গোরা। লেখক : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

বই : গোরা।
লেখক : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
ধরণ: রাজনৈতিক এবং সামাজিক উপন্যাস।
রেটিং: ৭.৮/১০

১৯১০ সালে রচিত ‘গোরা’ উপন্যাসটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বৃহত্তম এবং অনেকের মতে শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে ব্রাহ্মসমাজ আন্দোলন, হিন্দু সংস্কার আন্দোলন, দেশপ্রেম, নারীমুক্তি,অসাম্প্রদায়িক চেতনা, ধর্মান্ধতা, জাতপ্রথা, সামাজিক অধিকার আন্দোলন সবকিছুই একইসাথে এই উপন্যাসে ফুঁটে উঠেছে। কলকাতার প্রবাসী পত্রিকায় ১৯০৮ থেকে ১৯১০ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ পায়। বাংলা সাহিত্যের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই উপন্যাস অবলম্বনে ১৯৩৮,২০১২ এবং ২০১৫ সালে চলচ্চিত্র এবং নাটক ও নির্মিত হয়েছে।

কাহিনী সংক্ষেপ : উপন্যাসের প্রধান দুই চরিত্র গোরা এবং বিনয় পরস্পর অন্তরঙ্গ বন্ধু। বিনয় গোরার মা আনন্দময়ী কে মাতৃরুপে শ্রদ্ধা করে এবং আনন্দময়ী ও বিনয়কে আপন সন্তানের মতো মাতৃস্নেহ প্রদান করেন। দুজনেই জীবনে কখনো বিয়ে না করে দেশের কল্যাণে নিজেদের উৎসর্গ করবে বলে একে অপরের কাছে প্রতিশ্রুতি বদ্ধ। কিন্তু এই প্রতিশ্রুতির ভাঙন শুরু হয় একদিন সকালে বিনয়ের বাড়ির সামনে ব্রাক্ষ্ম ধর্মাবলম্বী পরেশবাবু এবং তার পালিত কন্যা সুচরিতা সড়ক দূর্ঘটনার স্বীকার হওয়ায় বিনয়ের সাথে পরেশবাবুর পরিবারের সুসম্পর্ক স্থাপিত হওয়ার মাধ্যমে। প্রাচীণ হিন্দু ধর্মে দীক্ষিত ,কঠোরভাবে সমস্ত নিয়মপালন কারী ব্রাক্ষণ বন্ধু গোরা তাদের প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ হওয়ার ভয় পেলেও, বিনয় কখনোই প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করার বিন্দুমাত্র লক্ষ্মণ ও দেখায়নি। কিন্তু গোরার আচারণে বিনয় তাদের ফাঁটল ধরা বন্ধুত্ব আরও দৃঢ় করতে গোরার বন্ধু মহিমের মেয়ে শশীমুখী কে বিয়ে করতে রাজি হয়। পরেশ বাবুর পরিবারের সাথে বিনয়ের সম্পর্ক আরও ভালো হতে সাহায্য করে পরেশ বাবুর পালক পুত্র সতীশ নামের এক বালক।আবার গোরার সাথে পরেশ বাবুর পরিবারের সম্পর্ক হয় গোরার পালক পিতা কৃষ্ণদয়াল বাবুর বন্ধু পরেশবাবু হওয়ায়।
প্রথমদিকে বিনয় সুচরিতার প্রেমে পড়েছে এমন ইঙ্গিত পাওয়া গেলেও সুচরিতা গোরার দেশপ্রেম, একনিষ্ঠতা এবং নৈতিকতায় মুগ্ধ হয়ে গোরার প্রেমে পড়ে। কিন্তু গোরা দর্শন এবং ধর্মীয় নৈতিকতার বেড়াজালে তা অস্বীকার করে।
অপরদিকে বিনয়ের ব্যাক্তিগত তুলনামূলক আধুনিক দর্শনে মুগ্ধ হয়ে পরেশবাবুর মেজ মেয়ে ললিতা তার প্রেমে পড়ে।
গোরার মাধ্যমে সমস্ত কুসংস্কারাচ্ছন্ন ভারতের হিন্দুদের কে এক করে পৃথিবীতে ভারতীয়ের শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে পৃথিবীতে উত্থাপন করার লক্ষ্যে ভারতীয়দের নৈতিক ঘটানোর প্রচেষ্টার পাশাপাশি সুক্ষ প্রেমকাহিনী ও কবিগুরু দারুণ দক্ষতায় পরিচালিত করেছে সমগ্র উপন্যাসে।
ঘটনাচক্রে ইংরেজ সংস্কৃতি চরম ঘৃণা করা গোরা কারাবন্দী হলে বিনয় এবং ললিতা তা জানতে পেরে অনুষ্ঠানে নাচগান না রুদ্রমূর্তি ধারণ করে ললিতা প্রতিবাদ করে এবং বিনয় ও সেই প্রতিবাদে অংশ না নিয়ে ললিতার সাথে যাত্রাপথে সারারাত লঞ্চে অতিবাহিত করার মাধ্যমে ফিরে আসে। ফিরে এসে নিজের ধর্ম কে ত্যাগ করে বিয়ে করতে চাইলেও আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত এবং উন্নত চিন্তাভাবনার বাহক ললিতা তা প্রত্যাখান করে নিজ নিজ ধর্মে থেকে বিয়ে করে।
অন্যদিকে গোরা তার পালক পিতা কৃষ্ণদয়ালের কাছে সিপাহি বিদ্রোহের সময়ে তাকে পেয়ে সন্তানহীন কৃষ্ণদয়াল-আনন্দময়ী দম্পতি তাকে সন্তান হিসেবে লালনপালন করে এবং গোরা জানতে পারে যে খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী মৃত আইরিশ দম্পতির সন্তান সে। যা এই উপন্যাসের সবচেয়ে নাটকীয় মুহূর্ত। এই কথা জেনে গোরা পরেশবাবুর কাছে গিয়ে ক্ষমা চেয়ে সুচরিতা কে গ্রহণ করে।
গোরা নিজ ধর্ম পালন করতে গিয়ে এবং তৃণমূলের মানুষের সাথে একাত্মভাবে যুক্ত হয়ে আসল মানব ধর্ম এবং নৈতিকতার সাথে পরিচিত হয়। আর সেই পরিচিত হওয়ার বিভিন্নরকম দৃষ্টিকোণ এবং মাধ্যম দিয়ে ক্রমেই কবিগুরু কাহিনী প্রবাহ অক্ষুণ্ণ রাখেন।

