বইয়ের নাম :- ডাকাতের আখড়ায়
লেখকের নাম :-অরুণ কুমার বিশ্বাস।
মলাটমূল্য :-১৮০
পৃষ্ঠাসংখ্যা :- ৯৬
ধরণ :- গোয়েন্দা গল্প।
প্রকাশকাল :- ২১ বইমেলা ২০২১
রিভিউ :- ফারজানা ইসলাম জামিয়া (all credit)
পেশা :- শিক্ষার্থী।
একটু দোনামোনা করে শেষে ওঠে দাঁড়ালো বিশু। ওর পড়া হয়নি। হবে কি করে? পড়াশোনা করতে যে মোটেও ভালো লাগে না বিশুর। মাঝে মাঝে মনে হয় সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে শান্তিনিকেতনে চলে যাবে বিশু। যেখানে নাকি গাছ তলায় বসে ক্লাস করে ছাত্ররা । স্যাররা ও বেশ রসিয়ে রসিয়ে কোলে বসিয়ে ক্লাস নেন,,ফুল পাখিদের গল্প শুনায়। চার দেওয়ালের মাঝে এমন ভ্যাপসা গরমে ক্লাস করা যায় না। না পড়াশোনায় মন বসে।
সাবাস! এইতো বাঘের বাচ্চার মত বুকের পাঠা! সবাই পড়া শিখেছে একমাত্র বিশু ছাড়া। কোনো ভয় নেই বিশু। মেরুদণ্ড সোজা করে হাই বেঞ্চের উপর উঠে দাঁড়া। সবাই তোকে দেখুক। সবাই তোকে দেখে শিখুক। কি করে সত্য বলতে হয়। গমগমে গলায় বললেন ওদের ইংরেজি স্যার বাঘা মোতালেব মিয়া। একজোড়া পাহাড়ি বেত আলগোছে দোলাচ্ছেন তিনি।
নিঃশব্দের স্যারের আদেশ পালন করল বিশু।বানরের মত ছোট লাফ মেরে বেঞ্চের উপর উঠে দাঁড়ায় সে।
এইবার বল,, পড়া শিখিস নি কেন তুই? বেত হাতে এগিয়ে এলেন মোতালেব।
পড়বো কি করে? কাল রাতে যে কারেন্ট ছিলনা! নিপাট ভদ্রলোক এর মত বলল বিশু।
কিরে বাবলা বিশুর কথা কি ঠিক? তোদের বাড়ির ওদের পাশেই।বিশুর বন্ধু বাবলার দিকে কড়া চোখে তাকালেন মোতালেব।
বাবলা চুপ! কোন কথা সরছে না তার মুখে। সে পড়েছে উভয় সংকটে। মানে হর্নস অব ডিলেমা। সত্য কথা বললে বিশুর পিঠে পড়ে যাবে বেতের বাড়ি। আর মিথ্যা বললে বেতের গায়ে নিজেই শামি কাবাব হয়ে যাবে এক নিমিষে।
কিরে, কথা বলছিস না কেন উলু বানর? হুংকার ছেড়ে বললেন ইংলিশ স্যার।
উলু বানর! উলু বানর কথাটা শুনেই বেশ মজা পেলো বিশু। উলু বানর! ব্যপারটা নিশ্চয় অন্য সব বানরদের চেয়ে আলাদা। বুকের ভিতর দমফাটা হাসিটা চেপে রাখতে না পেরে ঠোট ফাঁক করেছিল মাত্র, তক্ষুনি জবাফুল চোখে ওর দিকে তাকালেন স্যার। আর অমনি ফুটো বেলুনের মতো চুপসে গেলো বিশু। হাসির দমকটা কোঁত করে গিলে নিয়ে মনে মনে ভাবলো ,, খুব শিগগির দেখে আসবে চিড়িয়াখানায় গিয়ে। উলু বানর জিনিসটা আসলে কি,,!
বাবলা সত্যি-মিথ্যা কোনটাই না বলে ধন্দে পড়লেন স্যার। বিশুর কথাই কি তবে সত্যি! কারেন্ট না থাকলে পড়বে কি করে বেচারা! হঠাৎ কি মনে করে আবার হুংকার দিলেন মোতালেব মিঞা_
‘ কারেন্ট নেই তো কি হয়েছে! মোম জ্বেলে পড়তে পারলিনা বেল্লিক? বড় হতে গেলে অনেক কাঠখড় পুড়াতে হয়। আর এতো সামান্য মোমবাতি। শুনিসনি আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম রাস্তায় দাড়িঁয়ে ল্যাম্প পোষ্টের আলোয় পুথি পড়তেন।
‘ সে চেষ্টা কি আর করিনি স্যার? ফটিকের দোকান থেকে মোম কিনে এনেছিলুম স্যার। ইয়া মোটা আর লম্বা। মোটা হলে কি হবে? যেই না মোম জ্বেলে পড়তে বসলুম, অমনি এক অবাক কান্ড ঘটলো স্যার____
‘ কী কান্ড খুলে বলবি তো হারামজাদা?
