- বই : মিশন উইথ মাউন্টব্যাটেন
- লেখক : অ্যালান ক্যাম্বেল জনসন
- প্রকাশনী : শোভা প্রকাশ
- বিষয় : ইতিহাস ও ঐতিহ্য
- কভার : হার্ড কভার
- ভাষা : বাংলা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু থেকেই ব্রিটিশ রাজ বুঝতে পারে ভারতে তাদের সময় শেষ হয়ে আসছে। অবশ্য সিপাহী বিপ্লবের পর থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছ হতে ব্রিটিশ রাজ ভারতের ক্ষমতাহাতে তুলে নিলেও মূলত ১৮ শতকের শেষ ভাগে ও উনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ভারতে শিক্ষিত, আধুনিক ও স্বাধীন চেতা মানুষের আবির্ভাব হয়। যার কারণেব্রিটিশ রাজ বুঝে যায় যে তাদের সময় শেষ হয়ে আসছে। অন্য দিকে ইউরােপে হিটলারের জার্মানি, এশিয়ার জাপানের অক্ষশক্তি হিসেবে উত্থান, আমেরিকার নতুন পরাশক্তি হিসেবে ঘােষণা মােটামুটি ব্রিটিশরাজ কে ভয় পাইয়ে দেয়।
তখন ভারতে লীগ-কংগ্রেসের দৌরাত্ম চলছে। কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। একে একে ব্যর্থ হয় কেবিনেট মিশন, ক্রিপশ | মিশন, সিমলা চুক্তির মত পদক্ষেপ গুলাে। কংগ্রেসের অখণ্ড ভারত, জিন্নাহ’র ভারতীয় মুসলমানদের জন্য আলাদাভুমি উপমহাদেশ কে টালমাটাল করে দেয়। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এ্যাটলি লর্ড মাউন্টব্যাটেন কে ভারতে পাঠান শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে। এ বইটা আসলে মাউন্টব্যাটেনের দিনলিপি যেখানে প্রতিটি ঘটনা সুস্পষ্ট ভাবে লিপিবদ্ধ আছে। ভারত ভাগের এক ঐতিহাসিক দলিল এই বই।
মিশন উইথ মাউন্টব্যাটেন বই থেকে – ভারতে ব্রিটিশের ক্ষমতা হস্তান্তরের ঘটনাই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর সমগ্র বিশ্বের ঘটনাবলির মধ্যে বোধহয় বৃহত্তম পরিবর্তনের ঘটনা বলে সর্বত্র স্বীকৃত হয়েছে। আমি আমার দিনলিপিরূপে লিখিত এই গ্রন্থে বেশিরভাগই ইতিহাসের মূল উপাদান পরিবেশন করেছি, সত্যিকার ইতিহাস রচনার প্রয়াস করিনি। ভারত সম্বন্ধে কোনো বিচারকের রায়ের মতো অভিমত না দিয়ে চেষ্টা করেছি বেশিরভাগই সাক্ষ্য-প্রমাণ ও তথ্য পরিবেশন করার। সে সময়ের মূল ঘটনা এবং ঘটনার চরিত্রে যাঁরা ছিলেন তাঁরা এখনও অতীতের বিষয় হয়ে পড়েনি। সেই ঘটনা এবং তার সাথে জড়িত ব্যক্তিত্বের স্মৃতি আজও আমার এত কাছে যে, উভয়কেই বিচার-বিশ্লেষণ করা বা একটা চূড়ান্ত অভিমত দেওয়াও আমার পক্ষে সম্ভবপর নয়।
মিশন উইথ মাউন্টব্যাটেন (PDF Download Free)
- ISBN: 9789847116570
- লেখক: অ্যালেন ক্যাম্বেল জনসন
- অনুবাদক: এনায়েত রসুল
- বইয়ের ধরণ: অনুবাদ: ইতিহাস ও ঐতিহ্য
- সংস্করণ: ২য় মুদ্রন, ২০১৭
- পৃষ্ঠা: ৪৭৮
- প্রকাশনী: অন্বেষা প্রকাশন
- দেশ: বাংলাদেশ
- ভাষা: বাংলা
শেষ ভাইসরয়ের ভারতযাত্রা
লন্ডন, বৃহস্পতিবার, ১৯ ডিসেম্বর, ১৯৪৬ : আজ সকালবেলা মাউন্টব্যাটেনের চেস্টার স্ট্রিটের বাড়িতে প্রাতরাশে যোগদানের জন্য যথাসময়ে উপস্থিত হলাম। যুদ্ধের সময় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সুপ্রীম কমান্ডার হয়ে মাউন্টব্যাটেন যখন কাজ করছিলেন, তখন তাঁর দৈনন্দিন যুদ্ধকর্ম-বিবরণী লেখার কাজের ভার ছিল আমার উপর। যুদ্ধ নেই, সেই কার্যপদও এখন আর আমার নেই, তবুও মাউন্টব্যাটেন আমাকে তাঁর লিখিত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া কমান্ডের ডেসপ্যাচগুলো একবার দেখার জন্য বলেছেন। প্রাতরাশ শেষ করে কিছুক্ষণ এসব ডেসপ্যাচ দেখার কাজেই কাটিয়ে দিলাম, কিন্তু একাজ এত অল্প সময়ের মধ্যে সম্পূর্ণ হবার নয়। তাছাড়া, মাউন্টব্যাটেনেরও একবার বাইরে বের হবার প্রয়োজন ছিল। তিনি যাবেন শিল্পী অসোয়াল্ড বার্লের স্টুডিওতে। মাউন্টব্যাটেনের একটি পোর্ট্রেট আঁকতে শুরু করেছেন অসোয়াল্ড। অগত্যা মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গেই বের হলাম।
গাড়িতে উঠেই মাউন্টব্যাটেন সব জানালার কাঁচ তুলে দিয়ে জানালা বন্ধ করে দিলেন। তারপর চাপাস্বরে বললেন যে, তিনি এখন আমাকে এমন একটি সংবাদ শোনাবেন, যে সংবাদ তাঁর পরিবারের বাইরে কেউ এখনও জানেন না। সংবাদটা যেন আমার মুখ থেকে দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তির কানে না যায়, গোপনীয়তা রক্ষার এ নির্দেশও তিনি আমাকে শুনিয়ে রাখলেন।
মাউন্টব্যাটেন বললেন যে, গতকাল সন্ধ্যাবেলা এটলি তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। ওয়েভেল ভারত থেকে চলে আসছেন এবং তাঁর স্থানে এবার মাউন্টব্যাটেনকেই ভাইসরয় হয়ে ভারতে যেতে হবে।
এ প্রস্তাব করেছেন এটলি। বিস্মিত হলাম, কারণ এ ধরনের সংবাদ শুনবার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না এবং শুনবো বলে কল্পনাও করতে পারিনি, যদিও মাউন্টব্যাটেনকে নানারকম বিস্ময়কর ব্যাপারের মধ্যেই দেখতে আমি অভ্যস্ত। আমি আজ পর্যন্ত জানতাম যে, ১৯৪৭ সালের এপ্রিল মাসে মাউন্টব্যাটেন ফার্স্ট ক্রুজার স্কোয়াড্রনের রীয়ার অ্যাডমিরাল পদে নিযুক্ত হবেন এবং মাউন্টব্যাটেনও তার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন।
মাউন্টব্যাটেনের কাছ থেকেই এখন শুনতে পেলাম, এটলির সঙ্গে তাঁর কি আলোচনা হয়েছে। এটলি জিজ্ঞেস করেছেন, মাউন্টব্যাটেনের মন কি সত্যি সত্যিই সমুদ্রে যাবার জন্যই তৈরি হয়ে রয়েছে? মাউন্টব্যাটেন উত্তর দিয়েছেন-হ্যাঁ।