চরিত্র বিশ্লেষণ :

গোরা: উপন্যাসের প্রধান চরিত্র। উপন্যাসে কবিগুরু যেন “গোঁড়া” শব্দের ব্যাখ্যা গৌরমোহন বা চরিত্রের মাধ্যমে যেন ফুটিয়ে তুলেছেন। কুসংস্কার, দেশপ্রেম এবং জাতিভেদ কে পরম সত্য হিসেবে স্বীকার করা এই মানুষটা যেমন একদিকে ইংরেজ সংস্কৃতির চরম বিরোধী ছিলেন অন্যদিকে মানুষের কাছে পরম শ্রদ্ধা এবং ভালবাসার পাত্র ও ছিলেন।

পরেশবাবু: সমস্ত জাত, ধর্ম, বর্ণের ওপরে বিচরণ কারী একজন ব্যাক্তি। অবলীলায় সবকিছু আপম করে নিতে পারেন। গোরা, সুচরিতা, বিনয়, ললিতা থেকে শুরু করে উপন্যাসের প্রত্যেকের কাছে হতাশা,দুঃখ কষ্টের সময়ের যেমন একমাত্র আশ্রয়, তেমনই পাঠকের কাছেও প্রশান্তির একমাত্র মাধ্যম এই পরেশ চন্দ্র ভট্রাচার্য।

সুচরিতা: আধুনিক শিক্ষায় আলোকিত, অতীব ধৈর্যশীল,রুচিশীল, সহিষ্ণু এবং অসাধারণ রূপবতী পরেশবাবুর পালিত কন্যা।

ললিতা: আঠারো না পার হওয়া প্রতিবাদী স্বাধীনচেতা, তেজস্বী তরুণী। শ্যামবর্ণের এই চরিত্র যেমন একাধারে বিনয়ের প্রেমিকা তেমনই কুসংস্কারাচ্ছন্ন, ইংরেজ সংস্কৃতিতে কুঠারাঘাত করেছ্র। সামাজিক নিয়মের তোয়াক্কা না করে বিনয় কে বিয়ে করে দেখিয়েছেন যে জীবনে মানবধর্ম, প্রেম,ভালবাসা এবং আবেগের গুরুত্ব।

বিনয়: গোরার সবচেয়ে কাছের মানুষ। ললিতাকে সাহস করে বিয়ে করেন। গোরার সাথে সমাজ সংস্করণে যুক্ত থাকলেও গোরার মতো কুসংস্কারাচ্ছন্ন ছিল না,কিন্তু দেশপ্রেম ছিল। খুবই উন্নত একটি চরিত্র।

আনন্দময়ী: উপন্যাসে সবচেয়ে বিমুগ্ধ করেছে এই নারী। জগতে এত উদার, দয়ালু এবং উন্নত চরিত্রের মহিলা তৎকালীন সময়ে বিরল ছিল।

