গ্রীষ্মের বিকেলে ঝরে পড়া কৃষ্ণচূড়া ৬ষ্ট পর্ব ©মারুফ হুসাইন।

গ্রীষ্মের বিকেলে ঝরে পড়া কৃষ্ণচূড়া
৬ষ্ট পর্ব
©মারুফ হুসাইন।

(✍️ This article is collected from Maruf hossin timeline (All Credit To Go Real Hero The Author of this book 📖) 

শরিফুলের বুক কাপছে। সে কলিং চেপে দাঁড়িয়ে আছে৷ এখনো দরজা খোলা হয়নি। আসার আগে আফজাল সাহেবের কাছে ফোন দিয়েছিল৷ সে বাসায় নেই৷ তবে তাকে এসে পড়িয়ে যেতে বলেছেন। সপ্তাহে পাঁচদিন পড়াতে হবে৷ সময়ও একটু বেশি দিতে হবে। কারণ বাচ্চা মেয়ে। পড়ানোর তেমন কিছু নেই৷ পড়ানো বলতে পড়তে বসার অভ্যাস করানো৷ আর অক্ষর চেনানো৷ তার বেশি কিছু নয়। বেতনটাও মোটা অংকের। তাই একটু বেশি সময় নিয়ে পড়াতে তার কোনো অসুবিধে নেই৷ 
এখনো দরজা খোলা হয়নি। কলিং শরিফুল বেল চেপেছে প্রায় তিন-চার মিনিট হয়ে গেছে। আবার চাপবে কিনা ভাবতে লাগল। কিন্তু বারবার কলিংবেল চাপতেও কেমন দ্বিধা হচ্ছে।
আবার চাপবে কিনা ভাবতে ভাবতেই দরজা খুলে গেল। কাজের লোক দরজা খুলে দিয়ে তাকে সোফায় বসিয়ে চলে গেল।
সে এদিক-ওদিক তাকিয়ে ঘরটা দেখতে লাগল। বেশ গোছানো ঘর। অভিজাত্যের ছাপ আছে৷ 
‘স্যার আহেন!’
শরিফুল ঘাড় ঘুরায়৷ কাজের লোকটা দাঁড়িয়ে আছে। কোথায় পড়াতে হবে, কে জানে। সে উঠে দাঁড়ায়। কাজের লোকটার পিছু পিছু যায়৷ সামিয়ার রুমে নিয়ে বলে, ‘এই রুমেই পড়াইবেন৷ সামিয়ারে পাঠাইয়া দিতাসি!’
‘ঠিক আছে।’ বলে শরিফুল একটা চেয়ার টেনে টেবিলের সামনে বসে। গোলাপি রঙ্গের নতুন কেনা টেবিল। বিভিন্ন কার্টুনের স্টিকার লাগানো। মেয়েকে পড়ার টেবিলে বসতে আগ্রহী করার জন্যই হয়তো কার্টুনের স্টিকারে টেবিলটাকে সাজানো হয়েছে।
বেশ কিছুক্ষণ পর কাজের লোকটা সামিয়াকে নিয়ে আসল, ‘দাদা ভাই! তোমার নতুন আংকেল!’ বলে শরিফুলের দিকে ইশারা করে, ‘আংকেলকে সালাম দেও!’ 