এরপর এটলি আলোচনার প্রসঙ্গ অন্য দিকে টেনে নিয়ে গেলেন। ভারতীয় সঙ্কটের কথা উত্থাপন করলেন এটলি। তিনি বললেন, ওয়েভেল এ পর্যন্ত যা করতে পেরেছেন, তাকে বলা যায়, সামরিক দখল ছেড়ে দিয়ে চলে আসার মতো ভারত থেকে ব্রিটিশের শুধু সরে আসার একটা পরিকল্পনা। নতুন কোনো ব্যবস্থা উদ্ভাবনের জন্য এর চেয়ে বেশি কাজের কোনো গঠনমূলক পরিকল্পনা করে উঠতে পারেননি ওয়েভেল। ভারতে বর্তমানে যে পন্থায় রাজনৈতিক পরিবর্তন সাধনের চেষ্টা হচ্ছে, তার ফলও ভালো হচ্ছে না। কংগ্রেস ও মুসলিন লীগ, উভয়েরই উপর এর প্রতিক্রিয়া বেশ খারাপভাবেই দেখা দিয়েছে। এসব ব্যাপারে গভর্নমেন্টও অত্যন্ত অপ্রসন্ন হয়ে উঠেছেন। এটলি বললেন, যদি আমরা এ বিষয়ে এখনই খুব সজাগ ও সতর্ক না হই, তবে পরিণাম যতটা খারাপ হবে বলে আশঙ্কা করা যায়, বাস্তবে তার চেয়ে বেশি খারাপ হতে পারে। ভারতকে শুধু যে গৃহযুদ্ধের মধ্যেই ছেড়ে দিয়ে আসা হবে তা নয়, বস্তুত ভারতকে একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠায় উদ্যত কতকগুলো রাজনৈতিক আন্দোলনের গ্রাসের মধ্যে সঁপে দিয়ে আসা হবে। ভারতের রাজনৈতিক ক্ষেত্রের এ অচল অবস্থা দূর করার জন্য অবিলম্বে উপযুক্ত ব্যবস্থা অবলম্বনের প্রয়োজন। মন্ত্রি-মিশনের প্রধান প্রধান সদস্যদের সকলেরই মনে এখন এ ধারণা হয়েছে যে, সমস্যা সমাধান করতে হলে নতুন পন্থায় অগ্রসর হতে হবে। এমন লোক চাই, যিনি এ সমস্যা সমাধানে তাঁর ব্যক্তিগত প্রভাব প্রয়োগের যোগ্যতা রাখেন। মন্ত্রি-মিশনের প্রধান সদস্যেরা এ রকম এক যোগ্য ব্যক্তি সংগ্রহের কথাও চিন্তা করেছেন। তাঁরা সকলেই এ বিষয়ে একমত হয়েছেন যে, মাউন্টব্যাটেনই হলেন এ কাজের পক্ষে যোগ্যতম ব্যক্তি। এ কাজের উপযুক্ত গুণ এবং ব্যক্তিত্ব মাউন্টব্যাটেনের আছে।
মাউন্টব্যাটেন বলেছেন যে, তিনি একটি বিষয় পরিষ্কার বুঝিয়ে দিতে ইচ্ছা করেন। মাউন্টব্যাটেন যতদিন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সুপ্রীম কমান্ডার হয়ে কাজ করছিলেন, ততদিন ভারতে ওয়েভেলের কাজ ও নীতির মধ্যে এমন কিছু তিনি দেখতে পাননি, যার বিরুদ্ধে তাঁর কোনো আপত্তি ছিল। ওয়েভেলের নীতি তিনি সমর্থনই করেছেন। ওয়েভেলের সঙ্গে যতবার তাঁর আলোচনা হয়েছে, এমনকি বিগত জুন মাসে দিল্লিতে ওয়েভেলের সঙ্গে তাঁর যে শেষ আলোচনা হয়েছে, তাতেও তিনি বুঝেছেন যে, ওয়েভেলের অনুসৃত নীতিতে কোনো ভুল নেই। ওয়েভেল যা করেছেন মাউন্টব্যাটেনের উপর দায়িত্ব থাকলে তিনিও ঠিক তা-ই করতেন।
এটলি স্বীকার করলেন, ওয়েভেল এতদিন ধরে যে সাধারণ নীতি অনুসরণ করে কাজ করেছেন, মূলত সেই নীতির বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। আসল কথা হলো, নীতি প্রয়োগ করার অর্থাৎ নীতিকে কার্যে পরিণত করার সমস্যা এবং বাস্তব সত্যি এই যে, অজস্র চেষ্টা সত্ত্বেও সে নীতি ব্যর্থ হয়েছে, কাজের ক্ষেত্রে সে নীতি আদৌ প্রযুক্ত হতে পারেনি।
এটলি বললেন, এখন এ নতুন অবস্থার কারণে সমস্যাটা প্রধানত একটা ব্যক্তিত্বঘটিত সমস্যাই হয়ে উঠেছে। ভারতীয় নেতাদের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে ঘনিষ্ঠতর হয়ে সমস্যার সমাধান সম্বন্ধে উপায় নির্ণয় করাই এখন হলো সবচেয়ে বড়ো কাজের কথা।
মাউন্টব্যাটেন আমাকে বললেন, এটলির কাছ থেকে এই সব কথা শুনেও তিনি খুব জোর আপত্তি করে বলেছেন যে, সমুদ্রে নৌ-সৈন্যের অধিনায়কতার পদে থেকেই তিনি রাষ্ট্রের সেবায় বেশি কাজ করতে পারবেন বলে মনে করেন। তিনি প্রশ্ন করেছেন ভারতে ভাইসরয়ের পদে নিযুক্ত হবার মতো যোগ্য লোক কী আর কেউ নেই? অকিনলেক তো ভারতে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা লাভ করেছেন। সুতরাং অকিনলেককে ওই পদে নিয়োগ করা কী যায় না?
এটলিকে শেষ পর্যন্ত কোনো কথা দিয়ে আসতে পারেননি মাউন্টব্যাটেন। প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানও তিনি করেননি। মাউন্টব্যাটেন প্রথমত ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের নীতি সম্বন্ধে পরিষ্কারভাবে ধারণা করে নিতে চেয়েছেন। ভারতে কী নীতি অনুসরণ করতে চান গভর্নমেন্ট? তাছাড়া, ইংল্যান্ড-নৃপতির সঙ্গেও মাউন্টব্যাটেনকে একবার আলোচনা করতে হবে। ভাইসরয়ের পদ গ্রহণের অর্থ ইংল্যান্ড-নৃপতিরই প্রতিভূ হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ। ভারতের শাসনিক দায়িত্বের ক্ষেত্রে ভাইসরয় হলেন ইংল্যান্ড-নৃপতির মনোনীত কর্মচারী এবং দেশিয় রাজ্যগুলোর শাসনিক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে ভাইসরয় হলেন প্রত্যক্ষভাবে ইংল্যান্ড নৃপতিরই ব্যক্তিগত প্রতিনিধি তথা প্রতিভূ। সুতরাং মাউন্টব্যাটেন ইংল্যান্ড নৃপতির সঙ্গে পরামর্শ না করে এটলিকে কোনো প্রতিশ্রুতি দিতে পারছেন না।
আমার অভিমত জিজ্ঞেস করলেন মাউন্টব্যাটেন। আমি বললাম, গভর্নমেন্টের কাছ থেকে তাঁদের উদ্দেশ্যের পরিচয় এবং কর্তব্যের নির্দেশ অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে না জেনে নিয়ে এমন নিদারুণ দায়িত্ব গ্রহণ করা মাউন্টব্যাটেনের পক্ষে উচিত হবে না।
মাউন্টব্যাটেন বললেন—ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের কাছ থেকে আমাকে একটা বিষয়ে নিঃসন্দেহ হয়ে নিতে হবে; কতদিনের মধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে?