‘ বলছি স্যার! বলছি। মোম জ্বালতেই দেখি হলুদ রঙের আলোর বদলে রক্তের মতো লাল টকটকে আলো বেরুচ্ছে। আর কে যেন ভূতুরে কন্ঠে ঘড়ঘড় করে বলছে, আমরা শহীদদের আত্না। একাত্তরে লড়াই করেছি কি রাজাকারদের কাছে পৃষ্ঠ হবার জন্য? আরো রক্ত চাই। আরো। তোরা অশ্রু তুলে নে হাতে। দেশে আরেকটা যুদ্ধ দরকার। শিয়াল আর হায়না তাড়ানোর যুদ্ধ।
‘ তাই নাকি? সত্যি শুনেছিস? তুই বড় ভাগ্যবান রে বিশু, একাত্তরের শহীদদের কন্ঠ শুনেছিস। এমন ভাগ্যি ক ‘ জনের হয় বল? এখন তো শুধু রাজাকারদের লক্ষ ঝম্প, দেশদ্রোহীর গলাবািজ। সত্যি আরেকটা যুদ্ধ দরকার। ক্ষুদা আর অভাব তাড়ানো যুদ্ধ। এ কথা বলেই কেমন বেসামাল হয়ে পড়লেন ইংলিশ স্যার মোতালেব মিঞা —-
একটু পড়েই গম্ভীর সুরে বললেন, নেমে আয়, নেমে আয় বিশু। আমাদের সবাইকে এক যোগে যুদ্ধ করতে হবে। এ লড়াই মর্যাদার লড়াই,,নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই।
সেদিন আর ক্লাস হলো না।স্যার তন্ময় হয়ে গেলেন হারানো ইতিহাসে। একটানা বলে গেলেন একাত্তরের সেই উত্তাল দিনগুলোর কথা। স্যারের বাবা শহীদ হয়েছেন স্বাধীনতার যুদ্ধে। রাজাকারদের দু’চোখে দেখতে পারেন না তিনি। সুযোগ পেলে বলে তারা’ দেশদ্রোহী, বেইমান,রক্তলোভী হায়না। ওদের খতম করতে না পারলে দেশটাকে বাঁচানো যাবেনা।
স্যারের কথা শুনতে ভীষণ ভালো লাগে বিশুর। একটু বদমেজাজী হলেও স্যারের মনটা গিনি সোনার মতো খাঁটি।
সেদিন ছুটি শেষে বাড়ি ফেরার পথে বিশুকে পাকড়াও করল বাবলা আর তার বোন কেয়া। দুজনেই ভীষণ ভালবাসে বিশুকে।বেচারা, টাকার অভাবে নতুন বই কিনে পড়তে পারেনা। গেলবারের পুরনো বই ধার করে পড়তে হয়। ফিচেল হেসে বলল বাবলা,
‘তুই কি সত্যিই মোমবাতি থেকে রক্ত ঝরতে দেখেছিস? নাকি স্যার কে বোকা পেয়ে ওসব ঝেড়েছিস?
