বইয়ের নামঃ প্রত্যাবর্তন
সম্পাদনা: আরিফ আজাদ
বইয়ের ধরনঃ মিথ্যা ও কলুষিত জীবন থেকে একঝাঁক নীড়ে ফেরার গল্প।
নিজ মতামত: “প্রত্যাবর্তন” মোহ আর মিথ্যার ভেতর দিয়ে যখন প্রতিটি আত্মা চলতে গিয়ে নিমজ্জিত হয় অন্ধকারের অতল গহ্বরে। ঠিক তখনই ঐ আলোহীন অন্ধকারের সেই ভয়ার্ত কুপ থেকে কেউ ফিরে আসে শান্তির ছায়া তলে কেউ বা আবার নিজেকে হারিয়ে ফেলে গহীন থেকে গহীনে, সেরকম আধার আর আলোই ঘেরা প্রতিটা আত্মার গল্প নিয়েই প্রতাবর্তন।
রেটিংঃ 10/10
★প্রত্যেকটা বৃত্তের একটা নির্দিষ্ট কেন্দ্র থাকে, তবে প্রতিটি আত্মারও কি কোন নির্দিষ্ট কেন্দ্র বিন্দু আছে?
প্রতিটি আত্মা মোহ আর মিথ্যার বক্র পথে নিজেকে সপে দিয়ে আভিজাত্য ও সুখময় জীবনের সন্ধানে লোভ ও লালসার গহীন অন্ধকারে ডুবে থেকে যখন ফিরে পায় সুখময় জীবনের মরীচিকার ফাঁদ, প্রতিটা আত্মাই যখন এই ভয়ার্ত ফাঁদের অতল গহ্বেরে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে ঠিক তখনই সেই বক্র পথের অতল গহ্বর থেকে কতগুলো আত্মা নিজেকে ফিরিয়ে আনেন সিরাতুল মুসতাকিমের সরল পথের নিদিষ্ট কেন্দ্র বিন্দুতে। যেখানে আত্মা গুলো নতুন করে ফিরে পায় শান্তির আভাসে ঘেরা সুখময় জীবন। আর কতগুলো আত্মা যখন বক্র পথের অন্ধকারের অতল গহ্বরের গহীন থেকে গহীনে শান্তির ছায়া খুঁজেতে থাকেন তাঁরা কি কখনো সেই লোভ লালসা আর আভিজাত্যর ভয়ার্ত কুপ থেকে অন্ধকার ব্যতীত আলোর দেখা পায়!
বই : প্রত্যাবর্তন
সম্পাদনা : আরিফ আজাদ
প্রকাশনী : সমকালীন প্রকাশন
পৃষ্ঠা সংখ্যা : ২২৪
মুদ্রিত মূল্য : ৩০০
ইসলামি বই রিভিউ
“জীবনের কতগুলো ভাত ভাত দুপুর আর ঘুম ঘুম সকাল কেটে গেলো পরম অবহেলায়।আরও কত যাবে।যেতে যেতে একটা দিন সময়ের বাক্সটাও ফুরিয়ে যাবে দুম করে।” [আপনারে খুঁজিয়া বেড়াই—প্রত্যাবর্তন]
মানুষের ইগনোরেন্সের তুলনা করা চলে অনেকটা পোকা মাকড়ের সাথে।পোকা মাকড় যেমন আলো দেখে বোকার মতো আগুনে গিয়ে ঝাপ দিয়ে নিজের ধ্বংস ডেকে আনে,মানুষও তেমনি দুনিয়ার চাকচিক্যে বোকা বনে গিয়ে নিজেকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়।সেই আগুন তাদেরকে গ্রাস করার আগেই অতীতে বোকা বনে যাওয়া কিছু মানুষ সক্ষম হয় আগুনের কাছ থেকে ফিরে আসতে…..