এ বিষয়ে যদি একটা চূড়ান্ত সময়সীমা নির্দিষ্ট না করে দেওয়া হয়, তবে ভারতীয় জনমতের ক্ষোভ ও অবিশ্বাসের মধ্যে পড়ে প্রথম থেকেই আমার চেষ্টা পণ্ড হতে থাকবে এবং আমি এ ধরনের অবস্থার মধ্যে নিজেকে টেনে নিয়ে যেতে পারি না।
মাউন্টব্যাটেনের কথা শুনে মনে হলো, তিনি ঝুঁকি নিতে রাজি আছেন। তিনি এ বিষয়ে সচেতন আছেন যে, এ কাজের মধ্যে শেষ পর্যন্ত ফলাফলের সব বদনামের বোঝা তাঁরই ঘাড়ে পড়ার একটা আশঙ্কাও অবশ্য রয়েছে, কিন্তু খুব বেশি আছে বলে তিনি মনে করেন না।
লন্ডন, বুধবার, ১৫ জানুয়ারি, ১৯৪৭: এখন এক প্রকারের সুনিশ্চিতই হয়ে গিয়েছে যে, মাউন্টব্যাটেন ভাইসরয়ের পদ গ্রহণ করবেন। ভারতে ক্ষমতা হস্তান্তরের একটা সময়সীমা নির্দিষ্ট করে দেবার নীতিও গভর্নমেন্ট স্বীকার করেছেন। কিন্তু কোন্ তারিখের মধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে, সে সম্বন্ধে সুস্পষ্টভাবে কোন্ সিদ্ধান্ত গভর্নমেন্ট করে উঠতে পারছেন না। গভর্নমেন্ট বলেছেন, ১৯৪৮ সালের দ্বিতীয়ার্ধের মধ্যেই ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে। কিন্তু মাউন্টব্যাটেনের মনেও এ ধারণা অত্যন্ত প্রবল হয়ে উঠেছে যে, ক্ষমতা হস্তান্তরের তারিখ যত এগিয়ে দেওয়া হবে, মাউন্টব্যাটেনের পক্ষেও ভারতীয় রাজনৈতিক সমস্যর সমাধান করার প্রয়াস তত দ্রুত সাফল্য লাভ করবে। সুতরাং মাউন্টব্যাটেন দাবি করেছেন, ১৯৪৮ সালের দ্বিতীয়ার্ধের মধ্যে’ অর্থ যেন জুন মাসের মধ্যে বুঝায়, ডিসেম্বর মাসের মধ্যে নয়।
বড়োদিনের প্রথম সপ্তাহ দেখা দেবার আগে এটলির সঙ্গে মাউন্টব্যাটেনের আলোচনাও এ পর্যন্ত এসে থেমে ছিল। চূড়ান্ত আলোচনার পর্ব বাকি থেকে যায়। মাউন্টব্যাটেনও সপরিবারে অবসর যাপনের জন্য ডাভোসে চলে যান। কিন্তু আটচল্লিশ ঘণ্টা পার হতে না হতেই লন্ডন থেকে জরুরি আহ্বান চলে এলো, সঙ্গে সঙ্গে একটি বিশেষ বিমানও উপস্থিত হলো তাঁকে লন্ডন নিয়ে যাবার জন্য।
সংবাদপত্র মহল এ ঘটনার সংবাদ জানতে পারলেন, কিন্তু ঘটনার মর্মার্থ বুঝে উঠতে পারলেন না। ‘ডেইলি মেলের’ সম্পাদক ফ্র্যাঙ্ক ওরেল আমাকে বললেন যে, মাউন্টব্যাটেনকে প্যালেস্টাইনে পাঠাবার জন্যই ব্যবস্থা হচ্ছে বলে তিনি অনুমান করছেন।
গভর্নমেন্টের নতুন ঘোষণার খসড়ায় উল্লিখিত শর্তগুলো বেশ ভালো করেই বিবেচনা করলেন মাউন্টব্যাটেন এবং দেখে সন্তুষ্ট হলেন। দেখলেন, ভবিষ্যতে তাঁর নৌবিভাগীয় সার্ভিসের সুযোগও একটি উল্লেখের মধ্যে অক্ষুণ্ণ রাখা হয়েছে। ভাইসরয়ের পদ গ্রহণে চূড়ান্ত সম্মতি জানিয়ে দিলেন মাউন্টব্যাটেন।
মাউন্টব্যাটেন এ আশঙ্কা করছিলেন এবং সে সম্বন্ধে গভর্নমেন্টকেও সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে, ভাইসরয়ের পদে তাঁর এ নিয়োগে অনেকের মনে ব্রিটিশের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে একটা ভুল ধারণা উদ্ভূত হবার সম্ভাবনা রয়েছে। ধারণা হতে পারে, ভারতীয় সমস্যার কোনো সঙ্গত সমাধান করতে না পেরে, ব্রিটিশ গভর্নমেন্টে ভারতের উপর তাঁদের নিজেদেরই ইচ্ছামতো একটা সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে উদ্যোগী হয়েছেন। আরও ধারণা হতে পারে, ভারতে ভাইসরয় নিয়োগের প্রথাটিও বিট্রিশ গভর্নমেন্ট চিরস্থায়ী করে রাখতে চেয়েছেন। সুতরাং ভারতের রাজনৈতিক দলগুলোই যদি কতগুলো নীতি ও শর্ত নিজেরাই উল্লেখ করে সেই নীতি ও শর্ত অনুযায়ী ভাইসরয়ের কর্তব্য পালনে মাউন্টব্যাটেনকে খোলাখুলিভাবে আমন্ত্রণ করেন, তবে মাউন্টব্যাটেনের ভাইসরয় পদ গ্রহণের ব্যাপার সম্পর্কে ওইসব ভ্রান্ত ধারণা দেখা দিতে পারবে না। ভারতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ হতে নতুন ভাইসরয়ের জন্য আমন্ত্রণ উত্থাপিত হলে তবেই মাউন্টব্যাটেন ভাইসরয়ের পদ গ্রহণ করবেন, এ-শর্ত করতে চেয়েছিলেন মাউন্টব্যাটেন। কিন্তু এটলি মাউন্টব্যাটেনের এই প্রস্তাবের সকল দিক ব্যাখ্যা করে এ অভিমত দিলেন যে, এ প্রস্তাব বাস্তবে সম্ভবপর হতে পারে না। তবে এই সঙ্গে আর একটি নীতি সম্পূর্ণরূপেই স্বীকার করে নিলেন এটলি। নির্দিষ্ট একটি তারিখের মধ্যেই ভারতে ব্রিটিশরাজের অবসান ঘটিয়ে দিতে হবে, ভারতের রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের কোনো পরিকল্পনা গ্রহণে সম্মত হোক বা না হোক। তাছাড়া, যদি ভারতীয় রাজনৈতিক দলগুলো ওই নির্দিষ্ট তারিখের পূর্বেই একমত হয়ে ভারতের জন্য একটা নতুন শাসনতন্ত্র রচনা করতে এবং সে শাসনতন্ত্র মেনে নিতে রাজি হয়ে যায়, তবে নির্দিষ্ট তারিখের পূর্বেই ক্ষমতা হস্তান্তর করে দেওয়া হবে।
লন্ডন, সোমবার, ১৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৭ : আর একটি দাবি করেছেন মাউন্টব্যাটেন এবং গভর্নমেন্ট মাউন্টব্যাটেনের এ দাবিও মেনে নিয়েছেন। দিল্লিতে লর্ড ওয়েভেল এখন যে ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের কর্মচারীদের নিয়ে কাজ চালাচ্ছেন, তাঁরা যথেষ্ট সুদক্ষ হলেও মাত্র সেই স্টাফের সাহায্যে মাউন্টব্যাটেন তাঁর কাজ ভালোভাবে চালিয়ে যেতে পারবেন বলে মনে করছেন না। মাউন্টব্যাটেনকে ভারতে গিয়ে এমন এক কাজের ভার নিতে হবে, সামরিক এবং রাজনৈতিক গুরুত্বের দিক দিয়ে তার চেয়ে বৃহৎ কোনো কাজের দায়িত্ব এর আগে কোনো ভাইসরয়কেই গ্রহণ করতে হয়নি। তা ছাড়া, সাধারণত একজন ভাইসরয়ের জন্য নির্দিষ্ট কর্মকালের মাত্র এক চতুর্থাংশকালের মধ্যেই নতুন ভাইসরয় মাউন্টব্যাটেনকে সকল কর্তব্য সমাপ্ত করে ফেলার দায়িত্ব অর্পণ করা হচ্ছে। সুতরাং মাউন্টব্যাটেনের জন্য অতিরিক্ত স্টাফ চাই। গভর্নমেন্ট এ প্রস্তাব মেনে নিলেন।
