বইয়ের নামঃ জোছনা ও জননীর গল্প
লেখকঃ হুমায়ূন আহমেদ
প্রকাশনীঃ অন্যপ্রকাশ
বইয়ের ধরণঃ মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক উপন্যাস
প্রথম প্রকাশঃ ২০০৪
পৃষ্ঠাসংখ্যাঃ ৫২৭
মলাট মূল্যঃ ৮০০
পোস্ট :০২
★বই পর্যালোচনা★
বইয়ের কাহিনী শুরু ১৯৭১ সালের ফাল্গুনে। নীলগঞ্জ হাইস্কুলের আরবী শিক্ষক মাওলানা ইরতাজউদ্দীন কাশেমপুরী তাঁর ছোট ভাই শাহেদ ও তার পরিবারের সাথে দেখা করতে ঢাকায় আসেন। কিন্তু শাহেদ বাসা পরিবর্তন করায় তাঁর বাসা খুঁজে পেতে অনেক কষ্ট পোহাতে হয় ইরতাজউদ্দিনকে। শাহেদের স্ত্রী আসমানী তার স্বামীকে খুব ভালোবাসলেও সামান্য কারণেই স্বামীর সাথে রাগ অভিমান করে বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার এক খারাপ অভ্যাস আছে তার।এরকমই ২৫ শে মার্চের কালরাতে আসমানী তাদের সন্তান রুনীকে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়।শাহেদ সেই ভয়ঙ্কর রাতেই আসমানীকে খুঁজতে বের হয়।কিন্তু তাকে খুঁজে না পেয়ে দূর্ভাগ্যক্রমে শাহেদ এক বাড়িতে আশ্রয় নেয়।সে ভয়ানক কালরাত্রি শাহেদের ভাগ্যকে যেনো সেই পরিবারের সাথে এক সুতোয় গেঁথে দেয়।সেই কালরাত্রির পরদিন থেকেই ঢাকার মানুষ ভয়,আতঙ্ক আর অসহায়ত্ব নিয়ে জীবন বাঁচানোর তাগিদে শহর ছেড়ে পালাতে থাকে। আসমানী আর শাহেদও ঘটনার পরিক্রমায় বিচ্ছিন্ন ভাবে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ভেসে যায়।এই ভেসে চলা আর খুঁজে বেড়ানো অব্যাহত থাকে পুরো উপন্যাস জুড়েই।সেই অভিমানী আসমানীর ঠাই হয় ওপারের শরণার্থী শিবিরে।সে কি শেষ পর্যন্ত তার স্বামীকে খুঁজে পেয়েছিলো? নাকি ইতিহাসের কালো অন্ধকারে হারিয়ে গিয়েছিলো?
উপন্যাসের আরেক প্রধান চরিত্র শাহেদের বন্ধু নাইমুল। অসম্ভব মেধাবী,পড়ুয়া,পিছুটানহীন আর স্বপ্নচারী নাইমুলের বিয়ে হয় পাকিস্তান পুলিশ ইন্সপেক্টর মোবারক হোসেনের বড় মেয়ে মরিয়মকে।কিন্তু বিয়ের পর সে দেশপ্রেমের টানে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়।যুদ্ধে যাওয়ার আগে সে তার স্ত্রীকে কথা দেয় যে সে যুদ্ধ শেষে আবারো ফিরে আসবে।অসম সাহসী নাইমুল যুদ্ধের পরে তার স্ত্রীর কাছে ফিরে এসেছিলো কি?সে কথা রাখতে পেরেছিলো?