আগুন থেকে পালিয়ে বেড়ানো সব মানুষের গল্প সবার জানা হয়ে উঠে না।কিছু গল্প থেকে যায় অজানা।ছাপা হয় না কাগজে।গাঁথা হয় না শব্দে।কিন্তু যেগুলো গাঁথা হয় শব্দে,ছাপা হয় বইয়ে সেগুলো ছুঁয়ে যায় প্রত্যাবর্তিত হওয়া প্রতিটি অন্তরকে।তেমনি কিছু হৃদয় ছোঁয়া গল্প নিয়ে লেখা “প্রত্যাবর্তন” বইটা।
একেকটা গল্পের রাইটার ভিন্ন ভিন্ন হওয়ায় গল্পের স্বাদ আর ফ্লেভারও ছিল ভিন্ন ভিন্ন।প্রতিটা গল্পে এমন কিছু কিছু লাইন ছিল যা সত্যিই বাঁধাই করে রাখার মতো।আবার অনেক লাইন পড়ে বেশ ভালোই বিনোদন পেয়েছি।ইচ্ছে করছে সব গল্প থেকে হার্ট টাচিং কথাগুলো এখানে লিখে ফেলি।কিন্তু আমার ফিল আর সবার ফিল তো একরকম না।অনেকে হয়তো বোরড হয়ে যাবে।তাই কথাগুলো না হয় অন্য কোথাও বাঁধাই করেই রেখে দিবো।
১.
“ছেলেটা এখন দুনিয়ার ক’টা দিন ইঁদুরের মতই বাঁচতে চায়।”[টাইট্রেশন—প্রত্যাবর্তন]
চাকচিক্যময় দুনিয়ার আলো বাতাসে গা ভাসিয়ে দেওয়ার মত যথেষ্ট সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কিছু মানুষ বাঁচতে চায় ইদুরের মতো।ইঁদুর যেমন আলো দেখে লুকিয়ে যায়।তেমনি ধোঁকাবাজ দুনিয়ার আলো থেকেও কিছু মানুষ লুকোতে যায়।বাঁচতে চায় চাকচিক্যময় আলোর ভেতর লুকিয়ে থাকা ঘোরতর অন্ধকার থেকে….লেট দেম হাইড ফ্রম দ্য লাইট।লেট দেম লিভ লাইক অ্যা রেট।
২.
“ভালোবাসি তাদের যারা সত্যকে হৃদয় দিয়ে খোঁজে।হোক সে আস্তিক বা নাস্তিক–সত্য খোঁজার চেষ্টা করলে,হৃদয় দিয়ে চাইলে,আল্লাহ পথ দিয়ে দেন।কেউ তার দিকে এক হাত অগ্রসর হলে তিঁনি তার দিকে দু-হাত অগ্রসর হন।কেউ তাঁর দিকে হেঁটে আসলে তিঁনি তার দিকে দৌড়ে আসেন।”[গল্পটা হাসি কান্নার—প্রত্যাবর্তন]
সব মানুষের সামনেই সত্য আসে।কেউ সত্য থেকে পালিয়ে বেড়ায়,কেউ এড়িয়ে চলে।আবার কেউ উপস্থিত হওয়া সত্যকে খুটে খুটে দেখে।খোঁজে খোঁজে বের করে সত্যের আদ্যোপান্ত।কেউ কামড়ে ধরে বসে থাকে পূর্বাবস্থায়।কেউ সত্যকে মেনে না নেওয়ার জন্য দাড় করায় অসংখ্য অজুহাত।কেউবা আবার মেনে নেয় সত্যকে।যারা মেনে নেয় তারা তাদের সাহায্যকারী হিসেবে পায় বিশ্বজাহানের অধিপতিকে।আর কি চাই তাদের!!!
৩.
“বড় হতে হতে বহির্জগৎ,সংস্কৃতি,কৃষ্টি,দর্শন আর নানান কিসিমের মানুষের সংস্পর্শে এসে সেই ধোয়াশাগুলো কালো মেঘে রূপ নেয়।আর এভাবে এক সময় আড়ালে পড়া সূর্যটাকেই দিব্যি ভুলে বসি আমরা।অবচেতন তখন বলে ওঠেঃ সূর্য আবার কী?”[নীড়ে ফেরার গল্প—প্রত্যাবর্তন]
তেমনি কিছু মানুষের গল্পও ছিল বইটাতে।যারা ভুলে গিয়েছিল চির সত্যকে।তারপর নাটকীয়ভাবে আবার ফিরে এসেছে নীড়ে।সমস্ত প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর যিনি তাঁর পথহারা বান্দাদের সরল পথ দেখান।
৪.
