কারা কোরআনের ব্যাখ্যাকার হতে পারেন? – ড. বিলাল ফিলিপস

তাফসীর শাস্ত্রের ঐতিহাসিক ক্রমবিকাশ, এর সঠিক পদ্ধতি ও সঠিক ধারা থেকে বিচ্যুত তাফসীরের উদাহরণ এবং তথ্য উপাত্ত্ব বিশ্লেষণ করে কুরআনের বিশুদ্ধ ও গ্রহণযোগ্য তাফসীর করার জন্য নিম্নোক্ত শর্তসমূহকে অপরিহার্য বিবেচনা করা হয়। এসব শর্তাবলীর কোনো একটি বাদ দিলে কুরআনের বিকৃত ব্যাখ্যা বেরিয়ে আসার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছেঃ

১. সঠিক আকীদা বিশ্বাস

কুরআনের তাফসীরকে দ্বীনবিরোধী মারাত্মক ভুল থেকে মুক্ত রেখে বিশুদ্ধতা অক্ষুণ্ণ রাখতে হলে মুফাসসিরকে সবার আগে ইসলামের সঠিক আকীদা বিশ্বাসের ধারক হতে হবে। ইসলামের প্রতি কারও শুধু আন্তরিকতা ও একনিষ্ঠতা থাকার মানেই এ নয় যে তার আকীদা বিশ্বাস বিশুদ্ধ। ইসলাম সম্পর্কে কারো আকিদা বিশ্বাস কেবল তখনই বিশুদ্ধ সাব্যস্ত হবে যখন তা নবী (সাঃ) ও তাঁর সাহাবীদের আকীদা বিশ্বাসের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। ইসলামের সঠিক আকিদা বিশ্বাসের মৌলিক বিষয়সমূহের ব্যাপারে অজ্ঞতা মুফাসসিরকে নিশ্চিতরূপে ভুল ব্যাখ্যার দিকে ধাবিত করবে। এমন ব্যক্তি অবধারিতভাবে সঠিক ব্যাখ্যা ও ভুল ব্যাখ্যার মধ্যে পার্থক্য নিরূপনে অক্ষম হয়ে পড়বেন। ফলশ্রুতিতে তাকে তার ব্যক্তিগত রায়ের উপর নির্ভর করতে হবে। অজ্ঞতা প্রসূত এ ধরণের কাজ ইসলাম, মুসলিম জাতি ও তার নিজের জন্য মারাত্নক ক্ষতির কারণ হয়ে দাড়াতে পারে। সঠিক আকীদা বিশ্বাস সব সময়ই মানুষকে ফিরকাবাজির সংকীর্ণ গণ্ডি থেকে মুক্ত রাখে। বিশুদ্ধ আকীদা বিশ্বাসই কেবল মুফাসসিরকে বিভিন্ন দর্শন, সংকীর্ণ দলাদলী, আন্দোলন ও ফিরকাবাজির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মুক্ত রাখে। আগে থেকেই লালিত কোনো চিন্তাধারা ও মতবাদের অনুকূলে কুরআন থেকে নিছক সমর্থন খুঁজে বের করার প্রয়াস চালানো কোনো মুফাসসিরের জন্য আদৌ সমীচীন নয়। এ ধরণের প্রয়াস নিশ্চিতভাবে তাকে কুরআনের ফিরকাভিত্তিক সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি ও মারাত্নক অপব্যখ্যার দিকে ধাবিত করবে।

২. সঠিক পদ্ধতি অবলম্বন

তাফসীরের সকল ন্যায়নিষ্ঠ প্রচেষ্টার সূচনা হতে হবে স্বয়ং কুরআন দ্বারা কুরআনের তাফসীর করার মাধ্যমে। স্বয়ং কুরআনে কোনো আয়াতের ব্যাখ্যা না পাওয়া গেলে তখন তার জন্য আল্লাহর রসূলের সুন্নাহতে অনুসন্ধান চালাতে হবে। তাতেও যদি খুঁজে পাওয়া না যায়, তাহলে সাহাবায়ে কেরাম ও তাবি‘ঈনদের ব্যাখ্যার দিকে ফিরে যেতে হবে। এসব পদক্ষেপ অবলম্বনের পর যা কিছু বাকি থাকে কুরআনের ভাষার সাহিত্যশৈলীর মধ্যে তা খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। এ পদ্ধতির মধ্যেই কেবল ওহী নাযিলকারী ও ব্যাখ্যাদাতা হিসেবে আল্লাহ তা‘আলার ভূমিকা এবং ওহীর অনুশীলনধর্মী ব্যাখ্যাকার হিসেবে নবী (সাঃ) এর ভূমিকাকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা হয়েছে। একইভাবে নবী (সাঃ) কর্তৃক ওহীর ব্যাখ্যা তথা বাস্তব প্রয়োগ পদ্ধতি পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে সাহাবায়ে কেরাম ও তাবি‘ঈনদের ভূমিকা এবং ওহীর বাহন হিসেবে আরবি ভাষার চিরায়ত ভূমিকা- এ সব কিছুকে এ প্রক্রিয়ায় যথাযথ মূল্যায়ন করা হয়।

অন্য যে কোনো পদ্ধতি এসব গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়ার এক বা একাধিক ধারাকে সরাসরি নাকচ করে দেয়। এর মানে দাঁড়ায় এই যে, যেন তারাই আল্লাহর কাছ থেকে সরাসরি ওহী লাভ করেছেন; অথবা নবী (সাঃ) ও তাঁর সাহাবীদের চেয়েও তারা ওহীকে আরো সঠিকভাবে উপলব্ধি করেছেন। যারাই তাফসীরের এ বাস্তবধর্মী প্রক্রিয়া উপেক্ষা করেছেন তাদের তাফসীর অধ্যয়ন করলে দেখা যাবে যে, ইলহাম ও কাশফ এর মতো বিভিন্ন পরিভাষার ছদ্মাবরণে তারা যেন পরোক্ষভাবে তাদের উপরই ওহী অবতীর্ণ হওয়ার দাবী করে বসেছেন।

৩. সঠিক জ্ঞান

মুফাসসিরকে অবশ্যই প্রাচীন আরবি ভাষা, এর ব্যাকরণগত গঠন ও বাকরীতির ব্যাপারে বাস্তব জ্ঞানের অধিকারী হতে হবে। কারণ আরবীই তো কুরআনের ভাষা। যে তাফসীর কেবল কুরআনের কিছু আয়াতের অনুবাদের ভিত্তিতে করা হয়, তাতে বিকৃতির ব্যপক সম্ভাবনা থেকে যায়। ইবনু আব্বাস (রা.) এর ছাত্র মুজাহিদ রহঃ এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘আরবি ভাষার পর্যাপ্ত জ্ঞান না থাকলে কোনো ঈমানদারের জন্য আল্লাহর কিতাবের ব্যাখ্যা করা বৈধ নয়’। মুফাসসিরকে কুরআনের সাথে সংশ্লিষ্ট জ্ঞানের অন্যান্য শাখার উপরও সম্যক সচেতন হতে হবে, যেমন হাদীস ও ফিকহ শাস্ত্র ইত্যাদি। তাঁকে হাদীস শাস্ত্রের সাথে পরিচিত হতে হবে এ বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য যে, নবী (সাঃ) ও তাঁর সাহাবীদের থেকে বর্ণীত যেসব ব্যাখ্যা তিনি তাঁর তাফসীরে ব্যবহার করছেন তা নিশ্চিতভাবে বিশুদ্ধ ও সঠিক। তাঁকে ফিকহ শাস্ত্রের মৌলিক নীতিমালাও (উসূলুল ফিকহ) জানতে হবে, যাতে তিনি কুরআনের আয়াতসমূহ থেকে নির্ভুলভাবে ইসলামী আইন-কানুন বের করে আনতে সক্ষম হন। জ্ঞানের এ দু’টি শাখার পর্যাপ্ত ও বিশুদ্ধ জ্ঞান ব্যতীত, একজন মুফাসসিরের পক্ষে তার তাফসীরকে ভুল তথ্য থেকে মুক্ত রাখা প্রায় অসম্ভব বললেই চলে। কারণ, দুঃখজনক হলেও সত্য যে, দুর্বল ও জাল বর্ণনার পরিধি অনেক বিস্তৃত এবং ফিক্‌হ কেন্দ্রিক মাযহাব ও মতপার্থক্যের পরিমানও সংখ্যায় বেশ অনেক ও বহুমুখী।

[ড. বিলাল ফিলিপস রচিত ‘কুরআন বোঝার মূলনীতি’ বই থেকে নেয়া।]

সিয়ান | বিশুদ্ধ জ্ঞান | বিশ্বমান

Leave a Reply 0

Your email address will not be published. Required fields are marked *