Post ID 111565
বইঃ- অর্ধবৃত্ত
লেখকঃ- সাদাত হোসাইন
প্রকাশনীঃ- অন্যধারা
মুদ্রিত মূল্যঃ- ৫৯০ টাকা
রেটিংঃ- ১০/১০
পড়তে পারেন_
Sadat Hossain এর আরো কিছু বই।
প্রথমেই বইয়ের লেখক সাহেব কে নিয়ে একটু সমালোচনা করতে চাই।
সাদাত হোসাইন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী। এই মানুষটি একজন গল্পের মানুষ। মস্তিষ্কে, মনে অনেক অনেক গল্পেরা বাস করে তার।সাধারণ জীবনে ঘটে যাওয়া দৈনন্দিন ঘটনা গুলোই তীব্র অনুভূতি দিয়ে গল্প ফুটিয়ে তোলা একজন অনন্যসাধারণ মানুষ।
☑️এবার আসি বই সংক্রান্ত আলোচনায়।
অর্ধবৃত্ত।
আসলে জীবন কি?সম্পর্ক কি?জীবনের সঙ্গে সম্পর্কের সংযোগে আসলেই কি জীবন একটি বৃত্ত?এই বৃত্তটি পূর্নবৃত্ত নাকি অর্ধবৃত্ত?
জীবনের সঙ্গে আসলে সম্পর্কের সম্পর্ক নিবিড়। জীবনের সবচেয়ে কঠিন বা সবচেয়ে সহজ সমীকরণ ই হলো সম্পর্ক।
জীবনে ঘটে যাওয়া অদ্ভুত,কিম্ভুত ঘটনা বা হয়ে যাওয়া বিদঘুটে, কদাকার সম্পর্ক সবই একটি বৃত্তের মাঝে বন্দী।
প্রতিদিনকার জীবনে আমাদের সাথে কত কিছুই না ঘটে।ঘটে যাওয়া এই ঘটনা গুলোর বিবরণ কি আমরা পূর্ন অনুভূতির সাথে দিতে পারবো?আমাদের লেখক সাহেব তো পুরো এক জীবন তার লেখা বইয়েই তুলে ধরেছেন।বেদনার এমন অদ্ভুত অনুভূতি লিখে প্রকাশ করেছেন, যখন আপনি বইটি পড়বেন তখন আপনার মনে হবে যেন প্রত্যেকটা ঘটনা আপনার চোখের সামনে ঘটছে।সুখের অনুভূতি কতটা সুনিপুন হয়ে মনের গভীরে শীতল বাতাস বইয়ে দিতে পারে তা অর্ধবৃত্ত পড়লেই বুঝবেন।
ভালোবাসা,প্রেম,শরীর…শুনতে বিদঘুটে লাগলেও এই শব্দগুলি একে অপরের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে।আমরা প্রকাশ করিনা বলেই আমাদের কাছে বিদঘুটে মনে হয়।
কৈশোরে একটা মেয়ে কতটা সুন্দর ভাবে ভাবতে পারে,মনের অনুভূতি বলতে পারে,লুকোতে পারে তা আমরা গল্পের ঋদ্ধি কে দেখলে বুঝতে পারি।
একজন মানুষ শুধুমাত্র তার ব্যক্তিজীবনে অসাধারন বলে,সবসময় সব কাজ সুন্দর ভাবে করতে পারেন বলেই দেখা যায় আমরা ওই মানুষটিকে প্রয়োজনের তালিকায় প্রথমে রাখি।এরকম ই একজন ব্যক্তি গল্পের মুনিয়া।যাকে ঘিরেই পুরো গল্প।
আসলেই কি মুনিয়ার মত মানুষেরা সবসময় প্রয়োজন ই হয়??প্রিয়জন হয়না??