না রে, বাবলা। সব কিছু কিনে কি আর মজা করা যায়? যা বলেছি সবই সত্য একচুলও মিথ্যে নয়।
‘আমি বিশ্বাস করি না ‘ওর কথা। সাফ জানিয়ে দিল কেয়া। কেয়া বাবলার চেয়ে বছর দুয়েকের বড় হবে। ছোটকালে টাইফয়েড হয়েছিল। তাই পিছিয়ে পড়েছে একটু। তবে ওর মাথা ভালো। যা একবার শুনে তাই মনে রাখতে পারে। যাকে বলে ফটোগ্রাফিক মেমোরি।
তুমি বিশ্বাস না করলে আমার তাতে বয়েই গেল। কেয়ার দিকে শাসানিক চোখে তাকালো অঘটন-ঘটন পটিয়সী বিশু।
‘ফটিকের দোকানের মোম কি আলাদা কিচ্ছু? নাকি তোর চোখে স্পেশাল কোন লেন্স লাগানো আছে? মোম পুড়ে রক্ত বেরুয় তা তো কখনো শুনিনি? ঝুনা তাকির্কের ঢঙে বলল কেয়া।
‘ সবাই সবকিছু দেখতে পাইনা কেয়া। অযথা কথা বাড়িয়ো না। দেখার জন্য তেমন চোখে লাগে। মুরুব্বির মত বলল বিশু।
‘ সে তো বটেই। তুই যেমন রাতের অন্ধকারেও ঠাকুরবাড়ির গাছে পাকা পেয়ারা দেখতে পাস, অমন করে কেউ দেখতে পায়না। আসলে তুই বিশু বাহাদূর নোস। বিশু বাদুর। রাতের বেলায় ও তোর চোখ জ্বলে।
‘ এবার থামতো কেয়া। বিশু আমার বন্ধু। আমার বন্ধুকে আক্রমণ করার কোনো রাইট তোর নেই। বন্ধুর পক্ষ নিলো বাবলা।
সেদিন আর কথা এগোয়নি। বিশু সত্যি নাকি মিথ্যে বলছে সেটাও জানা হয়নি। তবে একটা ব্যপার এ দ্বিমত নেই কারো। বিশু, কেয়া, বাবলার মতো বন্ধুত্ব কারো হয়না।
🌺কাহিনী সংক্ষেপ :-
গ্ৰামের নাম গড়পুকুর। যেখানে ইলেকট্রিসিটি এসেছে কিন্তু আলো যা জ্বলে তাতে অন্ধকার কাটে না।এই গ্রামের একজন অতি চালাক ছেলে,বিশু। তার বন্ধু বাবলা, কেয়া,গুড্ডু সেই গ্ৰামের বাসিন্দা।বিশু তার মাকে ছাড়া আর কাউকে ভয় পেত না। এমনকি সে তার ইংরেজি টিচার মোতালেব স্যারকেও ভয় পেত না।
গড়পুকুর গ্ৰামের মুরব্বি নবু শেখের বাড়িতে ডাকাত পড়ল।ডাকাতিটা ছিল ভয়ঙ্কর। ডাকাতির সুবিধার জন্য কুকুরকে ফাঁস দিয়ে মেরে ফেলেছে ডাকাতরা। কুকুরটির নাম ছিল”হিটলার”। সবাইকে মেরেধুরে ঘরে যা ছিল সব কিছু নিয়ে গেল।তার কিছুদিন পর বাবলা ও কেয়ার বাড়িতে ডাকাতি হলো। ডাকাতদের সঙ্গে ছিল একটা প্রাণী,যে অদ্ভুত কৌশলে গেরস্থের গলায় ফাঁস পরায়।বাবলা কৌশলে ডাকাতদের তাড়িয়ে দেয়। বাড়ির কারো কোনো ক্ষতি হয় নি। ডাকাতরা তাদের কুকুরকেও মারতে পারে নি।
এমনকি তাদের বাড়ি থেকে কিছু নিয়ে যেতেও পারে নি।বাবলা অবশ্য একজন ডাকাতের নাম জানতে পেরেছে,যার নাম বগা।বিশুরা ডাকাতদের পিছু ধাওয়া করে একসময় তাদের আস্তানার খবর পায়।পাংশার পাশে যে মরা গাঙ,তার ওপারে নাকি বগা ও তার ওস্তাদ মুখ লুকিয়েছে। এরপর বিশুর গোয়েন্দা বাহিনী গভীর রাতে পাংশার ঢালে, জঙ্গলে ডাকাতদের আস্তানায় অভিযানে গিয়ে ফেঁসে যায় এবং ডাকাতরা বিশু ও বাবলাকে বেঁধে রাখে।সেসময় গুড্ডুর বুমেরাং দিয়ে ডাকাতদের একজন আহত হয়।
কিন্তু এরপর কী হবে?বিশু আর বাবলা কী সেই আস্তানা থেকে বের হতে পারবে?তারা কী গ্ৰামের শান্তি ফিরিয়ে আনতে পারবে? সেই অদ্ভুত প্রাণীর নাম কী তারা জানতে পারবে?
🌺সবচেয়ে ভালোলাগার থিম :-
উলু বানর! উলু বানর কথাটা শুনেই বেশ মজা পেলো বিশু। উলু বানর! ব্যপারটা নিশ্চয় অন্য সব বানরদের চেয়ে আলাদা। বুকের ভিতর দমফাটা হাসিটা চেপে রাখতে না পেরে ঠোট ফাঁক করেছিল মাত্র, তক্ষুনি জবাফুল চোখে ওর দিকে তাকালেন স্যার। আর অমনি ফুটো বেলুনের মতো চুপসে গেলো বিশু। হাসির দমকটা কোঁত করে গিলে নিয়ে মনে মনে ভাবলো ,, খুব শিগগির দেখে আসবে চিড়িয়াখানায় গিয়ে। উলু বানর জিনিসটা আসলে কি,,!