আরও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র সমূহ হচ্ছে কৃষ্ণদয়াল,বরদাসুন্দরী, সতীশ, হরিমোহনী, হারানবাবু, মনোরমা, অবিনাশ,কৈলাশ, সুধীর।

কিঞ্চিৎ সমালোচনা :
১। ১৮ এর নিচের মেয়েদের সাথে দুজন প্রায় মধ্যবয়সী মানুষের প্রেম এবং পরিণয় কিছুটা অদ্ভুত-ই বটে।
২। “বেশি বকা বক্তিয়ার” বলে বখতিয়ার খলজি’র মতো একজন মানুষকে উল্লেখ করার ব্যাপারটি ভালো লাগে নাই।

ভালো লাগার মতো বিষয় :
★ কুসংস্কার, জাতপ্রথা এবং সাম্প্রদায়িকতা কে একেবারে চপোটাঘাত করেছেন।

পাঠ প্রতিক্রিয়া: গল্পে, উপন্যাসে, কবিতায়, প্রবন্ধে, নাটকে, অভিভাষনে বাংলা সাহিত্যের প্রথম নোবেল বিজয়ী লেখক বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অসংখ্যবার সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন। সমস্যা চিহ্নিত করে তার সমাধানের উপায় ও নির্দেশ করেছেন।
কবিগুরুর এই উপন্যাসের কোন চরিত্র ম্লান থাকেনি। কোন চরিত্রই অকারণ নয়। সব চরিত্রকেই অত্যন্ত দুর্ধর্ষ করে তুলেছেন তিনি। সব চরিত্রই নিজ নিজ জায়গা থেকে কি অসাধারণ, কি নির্মম, কি উজ্জ্বল, চাঞ্চল্য, নিস্পৃহ ভাবতেই শিহরিত হয়ে উঠতে হয়!
মানবধর্ম অর্থাৎ পৃথিবীতে মানুষের চেয়ে বড় সত্য আর কিছুই হতে পারে না তা সে যত বড় ধর্ম, জাতি কিংবা সংস্কারই হোক না কেন। মানুষ পৃথিবীতে আসার পরেই সমস্ত সাম্প্রদায়িকতা, জাতিভেদ পৃথিবীতে এসেছে। সুতরাং, মানুষের চেয়ে বড় কোনো কিছুই হতেই পারে না। তাই, একজন মানুষ সবকিছুর উর্ধ্বে গিয়ে শুধু পৃথিবীতে থেকে স্রষ্টার নিদর্শনকে ভালবেসে নিজেকে নাম নিজের মন মতো পরিচালিত করতে পারে।
একদিকে যেমন সাম্প্রদায়িকতা, উগ্র-জাতীয়তাবাদ, কুসংস্কারের মতো সামাজিক বিষয়গুলো নিয়ে সমালোচনা করেছেন, অপরদিকে ব্যাক্তিগত প্রেম, ভালবাসা, চিন্তা-চেতনা, মমত্ববোধ এবং বিশ্বাস নিয়েও অসাধারণ ভাবে চরিত্রের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলে দেখিয়েছেন মানুষের চেয়ে বড় সত্য আর কিছুই হতে পারে না।।
তবে কিছু ক্ষেত্রে সংলাপ অত্যান্ত দীর্ঘ হওয়ায় পাঠেকের বিরক্ত লাগলেও পরে তার মর্মার্থ স্পষ্ট হবে। যদি কোনো পাঠকের ধর্ম, রাজনীতি, ইতিহাস, সামাজিক রীতিনীতি এবং ব্যাক্তি সত্তা নিয়ে আগ্রহ থাকে, তাহলে এই উপন্যাস তার কাছে শ্রেষ্ঠ সম্পদ।
প্রকৃতপক্ষে, এই ধরনের উপন্যাস কে একটা রিভিউয়ের মাধ্যমে কখনোই তার সম্পূর্ণ নিগূঢ় ভাব এবং গুরুত্ব সহকারে রূপায়িত করা সম্ভব না কারণ এর গভীরতা এতটাই যে যতই লিখি না কেন তাই তুচ্ছ মনে হয় এর সম্পূর্ণ ভাবের কাছে।

কিছু প্রিয় উক্তি :
“মানুষের সমস্ত প্রকৃতিকে এক মুহূর্তে জাগ্রত করিবার উপায় এই প্রেম।”
“সম্প্রদায় এমন জিনিস যে, মানুষ যে মানুষ, এই সকলের চেয়ে সহজ কথাটাই সে একেবারে ভুলিয়ে দেয়।”
“ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত সাধনার জিনিস, তাহাকে কোন সমাজের সঙ্গে জড়িত করা উচিত নহে।”

#বুক_রিভিউ

Leave a Reply 0

Your email address will not be published. Required fields are marked *