“তারপর?তারপর শুধু ত্যাগ আর যোগের ইতিহাস।কোরআন আর সুন্নাহকে একটু একটু করে জানতে চাওয়ার ইতিহাস।এগুলো ভালো লাগার ইতিহাস,ভালোবাসার ইতিহাস।এটাই আমার হুজুর হবার ইতিহাস।”[আমি এবং আমাদের গল্প—প্রত্যাবর্তন]
নীড়ে ফিরেই কি গল্পগুলা শেষ হয়ে যায়?একটুও না।আসল গল্পটা শুরু হয় ফেরার পর থেকে।যেখানে আধিপত্য বিস্তার করে জিজ্ঞাসু আর পিপাসু মস্তিষ্ক।তারপর শুরু হয় অনুসন্ধান আর সেক্রিফাইস।এ সেক্রিফাইসে কোন কষ্ট থাকে না।থাকে কেবল প্রশান্তি।স্বেচ্ছায় যা ত্যাগ করা হয় তাতে তো প্রশান্তি থাকারই কথা।
৫.
“তাই এখনো নিজের জীবনের গল্পগুলো প্রতিনিয়ত আঁকি।আঁকতে গিয়ে ভুল হয়।ভুলগুলো মুছতে থাকি।থেমে না থেকে আবারো আঁকি।”[ফিরে আসার গল্প—প্রত্যাবর্তন]
টুকটাক ত্যাগ করেই কি সফল হওয়া যায়?সফল হতে নিখুদ হওয়া চাই।সবাই কি একেবারেই নিখুদ হতে পারে?পারে না।ভুল হয়।ভুলগুলো সুধরাতে হয়।নিখুদ হয়ে টিকে থাকার জন্য এভাবেই লড়ে যেতে হয়।
৬.
“কত শতবার উল্টে পড়ে যাই।জামা ছিঁড়ে যায়,হাড় ভেঙ্গে যায়,রক্তাক্ত হই কষ্টে।আবার উঠি,আবার হাঁটতে গিয়ে হোঁচট খাওয়া।ভয়ংকর,ভয়ংকর সব তীব্র ব্যাথায় খালি চোখ দুটো লোনা হয়ে গাল ভাসিয়ে দেয়।তবুও আশার বাণী আমাকে আলো দেখায়।সেই আলোয় ভর করেই আমি উঠে বসি,চোখ মুছে শক্ত পায়ে দাঁড়াই।না থামার দৃঢ় প্রত্যয়ে আবারও পা বাড়াই সামনে।চলতে থাকি।” [অন্ধের যাত্রা সমীকরণ—প্রত্যাবর্তন]
সব কিছু ব্যাখ্যা করতে নেই।ব্যাখ্যা করতে গেলে এর আসল মর্মার্থ প্রস্ফুটিত হয় না।কিছু জিনিস কেবল ফিল’ই করা যায়।সবাই আবার ফিলও করতে পারে না।যাদের অভিজ্ঞতা আছে তারাই কেবল ফিল করতে পারে আসল মর্মার্থ…
মুসলিম পরিবারে জন্ম নিয়েও অনেকে সৃষ্টিকর্তাকে চিনে না।আবার অমুসলিম পরিবারে জন্মেও অনেকে চিনে ফেলে তার সত্যিকারের সৃষ্টিকর্তাকে।তেমনি চার জন মানুষের গল্পও ছিল বইটাতে।তার মধ্যে “ফেরার কথাই ছিল” গল্পের লজিকগুলো সেইরকম অসাম ছিল।আবার প্রথম দুইটা গল্পের একেবারে শেষের অংশটা পড়ে খুব খারাপ লেগেছে।বিষয়টা আমরা যারা মুসলিম পরিবারে জন্মেছি তাদের জন্য যেমন একটা নিদর্শন তেমনি ঐ রিভার্টেড মানুষগুলোর জন্যেও নিদর্শন।সত্যিই আমাদের লড়াই আর তাদের লড়াইয়ে অনেক পার্থক্য।আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহ আমাদের মুসলিম পরিবারে পাঠিয়েছেন বলে।তবে এত কোটি কোটি অমুসলিমদের মধ্যে আল্লাহ যে তাদেরকে অনন্তকালের আগুন থেকে রক্ষা করার জন্য বেছে নিয়েছেন সেটাও অনেক বড় একটা নিয়ামাহ!