অভিমান আর ইগোর দেয়াল আস্তে আস্তে কতটা শক্ত হয়ে যায় আমরা ঘুনাক্ষরেও টের পাইনা।সে ফোন দিলোনা কেন?আমিও দিবোনা।শুধু এইটুকু অভিমানে একদিন সামনের মানুষটা নাই হয়ে যায়।অন্যকারো হয়ে যায়।আমাদের কাছে ভালোবাসা না পেয়ে অন্য কারো কাছে ভালোবাসার সন্ধান করে।যেমনটা ঘটেছে মুনিয়া আর রাফির মাঝে।
বছরের পর বছর সংসার করে একটা মানুষ অন্য একটা মানুষের ওপর যে নির্ভর হয়ে যায়,অভ্যাসে পরিনত হয় তার জলজ্যান্ত প্রমান মুনিয়ার শশুর-শাশুরী।
লেখক গল্পে ভালোবাসা,সুখ,বেদনার অনুভূতি গুলোকে এত সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলেছেন যেন চোখের সামনে ঘটে যাওয়া একজীবনের প্রতিচ্ছবি এই অর্ধবৃত্ত বইটি।
এতটা নিখুত ভাবেও যে অনুভূতি প্রকাশ করা যায় তা সাদাত ভাইয়ের বই পড়লে বোঝা যাবে।
উপরোক্ত কারণেই রেটিং ১০/১০ দিয়েছি আমি।তাছাড়া পুরো বইয়ে বানান সংক্রান্ত কোনো জটিলতা নেই।কিছু কিছু আঞ্চলিকতা বাক্য গুলোকে আরো বেশি প্রানবন্ত করে তুলেছে।একটির পর একটি ঘটনা খুব নিখুতভাবে সাজানো হয়েছে।গল্পের এক অংশ পড়ার পর অন্য অংশের জন্য মন কৌতুহলী হয়ে উঠবে। এতে কোনো সন্দেহ নেই।
পরিশেষে, নতুন পাঠকের উদ্দেশ্যে বলতে চাই,আপনি যখন অর্ধবৃত্ত পড়বেন তখন পুরো একজীবনের হাসি কান্না চোখের সামনে দেখতে পাবেন।আরো দেখতে পাবেন সমাজে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনার সাথে সম্পর্কিত বেশকিছু ঘটনা। হিংসা,রাগ, ক্ষোভ,ভালোবাসা,স্নেহ,আশা,বেদনা সবকিছুর সংমিশ্রণে এক অর্ধবৃত্ত এক অনবদ্য সৃষ্টি। ❤অতএব বইটি কিনলে টাকা লস প্রজেক্টে যাবেনা এইটুকু গ্যারান্টেড।
ভালো লাগার লাইন গুলোঃ- সাদাত ভাইয়ের লেখা অন্যান্য কবিতা,কাজল চোখের মেয়ে(বই),এবং অর্ধবৃত্তে লেখা বিভিন্ন কবিতা সহ এই লাইন গুলো,
“আমার কোনো বন্ধু নেই।
আমি কেবল কোলাহলে ভিড়ের ভেতর হারিয়ে যাই,
ভুল মানুষে,যত্নে জমা ফুলগুলো সব বাড়িয়ে যাই,
হাওয়ায় ভাসা দীর্ঘশ্বাস বাতাস ভেবে,
নির্বাসনের একটা জীবন মাড়িয়ে যাই।
অনেক অনেক দোয়া ও ভালোবাসা সাদাত ভাইয়ের জন্য।মালিক আরো অনেক বেশি সুন্দর লেখার তৌফিক দান করুক।সাদাত ভাই থেকে যাক পাঠকের মনে আজীবন।শুভকামনা।
📢 রিভিউ নং ২_______________________
বুক রিভিউ (স্পয়লার)
বইঃ ‘অর্ধবৃত্ত’
লেখকঃ সাদাত হোসাইন
পার্সোনাল রেটিংঃ ৯/১০
একটা রাত। এক ভয়াল দুঃস্বপ্নের রাত। অসংখ্য স্বপ্ন আর সম্ভাবনার অবিশ্বাস্য যবনিকাপাত। জীবন যেন তার বুকভর্তি জমিয়ে রেখেছিল তীব্র গরল। সেই গরল সে ঢেলে দিল ভয়াল সেই কাল রাত্তিরেই। তারপর কত দিন এলো। কত রাত এলো। কিন্তু সেই রাত্রি আর কাটে না। যেন আরো গাঢ় হয়। যেন আরো জেঁকে বসে বুকের ভেতর। যেন আরো তীব্র শোকে চোখজুড়ে স্থির হয়ে থাকে। গেড়ে বসে আরো গভীরে। যেন এর থেকে মুক্তি নেই। কোনো মুক্তি নেই।
সম্পর্কের সংকট থেকেই শুরু হয় নানানবিধ সমস্যা। যে চার দেয়ালের ঘর মানুষের ভেতরে বন্ধন তৈরি করে, সেই দেয়ালই আবার কখন কখন হয়ে ওঠে সম্পর্ক বিভেদের বেড়াজাল। তাহলে অর্ধবৃত্ত আসলে কী? অর্ধবৃত্ত মূলত সেইসব সম্পর্কের সংযোগ, সংকট ও সমীকরণের গল্প। দেয়াল ও দ্বিধার গল্প। বিভেদ ও বন্ধনের গল্প। যার অদ্যোপান্ত জুড়ে রয়েছে জীবন। সম্পর্ক যদি জীবনের কেন্দ্র হয়, জীবন তবে বৃত্ত। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, সেই জীবন কী, পূর্ণ না অর্ধবৃত্ত? আমরা সবাই একটা বৃত্তে বাস করি। কিন্তু সেটি পূর্ণ নয়। কখনো মনে হয় না, জীবনের যেই সমীকরণটা মিলানোর জন্য আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করছি, সেটা আসলে আমাদের কাছে থেকেও দূরে। জীবনবৃত্তটা আসলে পূর্ণ নয়। সেই অর্ধবৃত্তটা আমাদের একজনমের তৃষ্ণাগুলো সঞ্চয় করে।