মাওলানা ইরতাজউদ্দিন একদম ধর্মপ্রান মুসলমান।তাই তিনি পাকিস্তানিদের ভালোবেসে শান্তিবাহিনীতে যোগ দেন।কিন্তু মিলিটারিদের নির্মমতা তার মনকে বিষিয়ে তোলে।যে কারণে তিনি ধর্মমতে মিলিটারিদের জুম্মার নামাজ পড়াতে অস্বীকৃতি জানান।যার ফলে তাকে ভোগ করতে হয় নির্মম যন্ত্রণা।
উপন্যাসে কলিমুল্লাহর মতো রঙ ধারণ করা গিরগিটিও খুঁজে পাওয়া যায়।পথকবি কলিমুল্লাহ নিজের জীবন বাঁচানোর জন্য যখন যেখানে যেমন দরকার তেমনই রূপ পাল্টে নেয়।তার কাছে মুক্তিবাহিনী কিংবা পাকিস্তানি মিলিটারির কোন আলাদা সংজ্ঞা নেই।তার কাছে তার জীবনটাই মূখ্য।এরকম অসংখ্য স্বার্থান্বেশী চরিত্রের উত্থান ঘটেছিলো সেই সময়।
অন্যদিকে দেশরত্ম শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি কারাগারে বন্দি। মাওলানা ভাসানী তার কলকাতার বাসায় ঘরবন্দি৷জিয়াউল গণি উসমানির নেতৃত্বে দেশের নৌবাহিনী,বিমানিবাহিনী,সেনাবাহিনীর সকল জওয়ান স্বাধীন দেশের সোনালী সূর্য্য দেখার প্রত্যাশায় নিজেদের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়াইয়ে নেমেছে।মেজর জিয়াউর রহমান প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরি করেছেন৷বাংলার নীরিহ সাধারণ জনগন অসীম সাহসীকতার পরিচয় দিয়ে পাকিস্তানি পেশাদার মিলিটারি বাহিনীর সাথে যুদ্ধে নেমেছে। কবি সাহিত্যিকরা তাদের কলম আর লিখনি দিয়ে উদ্বুদ্ধ করে যাচ্ছে যোদ্ধাদের।
অবশেষে দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষরণের পর এলো বিজয়ের ক্ষণ।বাংলার নীরিহ জনগন হারিয়ে দিয়েছে একটা প্রশিক্ষিত বাহিনীকে।অর্জন করে নিয়েছে স্বাধীন বাংলার লাল-সবুজ পতাকা ৷
★পাঠ প্রতিক্রিয়া★
বইটা পড়ার পর যে অনুভূতিটা হয়েছিলো সেটা কয়েক শব্দে বর্ননা করার ক্ষমতা আমার নেই।আমরা যারা স্বাধীন দেশের নাগরিক তারা সবাই যুদ্ধ স্বচক্ষে না দেখলেও বিভিন্ন বই-পুস্তক,পত্র-পত্রিকা,গল্প-উপন্যাস পড়ে,নাটক-সিনেমা দেখে,দাদী-নানীদের কাছ থেক গল্প শুনে শুনে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে মোটামুটি জ্ঞান আমাদের সবারই হয়ে যায়।কারো জ্ঞান খুব গভীর আর কারোটা হয়তো মনে রেখাপাত করার মতো যথেষ্ট না।কিন্তু “জোসনা ও জননীর গল্প” বইটা পড়ার পর যুদ্ধের নির্মমতা,গৌরবগাঁথা সব একদম আমার হৃদয়ের গভীরে গেঁথে গিয়েছে।মনে হচ্ছিলো আমি স্বয়ং যুদ্ধে আছি,যুদ্ধ দেখছি।এতোটাই ভিতরে ঢুকে পড়েছিলাম মনে হচ্ছিলো আমি যেন এই বইয়ের মাধ্যমে নিজের চোখে দেশমাতৃকার স্বাধীনতা দেখলাম।
★চরিত্রায়ণ★
বিশাল ক্যানভাসে বিস্তৃত এই উপন্যাসে অসংখ্য চরিত্র রয়েছে।কিন্তু প্রধান চরিত্র হিসেবে কোন মনুষ্য চরিত্রকে চিহ্নিত করা যায়না।শাহেদ,আসমানি,রুনি,গৌরাঙ্গ,ইরতাজউদ্দীন,কলিমুল্লাহর,ধীরেন্দ্রনাথ স্যার,নাইমুল,মরিয়ম,মোবারক হোসাইন,কংকন এসব কল্পিত চরিত্ররা সবাই যার যার ভূমিকায় জ্বলজ্বলে।সেই সাথে শেখ মুজিব,জিয়াউর রহমান,মওলানা ভাসানী,জেনারেল ওসমানি,কাদের সিদ্দিকী,কবি শামসুর রহমান,ইয়াহিয়া খান,টিক্কা খানদের মতো বাস্তব চরিত্র বইটিকে আরো বেশি প্রাণবন্ত আর বাস্তব করে তুলেছে।সেই সাথে লেখক হুমায়ূন আহমেদ যুদ্ধ চলাকালীন তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিভিন্ন ঘটনাবলিও তুলে ধরেছেন।এতো বিশাল কলেবরের উপন্যাসের কোন দিকে কোন চরিত্রের উপস্থিতি ম্লান হয়নি,কোথাও তাল হারায়নি।বরং সমান তালে সব চরিত্র যার যার ভূমিকা পালন করে গিয়েছে।এই বিষয়টি সত্যিই মুগ্ধ করার মতো।
★প্লট উপস্থাপন★
বইটির পুরো কাহিনীই মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে,মুক্তিযুদ্ধের সময়কাল আর ঘটনাবলী নিয়ে রচিত।এটি ইতিহাস আশ্রিত বই হলেও কোন ঐতিহাসিক দলীল নয়।ফিকশনের সাথে সাথে বিভিন্ন পত্র পত্রিকা থেকে নেওয়া ঐতিহাসিক তথ্য মিশিয়ে লেখক বইটিকে জীবন্ত করে তুলেছেন।যাতে বই পড়ে মানুষ মুক্তিযুদ্ধকে খুব কাছ থেকে উপলব্ধি করতে পারে।উপন্যাসে লেখক বিভিন্ন ঐতিহাসিক,রাজনৈতিক চরিত্র আর লোকের কাছ থেকে শোনা তথ্যও এমন সুক্ষভাবে মিশিয়ে দিয়েছেন যে,মনেই হয়না এসব কাহিনীর বাইরের অংশ।এ সমস্ত তথ্য,উপাত্ত প্লটকে আরো শক্তিশালী আর জীবন্ত করে তুলেছে।
★লেখনশৈলী★
হুমায়ূন আহমেদের লেখনশৈলী নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নাই।জীবনীধর্মী,ফিকশনাল,নন-ফিকশনাল,আত্মিজীবনী,ঐতিহাসিক,সায়েন্স ফিকশন সব ধরনের জনরাতেই তার সাবলীল বিচরণ।
আর এই বইতে লেখক ফিকশন,নন-ফিকশন আর ইতিহাস মিলিয়ে সাবলীল ভাবে মুক্তিযুদ্ধের যে জীবন্ত চিত্র চিত্রিত করেছেন তার মাধ্যমে কঠিন ইতিহাস আর তথ্যগুলোও মনের অজান্তেই পাঠকের মস্তিষ্কে জায়গা করে নিতে বাধ্য।গল্পের চরিত্রায়ণ,থিম,প্লট,উপস্থাপন সব মিলিয়েই একটা কমপ্লিট প্যাকেজ তৈরি করেছেন লেখক।বইটিকে তথ্য সমৃদ্ধ করে তুলতে লেখককে যে প্রচন্ডরকম খাটতে হয়েছে এতে কোন সন্দেহ নেই।
★সার্বিক মূল্যায়ন★
এই বইটিকে হয়তো মুক্তিযুদ্ধের সেরা উপন্যাস বা বই বলা যাবেনা। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত এর চেয়েও দারুণ আরো অসংখ্য প্রামাণ্য,ঐতিহাসিক বই রয়েছে।কিন্তু এই বইটা পাঠকের হৃদয়ে তার আপন জায়গা বানিয়ে নিবে।বিশাল কলেবরের এই উপন্যাস দারুণ গতিতে এগিয়েছে।কোথাও গতি হারায়নি,বিরক্তি ধরায়নি।বরং একটানে শেষ করে উঠার তাগিদ কাজ করেছে সর্বক্ষণ।উপন্যাস শেষ করার পর আনন্দের সাথে সাথে একটা গভীর বিষাদ আর কষ্টও হৃদয় ছুঁয়ে যায়!ভাবতে বাধ্য করে,এই যে এতো কষ্ট,এতো ত্যাগের মাধ্যমে পাওয়া এই স্বাধীনতার কতোটা মূল্য আমরা দিতে পেরেছি?মুক্তিযোদ্ধাদের ঋণ কি এতোটুকুও শোধ করতে পেরেছি আমরা?
★বইটি মনে রাখার কারণ★
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অসংখ্য বই থাকলেও এই বই মনে রাখার কারণ হলো-এই বইয়ের মূল চরিত্র বাংলাদেশ।অসংখ্য চরিত্র নিয়ে বইটি আবর্তিত হলেও বইটির প্রধান চরিত্র ছিলো “একটি বাংলাদেশ”। এবং বইয়ের এই দিকটিই বইটিকে অনন্য করে তুলেছে।
★প্রিয় উক্তি(স্পয়েলার এলার্ট)★
“নাইমুল কথা রাখেনি।
সে ফিরে আসতে পারেনি তার স্ত্রীর কাছে।
বাংলার বিশাল প্রান্তরের কোথাও তার কবর হয়েছে।
কেউ জানে না কোথায়।
এই দেশের ঠিকানাবিহীন অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধার কবরের মাঝে তারটাও আছে। তাতে কিছু যায় আসে না। বাংলার মাটি পরম আদরে তার বীর সন্তানকে ধারণ করেছে।
জোছনার রাতে সে তার বীর সন্তানদের কবরে অপূর্ব নকশা তৈরি করে।
গভীর বেদনায় বলে-
আহারে… আহারে…”
এবং উল্লেখিত এই লাইনগুলির মধ্যেই বইয়ের নামকরণের সার্থকতা খুঁজে পাওয়া যায়।বাংলা মায়ের জন্য জীবন দিয়ে,জোছনা মাখা জননীর কোলে পরম আদরে ঘুমিয়ে থাকার সৌভাগ্য কয়জনের হয়?
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?