আসলেই দেখতে হবে উলু বানর জিনিসটা কি?
গল্পের চরিত্র :- গল্পের প্রধান হলো চরিত্র। আবার সেই চরিত্রগুলোর মাঝেও কিছু প্রধান চরিত্র থাকে। তেমনি ডাকাতের আখড়ায় উপন্যাসের কিছু প্রধান চরিত্র হলো :- বিশু, কেয়া, বাবলা, গুড্ডু, মোতালেব মিঞা, বগা, নবু শেখ। এছাড়াও গল্পে রয়েছে কিছু সাধারণ চরিত্র। তবে প্রধানত গল্পটাতে এই কয়েকটা চরিত্রই বেশী প্রাধান্য পেয়েছে।
🌺পাঠ প্রতিক্রিয়া :- বইটি মূলত ডাকাত ও ছোট্ট গোয়েন্দাদের নিয়ে লিখা। বরাবর ই রহস্য উদঘাটন গল্প আমার পছন্দের ছিলো। সেক্ষেত্রে এবার ও তার ব্যাতিক্রম কিছুনা। অন্যান্য বইয়ের চেয়ে এই রকম রহস্য, আর থ্রিলার বই গুলোতে একটু বেশীই আকর্ষণ থাকে। আর এই বইটি যেহেতু সে রকম পর্যায়ের ই কিছু সেক্ষেত্রে এটিও আমার কাছে প্রথমত আকর্ষণীয় ছিলো। কিন্তু যখনি পড়া শুরু করলাম তখনি সেই আকর্ষণটা বেড়ে গিয়ে এক বিরাট উত্তেজনার সৃষ্টি হলো। যতই সামনে এগুতে লাগলাম,ততই ভালো লাগতে লাগলো। সেই সাথে বাড়তে লাগলো প্রশ্ন।
মাঝরাতে সেই আস্তানায় হানা দেয়ার পর বিশু ও বাবলা ডাকাতদের হাতে ধরা পড়ে ফেঁসে যায় এবং ডাকাতরা তাদের বেঁধে রাখে। কি হবে এরপর? কে ওদের বাঁচাবে? গুড্ডু কোথায় গেল? তারা কি পারবে অপরাধীকে শনাক্ত করতে? নাকি নিজেরাই কারো শিকার হবে? নাকি এখানেই কি শেষ হয়ে যাবে তাদের জীবন ?
এই রকম হাজরটা প্রশ্নের পশরা সেজে গেলো সামনে । অবশেষে সকল প্রশ্নের অবসান ঘটলো যখনি বইটা পড়া শেষ করলাম। তবে রয়ে গেলো আক্ষেপ। মনে হতে লাগলো এত তাড়াতাড়ি কেন শেষ হয়ে গেলো? আরেকটু বড় হলেও তো মন্দ হতোনা। এছাড়া ও গল্পে বন্ধুত্বের দিকটা ফুটে ওঠেছে অসাধারণ ভাবে। যেটা আরও বেশী হৃদয় ছুঁয়েছে।সব মিলিয়ে মিশিয়ে গল্পটি ছিলো অসাধারণ একটি গল্প। এক কথায় অতুলনীয়।
লেখক পরিচিতি : লেখক অরুণ কুমার বিশ্বাসের জন্ম ২৭ ডিসেম্বর, ১৯৭৭ গােপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়ায় জহরের কান্দি গ্রামে। তিনি ই কে ইউ হাইস্কুল থেকে এসএসসি (১৯৯৩), ঢাকার নটরডেম কলেজ থেকে এইচএসসি (১৯৯৫) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে সম্মানসহ এম এ (২০০১) ডিগ্ৰী অর্জন করেন।
শুল্ক বিভাগের ডেপুটি কমিশনার এই লেখক সম্প্রতি ইংল্যান্ডের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত লন্ডন মেট্রোপলিটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হিউম্যান রিসাের্স ম্যানেজমেন্টে মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন। মেধার স্বীকৃতি হিসেবে নটরডেম কলেজ থেকে পেয়েছেন অ্যাওয়ার্ড ফর এক্সেলেন্স। তিনি লিখতে ভালবাসেন,ভ্রমণ তার প্রিয় শখ, খানিকটা নেশার মতাে। নতুন দেশ, নতুন মানুষ তার গবেষণার বিষয়। বর্তমানে তিনি পেশাগত কাজের ফাঁকে ফাঁকে লেখালেখির কাজ করে যাচ্ছেন।
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?