জেব্রাকে দেখতে আমার কেমন মনে হয় জানেন? —জেলখানার কয়েদিদের মতো। তারা যতই খাঁচার পেছনে অথবা খোলা মাঠে থাকুক না-ই বা কেন। যদিও ❛দ্য বয় ইন দি স্ট্রাইপ্ড পাজামাস❜ বইয়ে জেব্রা জাতীয় কোনো প্রাণীর কথা লেখা নেই; তবে জেব্রার চামড়ার মতোই ডোরাকাটা পোশাক পরিহিত এক বালকের প্রতিচ্ছবি এঁকে যে হৃদয়বিদারক গল্প লেখক ফেঁদেছেন—তা এককথায় প্রকাশ করাও সহজ নয়।
এই কঠিনতার পেছনে মূল কারণও দুটো চরিত্র। নয় বছরে পদার্পণ করা ব্রুনো। যে থাকে বার্লিন শহরের একটি পাঁচতলা বিল্ডিংয়ে বাবা, মা ও বোনের সাথে। তার বাবা নাৎসি জার্মানির একজন গুরুত্বপূর্ণ সেনাকর্মকর্তা। পদোন্নতি হয়ে তিনি যখন কমান্ড্যান্ট ও ফিউরিসাহেবের প্রিয়পাত্র বনে যান; তখনই ঘটে মূল ঘটনা। বার্লিন শহরের সৌন্দর্য ছেড়ে ব্রুনোদের পাড়ি দিতে হয় নতুন এক জায়গা আউট-উইথে। যেখানে ব্রুনোর বাবাকে ফিউরিসাহেব পাঠিয়েছেন বিশেষ এক দায়িত্ব অর্পণ করে।
ছোট্ট ব্রুনো তখনও জানত না যে তার জীবনে বিশাল এক পরিবর্তন আসতে চলেছে।নতুন পরিবেশে গিয়ে ব্রুনো পুরোপুরি একা হয়ে পড়ে। বার্লিনে থাকাকালীন তিন জন বিশেষ বন্ধুর কথা সে চেয়েও ভুলতে পারে না। এমনকি খুনশুটিতে মেতে থাকা তার একমাত্র বোন গ্রেটেলেরও একই অবস্থা। যে কি-না সব সময় তার ওপর কর্তৃত্ব ফলানোর চেষ্টা করে। খারাপ লাগার আরও একটি কারণ হিসেবে ব্রুনো টের পায় যে, পাঁচতলা থেকে তাদের এখন থাকতে হয় তিনতলা বিল্ডিংয়ে। যে বিন্ডিংয়ের আশেপাশে বিষণ্ণতা খেলা করে। ব্রুনোর রুমের জানালা দিয়ে তাকালে কাঁটাতারের বেষ্টনীর ওপাশে সৈন্যদের অস্ত্র হাতে পাহারা এবং একই ঢঙের ডোরাকাটা পোশাক পরিহিত আবালবৃদ্ধবনিতাদের দেখা যায়।
যারা সদা ভীত আর মাথা নিচু করে থাকে সৈনিকদের কারণে। ব্রুনো জানে না তারা কারা আর কেন তাদের একই পোশাক পরানো হয়েছে। ব্রুনোর বাবার মতে—তারা কোনো মানুষ না বা মানুষের জাতে পড়ে না। কিন্তু ব্রুনো জানে না এই জাত-বেজাত কী। সে ভেবে পায় না কেন তাদের থেকে ওই ডোরাকাটা পোশাকের মানুষগুলো আলাদা জীবনযাপন করছে।
প্রশ্ন অনেক কিন্তু উত্তর?
দ্য বয় ইন দি স্ট্রাইপ্ড পাজামাস উপন্যাস দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার এক জার্মান কমান্ড্যান্ট পরিবারের ওপর নির্ভর করে লেখা। পরিবারের ছোট্ট সদস্য ব্রুনো এই উপন্যাসের মধ্যমণি। তার দৃষ্টিকোণ থেকে লেখক পুরো কাহিনিটি পরিষ্কার ভাবে দেখানো হলেও; খুঁটিনাটি অনেক কিছু তিনি ধোঁয়াশায় রেখে দিয়েছেন। তবে সেই গূঢ়ার্থ বোঝার জন্য খুব বেশি জ্ঞানী হওয়ার প্রয়োজন নেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে জানাশোনা থাকলে সহজে তা অনুধাবন করতে পারবেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে একটি জার্মান পরিবারের অবস্থা, সেই পরিবারের সন্তানদের চিন্তাভাবনা, বড়োদের মধ্যকার আলোচনা; বিশেষ অর্থ বহন করে।
স্পর্শকাতর কিছু ঘটনার প্রদর্শন না করে লেখক শুধু সংলাপ আর ব্রুনোর অবচেতন মনের ভাবনায় ভর করে সকল কিছু ব্যক্ত করে দেখাতে পেরেছেন। যা ভাবায় আবার একইসাথে ব্যথিত করে। ব্রুনোদের সাথে থাকা মারিয়া আর আউট-উইথে লেফটেন্যান্ট কটলার পার্শ্বচরিত্র হয়েও যেন কিছু সময়ের জন্য প্রধান চরিত্রের চেয়ার দখল করে রাখে। তা-ছাড়া লেখক একই বয়সি দুটো ছেলের দু’রকম জীবনের যে তারতম্য; তা দেখানো হয়েছে দক্ষতার সাথে। ব্রুনো আর শুমেল। দুজন দুই মেরুর বাসিন্দা হয়েও যেন একই ছাঁচে গড়া। মাঝে বাধা শুধু একটি কাঁটাতারের বেড়া।
সেই শুমেলের পরিবারের সাথে ব্রুনোর পরিবারের আশ্চর্য এক সম্পর্কের করুণ পরিণতি যে সমাপ্তিতে গিয়ে ইটপাটকেল খেলায় রূপান্তরিত হবে; তা ছিল অজানা। কয়েকটি সুতোর বাঁধন, কাজের ফল আর অবুঝ বালকের পরিণতি নিয়ে লেখা ❛দ্য বয় ইন দি স্ট্রাইপ্ড পাজামাস❜ উপন্যাস। এই উপন্যাসের ভালোমন্দ নিয়ে লেখালিখি কম হয়নি। কারও মতে ব্রুনোর চরিত্রটা একেবারে বেকার। নয় বছর এক ছেলের এমন বাহুল্যতা একেবারেই মেনে নেওয়ার মতো না। অবুঝ আর বিরক্তি ধরানো কাজকারবার মাঝেমধ্যে ভ্রুকুঞ্চনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিষয়টি আমারও মনে হয়েছে। তবে লেখক হয়তো এটাই চেয়েছেন।
প্রথমে একটি চরিত্রকে বিরক্তিকর বা খারাপ বানিয়ে শেষের দিকে ব্যাকুলতার সাগরে তাকে ডুবিয়ে দেওয়া। বিষয়টি সস্তা মনে হলেও এই উপন্যাসের ক্ষেত্রে উচিত পরিণতি হয়েছে বলে মনে করছি। —হয়তো যারা উপন্যাসটি পড়েছেন বা পড়বেন তারা আমাকে নিষ্ঠুর ভাবতে পারেন। অসুবিধা নেই। উক্ত উপন্যাসটির অনুবাদ করেছেন সালমান হক। তাঁর প্রকাশিত পঞ্চম বই হলেও অনুবাদ করা প্রথম বই।
প্রথম অনুবাদ হিসেবে বইটির শব্দচয়ন প্রাঞ্জল যা তরতর করে পড়ে নেওয়া যায় কোনো বাধাবিপত্তি ছাড়াই। ‘দ্য আইরিশ এক্সামিনার’ বইটিকে মানবিক গল্প বলে সম্বোধন করলেও; এটাকে কোনো দিক থেকে মানবিক গল্প মনে হয়নি। মানবতার উদাহরণ শুধু লুকিয়ে কিছু খাবার দেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ সম্পর্কে থাকা উচিত নয়। বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি বাহিনীর নৃশংসতা নিয়ে নতুন কোনো আলোকপাত করার প্রয়োজন নেই; সেই ভয়াবহতা উল্লেখ করে লেখক জন বয়েন বইয়ের সমাপ্তিতে লিখেছেন─এই ছিল ব্রুনো আর তার পরিবারের গল্প। এসব অনেক বছর আগে ঘটেছিল। কিন্তু এরকম আর কোনো কিছু আর কখনও ঘটবে না। অন্তত এই যুগে। হাস্যকর বটে! এমন একই ঘটনা তো প্রতিনিয়ত ঘটছে এই পৃথিবীতে।
সব ঘটনার সমীকরণ যে এক সূত্র দিয়ে করা হবে এমনও না। সভ্যতা যেমন এগিয়ে যাচ্ছে তেমনই সেটার ভয়াবহতা দিগুণ ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার পরিণতি এই গল্পের চেয়েও খারাপ আকার ধারণ করবে। কারণ বাস্তবতা সব সময় কঠিন আর নৃশংস। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে বাতিঘর প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হওয়া বইটির মুদ্রিত মূল্য ১৪০ টাকা মাত্র। |review writer 💕 Peal Roy Partha
#দ্য বয় ইন দি স্ট্রাইপ্ড পাজামাস | রিভিউ