দিল্লির ভাইসরয় ভবনে মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে তাঁর অতিরিক্ত স্টাফ হিসাবে যাঁরা কাজ করবেন, তাঁদের নামও জানা গেল। কয়েকটি নতুন পদ সৃষ্টি করছেন মাউন্টব্যাটেন, ইতোপূর্বে দিল্লির ভাইসরয় ভবনে এ ধরনের পদাধিকারী কোনো কর্মচারী ছিল না। ভাইসরয়ের চিফ অব স্টাফ বা প্রধান কর্মাধ্যক্ষের পদ গ্রহণ করতে রাজি হয়েছে লর্ড ইস্মে। প্রধান সেক্রেটারী হবেন স্যার এরিক মিয়েভিল। ভের্নন আর্কিন ক্রামকে কনফারেন্স সেক্রেটারি বা সম্মেলন সচিবের পদে নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ব্রকমান এবং নিকস্ উভয়েই ১৯৪৩ সালে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া কমান্ডের সৈন্যাধ্যক্ষ মাউন্টব্যাটেনের অধীনে কাজ করেছিলেন। ব্রকমান ছিলেন নৌসচিব এবং নিকস্ ছিলেন নৌ-সৈন্যের পদস্থ কর্মচারী। এরা দুজনে যথাক্রমে ভাইসরয় মাউন্টব্যাটেনের পার্সোনাল ও ডেপুটি পার্সোনাল সেক্রেটারি পদে নিযুক্ত হলেন।
আমি ছিলাম দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া কমান্ডের জনৈক উইং কমান্ডার। মাউন্টব্যাটেনেরই পরিচালনাধীনে চার বছর কাজ করেছি। এখন আমার কাজ নেই। অল্পদিন হলো সামরিক কর্মজীবন থেকে ছাড়া পেয়েছি, কারণ যুদ্ধোত্তর সৈন্য বিদায় করার পালা আরম্ভ হয়ে গিয়েছে। মাউন্টব্যাটেনের ইচ্ছা, আমি তাঁর ‘প্রেস অ্যাটাশে বা সংবাদ-কর্মচারীর পদ গ্রহণ করি। সংবাদ সংগ্রহ, পরিবেশন এবং প্রচারের জন্যও এই রকম একটি কর্তব্যের পদ ভাইসরয়ের স্টাফের মধ্যে রাখার যথেষ্ট প্রয়োজনীয়তা আছে বলেই অনুভব করছিলেন মাউন্টব্যাটেন।
লন্ডন, বৃহস্পতিবার, ২০ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৭: আমি রাজি হয়েছি। মাউন্টব্যাটেনের চেস্টার স্ট্রিটের বাড়িতে আর একবার এসে তাঁকে আমার চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দিয়ে এসেছি। নতুন ভাইসরয় মাউন্টব্যাটেনের সংবাদ কর্মচারীর পদে আমিই কাজ করব।
মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে একই গাড়িতে বসে ফেব্রুয়ারির এ রুক্ষ অপরাহ্নে বরফ ছড়ানো পথের উপর দিয়ে বাকিংহামশায়ারের দিকে যাচ্ছিলাম। মাউন্টব্যাটেন বললেন—চার্চিল অসন্তুষ্ট হয়েছেন। চার্চিল এ অভিযোগ করে বেড়াচ্ছেন যে, সোস্যালিস্ট দল নিজেদের ব্যর্থতার অপরাধ ঢাকার জন্য মাউন্টব্যাটেনের সুনামের আড়ালে আশ্রয় গ্রহণ করার চেষ্টা করছেন।
চেস্টার স্ট্রিটের বাড়িতে ফিরে এলাম। এসেই শুনলাম, কমন্স সভায় এটলি নতুন ভাইসরয়ের নাম ঘোষণা করে দিয়েছেন। সপ্রশংস ধ্বনির দ্বারা এ ঘোষণা কমন্স সভায় অভিনন্দিত হয়েছে।
আরও শুনলাম, কমন্স সভায় চার্চিলের প্রতিবাদে একটা চাঞ্চল্যও সৃষ্টি হয়েছিল। ভারতের ভাইসরয় পদে মাউন্টব্যাটেনের নিয়োগের সিদ্ধান্ত যেভাবে সমালোচনা করেছেন চার্চিল, তাতে এটুকুই শুধু প্রমাণিত হয় যে, তিনি গভর্নমেন্টের এ নীতির ভেতর থেকে তাঁর নিজের রাজনৈতিক স্বার্থ প্রতিষ্ঠার সুযোগ টেনে বের করার জন্য তৈরি হয়েছেন।
ভারতের নতুন ভাইসরয়ের নিয়োগ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থাগত যেসব নির্দেশও ঘোষণা করেছেন এটলি, সেসব নির্দেশ বস্তুত নতুন ভাইসরয়কে স্বাচ্ছন্দে কাজ করার এক উদার অবকাশ দিয়েছে। যদি ভারতে ভারতীয় জনসাধারণের পূর্ণ প্রতিনিধিত্বে গঠিত গণপরিষদ একমত হয়ে ১৯৪৮ সালের জুন মাসের মধ্যে কোনো শাসনতন্ত্র রচনা করে উঠতে না পারেন, তবে ব্রিটিশ গভর্নমেন্টকে আবার চিন্তা করে নির্ণয় করতে হবে, নির্দিষ্ট তারিখে কার উপর ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে? “ব্রিটিশ ভারতের কোনো একটি কেন্দ্রীয় সরকারকে কিংবা বিভিন্ন কয়েকটি অঞ্চলে বর্তমানে প্রচলিত প্রাদেশিক সরকারগুলোকে অথবা ভারতীয় জনসাধারণের সর্বোত্তম কল্যাণের দিকে লক্ষ্য রেখে অন্য কোনো যুক্তিসঙ্গত পন্থায় ক্ষমতা অর্পণের ব্যবস্থা করবেন ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট।”
কমন্স সভার এই অধিবেশনে দেশিয় রাজ্যগুলোর সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী এটলি স্পষ্ট করেই বললেন যে, অধিরাজক ক্ষমতা কোনো নতুন গভর্নমেন্টের উপর অর্পণ করা হবে না।
ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য নির্দিষ্ট তারিখের ঘোষণা শুনে চমকে উঠলেন রক্ষণশীল ‘কনজারভেটিভ’ দল।
লন্ডন, বুধবার, ৫ মার্চ, ১৯৪৭: যেমন পার্লামেন্টের অধিবেশনের বিতর্কে তেমনই অন্যান্য সূত্রেও ব্রিটিশ জনমতের পরিচয় জানবার সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে। ভারতে ক্ষমতা হস্তান্তরের এই আয়োজন এবং ব্যবস্থাকে কে কী চোখে দেখেছেন?
