ডের একটি ভিন্নস্বাদের বই ‘চিলেকোঠার ঘর’। বইটার প্রচারণা দেখেই কেনার জন্য পাগল হয়ে উঠেছিলাম। অবশ্য পড়ে আর কিনতে হয়নি। গিফট পেয়েছি।
বইটা সবাইকে অতীতের দিনগুলোতে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। পরিবারের নিষেধাজ্ঞা, বন্ধুদের সাথে আনন্দ উদযাপন, বিদ্রোহ, একাকীত্ব, অসম প্রেম, নিয়ম ভাঙার ঝোঁক, ‘আমি/আমরা’ দিয়ে করা জাতিগত ভেদাভেদ ভুলে বন্ধুত্বের নতুন জগত তৈরি সব মিলিয়ে আপনার ভাবার কোনো ফুরসত থাকবে না।
রক্তের বন্ধন ছাপিয়ে আত্মার বন্ধন কতটা দৃঢ় হয়ে উঠতে পারে তাই লেখক খুব সাদামাটা বর্ণনায় অসাধারণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। যে ভালোবাসা মেলে হোলি উৎসব, চাটের দোকান অথবা তীর্থের ঘাটে।
সময়ের চোরাস্রোত রক্তমাংসের অবয়বটাকে গ্রাস করলেও ভেতরের হৃদয়টা ঠিকই বন্ধুর প্রতি সেই আগের ভালোবাসা পুষে রাখে। অনেক বড় স্বপ্ন দেখেও ফিরতে হয় নিজের ছোট্ট ভুবনে। এ থেকে পালানোর কোনো পথ নেই। স্বপ্নের মত পরম আরাধ্য হয়ে ওঠে সেই ছোট্ট ঘরটি। বইয়ের পাতায় পাতায় খুঁজে পাওয়া যায় এই বিচিত্র অনুভূতিগুলো।
এখানে টানটান উত্তেজনা নেই, ইতিহাসের চমক নেই বা শিহরণ জাগানোর মত কিছু নেই। তবে আছে কিছু বিশুদ্ধতম অনুভূতি। ফেলে আসা দিনের ঘ্রাণ। এটাকে অবশ্য সেমি অটোবায়োগ্রাফিও বলা যেতে পারে। মাত্র সতেরো বছর বয়সে এমন একটা বই লিখে ফেলা চাট্টিখানি কথা নয়। প্রকাশের পরের বছরই John Llewellyn Rhys পুরষ্কার অর্জন করেন। এক দেশহারা, পরিবারহারা কিশোর কালের পরিক্রমায় হয়ে ওঠেন বিশ্ববিখ্যাত।
বুকফার্মের পরিবেশনা চমৎকার। অনুবাদ ঝরঝরে।প্রচ্ছদটাও অসাধারণ। মুদ্রণপ্রমাদ চোখে পড়েনি।
টান টান উত্তেজনা বা ঘটনার ঘনঘটা থেকে বেরিয়ে ভিন্নধারার কিছু পড়তে চাইলে পড়ে দেখতে পারেন।
Sayeda Mofakkhera Ahmed ভালোবাসা নিও।❤️
Leave a comment