শরিফুল বস্তিতে বাচ্চাদের পড়ালেও তার বড়লোক ঘরের বাচ্চা মেয়ে পড়ানোর অভিজ্ঞতা নেই। কিন্তু এইটুকু বুঝতে পারে, বাচ্চা মেয়ে পড়ানো এতোটা সহজ হবে না। প্রথমে তার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে কৌশলে পড়ানোর অভ্যাস করতে হবে। তাই সে চকোলেট নিয়ে এসেছিল। সামিয়ার দিকে চকোলেট এগিয়ে ধরল। কিন্তু তাতেও সে কাছে আসতে চাইল না। ভয়ে ভয়ে দূরে রইল।
‘আসো মা! এটা নাও!’ মুখে বেশ চওড়া হাসি এনে শরিফুল বলল।
বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টা করেও সামিয়াকে কাছে আনা গেল না। তখন শরিফুল হাত নেড়েচেড়ে ম্যাজিশিয়ানদের মতো হাত থেকে একটা ফুল বের করে সামিয়ার দিকে এগিয়ে দিল। সামিয়া বেশ অবাক হয়ে আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে এসে ফুলটা নিল।
বস্তির বাচ্চাদেরকে পড়ানোর প্রতি আগ্রহী করে তুলার জন্য শরিফুল বেশ কিছু ম্যাজিক ট্রিক শিখে রেখেছিল৷ এই ম্যাজিকগুলো দেখিয়েই বস্তির ছেলেমেয়েদেরকে তার পাঠশালার দিকে নিয়ে আসে৷ তার এই ট্যাকনিক বেশ কাজেও দিয়েছে৷ এখন সামিয়ার সাথে খাতির করতেও এই ট্যাকনিক কাজে লেগেছে৷
অল্প সময়েই শরিফুল সামিয়ার  সাথে খাতির জমিয়ে ফেলেছে। আজকে তার বই নিয়া পড়ানোর ইচ্ছা নেই৷ সামিয়ার সাথে খেলেই সময় কাটিয়ে দেয়।
‘স্যার, ম্যাডাম! আপনাকে খাওয়া-দাওয়া করে যেতে বলেছেন।’ ঘন্টাখানেক কাটিয়ে দেয়ার পর কাজের লোকটা এসে বলে গেল।
‘আচ্ছা, দেখি।’ বলে শরিফুল আবার সামিয়ার দিকে মনোযোগ দিল। তারা বিল্ডিং বক্স নিয়ে খেলছিল।
শরিফুল বাচ্চাটাকে প্রথম দিন-ই দেখেছিল। তখন তার তেমন কিছু মনে হয়নি। কিন্তু আজ যখন সামনে আসল, তখন দেখতেই তার বুকে মোচড় দিয়ে ওঠেছিল৷ সামিয়া দেখতে হুবহু মুনার মতোই। বলা যায় মুনার কার্বন কপি। যতক্ষণ মেয়েটার সাথে খেলা করেছে, ততক্ষণ তার মনে কেমন উদাসীনতা ভর করা ছিল।
মুনাদের বাসা থেকে বের হয়ে শরিফুল হাসপাতালে যাওয়ার কথা ভাবল। দু দিন হয়ে গেছে, বিলকিস আপাকে দেখতে যায় না। তবে ফোনে খোঁজ খবর নিয়েছে৷ মাঞ্জুরুলের দেয়া লোকটা নিজের মানুষ মনে করেই বিলকিস আপার দেখাশোনা করছে। মাঞ্জুরুল ডিউটিতে গেলে বন্ধুত্বের খাতিরে সেও দেখে আসছে।
মুনা তাকে খাওয়া-দাওয়া করে যেতে বলেছিল। কিন্তু সে পড়ানো শেষে কাউকে কিছু না বলে চোরের মতো বেরিয়ে এসেছে। সে জানে, প্রতিদিন তার এই বাসায় যেতে হবে। তাই একদিন পালিয়ে এসে কোনো লাভ নেই৷ মুনার মুখামুখি তার হতেই হবে। তবুও যে ক’দিন না হয়ে পারা যায়।
মুনা গোসল করে ফ্রেশ হয়ে ছিমছাম করে সেজেছিল। সেও বলতে পারে না, কেন সেজেছে! শরিফুল আসার পর থেকেই তার মনে উত্তেজনা কাজ করছে। সে থেকেই হালকা সাজার জন্য তার মনের এই তাগাদা। সে জানে, তার মন যতই চায়, সে শরিফুলের সামনে যাবে না। তবুও হালকা সাজুগুজু করার মনের  এই তাগাদাকে সে এড়িয়ে যেতে পারেনি৷
সে নিজের হাতে বেশ ভালো খাবার দাবার রান্না করেছিল।
‘চাচা!’ খাবারগুলো টেবিলে সাজিয়ে কাজের লোকটাকে ডাক দেয়।
‘হে বউ কউ!’ পঞ্চাশোর্ধ্ব জমশেদ নামের এই লোকটা আফজাল সাহেবের দূর সম্পর্কের চাচা হয়। গরীব মানুষ। ছেলে-মেয়ে কেউ নেই। তাই আফজাল সাহেব তার ঘরের দেখাশোনার জন্য নিয়ে এসেছেন।
‘সামিয়ার স্যারকে ডেকে টেবিলে খেতে বসান!’