অন্যধারা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক ও নির্মাতা সাদাত হোসাইনের ৩৮৩ পৃষ্ঠার এই বইটিতে আমরা আমাদের মনস্তাত্তিক জগতের যে সম্পর্কের টানাপোড়নে ভুগি তার অনেকটাই বলা হয়েছে হয়তো নতুন কোনো সম্পর্কের মলাটে। নতুনভাবে।সবচেয়ে সহজ, সরল যে সম্পর্ক সেটারও যে এতটা জটিল রূপ হতে পারে কিংবা জটিল সম্পর্ককে চাইলেই যে এত সহজ সমাধানে নিয়ে আসা যায়, সেটাই এই বইয়ের লেখকের স্বার্থকতা। ভেবেছিলাম, খুব সহজেই অল্পদিনে শেষ করতে পারবো বইটি। কারণ, ইতিপূর্বে এমন মোটা উপন্যাস অনেক শেষ করেছি। পড়া শুরু করতেই আমার ধারণা পাল্টে গেলো। কিছুকিছু কোটেশন পেলাম— যেগুলো বারবার না পড়ে মনের ভেতরে পরিপূর্ণ শান্তি অনুভব করতে পারছিলাম না। সেই সমস্ত স্থানগুলো চুম্বকের মত আকর্ষিত করছিলো আমাকে। এক, দুই করে পৃষ্ঠা যতই বাড়ছিল, মাথার ভেতরে ততই চাপ পড়ছিল। মূলত দেশ ও সমাজ, মন ও মানুষ, প্রেম ও ভালোবাসা; এ সবকিছুরই সমষ্টি ‘অর্ধবৃত্ত।’ জীবন আসলেই বৃত্ত নয়; জীবন হল ‘অর্ধবৃত্ত।’ এই বৃত্তের এক প্রান্তে যদি রাফির কবিতা মুনিয়ার একাকীত্ব প্রশমিত করে, তবে অপর প্রান্তে মুনিয়ার কিশোরী মেয়ে ঋদ্ধিরও এই কবিতার কবিটার জন্য মন কেমন কেমন করে।
এই উপন্যাসের প্রত্যেকটি চরিত্র পড়েই আমার কেবল মনে হয়েছে, আরে, এটাতো অমুকের গল্প। ওটা তমুকের! জীবনের যে প্রবল বিরুদ্ধ স্রোতে মানুষ যুদ্ধ করে, নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যে লড়াই করে, তার সবই কী মূল্যহীন? নিজের নারী, স্ত্রী, মা কিংবা প্রেমিকা সত্তার বাইরেও আলাদা একটা পরিচয় প্রতিষ্ঠার জন্য, আলাদা একটা অবস্থান তৈরির জন্য যে কণ্টকাকীর্ণ দুর্গম পথ সে পাড়ি দেয়, তার সবই কী তবে অর্থহীন? যদি তা না-ই হবে, তবে সেসব পরিচয় ছাপিয়ে শেষ পর্যন্ত তার নিজের কাছেই নিজের শরীরী পরিচয়টা কেনো বড় হয়ে ওঠে? কেনো মনে হয়, কেবল শরীরী আবেদন ফুরিয়ে গেলেই প্রেমিকা তার প্রেমিকের কাছে গুরুত্বহীন হয়ে যায়?তাহলে কী পুরুষের কাছে নারীর শরীরী সৌন্দর্যই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ? তবে নারীর কাছে গুরুত্বপূর্ণ কী? এ এক কঠিন ধাঁধাঁযুক্ত প্রশ্ন!
সবচে মজার বিষয় হলো— গতকাল বিকেলে উপন্যাসটি শেষ হয়েছে। শেষ করেই ঘুমানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু কোনভাবেই ঘুম আসছিলো না। এপাশ ওপাশ করতে করতে হঠাৎ কখন জানি ঘুমিয়ে গেলাম। ঘুমের ভেতরে আমি নাদিয়াকে দেখতে পেলাম। গভীর জঙ্গলে নাদিয়া পেছনে তাকাচ্ছে, আর দৌড়াচ্ছে। আমার স্পষ্ট মনে আছে, এক বিধ্বস্ত নাদিয়াকে আমি পালাতে দেখেছি আমার সেই স্বপ্নে। মানুষ যেটি নিয়ে বেশি ভাবে, সেটি নাকি মানুষের স্বপ্নে আসে। হয়ত সেটি আমার ভাবনা থেকে স্বপ্নে ঢুকেছে।
জীবনে মোটামুটি অনেক উপন্যাস পড়েছি। তবে এই উপন্যাসটি পড়ার জন্য যতটা সময় নিয়েছি, ততটা সময় কোন উপন্যাসে নেইনি। দীর্ঘ সতেরো দিনের পরিসমাপ্তিতে উপন্যাসটি শেষ হয়েছে আমার। এই সতেরোটা দিন উপন্যাসটি আমার শোবার রুমে বালিশের পাশে মাথার কাছেই থাকত। অবসরের সময়টাতে পড়েই সতেরোটা দিন অতিবাহিত হয়েছে। তিনশো পৃষ্ঠার কাছাকাছি যেতে না যেতেই শুরু হলো রহস্য উন্মোচন। একেবারে রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনা। যেহেতু এটা একটি জীবনকেন্দ্রিক উপন্যাস, সুতরাং তাতে তো থ্রিল থাকবেই। এটাই স্বাভাবিক। জীবন মানেই তো রহস্য। কিন্তু আমার কাছে কেন জানি মনে হয়েছে, উপন্যাসটি ৩৮৩ পৃষ্ঠায় না থেমে আরো অনেকখানি পথ টেনে চলতে পারতো। সেই গতিতেই সামনের দিকে এগুচ্ছিল। তিনশো পৃষ্ঠার পরেই উপন্যাসটিকে টার্ন করা হয়েছে। অবশ্য সাদাত হোসাইন বড় পরিসর লেখে, ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে সহজ কথা লেখে, অনার্থক বই মোটা করার ধান্দায় থাকে। এমন কত কত কথা কতজনে বলে। কিন্তু আমার কাছে ৩৮৩ পৃষ্ঠার উপন্যাসটি পড়েও মনে হল ক্ষুদ্র হয়ে গেল। আমার তৃষ্ণাটা মেটেনি। হয়তো লেখক কিছু পাঠকের অভিযোগ কানে নিয়ে লেখাটা আর বাড়াতে চাননি সামনের দিকে। তবে শেষেরটুকু আমার কাছে তাড়াহুড়োই মনে হয়েছে।
সবশেষে একটা কথাই বারবার উপলব্ধি করেছি— সাদাত হোসাইনের নিঃসঙ্গ নক্ষত্র পড়ে মনে হয়েছিল, তার লেখা এটিই বেস্ট উপন্যাস। তারপর নির্বাসন পড়ে বেস্টের তালিকায় সেটিই এসেছিল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে— অর্ধবৃত্তই বেস্ট। আমি মনে করি, একজন পাঠক যখন একজন লেখকের প্রত্যেকটি বইকেই বেস্ট মনে করবেন বা এই লেখকের প্রিয় বই কোনটি প্রশ্নের উত্তরে ভাবান্বিত হবেন, ঠিক সেই পরিস্থিতিটাই একজন লেখকেন সবচে বড় পাওয়া। সবচে বড় অর্জন। যেটি এই বইয়ের লেখক অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন। এটি সম্পূর্ণই আমার ধারণা। আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে— লেখক তার প্রত্যেকটি বইয়ের সমাপ্তিতে পাঠকের জন্য একটা ভাবনার জগত তৈরি করে দেন। একটা প্রশ্ন রেখে যান। যেখানটাতে পাঠক তার নিজের মত করে ভেবে নিবে। যেমনটি দেখেছি নির্বাসনের সমাপ্তিতে। ঠিক তেমনি এই বইটিতেও লেখক পাঠকের জন্য একটি ভাবনার জগত তৈরি করে রেখেছেন শেষটিতে। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছিল শফিকের ব্যাপারে। রাফি ছেলেটার ব্যাপারে। দিপুর ব্যাপারে।
উপন্যাসটি বড় হবার কারণঃ
প্রতিটি পৃষ্ঠায়ই কিছু না কিছু প্রাসাঙ্গিক কথা বা বর্ণনা রয়েছে। ডায়লোগ কম। লেখকের অনুভূতির কথা বেশি। যেটা অন্যান্য উপন্যাসে হয়তো অতটা থাকে না। তবে মজার বিষয় হলো, গল্পের মূল প্লটের বাইরেও সেসব কথা কেনো জানি আমার খুব ভালো লেগেছে। মন ছুঁয়ে গেছে। সেই সমস্ত কোটেশন টাইপের লেখাগুলো পড়ার সময়ে বারবার থমকে যেতে হয়েছে। মার্ক করতে হয়েছে। বারবার মনে হচ্ছিল, কালো কালিতে গোটা গোটা অক্ষরে অনুভূতির যে কথাগুলো লেখা রয়েছে, সেগুলো আর কারোর নয়, নয় উপন্যাসের; এ আমার কথা! আমার অনুভূতির কথা। বুকের গভীরে জমানো আমাদের মনের কথা!
অতিরিক্ত চরিত্রঃ
গল্পের প্রয়োজনে অনেক সময়ে অনেকগুলো চরিত্র উপন্যাসটিতে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছে। যেটাতে পাঠক সাধারণত বিরক্ত হয়ে ওঠে। পাঠকের চোখেমুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট হয়। অথচ এই উপন্যাসটিতে প্রয়োজনীয় প্রত্যেকটি চরিত্রই এমনভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যে, বিরক্তির ছাপ তো দূরের কথা; বরং মন ছুঁয়ে যায়। মনে হয়, এই চরিত্রটাই বোধহয় উপন্যাসের মূল চরিত্র। সারাক্ষণ মাথার ভেতরে ‘ কী হবে, কী হবে’ চিন্তাটা ঘুরপাক খাচ্ছিলো। লেখক তার নিঁখুত উপস্থাপনায় চরিত্রগুলো ঠিক সেভাবেই দাঁড় করিয়েছেন। উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্রই এতটা স্বতন্ত্র ছিল যে এর কোনো একটিকে বাদ রেখে অন্যটি নিয়ে কল্পনা করলে সেটিও হয়ে যাবে অর্ধবৃত্ত।
উপন্যাসের মূল কাহিনী সংক্ষেপঃ
একটা বাড়ি। বাড়িটার কোন নাম নেই। সেই নামহীন বাড়িটার তবু প্রাণ ছিলো। বাড়িটা অকস্মাৎ প্রাণহীন হয়ে গেল। বাড়ির প্রাণ মূলত মানুষ। মানুষবিহীন বাড়ি কেবল ইটকাঠের কাঠামো। সেখানে প্রাণ নেই। বেঁচে থাকার ঘ্রাণ নেই। শব্দ নেই, কোলাহল নেই। হৃদস্পন্দন নেই। অথচ এই বাড়িটাতে এখনো মানুষ আছে। এই বাড়ির প্রতিটি ঘরে ঘরে তারা এখনো নিঃশ্বাস নিচ্ছে। তাদের হৃদস্পন্দন আছে। কিন্তু সেই নিঃশ্বাস কিংবা হৃদস্পন্দনে কোনো শব্দ নেই। যেন শব্দ হলেই অন্য কেউ তীব্র আতঙ্কে কেঁপে উঠবে। ডুকরে কেঁদে উঠবে। মানুষ মূলত মরে যায় মনে। এই মানুষগুলোও মনে মনে মৃত। যেন পাশাপাশি ঘরগুলো পাশাপাশি কবর। যেন প্রতিটি কবরে একেকটা নিষ্প্রাণ লাশ। আর বাড়িটা আস্ত এক গোরস্থান। এক নিঃশব্দ, প্রাণহীন, নির্জীব গোরস্থান।
একটা রাত। এক ভয়াল দুঃস্বপ্নের রাত। অসংখ্য স্বপ্ন আর সম্ভাবনার অবিশ্বাস্য যবনিকাপাত। জীবন যেন তার বুকভর্তি জমিয়ে রেখেছিল তীব্র গরল। সেই গরল সে ঢেলে দিল ভয়াল সেই কাল রাত্তিরেই। তারপর কত দিন এলো। কত রাত এলো। কিন্তু সেই রাত্রি আর কাটে না। যেন আরো গাঢ় হয়। যেন আরো জেঁকে বসে বুকের ভেতর। যেন আরো তীব্র শোকে চোখজুড়ে স্থির হয়ে থাকে। গেড়ে বসে আরো গভীরে। যেন এর থেকে মুক্তি নেই। কোনো মুক্তি নেই।
চার ছেলে এবং এক মেয়ে নিয়ে সুখী সংসার এই বাড়ির কর্তা আফজাল আহমেদ এবং মছিদা বেগমের। আশফাক আহমেদ, জাফর আহমেদ, রুবেল আহমেদ, দিপু আহমেদ এবং একমাত্র কন্যা সেলিনা আহমেদ।
বড় ছেলে আশফাক আহমেদঃ
পেশায় একজন কলেজ শিক্ষক। তাঁর স্ত্রী হাফসা। শারিরীক প্রতিবন্ধী। একেবারেই চলতে ফিরতে পারেন না হাফসা। বলা চলে অন্যজনের সাহায্যে তাকে চলতে হয়। সারাদিন বিছানায় পড়ে থাকেন। তাদের দুই কন্যা। নাবিলা এবং নাদিয়া।
নাবিলাঃ
কোচিং টিচার সাজ্জাদের সাথে প্রেমের সম্পর্কে বিয়ে হয়েছে নাবিলার। প্রতিনিয়ত যৌতুক নিয়ে স্বামীর অমানবিক নির্যাতন সহ্য করছেন সে। শুরু থেকে শেষ অবধি নাবিলার কোনো উন্নতি দেখা যায়নি। শুরুতেই তার স্বামী সাজ্জাদ নিখোঁজ হয়। শেষ পর্যন্ত তার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। যে কারণে সাজ্জাদের চরিত্রটাকে উপন্যাস থেকে আলাদা করে ফেলেছে।
নাদিয়াঃ
খুবই সাদামাটা একটা মেয়ে।
বড় বোন নাবিলার ভুলের মাশুল পোষাতে হচ্ছিল তাকে। সে কখনই তার ইচ্ছের ডানা প্রসারিত করতে পারেনি নাবিলার ভুলের পুনরাবৃত্তি হবার ভয়ে। এই চরিত্রটা একদম আমার বুকের ভেতরে গেঁথে রয়েছে। বাপ পাগল মেয়ে নাদিয়া। তবে সবশেষে তার সাথে যেটা হয়েছে, সেটা একদম মানার মত ছিল না। নাদিয়ার অজান্তেই অনুভূতির কঠিন লেনাদেনা চলছিল নাবিলার দেবর শফিকের সাথে। কিন্তু শফিককে চাইলেও কিছুই করার ক্ষমতা নেই তার। তার এই প্রবল অপরাগতায় একটা তুমুল অসম্ভাব্যতার ভাবনা সারাক্ষণ তাকে তটস্থ করে রাখত। কিছুই বুঝতে দিতে চাইত না। দুর্লঙ্ঘ্য এক পাহাড় দাঁড় করিয়ে দিত তার ইচ্ছের চারপাশে। নিজের একান্ত ব্যক্তিগত ভালোলাগাটাকে যেকোনো উপায়ে উপেক্ষা করতে চাইত সে। বড় বোন নাবিলার জীবনের নিষ্ঠুরতম অভিজ্ঞতার গল্প তার জীবনে তুলে দিয়েছে কঠিন এক নিষেধের দেয়াল। ওই দুর্লঙ্ঘ্য দেয়াল সে সচেতনভাবে কখনো অতিক্রম করার কথা ভাবেনি। কিন্তু তার অবচেতন মন আড়ালে-আবডালে কখন যে এমন বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল তা সে টেরই পায়নি।
নাদিয়ার মা এবং খালা মিলে নাদিয়ার বিয়ের জন্য কলেজের শিক্ষক মুকিতকে পছন্দ করেছেন। অবশ্য মুকিতের মা ইতিমধ্যে তাদের বাড়িতে এসে নাদিয়াকে আংটিও পরিয়ে গেছেন। নাদিয়ার পরীক্ষা শেষ হলেই বিয়ে হবে তাদের। এদিকে নাদিয়ার বাবা আশফাক আহমেদের অবৈধ সম্পর্ক তার কর্মস্থল তথা কলেজের প্রতিষ্ঠাতার মেয়ে আফসানা চৌধুরির সাথে। আফসানা চৌধুরি তাকে বিভিন্ন সময়ে টাকাপয়সা দিয়ে সাহায্য করেছেন। তারা গোপনে বিয়েও করেছেন। শুধুমাত্র আশফাক আহমদের ছোট মেয়ে নাদিয়ার বিয়ে না হওয়া অব্দি বিয়ের ঘোষণা দিতে পারছেন না তারা। সেই তাগিদেই আফসানা চৌধুরি নাদিয়ার বিয়ের জন্য পাত্র খুঁজে বের করেছেন তার কলেজের প্রশাসনিক পদে থাকা জহিরুলকে। হঠাৎ একদিন আশফাক আহমেদ নাদিয়াকে বেড়াতে নিয়ে যান আফসানার বাড়িতে। সেখানে দু’দিন থাকার পর জরুরী কাজে আশফাককে যেতে হয় ময়মনসিংহ। তখন আফসানার বাড়িতেই থাকে নাদিয়া।
সেদিন রাতেই আফসানা তার পছন্দ করা ছেলে জহিরুলকে নিয়ে আসেন বিয়ের জন্য। নাদিয়া বিষয়টি টের পেয়ে বাড়ির পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে বের হয়। দীর্ঘ জঙ্গল পেরিয়ে পিচঢালা বড় রাস্তায় পৌছতে রাতের অর্ধেকটা কেটে যায় তার। সেখানে একটি বাসে উঠে। পুরো বাসে যাত্রী ছিলো মাত্র তিনজন। কিছুক্ষণ পরে তারাও নেমে যায়। অবশিষ্ট থাকে নাদিয়া। তারপর তার ওপরে নেমে আসে জীবনের অভিশপ্ত এক ভয়াল কাল অধ্যায়। বাসের ড্রাইভার এবং হেল্পার মিলে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে গলায় ওড়না পেচিয়ে চলন্ত গাড়ি থেকে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে নাদিয়াকে। অনেকদিন হাসপাতালে থাকার পরে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে নাদিয়া। কিন্তু তারপর থেকে আর কারো সাথে কোনো কথা বলে না সে। ওদিকে মুকিতও আর তাকে বিয়ে করতে চায় না। গোটা সমাজের চোখে তখন সে একজন ধর্ষিতা। কিন্তু শফিক? সবশেষে দেখা যায়, শফিকই নাদিয়াকে বুকে টেনে নেয়। শফিকের বুকেই গড়ে ওঠে নাদিয়ার শান্তি নিকেতন।
শফিকঃ
নাবিলার একমাত্র দেবর শফিক।
একজন সহজসরল মানুষ। একেবারে জলের ন্যায় স্বচ্ছ, মসৃণ। কেমন মেয়েদের মতো লজ্জাবতীও। নাদিয়ার চোখে চোখ তুলে কখনো কথা বলতে পারে না। সবসময়ই সন্ত্রস্ত থাকে। কেমন জড়সড় এক নিপাট ভদ্রলোক। নাদিয়া সামনে এলেই গলা বেয়ে দরদর করে ঘাম ঝরতে থাকে অনবরত। এমন স্বচ্ছ মানুষের বুকের ভেতরও কি প্রেম থাকে! ভালোবাসা থাকে! সত্যি বলতে— এই সমস্ত মানুষগুলো বুকের ভেতরে আস্তো এক পৃথিবী গোপণ চেপে খুব স্বাভাবিকভাবেই চলতে-ফিরতে পারে জগতে। এই চরিত্রটা উপন্যাসে না পড়লে হয়তো এতটা গোছালোভাবে জানতামই না!
মেজো ছেলে জাফর আহমেদঃ
পেশায় একজন চাকুরীজীবী।
তাঁর স্ত্রী মুনিয়া। সে পেশায় একজন স্কুল শিক্ষিকা। চল্লিশোর্ধ্ব রাগী মা, প্রচণ্ড ব্যক্তিত্ববান স্কুল শিক্ষক, দায়িত্বশীল গৃহকর্ত্রী, রূপবতী নারী মুনিয়া। রূপে এবং গুণে তার চারিপাশটা তার হাতের মুঠোয় রেখে দিয়েছে একেবারে। তাকে দেখলে মোটেই মনে হয় না— এত বয়স হয়েছে তার! নিজের স্বাস্থ্য এবং ফিগারকে করে রেখেছেন আকর্ষণীয়। ফলে অরিজিনাল বয়সটা বোঝা দায়। বাসা থেকে কিছুটা দূরের এক স্কুলের শিক্ষিকা ছিলেন মুনিয়া। সেখানে থাকাকালীন এক অনুষ্ঠানে মুনিয়ার বক্তব্য শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন টুমরো’স গ্লোরি হাই স্কুলের পরিচালনা পরিষদের রফিকুল আলম। তিনি মুনিয়াকে টুমরো’স গ্লোরি হাই স্কুলের শিক্ষিকা হিসেবে নিয়োগ দেন। এরপর মুনিয়ার সাথে রফিকুল আলমের একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। যেই সম্পর্কের কথা কেউ জানতো না। এর কিছুদিন বাদে রফিকুল আলম মুনিয়াকে স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা বানিয়ে দেন। তার কিছুদিন পরে মুনিয়া তার সাথে সম্পর্ক রাখতে চাইলেন না। তখন চল্লিশোর্ধ্ব মুনিয়ার অবৈধ সম্পর্কের স্থাপনা গড়ে ওঠেছে ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া রাফির সাথে।
রাফিঃ
ইউনিভার্সিটির ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র রাফি। পাগল! বেপরোয়া! হুটাহাট মন যাকিছু চায়, সেসবের বাস্তবতা ঘটিয়ে ছাড়ে। আপাদমস্তক পাগল এক ছেলে। বেশ দারূন তার লেখনীর হাত। তার লেখা কবিতা দিয়েই মুনিয়াকে সে পাগল বানিয়েছে।
টুমরো’স গ্লোরি হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা মুনিয়া। রাফির ছোটবোন রথি এবং মুনিয়ার মেয়ে ঋদ্ধি এই স্কুলের একই ক্লাসে পড়ে। আবার ঋদ্ধির ছোট চাচ্চু অর্থাৎ মুনিয়ার দেবর দিপু এবং রাফি ইউনিভার্সিটির বন্ধু। সেই সুত্রেই মুনিয়ার সাথে রাফির পরিচয়।
জগতে এই একটা গোপন কিংবা আপন জায়গা রয়েছে মুনিয়ার। যেখানে সে বাইরের জগত ছেড়ে পুরোপুরি নিরাভরণ হতে পারে। অপকট, ভানহীন হতে পারে। এখানে সে চল্লিশোর্ধ্ব অভিজাত, গম্ভীর, সমীহ জাগানো প্রখর ব্যক্তিত্বের কোনো নারী নয়, বরং প্রবল অভিমানী, আহ্লাদী এক কিশোরী, খেয়ালী তরুণী, তুমুল তেষ্টায় ছটফটে এক প্রেমিকা। এ তাঁর অদ্ভুত এক জগৎ। যেখানে রাফি ছাড়া অন্য কারোর প্রবেশাধিকার নেই।
একদিন মাঝরাতে রফিকুল আলম মদ খেয়ে এসে মুনিয়ার বাড়ির সামনে মাতলামি করেন। মুনিয়া নীচে গিয়ে তাকে সামলাতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। তাদের ভেতরে হাতাহাতির এক পর্যায়ে মুনিয়া একটা ইটের টুকরা দিয়ে রফিকুল আলমকে শেষ করে দেয় চিরতরে। ঘটনার শেষ দিকে সেখানে অবশ্য রাফিও এসেছিলো। এবং রাফিই লাশটা মুনিয়ার বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে রেখে আসছিলো। সেই খুনের তদন্ত করতে গিয়ে ওসি আতাহার আলী মুনিয়ার সমস্ত সম্পর্কের ব্যাপারে উদঘাটন করে ফেলেছিলেন। সবশেষে গিয়ে সেই খুনের দায় কাঁধে নিলো রাফি। সে থানায় গিয়ে অকপটে স্বীকার করলো, রফিকুল আলমকে সেই খুন করেছে। বাঁচিয়ে দিল মুনিয়া। মুনিয়ার সংসারকে। গোটা একটা জীবনকে।
ঋদ্ধিঃ
চৌদ্দ বছর বয়সী মুনিয়া এবং জাফরের একমাত্র কণ্যা ঋদ্ধি। সবে এসএসসি পরীক্ষার্থী। তবুও ঋদ্ধির ধারণা, সে অনেক বড় হয়ে গেছে। কিন্তু সবাই তাকে ছোট ভাবে। বাবামায়ের নানা ব্যস্ততার অগোচরে হঠাৎ করেই মেয়েটি বড় হয়ে ওঠে। কেউই যেন সেটা টের পেল না। মায়ের প্রেমিক রাফি নামের ছেলেটি তার ছোট্ট বুকের খুব গহীনে কোথাও যেন তিরতির করে বইয়ে দিয়েছে এক স্রোতস্বিনী নদী। রাফির লেখার ভক্ত ঋদ্ধি। লেখা থেকেই রাফির প্রেমে প্রতিনিয়ত হাবুডুবু খায়।
