ইসলামি সভ্যতায় চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাস : লেখক ড. রাগিব সারজানি

  • বই : ইসলামি সভ্যতায় চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাস
  • লেখক : ড. রাগিব সারজানি
  • প্রকাশনী : মাকতাবাতুল হাসান
  • বিষয় : ইসলামি ইতিহাস ও ঐতিহ্য
  • অনুবাদক : আবদুল্লাহিল বাকি, আশিকুর রহমান
  • পৃষ্ঠা : 347
  • ভাষা : বাংলা

মুসলিম সভ্যতায় চিকিৎসাবিজ্ঞান

মুসলিমজাতি স্বর্ণযুগে যেসব জাগতিক জ্ঞানবিজ্ঞানে অসামান্য অবদান রেখেছে, তন্মধ্যে চিকিৎসাবিজ্ঞান অন্যতম। মুসলিমদের পূর্বে চিকিৎসাশাস্ত্র সামগ্রিকভাবে অতটা ব্যাপক, ব্যতিক্রম এবং বাস্তবমুখী অগ্রগতি অর্জন করেনি। কোনো পাঠক কিংবা গবেষক চিকিৎসাশাস্ত্রের ইতিহাস নিয়ে গভীর পাঠে নিমগ্ন হলে তার ধারণা হতে পারে যে, মুসলিমদের পূর্বে চিকিৎসাবিজ্ঞানের যেন কোনো শাস্ত্রীয় ভিত্তিই ছিল না।

চিকিৎসাশাস্ত্রে মুসলিমদের অবদান কেবল রোগ-ব্যাধি নিরাময়ের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ ছিল না। বরং মুসলিমগণ মৌলিক পরীক্ষণমূলক (Experimental) পদ্ধতি আবিষ্কারেও অবদান রেখেছেন। তারা রোগ নিরাময় ও প্রতিরোধ, চিকিৎসার উপাদান ও সরঞ্জাম তৈরি এবং চিকিৎসার ক্ষেত্রে মানবিক ও আদর্শিক গুণ বজায় রেখেছেন। প্রায় সকল স্তরে প্রতিফলিত হয়েছে তাদের চেষ্টা-পরিশ্রম। ওষুধ আবিষ্কার থেকে শুরু করে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ব্যবচ্ছেদে তারা নতুন থেকে নতুনতম সহজ থেকে সহজতম পথে যাত্রা করেছিলেন।

ইসলামি সভ্যতায় চিকিৎসাশাস্ত্রের অগ্রগতির দরুন অসংখ্য চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও গবেষক জন্ম নিয়েছেন, যারা প্রাচীন সভ্যতার চিকিৎসাপদ্ধতি ভিন্নপথে ঘুরিয়ে দিয়েছেন। বর্তমান যুগের আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান মুসলিমদের সেই ধারার ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে। এই গ্রন্থের প্রতিটি অধ্যায়ে আমরা এই নিখাদ সত্যটি খুঁজে পাব।

এই অধ্যায়টি সাজানো হয়েছে কয়েকটি পরিচ্ছেদে। এসব পরিচ্ছেদে যেসব আলোচনা আসবে সেগুলো হলো—

• ইসলাম আগমনের পূর্বে চিকিৎসাবিজ্ঞান

• চিকিৎসাশাস্ত্রের বিকাশে ইসলাম

• চিকিৎসাশাস্ত্রে মুসলিমদের গুরুত্বপূর্ণ কিছু অবদান

• ইসলামি সভ্যতায় হাসপাতালব্যবস্থা

ইসলাম আগমনের পূর্বে চিকিৎসাবিজ্ঞান

এটা বললে বোধ হয় ভুল হবে না যে, চিকিৎসা এবং ওষুধ মানুষের শারীরিক ব্যথা ও যন্ত্রণার সাথেই জড়িত। কারণ যন্ত্রণা অনুভব করার পরই মানুষ সেই যন্ত্রণার প্রতিষেধক সন্ধান করে। তারপর চিকিৎসার মাধ্যমে রোগমুক্তি সম্ভব হয়। সুতরাং আমরা বলতে পারি, মানুষ যতটা প্রাচীন, চিকিৎসাশাস্ত্র ততটাই আদিম। সূচনা থেকেই আল্লাহর দেওয়া জ্ঞানের মাধ্যমে মানুষ নিজের বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতা ও উন্নতির মধ্য দিয়ে বিভিন্ন রোগের ওষুধ খুঁজে পেয়েছে। তবে এটা সত্যি, আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্রের তুলনায় তা ছিল একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ের। তখনকার মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক স্তরের সাথে সংগতি রেখেই এগুচ্ছিল চিকিৎসাশাস্ত্র। এটাকে সাধারণত প্রাগৈতিহাসিক চিকিৎসা (Prehistoric medicine) বা আদিম চিকিৎসা (Primitive Medicine) বলা হয়। এজন্যই ইবনে খালদুন (৮০৮ খ্রি.) বলেছেন, …আদিম সমাজে যারা নাগরিক জীবন যাপন করত তারা সীমাবদ্ধ অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে এক ধরনের চিকিৎসাপদ্ধতি আবিষ্কার করে নিয়েছিল। প্রজন্মপরম্পরায় এই চিকিৎসার রীতিনীতিগুলো তারা রপ্ত করত। সেগুলোর কিছু হয়তো সঠিক ছিল; কিন্তু সেই চিকিৎসাপদ্ধতির সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা ছিল না। (৮)

সামনে আমরা কয়েকটি অনুচ্ছেদে ইসলাম-পূর্ব যুগের চিকিৎসাব্যবস্থা সম্পর্কে কিছু আলোচনা তুলে ধরব। সেগুলো হলো—

• প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতায় চিকিৎসাব্যবস্থা

•• ব্যাবিলনীয় সভ্যতায় চিকিৎসাব্যবস্থা

• চীনা সভ্যতায় চিকিৎসাব্যবস্থা

• প্রাচীন ভারতবর্ষে চিকিৎসাব্যবস্থা

• গ্রিক সভ্যতায় চিকিৎসাব্যবস্থা

• রোমান সভ্যতায় চিকিৎসাব্যবস্থা

• ইসলাম-পূর্ব যুগে আরবের চিকিৎসাব্যবস্থা

[আল-ইবার ফি দিওয়ানিল মুবতাদায়ি ওয়াল-খবর, ১/ ৬৫০]

প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতায় চিকিৎসাব্যস্থা

প্রাচীনতম জাতি ও সভ্যতাগুলোর মাঝে মিশরীয় সভ্যতা চিকিৎসাব্যবস্থায় ব্যাপক উন্নতি লাভ করে। লক্ষণ দেখে রোগ নির্ণয়, অঙ্গ কর্তন, অপারেশন, লাশের মমিকরণ ইত্যাদি বিষয়ে তারা চূড়ান্ত যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখেছে। অনেক মমিতে বিভিন্ন অঙ্গের অস্ত্রপচারের চিহ্ন রয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন জাদুঘরে পাওয়া যায় তাদের আবিষ্কৃত প্যাপিরাস(৯), যাতে লেখা আছে তাদের চিকিৎসাগত বহু পরীক্ষানিরীক্ষার কথা। এমনকি তারা আমেনহোতেপকে বানিয়ে নিয়েছিল চিকিৎসা ও আরোগ্যের উপাস্য। (১০)

মহাকবি হোমার তার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ অডিসিতে মিশরীয় চিকিৎসকদের দক্ষতা তুলে ধরতে ভুলেননি। তিনি সেখানে বেশ কয়েকবার বলেছেন, তারা বিভিন্ন চিকিৎসাপদ্ধতি আবিষ্কার করেছে। প্রতিটি রোগের জন্য ছিল বিশেষজ্ঞ ডাক্তার। কথিত আছে, পারস্যের সম্রাট সাইরাস চক্ষুচিকিৎসক চেয়ে মিশরে দূত পাঠিয়েছিলেন। তার পৌত্র দারা মিশরীয় চিকিৎসকদের যোগ্যতা ও কর্মদক্ষতায় অভিভূত ছিলেন। এমনকি গ্রিকরাও জানত মিশরের চিকিৎসাদেবতা আমেনহোতেপের নাম। ভেষজ ওষুধবিজ্ঞান ও শল্যচিকিৎসার উপকরণ (Surgical instrument) সম্পর্কিত অনেক বিদ্যা গ্রিকরা হুবহু বর্ণনা করেছে মিশরীয়দের থেকে। (১১)

তবে লক্ষণীয় যে, মিশরীয়দের চিকিৎসাব্যবস্থা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল উপাসনালয়ের সাথে। বিভিন্ন রোগের আরোগ্যের ক্ষেত্রে তাদের ছিল অনেক উপাস্য। চিকিৎসকদের সাহায্যকারী মনে করা হতো উপাস্য থোথকে। দুরারোগ্য রোগ নিরাময়ের আশায় আরাধনা করা হতো আইসিস দেবীর। একসময় পুরো রোমান সাম্রাজ্যের মানুষ রোগ নিরাময়ের আশায় আইসিস

৯. প্যাপিরাস : প্রাচীন মিশরে নীলনদের তীরে নলখাগড়াজাতীয় গাছ পাওয়া যেত। সেই গাছ কেটে তা থেকে প্রাপ্ত খোল পাথর চাপা দিয়ে সোজা করে রোদে শুকিয়ে লেখার উপযোগী করা হতো। তারপর আঠা দিয়ে জোড়া দিয়ে রোল আকারে সংরক্ষণ করা হতো। এভাবে তৈরি প্রাচীন লেখার উপযোগী উপাদানকে প্যাপিরাস বলা হয়। বর্ণমালা সৃষ্টির ক্ষেত্রে মিশরীয়দের যেমন বিশেষ অবদান ছিল, তেমনই তারা আবিষ্কার করেছিলেন লেখার উপযোগী এই চমৎকার উপাদানটি। ১০. তাতাওউরুল ফিকরিল ইলমিয়্যি ইনদাল মুসলিমিন, পৃ. ১৭০

১১. ফি তারিখিত তিব ফিদ-দাওলাতিল ইসলামিয়্যা, পৃ. ১৮

দেবীর উপাসনা করত। আইসিস দেবীর প্রতিকৃতি ছিল সিংহাসনে অধিষ্ঠিতা নারীর মতো। কিছু প্রতিকৃতিতে দেখা যায় পুত্র হোরাস রয়েছে তার কোলে। (১২)

চিকিৎসাক্ষেত্রে জ্যোতিষীদের ভূমিকাও কম ছিল না। তারা অসুস্থদের সেবা করত। বিনিময়ে মন্দিরের আয় থেকে তাদের বেতন দেওয়া হতো। প্রাচীন মিশরীয়রা ধারণা করত, রোগবালাই মূলত মানুষের শরীরে বাসা বাঁধা মন্দ আত্মার কুফল। এজন্য জ্যোতিষীদের চিকিৎসাপদ্ধতিতে দেখা যায়, প্রথমে তারা মন্দ আত্মার প্রকৃতি, তাৎপর্য ও গুণাবলি বোঝার চেষ্টা করে। তারপর সে অনুযায়ী তাবিজ-কবজ, পানিপড়া, কখনো আবার জাদু-টোনার পাশাপাশি স্তব ও মন্ত্রোচ্চারণ, নৈবেদ্য ইত্যাদির মাধ্যমে মন্দ আত্মা তাড়ানোর চেষ্টা করে। বিভিন্ন মৃত পশুর হাড্ডি, চামড়া অথবা ঘাস-লতাপাতার মাধ্যমে তারা মন্দ আত্মার শক্তিকে প্রাথমিকভাবে নিঃশেষ করার চেষ্টা চালিয়ে যায়। (১৩)

সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই বলা যায় যে, প্রাচীন মিশরীয় চিকিৎসায় প্রথমে রোগ নিরাময়ের চেষ্টা ছিল জ্যোতিষীদের মাধ্যমে। এরপরে উপাসনালয়ের ধর্মীয় ব্যক্তিদের বাইরে একদল চিকিৎসকের দেখা পাওয়া যায়। তাদের মধ্য থেকে আবার দুটি দল বের হয়। একদল চিকিৎসা করত জাদু-টোনা ও মন্ত্র-তন্ত্রের মাধ্যমে। অপরদল চিকিৎসা করত ভেষজ ওষুধ ও শল্যচিকিৎসার মাধ্যমে। তাদের মাঝে বিভিন্ন চিকিৎসাবিশেষজ্ঞের দেখা মেলে। (১৪)

মমি তৈরির ক্ষেত্রে মিশরীয়রা যে চূড়ান্ত যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখেছিল, সেটা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত রয়েছে। ভাঙা হাড়ের চিকিৎসা, দাঁতের চিকিৎসা, জন্মনিয়ন্ত্রণ, বুক কেটে অপারেশন করা, পাকস্থলীর রোগ, ডায়রিয়া, মূত্রনালির রোগসহ বিভিন্ন রোগ-নির্ণয় ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে তারা ছিল সিদ্ধহস্ত। (১৫)

