বইয়ের নাম: কেউ কেউ কথা রাখে
লেখক: মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন
প্রকাশনায়: বাতিঘর প্রকাশনী
প্রকাশকাল: ডিসেম্বর, ২০১৫
প্রচ্ছদ: ডিলান
পৃষ্ঠাসংখ্যা: ২৬৯
ব্যক্তিগত রেটিং: ৯/১০
কথা সবাই রাখে না। ভালোবাসা,ন্যায়বিচার, নীতি এসবের জন্য নিজের থেকেও ক্ষমতাসীন কারো সাথে লড়াই করার সাহস সবাই দেখায় না।তবে কেউ কেউ ঠিকই দেখায়,কেউ কেউ কথা রাখে।কিন্তু এই কথা রাখার গল্পটা নিজের সম্পূর্ণ অজানা দুটো ভিন্ন যুগে গিয়ে বলার সাহস রাখেন কয়জন লেখক? সেটা জানার জন্য পড়তে হবে মোহাম্মদ নাজিম উদ্দীন এর লেখা ” কেউ কেউ কথা রাখে ” বইটি।
বই পরিচিতিঃ
“রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনো খেতে আসেননি ” বইটা পড়েই মোহাম্মদ নাজিম উদ্দীন স্যারের লেখনী ও থ্রিলারের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম৷ তারই লেখা “কেউ কেউ কথা রাখে ” বইটি নিয়ে আশা ছিল তুঙ্গে। তবে একফোঁটাও নিরাশ হইনি। তবে এটি তার মৌলিক লেখা নয়,বরং একটি অ্যাডাপ্টেসন কপি।আর্জেন্টাইন ঔপন্যাসিক এদুয়ার্দো সাচারির “La pregunta de sus ojos” উপন্যাসকে এই বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সাজিয়ে নতুন রূপ দিয়েছেন তিনি। এজন্য অবশ্য শুরুর ভুমিকাতেই লিখে দিয়েছেন,
“পাঠককে বলবো, ‘কেউ কেউ কথা রাখে’ পুরোপুরি নিরীক্ষাধর্মী একটি কাজ। গল্পটি আমার যেমন ভালো লেগেছে তেমনি তাদেরও যদি ভালো লাগে তবে নিজেকে সার্থক মনে করবো।”
তবে চমৎকার লেখনশৈলী,প্লট,বর্ণনাভঙি,চরিত্রায়ন এর মাধ্যমে জয় করে নিয়েছেন পাঠকসমাজকে ।
বই পর্যালোচনাঃ
মোহাম্মদ নাজিম উদ্দীন এর লেখার একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তার উপন্যাস অধ্যায়-১ থেকে শুরু না হয়ে শুরু হয় ‘মুখবন্ধ’ দিয়ে৷ এই বইয়ের মুখবন্ধটা হলো নায়কের প্রকাশক,সালসাবিল আহমেদ এর চিঠি। শুরুতে অপ্রয়োজনীয় মনে হলেও শেষে এর গুরুত্ব বোঝা যায়৷
এরপর থেকে শুরু হয় মূল উপাখ্যান। প্রথমেই দেখা যায় একজন বয়সের ভারে নুয়ে পড়া লেখক একজন আইনজীবীর কাছে যান একটা বইয়ের পাণ্ডুলিপি নিয়ে৷ এরাই উপন্যাসের নায়ক নায়িকা । প্রথম প্রথম লেখকের চমৎকার বর্ণনাভঙ্গির জন্য প্রেমের উপন্যাস মনে হলেও এরপর শুরু হয় থ্রিলারের জগৎ। মিলি নামের একটি নববিবাহিতার ধর্ষণ ও খুনকে কেন্দ্র করে শুরু হয় কাহিনি৷
উপন্যাসের নায়ক একজন সৎ পুলিশ অফিসার। নায়ক,নায়িকা রামজিয়া,এসএম হায়দার,মিনহাজ,ইমতিয়াজ সকলের জীবন আবর্তিত হয়েছে এই ঘটনাকে ঘিরে।তার প্রায় দুযুগ পর এই ঘটনা নিয়েই নায়ক রচনা করে তার উপন্যাস “কেউ কথা রাখেনি” । এরপর কী হয়েছিল? মেয়েটির খুনীকে কী নায়ক ধরতে পেরেছিল? খুনীর পরিণতি কী হয়েছিল? “কেউ কথা রাখেনি” কিভাবে “কেউ কেউ কথা রাখে” হল?জানতে হলে পড়তে হবে বইটি।
ব্যক্তিগত অনুভূতি:
উপন্যাসটা উত্তম পুরুষে রচিত একটি অসাধারণ উপন্যাস। এর প্রতিটা কথাই এসেছে একজন ভীরু গোছের পুলিশ অফিসারের মুখ আর হৃদয় থেকে। বইটির প্রেক্ষাপট ছিল স্বাধীনতা পরবর্তী সময়টা৷ মাত্র স্বাধীন একটা দেশে সবাই যখন সংস্কারে ব্যস্ত তখনই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে কিছু শোষক নেতা ও তাদের চেলাপোলারা৷ বাড়ে খুন,রাহাজানি,ধর্ষণ। সেই যুগের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি খুব সাবলীল ভাবে বর্ণনা করেছেন লেখক মোহাম্মদ নাজিম উদ্দীন।
“কেউ কেউ কথা রাখে ” বইটি মোহাম্মদ নাজিম উদ্দীন এর অন্যতম সৃষ্টি। এখানে শুধু একটা খুনের তদন্তই ফুটে ওঠেনি,ফুটে উঠেছে দুটো যুগের মানুষের জীবন৷ একজন একরোখা প্রতিবাদী মুক্তিযোদ্ধা এসএম হায়দার এর চরিত্র যেমন পাঠককে উত্তেজিত করবে,তেমনি বইপ্রেমী, শান্ত-শিষ্ট নায়কের চরিত্রটা উপন্যাসে একিটি নতুন মাত্রা যোগ করবে। এটি একটি নিখাদ প্রেমের গল্প,অন্যায়ের বিরূদ্ধে প্রতিবাদের গল্প,দেশ ও আশার গল্প।
লেখকের বর্ণনাভঙ্গি ও লেখনশৈলী অতুলনীয়। কোনোজায়গাতে কিছু কম বা বেশি মনে হয়নি। প্রতিটা চরিত্রের চরিত্রায়নও করেছেন পারফেক্টভাবে৷ শেষে মারাত্মক টুইস্ট দেখিয়েছেন লেখক যা বারবার উপন্যাসটা পড়তে বাধ্য করে। এখানেই মোহাম্মদ নাজিম উদ্দীন সেরা৷
তবে বইটিতে বেশ কিছু প্রিন্টিং মিস্টেক ছিল। বিশেষ করে ঈ কার গুলো ই কার করে দেয়ায় পড়তে একটু অসুবিধা হয়েছে। কিন্তু ওভারঅল বইটি দারুণ।
প্রিয় উক্তি:
“সময় শুধু সারিয়েই তোলে না, জড়তা আর দ্বিধার স্তুপও বাড়িয়ে দেয়।”
“সব দেশেই ক্রাইম হয় কিন্তু সভ্যদেশের কোনো সরকার, রাষ্ট্র ক্রাইমকে প্রশ্রয় দেয় না। কালচার অব ইমপিউনিটি যেন এ দেশে জেঁকে বসেছে একদম শুরু থেকে।”
“যারা বিয়ে করে সুখি হয় তারা স্ত্রী বিয়োগ হবার পর খুব বেশি দিন একা থাকতে পারে না। আবার বিয়ে করে বসে। কারণ, দ্বৈতজীবনে যে সুখি হওয়া যায় সে অভিজ্ঞতা তার আছে। আর যে মানুষটি বৈবাহিক জীবনে অসুখি, সে স্ত্রী বিয়োগের পর আর ও পথে পা বাড়ায় না। দ্বিতীয়বার অসুখি হবার ঝুঁকি নিতে চায় না সে।
আমার পড়া সেরা বইগুলোর মধ্যে একটা “কেউ কেউ কথা রাখে”। একজন লাতিন ঔপন্যাসিকের উপন্যাসকে নিজের দেশের প্রেক্ষাপটে বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপন করা যার তার কর্ম নয়। সেটা লেখক খুব নিপুনভাবে করে দেখিয়েছেন। প্রতিটা ঘটনা মনে হয়েছে আমার সামনেই সংঘটিত হচ্ছে। শেষের টুইস্টে হতবাক হয়ে গেছি পুরো। এটাই মোহাম্মদ নাজিম উদ্দীন এর লেখনী,অপূর্ব। যারা বইটি পড়েননি তারা পড়ে নিবেন,আর যারা মাত্র শুরু করবেন ভাবছেন, লেখকের আরেকটা রহস্যময় জগতে আপনাকে স্বাগতম।
রিভিউকারীঃ মো শাহরিয়ার কবির সাজ
নটরডেম কলেজ
ইমেইলঃ shahriarsaaj@gmail.com
(ছবি কালেক্টেড)
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?