সমালোচনাঃ গল্পগুলো যদি কোন মানুষের লিখা হতো তাহলে হয়তো বলতে পারতাম, “এই এই গল্পগুলো এভাবে না লিখে অন্যভাবে লিখলেও হতো।” কিন্তু গল্পগুলো তো কোন মানুষের লিখা না।দ্য গ্রেটেস্ট রাইটার–আল্লাহর লিখা।সব মানুষের জীবনের গল্পই আল্লাহর লিখা।জীবনের গল্পে কারো হাত থাকে না।উনারা কেবল শব্দের সুতোয় গেঁথে বইয়ে ছাপিয়েছেন। এখানে সমালোচনা বড়ই বেমানান।
যাইহোক,কাভার নিয়ে কিছু না লিখলে রিভিউটাই অপূর্ণ থেকে যাবে।কাভারটা খুব ভালো লেগেছে।কেবল পছন্দের রং দেখেই যে ভালো লেগেছে তা কিন্তু না।লাল রং এর সূর্য দেখে আমার কেন জানি মনে হচ্ছিল এটা প্রতিদিনকার স্বাভাবিক সেই সূর্য না।মনে হচ্ছিল এটা সেই প্রতিশ্রুত পশ্চিম গগনে উদিয়মান সূর্যেরই প্রতীক।যে সূর্য উঠার পর আর কারো তওবা কবুল হবে না।দেশ-বিদেশে অস্থিতিশীল কোন পরিস্থিতির সংবাদ পেলেই যে সূর্যটার কথা আমার মনে পরে,ভয় লাগে।
আর কাভারে দরজার ওপাশে আলো দিয়ে মিন করা হচ্ছে,পশ্চিম দিকে সূর্য উঠার আগেই কিছু মানুষ তওবা করে সত্যিকারের আলোতে ফিরে গিয়েছে।অপেক্ষা দরজাটা বন্ধ হওয়ার,আর একটু বাকি…কি টেরিইবল একটা পরিস্থিতি,ভাবতেই ভয় লাগে!!!
.
.
পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল-সবার হাতে একটা করে মশাল।কিসের?আগুনের?উহু,বার্তার মশাল।এ বার্তায় সাউন্ড পলুশান হয় না।এটা সাউন্ডহীন বার্তা।এ বার্তা জীবন থেকে আসে।পৌছে যায় আরো শত সহস্রের জীবনে।মাধ্যম হয় ভার্চুয়ালের কিংবা বইয়ের পাতা।বর্ণ আর শব্দগুচ্ছে গাঁথা হয় কিছু অভিজ্ঞতার বার্তা।নিজেকে বদলানোর বার্তা।অন্যকে বদলে দেওয়ার বার্তা।এ বার্তা ছুঁয়ে যায় তন্দ্রাচ্ছন্ন হৃদয়কে।আলোড়ন জাগায় পরিবর্তিত হওয়া আত্নার স্মৃতির পটে।
সারাদিন একা একা হেটে ক্লান্ত হয়ে দিনশেষে ফেসবুক কিংবা বইয়ের পাতায় চোখ রাখা কিছু মানুষ খোঁজে পায় তারই পথে হেটে চলা আরো কিছু পথিকের সন্ধান।সহযাত্রীদের দেখে খুশিতে আটখানা হয়ে সাহস পায় এগিয়ে যাওয়ার।দিনের সব একাকিত্বের ক্লান্তি ভুলে চোখ বুজে হারিয়ে যায় স্বপ্নের রাজ্যে।যে রাজ্যে থাকে প্রশান্তির আনাগোনা।ফিরে আসার প্রশান্তি….
মোহ আর মিথ্যার কলুষিত বক্র পথের আড়ালে লুকিয়ে থাকা মরীচিকার ফাঁদ নিয়েই প্রত্যাবর্তন।
তারিখ : ১৫-১২-২০২১, ৫:৩০ মিনিট
স্থান: বাহেরচর ছাত্র কল্যাণ ফাউন্ডেশন লাইব্রেরী, বাঞ্ছারামপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ।
কলমে:- আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ।