আল্লামা ইবনুল কায়্যিম জাওযিয়্যাহ রহ.

আল্লামা ইবনু কায়্যিম আল-জাওয়্যিাহ একটি নাম একটি ইতিহাস। তিনি মৃত হয়েও অমর হয়ে আছেন ইলমি জগতে। কেউ যদি তাঁর সান্নিধ্য পেতে চান তিনি যেন তাঁর রচিত গ্রন্থ অধ্যয়ন করেন। দেখতে পাবেন তিনি এক অতল মহাসমুদ্রে অবগাহন করছেন। তিনি ইলমী জগতের কুল-কিনারাহীন এক মহা সমুদ্র।

নাম

তিনি মুহাম্মদ ইবনে আবু বকর বিন আইয়ুব বিন সাআদ বিন হারিজ আয যুরাঈ আদ-দিমাশকি আল-হাম্বলি উপনাম : আবূ আবদুল্লাহ, শামসুদ্দিন ।

ইবনু কায়্যিমিল জাওজিয়্যাহ নামকরণ

ইবনু কায়্যিমিল জাওজিয়্যাহ নামে প্রসিদ্ধ। আল-জাওজিয়্যাহ দিমাশকের একটি মাদরাসা । মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা মহি উদ্দিন আবুল মাহাসিন ইউসুফ ইবনে আবদুর রহমান আল-জাওযি [মৃত্যু : ৬৫৬ হিজরি) প্রতি নিসবত করে মাদরাসার নাম রাখা হয়েছে। ইবনুল কায়্যিমের পিতা আবু-বকর [মৃত্যু : ৭২৩ হিজরি] সে মাদরাসার তত্ত্বাবধায়ক [কায়্যিম] ছিলেন । ইবনু কায়্যিমিল জাওজিয়্যাহ অর্থ : জাওজিয়্যাহ মাদরাসা তত্ত্বাবধায়কের পুত্র। তাঁকে ইবনুল কায়্যিমও বলা হয়। ইবনু হাজার আসকালানি ও জালালুদ্দীন সুস্মৃতি প্রমুখের নিকট তিনি শুধু ‘ইবনুল কায়্যিম’ নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন ।

জন্ম

৭ সফর ৬৯১ হিজরি ২৮ জানুয়ারী ১২৯২ ঈসায়ি দিমাশকে জন্ম ।

নোট

আরবিতে ‘কায়্যিম’ বলা হয় এমন ব্যক্তিকে যিনি মসজিদ কিংবা মাদরাসার তত্ত্বাবধান করেন তথা মসজিদ কিংবা মাদরাসার পবিত্রতা, পরিচ্ছন্নতা, সংস্কার, জায়নামাজ প্রস্তুতকরণ ও বাতি জালানোর কাজ সম্পাদন করেন। ইবনে হাজার আসকালানি আবু বকর কায়ি মিল জাওজিয়্যাহ সম্পর্কে বলেন, তিনি রশিদ আমেরি ও অন্যান্যদের কাছে শুনেছেন : তিনি এবাদতগুজার ও লৌকিকতাহীন ব্যক্তি ছিলেন। তিনি ইলমুল ফারায়েজে পারদর্শী ছিলেন। ৭২৩ হিজরিতে মৃত্যু বরণ করেন।- মিসর ফি আসরিল আইয়ুবিয়্যিন, সাইয়েদ বায আল-উরাইনি, পৃ: ২২৭, আদ-দুরারুল কামিনাহ : ১/৫২৭।

কারাবরণ

৭২৬ হিজরি/১৩২৬ ঈসাব্দের শাবান মাসে কবর যিয়ারতের জন্য ভ্রমণ করার বৈধতা অস্বীকার করায় ইবন তাইমিয়ার সাথে তাকেও দিমাশকের কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। এ জন্য তিনি নির্যাতন ভোগ করেন, বেত্রাঘাতে জর্জরিত হন এবং গাধার পিঠে বসিয়ে তাকে শহরে ঘুরানো হয় ইবন তাইমিয়ার ইন্তিকালের অনেক দিন পর ২০ যিলহজ ৭২৮ হিজরিতে তাকে মুক্তি দেয়া হয় । পরবর্তীতেও বিভিন্ন মাসআলায় মতভিন্নতার কারণে তাঁকে বহু যন্ত্রণা পোহাতে হয়।

তাঁর সম্পর্কে আলেমগণের মন্তব্য

১. তাঁর ইলমি যোগ্যতা, ইবাদত, আখলাক ইত্যাদি সম্পর্কে তাঁরই ছাত্র হাফেজ ইবন কাছির রাহিমাহুল্লাহ বলেন, তিনি ছিলেন সুমধুর তিলাওয়াত ও আকর্ষণীয় চারিত্রিক বৈশিষ্টের অধিকারী। কারও প্রতি বিদ্বেষ ছিল না, কাউকে কষ্ট দিতেন না, কারও দোষ-ত্রুটি অন্বেষণ করতেন না, কারও প্রতি তাঁর হিংসা ছিল না। আমি (ইবন কাছির) তাঁর খুব প্রিয়পাত্র ছিলাম। আমাদের এ যুগে পৃথিবীতে তার চাইতে বেশী ইবাদতগুজার কেউ ছিলেন বলে আমার জানা নাই। তার সালাত আদায়ের বিশেষ একটি দিক ছিল তিনি সালাত দীর্ঘ করতেন, রুকু সাজদাতে দীর্ঘ সময় কাটাতেন ।

২. ইবন রজব হাম্বলি বলেন, “তার মত গভীর পান্ডিত্যের অধিকারী আর কাউকে পাইনি । তিনি বিভিন্ন ধরনের জাগতিক পরীক্ষার সম্মুখীন হন এবং একাধিকবার নির্যাতনের শিকার হন। শেষবার তিনি নিজ উসতায ইবন তাইমিয়ার সাথে কারাবরণ করেন এবং তাকে উসতায় থেকে পৃথকভাবে রাখা হয় । শাইখের ইন্তিকালের পর তাকে মুক্তি দেয়া হয় ।

৩.হাফেজ ইবন হাজার আসকালানি রাহিমাহুল্লাহ বলেন, তিনি ছিলেন দুপায়ে চলাফেরা করা ইলমের এক জীবন্ত বিশ্বকোষ । তিনি স্বীয় লাইব্রেরী ও বাড়ি থেকে দূরে সফরে থাকা অবস্থায়ও বেশ কিছু গ্রন্থ রচনা করেছেন।

গ্রন্থাদি

বিভিন্ন বিষয়ে রচিত তাঁর গ্রন্থ সংখ্যা প্রায় আটান্নব্বইটি। গবেষক ও ইতিহাসবিদদের বর্ণনানুযায়ী এগুলোর কিছু ছিল মুদ্রিত, কিছু ছিল পাণ্ডুলিপি ও কিছু গ্রন্থ প্রতিপক্ষরা জ্বালিয়ে দিয়েছে আবার কিছু হারিয়েও গেছে । তাঁর রচিত প্রতিটি কিতাবই জনসমাদ্রিত ও পাঠকপ্রিয়তা লাভ করে। উপরে বর্ণিত কিতাবগুলো ব্যতীত অন্যান্য গ্রন্থ রয়েছে যেমন, ১. ‘আলামুল মুওয়াক্কিঈন আন রাব্বিল আলামিন’, ২. ইগাছতুল লাহফান মিন মাসায়িদিশ শাইতান’, ৩. ‘আল ওয়াবিলুস সায়্যিব মিনাল কালামিত তায়্যিব’, ৪. ‘তারিকুল হিজরাতইন ও বাবুস সাআদাতাইন’, ৫. যাদুল মাআদ ফি হাদয়ি খাইরিল ঈবাদ, ৬. ফজলুল ইলমি ওয়াল ওলামা, ৭. আহকামু আহলিজ জিম্মাহ, ৮. আল-ইজতিহাদ ওয়াত তাকলিদ, ৯. জালাউল আফহাম ফিস সালাতে ওয়াস সালামে আলা খায়রিল আনাম, ১০. হাদিউল আরওয়াহ ইলা বিলাদিল আফরাহ, ১১. আদ-দাউ ওয়াদ দাওাউ, ১২. আর-রূহ, ১৩. রওযাতুল মুহিব্বিন ওয়া নুহজাতুল মুশতাকিন, ১৪. আত-তিববুন নববি, ১৫. ইদ্দাতুস সাবেরিন, ১৬. আল-মানারুল মানিফ ফিস সহিহ ওয়াজ যয়িফ, শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবূ গুদ্দাহ তাহকিককৃত । ১৭. আল-ওয়াবেলুস সায়্যিব উল্লেখযোগ্য ।

মৃত্যু

১৩ রজব ৭৫১ হিজরি মোতাবেক ১৫ সেপ্টেম্বর ১৩৫০ ঈসাব্দে তিনি ৬০ বছর বয়সে দিমাশকে বৃহস্পতিবার এশার নামাযের পর ইন্তিকাল করেন। দিমাশকের জামে মাসজিদে জানাযা শেষে বাবুস সাগির কবরাস্থনে তাকে দাফন করা হয়।

আলামুল মুওয়াক্কিঈন এর হামযাতে যের হবে নাকি যবর হবে এ নিয়ে মতানৈক্য রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, যের ও যবর উভয়টি দিয়ে পড়া জায়েজ। যাদুল মাআদ এর ভূমিকায় গ্রন্থকারের জীবনী হতে সংগৃহিত, দারে ইবনে হজম, বৈরুত, লেবানন।

পৃ: ৫-১০ সংস্করণ: ১৯৯৯ ঈসায়ি ৫.যাইলু তারাকাতিল হানাবেলা : ২/৪৪৭,৪৫২, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ১৪/২৩৪, ২৩৫,

আল-বদরুল তালে : ৪/১৪৩, ১৪৬, দায়েরাতুল মাআরিফ আল-ইসলামিয়া : ১/২৬৮ ।

Leave a Reply 0

Your email address will not be published. Required fields are marked *