প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতায় চিকিৎসকগণ তাদের জ্ঞান-গবেষণা ও অভিজ্ঞতা লিখে রাখতেন প্যাপিরাস কাগজে। বিভিন্ন ধরনের প্যাপিরাস কাগজ সেখানে প্রচলিত ছিল। যেমন কুইন প্যাপিরাস। এখানে সাধারণত নারীদের রোগ ও —[১২. ফি তারিখিত তিব ফিদ-দাওলাতিল ইসলামিয়্যা, পৃ. ১৮১০. রুওয়াদু ইলমিত তিব ফিল হাযারাতিল ইসলামিয়্যা, পৃ. ১৬ ১৪. ফি তারিখিত তিব ফিদ-দাওলাতিল ইসলামিয়্যা, পৃ. ১৮১. রুওয়াদু ইলমিত তিব ফিল হাযারাতিল ইসলামিয়্যা, পৃ. ১৬]

— নিরাময়ের বর্ণনা ছিল। আরেকটি রয়েছে এডুইন স্মিথ প্যাপিরাস(১৬)। এর মধ্যে লেখা ছিল অস্ত্রপচারের নিয়মকানুন। আরও ছিল এবারস প্যাপিরাস । এটি অভ্যন্তরীণ রোগ, মন্দ আত্মার প্রকৃতি, ভেষজ ওষুধ ইত্যাদি সম্পর্কে লিখিত। মিশরের এই তিন ধরনের গ্রন্থ থেকে বোঝা যায়, তারা আসলে চিকিৎসাশাস্ত্রকে তিন ভাগে ভাগ করে ফেলেছিল।

১. নারী সম্পর্কিত রোগের চিকিৎসা

২. অঙ্গব্যবচ্ছেদ সম্পর্কিত চিকিৎসা ৩. অভ্যন্তরীণ রোগের চিকিৎসা

এই বিভক্তিগুলো বর্তমান যুগেও দেখা যায়। (১৭)

সংক্ষেপে বলা যায়, প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতায় জ্ঞানতত্ত্ব ও সুনির্দিষ্ট পদ্ধতির অধীনেই চিকিৎসার চর্চা ও বিকাশ ঘটেছে। এগিয়ে গিয়েছে তারা ধীরে ধীরে। কিন্তু ইন্দ্রজাল, জাদু-টোনা, মন্ত্র-তন্ত্র তাদের চিকিৎসাক্ষেত্রে বেশ প্রভাব বিস্তার করেছিল। সেখানে জ্যোতিষীদেরও বেশ প্রভাব লক্ষ করা যায়। ফলে তারা পিছিয়েই ছিল।১৬. এডুইন স্মিথ প্যাপিরাস : এটি একটি প্রাচীন মিশরীয় মেডিক্যাল পাঠ্যবই। ট্রমার ওপরে রচিত প্রাচীনতম সার্জিক্যাল নিবন্ধ এটি। ১৮৬২ খ্রিষ্টাব্দে এডুইন স্মিথ এই প্যাপিরাস ক্রয় করেছিলেন। তার নামানুসারে এটির নামকরণ করা হয়েছে। এই নথিটি সামরিক শল্যচিকিৎসার সারগ্রন্থ হতে পারে। এতে আঘাত, অস্থি ভঙ্গ, ক্ষত, স্থানচ্যুতি এবং টিউমার সংক্রান্ত ৪৮টি কেস স্টাডি বর্ণনা করা হয়েছে- অনুবাদক।
১৭. রুওয়াদু ইলমিত তিব ফিল হাযারাতিল ইসলামিয়্যা, পৃ. ১৭

ব্যাবিলনীয় সভ্যতায় চিকিৎসাব্যবস্থা

প্রাচীন মিশরীয় চিকিৎসাব্যবস্থার মতো ব্যাবিলনীয় চিকিৎসা-ব্যবস্থায় একাকার হয়ে গিয়েছিল জাদু ও জ্যোতিষশাস্ত্র। কারণ তারা বিশ্বাস করত, রোগ মূলত রোগীর পূর্বের কোনো পাপের ঐশী শাস্তি। এজন্যই দেখা যায়, জ্যোতিষী বা জাদুকররা চিকিৎসায় কোনো ভুল করলে তারা কোনো পদক্ষেপই নিত না। অন্যদিকে শল্যচিকিৎসক যদি প্রতিষেধক বা অঙ্গচ্ছেদের ক্ষেত্রে ন্যূনতম ভুল করত, তাহলে কঠিন শাস্তি দেওয়া হতো তাকে। কারণ সে নিজের অভিজ্ঞতা ও শক্তির ওপর নির্ভর করে চিকিৎসাকার্য পরিচালনা করত; জ্যোতিষীদের মতো জাদু অথবা ঐশীবিদ্যার আশ্রয় নিত না। হাম্মুরাবির সংবিধানে লিখিত রয়েছে, যদি চিকিৎসক অঙ্গচ্ছেদ বা অপারেশন করতে গিয়ে ভুল করে ফেলে তাহলে তার হাত কেটে ফেলা হবে। যদি তার পাওনা থেকে বেশি মূল্য নেয় তাহলে তাকে কারাগারে বন্দি করা হবে। হাম্বুরাবির সংবিধানে চিকিৎসকের পারিশ্রমিক এবং চিকিৎসাসেবার মূল্য নির্ধারিত ছিল। এ সংবিধানমতে শিশুকে দুধ পান করানোর ক্ষেত্রে কোনো ধরনের অবহেলা করলে দুধমাতাকে কঠিন শাস্তি প্রদান করা হতো । (১৮)

সভ্যতার আঁতুড়ঘর মেসোপটেমীয় সভ্যতায় চিকিৎসার তিনটি পদ্ধতি ছিল—(১৯)

১. প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যসেবা (Preventive healthcare)। এই ব্যবস্থায় স্বাভাবিক প্রেসক্রিপশন ও নির্দেশনার মাধ্যমে চিকিৎসা দেওয়া হতো।
১৮. ফি তারিখিত তিব ফিদ-দাওলাতিল ইসলামিয়্যা, পৃ. ২৪১৯. তারিখুল উলুমি ইনদাল আরব, পৃ. ৪৮

২. শারীরিক চিকিৎসাপদ্ধতি (Physical medicine)। প্রাণী, উদ্ভিদ এবং আকরিক থেকে আবিষ্কৃত বিভিন্ন ওষুধের মাধ্যমে এই চিকিৎসাপদ্ধতি পরিচালিত হতো।

৩. মনোরোগবিদ্যা (Psychiatry)। এ ক্ষেত্রে তারা সাধারণত জাদু ও বশীকরণবিদ্যা প্রয়োগ করত।

স্বাভাবিকভাবে চিকিৎসার ক্ষেত্রে তারা মাদকদ্রব্য ব্যবহার করত না। তবে অঙ্গব্যবচ্ছেদ ও অস্ত্রপচারের ক্ষেত্রে অজ্ঞান করার জন্য হাশিশ ও আফিম ব্যবহারের প্রচলন ছিল। চিকিৎসকরা যদি রোগীর চিকিৎসা প্রদানে ব্যর্থ হতো, তাহলে রোগীর অভিভাবকরা রোগীকে উন্মুক্ত স্থানে রেখে দিত। তারা আশা করত, হয়তো কেউ তার পাশ দিয়ে অতিক্রমকালে রোগের প্রকৃতি বুঝতে পেরে এর চিকিৎসা বলে দিতে পারবে। (২০)

সংক্ষেপে বলা যায়, ব্যাবিলনীয়দের চিকিৎসাব্যবস্থা ছিল মূলত জ্যোতিষশাস্ত্র ও জাদু-টোনানির্ভর। রোগের ক্ষেত্রে তাদের মৌলিক ধারণা ছিল, উপাস্যদের ক্রোধের কারণে অথবা কালো জাদুর প্রতিক্রিয়ায় মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে।

চীনা সভ্যতায় চিকিৎসাব্যবস্থা

চীনের প্রাচীন চিকিৎসাব্যবস্থার আলোচনা করতে গেলে আমাদের ফিরে যেতে হবে ঈসা আ.-এর জন্মের ৩ হাজার বছর পূর্বে। ওয়াই পোয়াং কে প্রাচীন চীনা সভ্যতায় প্রসিদ্ধ একজন চিকিৎসক হিসাবে বিবেচনা করা হয়। চীনাদের মধ্যে প্রথম উদ্ভিদের গুণাবলি ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে গবেষণা শুরু করেন শেন নং। তিনি পরিচিত ছিলেন সম্রাট ফুয়ু নামে। তিনি বিভিন্ন ভেষজ উদ্ভিদের প্রভাব নিজের ওপর পরীক্ষা করে দেখতেন। প্রাচীন চীনে চিকিৎসার প্রচলিত পদ্ধতি ছিল গাছ-লতাপাতার ওষুধ, গরম শিক দ্বারা দহন (Moxibustion) এবং আকুপাংচার (২১)। এজন্যই তারা শারীরবৃত্তি ও দেহের অভ্যন্তরীণ সূত্রগুলো জানতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। (২২) দেহের অভ্যন্তরীণ চিকিৎসার ক্ষেত্রেও প্রাচীন চীনের চিকিৎসকগণ অনেক এগিয়ে ছিলেন। তারা শল্যচিকিৎসার বিভিন্ন কায়দা-কৌশল আয়ত্ত করেছিলেন। আহমাদ শওকত তাশি তারিখুত তিব ওয়া আদাবুহু ওয়া আলামুহু গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, বর্তমানে ইগনিপাংচার (Ignipuncture) নামে যে চিকিৎসাপদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে, সেটাই মূলত প্রাচীন চীনের চিকিৎসাপদ্ধতি। গরম সুঁই চামড়ায় প্রবেশ করানোর মাধ্যমে এই চিকিৎসা প্রদান করা হয়। এজন্যই শারীরবিদ্যা সম্পর্কে তাদেরকে

২. আকুপাংচার : ফিজিয়োলজির তথ্য অনুযায়ী মানুষের শরীরের মধ্যেই সমস্ত রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা আছে। সেখানে গোলযোগ হলেই আমরা আক্রান্ত হই বিভিন্ন রোগে। অ্যালোপ্যাথি বা মডার্ন মেডিসিনের ক্ষেত্রে চিকিৎসক রোগীর শরীরের ঘাটতিগুলো অনুসন্ধান করে ওষুধ প্রয়োগ করে ঘাটতি পূরণ করার চেষ্টা করেন। আকুপাংচারের কাজটাও তাই। পার্থক্য একটাই, এখানে ওষুধ খেতে হয় না। নার্ভ স্টিমুলেট করে শরীরের ভেতরে থাকা কেমিক্যালগুলোর পরিমাণ বাড়িয়ে বা কমিয়ে ঠিকমতো কাজ করানোই আকুপাংচারের কাজ। বহু গবেষণার পর আকুপাংচারের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি প্রমাণিত হয়েছে। ১৯৭৯ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আকুপাংচারকে স্বীকৃতি দেয়।

২২. আত-তিব ইনদাল আরব ওয়াল মুসলিমিন তারিখ ওয়া মুসাহামাত, পৃ. ২৫, ২৬

বিস্তারিতভাবে জানতে হতো। তারা বিশ্বাস করত, মানবদেহ বহু আন্তঃসম্পর্কীয় তন্ত্রের সমন্বয়ে গঠিত । (২৩)

প্রাচীন চীনাদের সম্পর্কে আরও বলা হয়, তারা স্পন্দনের (Pulse) মাধ্যমেও রোগ নির্ণয় করতে পারত। তারা বিশ্বাস করত তাপ, ঠান্ডা, শুষ্ক এবং আর্দ্রতা রোগ সৃষ্টির কারণ। এজন্য তাদের ধারণা ছিল, বক্ষব্যাধি ও ফুসফুসের রোগ সাধারণত শীতকালে হয়। জ্বর হয় শরৎকালে। সর্দি-কাশি ও মানসিক রোগ হয় বসন্তকাল। আর চর্মরোগ প্রকাশ পায় গ্রীষ্মকালে। (২৪)

স্বাভাবিকভাবেই বলা যায়, প্রাচীন চীনের চিকিৎসাব্যবস্থা অন্যান্য জাতির চিকিৎসাব্যবস্থা থেকে অনেকটা ভিন্নরকম ছিল। তারা কোনো ধরনের জাদু-টোনা, মন্ত্র-তন্ত্র প্রয়োগ করত না চিকিৎসার ক্ষেত্রে। বরং আকুপাংচারে তাদের আগ্রহ লক্ষ করা যায়। সিংহভাগ রোগের চিকিৎসা তারা এ পদ্ধতিতেই করত।

 

Leave a Reply 0

Your email address will not be published. Required fields are marked *