এই ছোট্ট ঋদ্ধির একটা কথা বুকের ভেতরের বাঁপাশটাতে যেনো ঝড়ের গতিতে তীব্রভাবে আঘাত হানলো—
‘ভালোবাসলে অতোটা বোঝা যায় না,
কিন্তু ভালো না বাসলে বোঝা যায়।’
সেজো ছেলে রুবেল আহমেদঃ
পেশায় একজন ব্যবসায়ী।
জীবনে কোনদিন বিয়ে করবেন না বলে নিজের কাছে প্রতিশ্রুতিশীল এক মানব। পরিবারের মধ্যে তার তেমন কোন ভূমিকা নেই। উপন্যাসের শুরুর দিকে তার তেমন কোন উপস্থিতি না থাকলেও শেষের দিকে তুলি নামক একটি মেয়েকে হুট করে বিয়ে করে হাজির হন বাড়িতে। তাতে অবশ্য বাড়িতে তেমন একটা প্রভাব পড়েনি। কেবল সেলিনার কম পড়েছে। কারণ রুবেল বিয়ে করাতে সেলিনাকে রুবেলের রুম ছাড়তে হয়েছে। উপন্যাসে তার চরিত্রটাকে অতভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।
ছোট ছেলে দিপু আহমেদঃ
ইউনিভার্সিটির ফাইনালে ইয়ারে পড়ছেন।
তার কাজ শুধু সারাক্ষণ একমাত্র প্রেমিকা সুমিকে নিয়ে চিন্তাভাবনা করা। সুমিকে নিয়ে বান্দরবনের নীলগিরিতে ভরা পূর্নিমায় জোৎস্না বিলাস করবে সে। শুধুমাত্র এই সুযোগের অপেক্ষায় দিপু। কিন্তু সুমির একটাই কথা— তার বাবা অনেক কষ্ট করে তাকে পড়াশোনা করার জন্য ঢাকায় পাঠিয়েছেন। সুতরাং তিনি সময় নষ্ট করতে চান না একদমই।
কিন্তু সর্বশেষে সুমি রাজিই হলো বান্দরবন যেতে এবং তারা গেলেও। পূর্ণিমার জোৎস্নায় ভিজলো দুটো মন; দুটো দেহ। কিন্তু তাদের সুখময় সেই সময়টা বেশিক্ষণ সঙ্গ দেয়নি তাদেরকে। সুমির শ্বাসকষ্টের সমস্যা অনেক আগ থেকেই। সেই রাতে তীব্র শ্বাসকষ্টের সমস্যা দেখা দিল সুমির। কিন্তু ইনহিলার নিয়ে যায়নি সে। সেই শ্বাসকষ্টে তীব্র যন্ত্রণা নিয়েই দিপুর কোলে ঢলে পড়ল সুমি। এরপর দিপুর জেল হয়েছিলো বেশ ক’দিন। সুমির ময়নাতদন্ত শেষে দিপুকে ছেড়ে দেওয়া হলো। তবে সেই দিপু আর দিপু রইলো না। বেঁচে থেকেও যেন মৃত হয়েই বেঁচে রইলো দিপু।
সুমির মৃত্যুর পরের দিন তার বাবা অস্থির হয়ে ঢাকায় এসেছিল সুমিকে চমকে দিতে। কিন্তু তিনি ঢাকায় এসে নিজেই চমকে গেলেন। সুমির হলে ঢুকছে এমন এক ছাত্রীকে পেয়ে আজিজ মাস্টার সুমিকে একটা চিরকুট লিখে দিলেন— ‘মা গো, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তার মাকে দেখার জন্য ঝড়ের রাতে নদী সাঁতরে পারি দিয়েছিলেন। আজিজ মাস্টারেরতো আর মা নেই। এইজন্য সে তার মেয়েকে দেখার জন্য ঝড়ের রাতে নদী পার হয়ে ঢাকায় চলে এসেছে। এই মেয়েই তার মা। সে এখন এতিম ছেলের মতো মায়ের অপেক্ষায় গেটে দাঁড়িয়ে আছে।’ এই চিঠিখানা যখন আমি পড়ছিলাম, আমার চোখ দুটো ভিজে গেল। সবকিছু কেমন ঝাপসা হয়ে গেল। দরদর করে গা বেয়ে ঘাম ঝরতে শুরু করল। মাত্র দুটো লাইন। কিন্তু কতবার যে পড়েছি, তার কোনো ইয়ত্তা নেই।
এবং একমাত্র কন্যা সেলিনা আহমেদঃ
সদ্য ডিভোর্সি মেয়ে সেলিনা।
তার ধারণা— পরিবারের সবার কাছে তিনি বিশাল এক বোঝা। ডিভোর্সের পর থেকেই তার মেজাজ সারাক্ষণ খিটখিটে থাকে। কারোর কথা যেনো গায়ে সয় না তার। এই বাড়ির মধ্যে তাকে কেবল মুনিয়া সামলাতে পারে। ডিভোর্সের দীর্ঘদিন পর চাকরী মেলে সেলিনার। অফিসের বস আহসানের সাথে হয় তার মনের লেনাদেনা। হুট করেই একদিন তাকে বিয়ে করে বাড়িতে হাজির হন সেলিনা। এই মুখরা মেয়েটাও ভয়াল সেই রাতের পর কেমন নিশ্চুপ হয়ে গেল। চুপসে গেল। সে আর আগের মত মুখরা রইল না।
‘জীবন কখনই পূর্ণ বৃত্ত নয়,
জীবন আসলে এক অর্ধবৃত্ত।’
মুনশি মুহাম্মদ আরমান
কোটালীপাড়া | গোপালগঞ্জ
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?