কমন্স সভার বিতর্কে ক্রীপস্ যদিও ক্ষমতা হস্তান্তরের পর্ব চুকিয়ে দেবার জন্য একটা সময়সীমা বেধে দেবার প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে বিশেষ জোর দিয়ে কিছু বললেন না, কিন্তু তিনি এ অভিমত প্রকাশ করলেন যে, ১৯৪৮ সালের পরে ব্রিটিশের ভারতে অবস্থান সমর্থন করার মতো আর কোনো যুক্তি নেই। সামরিক এবং শাসনিক, উভয় কারণেই ১৯৪৮ সালের পরেও ব্রিটিশের পক্ষে ভারতে থাকা আর উচিত হবে না। লর্ড ওয়েভেল সম্বন্ধে ক্রীপস্ একটি কথাও বললেন না। ওয়েভেল সম্বন্ধে তাঁর এই নীরবতা বাস্তবিকই দুঃখের বিষয়। কারণ ওয়েভেল সম্বন্ধে একটা উল্লেখ পর্যন্ত করতে ভুলে যাওয়ার এই ব্যাপার সেই সন্দেহই আরও বেশি দৃঢ় করে তুলবে যে, বিদায়ী ভাইসরয় ওয়েভেল এবং এটলি-গভর্নমেন্টের মধ্যে প্রবল মতবিরোধ ঘটেছে।
লন্ডন, বৃহস্পতিবার, ৬ মার্চ, ১৯৪৭: কমন্স সভার বিতর্ক আজ চার্চিলের তপ্ত কথার ঝলক লেগে অস্থির হয়ে উঠল। এ রকমই হবে বলে আশা করেছিলাম। ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের এ পরিকল্পনাকে তিনি পূর্বানুসৃত নীতির ভয়ঙ্কর অন্যথাচরণ বলে উল্লেখ করলেন। শেষে লর্ড ওয়েভেল সম্বন্ধে উল্লেখ করলেন চার্চিল। তিনি বললেন—’আমি বলতে চাই, ভাইসরয় লর্ড ওয়েভেলকে বস্তুত পদচ্যুত করেছেন গভর্নমেন্ট। ওয়েভেলের পক্ষে সমর্থনের কোনো দায় আমার নেই। আমি শুধু বলতে চাই, আসলে ভুল করেছেন গভর্নমেন্ট এবং ওয়েভেলকে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় এ ভ্রান্ত গভর্নমেন্টেরই প্রতিনিধিত্ব করতে হয়েছে।’
নতুন ভাইসরয় মাউন্টব্যাটেন সম্পর্কেও উল্লেখ করে চার্চিল বললেন-এ সমস্ত ব্যাপারের স্বরূপ দেখে আমি বলতে বাধ্য যে, গভর্নমেন্ট এখন মহাযুদ্ধের যত কৃতী ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব ও খ্যাতিকে নিজেদের অকৃতিত্ব ঢাকার কাজে লাগাবার পন্থা গ্রহণ করেছেন।’
ভবিষ্যতবাণীও করলেন চার্চিল—‘ভারতকে দুভাগে ভাগ করার জন্য প্রস্তুত হয়েছেন গভর্নমেন্ট । শুধু দুভাগ নয়, এলোমেলোভাবে ভারতকে টুকরো টুকরো করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য সময়সীমা ঘোষণা করায় কোনো সুফল দেখা দেবে না। ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর কাণ্ডজ্ঞান জাগিয়ে তুলতে সাহায্য না করে নির্দিষ্ট সময়সীমার এই ঘোষণা বরং তাদের দিক থেকে নানা বিভিন্ন ও পরস্পর বিরুদ্ধ দাবি উপস্থিত করার প্ররোচনা হয়ে উঠবে। ভারতের এসব ‘পার্টি’ বলে থাকে যে, তারা হলো ভারতীয় জনসাধারণের প্রতিনিধি। এ দাবি একেবারে ভূয়া ও ভিত্তিহীন। ভারতের এসব পার্টির হাতে ক্ষমতা অর্পণ করার অর্থ কতগুলো খড়ের তৈরি মানুষের হাতে ক্ষমতা অর্পণ করা। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এসব পার্টির অস্তিত্বের লেশও খুঁজে পাওয়া যাবে না।’
চার্চিলের সমালোচনার উত্তর দিলেন এটলি। ওয়েভেল প্রসঙ্গ সম্বন্ধে চার্চিলের উক্তির প্রতিবাদ করলেন। ভারতীয় নেতাদের যোগ্যতার প্রসঙ্গে এটলি বললেন—‘দীর্ঘকাল হতে ভারতের শাসন পরিচালনায় আমরা যেসব ‘রিফর্ম’ বা সংস্কারব্যবস্থা প্রবর্তন করে এসেছি, তার মধ্যে একটা বড়ো ভুল ছিল। আমরা ভারতীয় সমাজকে দায়িত্ব গ্রহণের শিক্ষা না দিয়ে বস্তুত দায়িত্বহীন হবার শিক্ষাই দিয়ে এসেছি। প্রত্যেক ভারতীয় রাজনৈতিক নেতা এ যাবৎ গভর্নমেন্ট বিরোধী হয়ে থাকতেই বাধ্য হয়েছেন এবং অভিজ্ঞতা থেকেই বলা যায়, তাঁদের পক্ষে সর্বদা এভাবে বিরোধী হয়ে থাকার ফল ভালো হতে পারে না।’
ভারতের মাইনরিটি সমাজগুলোর প্রতি ব্রিটিশের দায়িত্বের প্রসঙ্গেও কতকগুলো মন্তব্য করলেন এটলি। এটলি বললেন- বলা হয়ে থাকে যে, ভারতের অস্পৃশ্য সমাজরা একটি মাইনরিটি এবং তাদের প্রতি ব্রিটিশের একটা দায়িত্ব আছে। অভিযোগ করা হয়েছে যে, বর্তমান ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট সেই ‘ট্রাস্ট’ তথা নৈতিক দায়িত্ব এখন অস্বীকার করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। এটলি তাঁর মন্তব্য করলেন—এই ট্রাস্ট তথা দায়িত্ব তো অনেককাল হতেই রয়েছে। এতদিনের মধ্যে সে দায়িত্ব পালন করা হয়নি কেন? যদি এ রকম কোনো দায়িত্ব আছে বলেই ধরা হয়, তবে বলতে হবে যে, সে দায়িত্ব আরও আগেই পালন করা উচিত ছিল। এখন ঠিক যে সময়ে আমরা ভারতে আমাদের শাসনেরই অবসান করার জন্য উদ্যোগী হয়েছি, সে সময়ে ট্রাস্টের প্রতি অবহেলা বা মাইনরিটির প্রতি বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগ উত্থাপন করার কোনো অর্থ হয় না।’
বক্তব্যের উপসংহারে এটলি বললেন—’নতুন ভাইসরয়ের প্রতি শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করছি আমি, তাঁর মিশন সফল হোক। ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের কোনো বিশ্বাসভঙ্গের পরিকল্পনা নিয়ে নয়, ভারতে এক সদুদ্দেশ্য সাধনেরই মিশন সফল করে তুলবার জন্য নিযুক্ত হয়েছেন নতুন ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন।
এটলি যদিও এই আবেদন করেছিলেন যে, পার্লামেন্টের সকল দলের পক্ষ থেকেই সম্মিলিতভাবে এই শুভেচ্ছার বাণী ভারতের জনসাধারণ এবং ভারতীয় নেতাদের উদ্দেশ্যে ঘোষিত হোক, তবুও এই আবেদন গভর্নমেন্টের ঘোষণা ও নীতিকে দলীয় অভিমতের দ্বন্দ্ব থেকে মুক্ত রাখতে সমর্থ হলো না। প্রস্তাব সম্পর্কে ভোট দাবি করা হলো। গভর্নমেন্টের নীতি এবং আমাদের মিশনের পক্ষে সমর্থন জানিয়ে তিন শত সাঁইত্রিশ এবং বিরুদ্ধে একশত পঁচাশি ভোট প্রদত্ত হলো। ভোটের দাবি এবং মি. চার্চিলের কতগুলো মন্তব্যে বিশেষ অপ্রসন্নতা ব্যক্ত হতে দেখে এ প্রস্তাব সম্বন্ধে গভর্নমেন্ট ও বিরোধীপক্ষের মধ্যে অভিমতের ব্যবধান যত বড়ো বলে মনে হতে পারে, আসলে সে ব্যবধান যে তার তুলনায় অনেক কম, সেটা এই ঐতিহাসিক বিতর্ক শোনার পর কেউ অনুভব না করে পারবেন না।
লন্ডন, সোমবার, ১০ মার্চ, ১৯৪৭: ভারত মাউন্টব্যাটেনের কাছে একেবারে নতুন কোনো দেশ নয়। ভারত সম্বন্ধে তাঁর কিছু অভিজ্ঞতাও আছে। প্রথম তিনি ভারতে গিয়েছিলেন ১৯২১ সালে, প্রিন্স অব ওয়েলসের পার্শ্বর্চর অফিসার হয়ে। তারপর ১৯৪৩ সালের অক্টোবর থেকে ১৯৪৪ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত মিত্রশক্তির সম্মিলিত কমান্ডের সুপ্রীম কমান্ডর হিসাবে তিনি দিল্লিতেই তাঁর প্রধান দপ্তর রেখেছিলেন। তারপর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া কমান্ডের অধ্যক্ষ হিসাবে মালয়ে তিনি প্রধান দপ্তর স্থাপন করলেন। এখানেই ভারতের জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে মাউন্টব্যাটেনের প্রথম সাক্ষাৎ। মালয়ের অন্যতম সংখ্যা প্রধান সমাজ ভারতীয়দের অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য লর্ড ওয়েভেলের প্রস্তাব অনুসারে নেহরু সে সময় মালয়ে একবার এসেছিলেন।
মাউন্টব্যাটেন ও নেহরুর সেই প্রথম সাক্ষাৎকারের স্মৃতি এখনও বেশ স্পষ্টই আমার মনে আছে। খুবই প্রীতিপূর্ণ হয়েছে এ সাক্ষাৎকার। স্পষ্টই বুঝতে পারা গিয়েছিল, উভয়েরই মনে উভয়ের সম্বন্ধে ব্যক্তিগত শ্রদ্ধার ভাব তখনই বেশ নিবিড় হয়ে দেখা দিয়েছিল।
মাউন্টব্যাটেন তাঁর নতুন দায়িত্ব সম্পর্কে আর একটা ব্যবস্থাগত বিষয়েও কিছুটা পরিবর্তন করে নিলেন। ‘গভর্নর জেনারেলের কার্যবিধির নির্দেশিকায় উল্লিখিত নির্দেশগুলোর কিছু কিছু পরিবর্তন। বর্তমানে যে নির্দেশিকা প্রচলিত রয়েছে, সে নির্দেশিকা ১৯৩৫ সালে ভারত-শাসন বিধানের লক্ষ্য সফল করার উদ্দেশ্য নিয়ে রচিত। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সঙ্কল্পকে কার্যে পরিণত করার দায়িত্বই এই নির্দেশিকায় গভর্নর-জেনারেলের দায়িত্বরূপে উল্লিখিত রয়েছে। কিন্তু এই নির্দেশিকা এখন গভর্নমেন্টের গৃহীত নতুন ভারত-নীতির সঙ্গে খাপ খায় না। সুতরাং এর কিছু কিছু পরিবর্তন না করে নিলে চলে না। এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ নতুন এক নির্দেশিকা রচিত হওয়াই উচিত ছিল। কিন্তু মাউন্টব্যাটেন এতটা দাবি করতে চান না এবং কোনো প্রয়োজনও আছে বলে মনে করেন না। গভর্নমেন্টও মনে করছেন যে, বর্তমান অবস্থা এবং ভারত সম্পর্কে নতুন আইন পার্লামেন্টে গৃহীত না হওয়া পর্যন্ত প্রচলিত নির্দেশিকা নতুন গভর্নর জেনারেল মাউন্টব্যাটেনের কাজের পক্ষে কোনো ব্যক্তিগত অসুবিধা সৃষ্টি করবে না। সুতরাং একেবারে নতুন একটা নির্দেশিকা রচনা ছেড়ে দিয়ে, মাউন্টব্যাটেনের কাজের সুবিধার জন্য নীতি-নিয়ামক কতগুলো নতুন কর্মসূত্রের উল্লেখ করে একটি পত্র মাউন্টব্যাটেনকে যদি গভর্নমেন্ট দেন, তবেই ব্যবস্থার দিক দিয়ে আর কোনো অসামঞ্জস্য থাকে না। এই দাবিই করলেন মাউন্টব্যাটেন। গভর্নমেন্টও সম্মত হলেন। পত্রে সুস্পষ্ট কতগুলো কর্মসূত্রের উল্লেখ করে মাউন্টব্যাটেনকে প্রদান করা হলো
১. ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য হলো ব্রিটিশ-ভারতের প্রদেশগুলো এবং দেশিয় রাজ্যগুলোকে নিয়ে ভারতে একটি এককেন্দ্রিক গভর্নমেন্ট প্রতিষ্ঠিত করা। যদি সম্ভব হয়, তবে এ নতুন গভর্নমেন্টকে ব্রিটিশ কমনওয়েলথের অন্তর্ভুক্ত রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। এ নতুন এককেন্দ্রিক গভর্নমেন্ট প্রতিষ্ঠিত করার পন্থা হলো, মন্ত্রি-মিশনের পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রতিষ্ঠিত গণপরিষদ। ভারতের সকল রাজনৈতিক দলকে এ পরিকল্পনায় সম্মত করার জন্য মাউন্টব্যাটেনও তাঁর সাধ্যমতো সকল চেষ্টা করবেন। যদি সম্ভব হয়, তবে ব্রিটিশ কমনওয়েলথের মধ্যে’- এ কথা কয়টি মাউন্টব্যাটেনেরই বিশেষ অনুরোধ অনুসারে উল্লেখ করা হয়েছে।
২. মন্ত্রি-মিশনের পরিকল্পনা একমাত্র ব্রিটিশ-ভারতের সম্পর্কে প্রযোজ্য এবং এ পরিকল্পনা কার্যত প্রযোজ্য হতে পারে, যদি ভারতের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল ওই পরিকল্পনা সমর্থন ও গ্রহণ করতে রাজি হন। যখন এ নীতিই ঘোষণা করা হয়েছে, তখন ওই দুই প্রধান রাজনৈতিক দলকে মন্ত্রি মিশনের পরিকল্পনা গ্রহণে বাধ্য করার কোনো কথা আর উঠতে পারে না। যদি আগামী ১ অক্টোবর পর্যন্ত অবস্থার পরিবর্তনের জন্য অপেক্ষা করে মাউন্টব্যাটেন বুঝতে পারেন যে, এককেন্দ্রিক গভর্নমেন্ট প্রতিষ্ঠার ভিত্তিতে দুই রাজনৈতিক দলের মতৈক্য সৃষ্টির কোনো ভরসা আর নেই তবে তিনি ব্রিটিশ গভর্নমেন্টকে জানাবেন, নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য কী ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।
৩. দেশিয় রাজ্যগুলোর রাজা তথা শাসকবর্গকে মাউন্টব্যাটেন এ কথা বোঝাবার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন যে, প্রত্যেক দেশিয় নৃপতির পক্ষে এখন নিজ নিজ রাজ্যে কোনো না কোনো প্রকারের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা দ্রুত প্রবর্তনের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। তাছাড়া, ভবিষ্যতের নতুন গভর্নমেন্টের সঙ্গে দেশিয় রাজারা যে ধরনের সম্পর্ক স্থাপন করবেন, সে সম্বন্ধে একটা সঙ্গত ও ন্যায়সম্মত ব্যবস্থা বর্তমান ব্রিটিশ ভারতের রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গেই আলোচনা করে উদ্ভাবন করতে হবে—এই নীতির প্রতি লক্ষ্য রেখেই মাউন্টব্যাটেন চেষ্টা করে যাবেন।
৪. ব্রিটিশ-ভারতে প্রশাসনিক ব্যাপারে মাউন্টব্যাটেন যে নীতি অনুসারে কাজ করবেন, তাকে এক কথায় বলা যায় ভারতীয়দের ঘনিষ্ঠতম সহযোগিতার সাহায্যে প্রশাসনিক ব্যবস্থা পরিচালনা করা।
৫. ভারতের দেশরক্ষা, অর্থাৎ সামরিক নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় অবস্থা ও ব্যবস্থার প্রতি লক্ষ্য রেখেই ক্ষমতা হস্তান্তরের আয়োজন করতে হবে। ভারতীয় বাহিনীর অখণ্ডতা অক্ষুণ্ন রাখার প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব সম্বন্ধে ভারতীয় নেতাদের সচেতন করবেন মাউন্টব্যাটেন। তাছাড়া, ভারত মহাসাগরের রক্ষা ব্যবস্থায় বর্তমানের মতো ভবিষ্যতেও ভারত ও ব্রিটিশের মধ্যে সহযোগিতা রক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধেও ভারতীয় নেতাদের মনে অনুকূল ধারণা সৃষ্টির জন্য মাউন্টব্যাটেন যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন।
মাউন্টব্যাটেন ছাড়া আর কোনো ভাইসরয়কে ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের কাছ থেকে কর্ম নিয়ামক এ রকম উদার অথচ দুরূহ নির্দেশ এর আগে কখনও গ্রহণ করতে হয়নি।
লন্ডন, মঙ্গলবার, ১১ মার্চ, ১৯৪৭: মাউন্টব্যাটেন ইতোমধ্যেই গভর্নমেন্ট পক্ষের প্রধানদের সঙ্গে অনেকবার সাক্ষাৎ করেছেন এবং অনেক আলোচনাও করেছেন। ইংল্যান্ড-নৃপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং আলোচনা হয়ে গিয়েছে। যেমন: এটলি, ক্রীপস, আলেকজান্ডার ও পেথিক লরেন্সের সঙ্গে দেখা করেছেন, তেমনই বিরোধী পক্ষের প্রধানদের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করতে তিনি ভোলেননি।
আজ সন্ধ্যায় আমার ফ্ল্যাটে মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে লর্ড স্যামুয়েলের সাক্ষাৎ হলো। সাক্ষাতের ব্যবস্থাটা আমিই করেছিলাম। আলোচনার বেশির ভাগ সময় মাউন্টব্যাটেনই কথা বললেন এবং স্যামুয়েল বেশির ভাগ সময় চুপ করে শুনলেন।
মাউন্টব্যাটেন বললেন, বিরোধী পক্ষ থেকে এমন অভিযোগ করার কোনো যুক্তি নেই যে, আমি একমাত্র এটলির ইচ্ছা অনুসারেই ভাইসরয়ের পদে নিযুক্ত হয়েছি। ইংল্যান্ড-নৃপতি আমার এ নিয়োগ আন্তরিকভাবে সমর্থন করেছেন। এমনকি, ব্যক্তিগতভাবে অনুরোধ করে ইংল্যান্ড-নৃপতি আমাকে জানিয়েছেন যে, বস্তুত একটা জাতীয় কর্তব্য হিসাবেই আমার পক্ষে এই পদ গ্রহণ করা উচিত ছিল এবং উচিত হয়েছে। সুতরাং আমাকে শুধু ‘প্রধানমন্ত্রী’ নিয়োগ করেছেন, বিরোধীদের পক্ষে একথা বলা নিতান্তই অন্যায়। ক্ষমতা হস্তান্তরের সময়সীমা নির্দিষ্ট করে দেওয়াতেই বা কী অন্যায় হয়েছে? স্বয়ং ওয়েভেলও এই মত পোষণ করেন যে, ১৯৪৮ সালের জুন মাস পর্যন্ত সময়সীমা বেধে দেওয়া ঠিকই হয়েছে।
মাউন্টব্যাটেন বললেন, অবস্থার অবনতি একেবারে চরম হবার আগেই পরিবর্তনের উদ্যোগ আরম্ভ করে ফেলাই ভালো। বিহার ও বাংলা অনেক দাঙ্গা হাঙ্গামার বিষ হজম করে এখন কিছুটা শান্ত হয়েছে। এ দুপ্রদেশে অশান্তির সম্ভাবনা কতকটা নিরুদ্ধ হয়েছে বলে মনে হয়। কিন্তু পাঞ্জাবে একটা সঙ্কট অপরিহার্য হয়ে উঠেছে বলে মনে হচ্ছে। পাঞ্জাবের ‘কোয়ালিশন’ প্রধানমন্ত্রী মুসলিম লীগের হাতে নিহত হবার ভয়ে গত পাঁচ মাস ধরে প্রতি রাত্রিতে গৃহ বদল করে লুকিয়ে থাকছেন। উত্তর-পশ্চিম সীমান্তেও হাঙ্গামা হবে বলে মাউন্টব্যাটেন আশঙ্কা প্রকাশ করলেন।
লর্ড স্যামুয়েলের কাছে জানতে চাইলেন মাউন্টব্যাটেন—আপনি কী বলেন? স্যামুয়েল বললেন যে, ভারতের সঙ্গে ব্রিটিশ-নৃপতির সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখতেই তিনি ইচ্ছা করেন। ক্ষমতা হস্তান্তরের পরেও ভারতের সঙ্গে ব্রিটিশ নৃপতির নিয়মতান্ত্রিক সম্পর্ক যেন বিচ্ছিন্ন না হয়। এর জন্য যদি ভারতে ভাইসরয় নিয়োগের প্রথাটি প্রচলিত রাখতে হয়, তবে তা-ই করা উচিত।
লন্ডন, বৃহস্পতিবার, ১৩ মার্চ, ১৯৪৭: ভারতে রওনা হবার আগে আমিও আমার পালনীয় কর্তব্যের কিছু কিছু করতে আরম্ভ করে দিয়েছি। এদিকের বিভিন্ন রাজনৈতিক মহলের অভিমত সংগ্রহ করেছি। স্যাভয়ে স্যার জর্জ ও লেডি শৃস্টারের সঙ্গে বসে একদিন ভোজন করাও হয়েছে। লর্ড হ্যালিফাক্স যখন ভারতে ভাইসরয় ছিলেন, তখন শূস্টার ছিলেন ভাইসরয়ের শাসন পরিষদে ফাইন্যান্স মেম্বার তথা অর্থ-সদস্য।
শৃস্টার বললেন, ভারতে রাজনৈতিক অবস্থার এ রকম শোচনীয়তার প্রধান কারণ এই যে, মুসলমানদের মধ্যে কোনো যোগ্য নেতা নেই। প্রথম শ্রেণির নেতা মুসলমানদের মধ্যে দেখা যায় না। শূস্টার বললেন, ১৯৩০ সালের গোলটেবিল বৈঠকে জিন্না তাঁর সম্পূর্ণ অযোগ্যতা ও ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছিলেন। এমনই ব্যর্থ হন যে, বৈঠকের পর কিছুকাল আর ভারতেই ফিরে গেলেন না জিন্না। স্কটল্যান্ডের এক নিভৃতে তাঁর ভগ্নীর সঙ্গে বস্তুত এক প্রকারের অবসর জীবন যাপন করতে আরম্ভ করেছিলেন। সে সময় শৃস্টারের সঙ্গে জিন্না ভ্রাতা-ভগ্নীর কয়েকবার দেখাও হয়েছিল।
‘পাঞ্জাব হলো একটি ট্রাজেডি’—শৃস্টার আক্ষেপ করলেন। সেখানে বিগত পাঁচ বছর ধরে যে রিফর্ম ব্যবস্থা এবং সাম্প্রদায়িক সহযোগিতা শান্তিপূর্ণ অবস্থা সৃষ্টি করে রেখেছিল, সে সবই এতদিনে মুসলিম লীগের উন্মত্ততার বেদিতে বলি দেওয়া হলো।
ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের ভারত-সচিবের নিযুক্ত কর্মচারীদের (সেক্রেটারি অব্ স্টেট সার্ভিসেস্) ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে মাউন্টব্যাটেন চিন্তা করছেন। ভারতীয় সিভিল ও ভারতীয় মিলিটারি সার্ভিসে শুধু ব্রিটিশ কর্মচারীই নয়, ভারতীয় কর্মচারী ও নিযুক্ত রয়েছে। ভারতে নতুন গভর্নমেন্ট প্রতিষ্ঠিত হবার পর এদের অবস্থা ও মর্যাদা কী রকম হবে?
এই সার্ভিসের কর্মচারীদের স্বার্থরক্ষা সম্বন্ধে গভর্নমেন্ট এর আগেই কতগুলো প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। প্রথম হলো, ভারতের শাসনতন্ত্রের পরিবর্তনের কারণে এই শ্রেণির সার্ভিসের অবসান হলে প্রত্যেক কর্মচারীকেই ক্ষতিপূরণস্বরূপ থোকা টাকা দিতে হবে। দ্বিতীয়, নতুন গভর্নমেন্টে এই কর্মচারীরা কাজ করতে রাজি হোক বা না হোক, ভারত-সচিবের সঙ্গে তাঁদের আর কোনো চুক্তিগত বাধ্যবাধকতা থাকবে না। সুতরাং নতুন গভর্নমেন্টের কাজে নিযুক্ত থাকলে এবং না থাকলেও প্রত্যেকেই ক্ষতিপূরণস্বরূপ টাকা পাবেন। তৃতীয়, নতুন গভর্নমেন্টের অধীনে কাজ করতে কাউকে বাধ্য করা হবে না। ভারত গভর্নমেন্ট যদি কম হারে বেতন দানের ব্যবস্থা করেন, তবে আপত্তি করতে হবে। এবং এসব প্রতিশ্রুতি পূরণের ব্যাপারে ব্রিটিশ ও ভারতীয় কর্মচারীদের মধ্যে কোনো পার্থক্য করা হবে না।
অভ্যর্থনাসভায় তারই সত্যিতা প্রমাণিত হতে দেখলাম। আমাদের কোনো ধারণাই ছিল না যে, আজকের এ সন্ধ্যার অভ্যর্থনা সভাতেই আমাদের উপর সাংবাদিকদের কৌতূহলের আক্রমণ এমন অবাধভাবে ছেড়ে দেবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সংবাদ-চিত্র গ্রহণের উপযোগী করে সভাকে প্রখর আলোকে প্লাবিত করে রাখা হয়েছিল। বিভিন্ন ভারতীয় সংবাদপত্রের প্রায় এক ডজন লন্ডন সংবাদদাতা মাউন্টব্যাটেনকে আটকে ধরলেন এবং অতি-পরিশ্রমী মৌমাছির ঝাঁকের মতো নানা প্রশ্নের গুঞ্জন তুলে সমস্তক্ষণ মাউন্টব্যাটেনকে ঘিরে রাখলেন। নিমন্ত্রণকর্তা ও গৃহস্বামী স্যার স্যামুয়েল এই আক্রমণ থেকে মাউন্টব্যাটেনকে উদ্ধারের জন্য একটুও চেষ্টা করলেন না। একজন অত্যুৎসাহী রিপোর্টার মাউন্টব্যাটেনকে প্রশ্ন করলেন- আপনি কী কখনও কার্ল মার্কস পড়েছেন? তার পরেই রিপোর্টার মহাশয় মাউন্টব্যাটেনকে এ আশ্বাসবাণী শোনালেন যে, মাউন্টব্যাটেনের ভাইসরয়ের পদে নিয়োগ তিনি সমর্থন করেন, কারণ মাউন্টব্যাটেনের মতো একজন অ্যাডমিরালই ভারত থেকে ব্রিটিশদের সমুদ্রপথে ব্রিটেনে অপসারণ করার জন্য সবচেয়ে ভালোরকম একটা ব্যবস্থা করতে পারবেন। এ বিষয়ে রিপোর্টার মহাশয়ের মনে কোনো সন্দেহই নেই।
অভ্যর্থনা সভা থেকে ফেরার সময় মনে হলো, এ অভিজ্ঞতা থেকে মাউন্টব্যাটেন একটা শিক্ষা পেয়ে গিয়েছেন। মাউন্টব্যাটেন শুধু এ মন্তব্য করলেন—দেখতে হয় ও শিখতে হয়।
করাচি, শুক্রবার, ২১ মার্চ, ১৯৪৭: দশ ঘণ্টা সময় আকাশপথেই কাটিয়ে দিয়ে আমরা করাচি এসে পৌঁছলাম। যুদ্ধের সময় করাচির পথে যানবাহনের ভিড়ের যা চেহারা দেখেছিলাম, সে চেহারা এখন আর নেই। যানবাহনের চলাচল সে সময়ের তুলনায় আজ নিতান্তই ক্ষীণ হয়ে গিয়েছে। সব চেয়ে বেশি বিস্মিত হলাম ঠিক এখানেই অতীতের শোনা একটি সুরধ্বনিকে আজ আবার শুনতে পেয়ে। বিমান থেকে অবতরণ করেই শুনতে পেলাম বিং ক্রসবি’র রেকর্ড বাজছে—মুনলাইট বিকামস ইউ। ১৯৪৩ সালের অক্টোবর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া কমান্ডের দপ্তরে যোগদানের জন্য যাবার সময় যেদিন বিমান পথে ভারতের মাটিতে প্রথম এসে নেমেছিলাম, সেদিনও এ সংগীতের সুরধ্বনিই প্রথম কানে এসে পৌঁছেছিল।
Title | মিশন উইথ মাউন্টব্যাটেন |
Author | এনায়েত রসুল |
Publisher | অন্বেষা প্রকাশন |
Quality | হার্ডকভার |
ISBN | 9789847116570 |
Edition | 2nd Printed, 2017 |
Number of Pages | 478 |
Country | বাংলাদেশ |
Language | বাংলা |
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?