‘বউমা! স্যার তো চইলা গেসে।’ সামিয়ার রুম থেকে ঘুরে এসে জমশেদ চাচা বলল।
‘আপনি খাবার খেয়ে যেতে বলেননি?’
‘কইসিলাম তো বউ!’ জমশেদ মিয়া উত্তর দেয়।
‘তাহলে কিছু না বলে এভাবে চলে গেল কেন!’ মুনা কিছুটা রাগান্বিত হয়ে বিরক্তি দেখিয়ে বলে, ‘এখন এই খাবারগুলা কী করব!’
সে মুখে খাবার নষ্ট হওয়ার জন্য রাগান্বিত আর বিরক্তি ভাব দেখালেও ভিতরে ভিতরে তার কষ্ট হচ্ছে। শরিফুলের এমন আচরণে তার উপর রাগ হচ্ছে। কিন্তু সেটা দেখানোর কোনো উপায় নেই বলে তার বুক ফেটে যাচ্ছে৷ এতো যত্ন নিয়ে রান্না করল। কিন্তু সে কিছু না বলে, না খেয়ে চোরের মতো পালিয়ে গেল৷ ঠিক সেদিন যেভাবে কাপুরুষ, চোরের মতো পালিয়ে গিয়েছিল।
জমশেদ চাচা সরে যেতেই সে উঠে দ্রুত সামিয়ার রুমে গেল। জমশেদ চাচার কথা তার বিশ্বাস হলেও তার মন মানতে চাচ্ছে না। তাই সে নিজে গিয়েই নিশ্চিত হতে চাইল। কিন্তু সামিয়ার রুমে সে ছাড়া আর কেউ নেই। শরিফুলের এমন ব্যবহারে তার বুক ফেটে কান্না বেরিয়ে আসতে চাইল। 
হাসপাতালের সামনে একটা টংয়ে বসে শরিফুল সিগারেট ধরায়৷ তখন তার মোবাইলে কল আসে৷ আননোন নাম্বার। কয়েক দিন আগেও এই নাম্বার থেকে কল এসেছিল। ধরতে পারেনি। আননোন নাম্বার বলে পরবর্তীতে ব্যাক করতেও ইচ্ছা করেনি৷ তার নাম্বারে কল আসে খুব কম। তাই কোনো নাম্বার থেকে একবার কল আসলে সেটা তার মনে থেকে যায়।
‘কোথায় আপনি?’ কল ধরতেই ওপাশ থেকে একটা মেয়ে কন্ঠ ভেসে আসে৷ 
‘কে বলছেন?’ শরিফুল চিনতে পারে না। 
‘কোথায় আছেন? তা বলুন আগে৷’
‘ঢাকা মেডিকেলের সামনে’
‘ঠিক আছে থাকুন!’ বলেই ওপাশ থেকে ফোন কেটে দেয়। 
প্রথমে চিনতে না পারলেও শরিফুলের এখন আর চিনতে অসুবিধে হয়নি। সেদিন নূহার অনেক বকবক শুনেছে সে। তাই প্রথমবার কন্ঠ না চিনলেও পরেরবার চিনে ফেলেছে৷ মেয়েটার কথা শুনে মনে হয়েছে, সে এখান এখানে আসবে।
শরিফুল মোবাইল বের করে ঘড়ি দেখে। আটটা বাজে। এই সময়ে মেয়েটা এভাবে আসতে চাচ্ছে কেন, শরিফুল বুঝে আসে না৷ সে এখানে থাকবে নাকি চলে যাবে, ভাবছে৷
মেয়েটাকে প্রশ্রয় দেয়া ঠিক হবে না, ভেবে সে হাঁটতে শুরু করে। এখান থেকে সরে যাচ্ছে।  মোবাইল বন্ধ করে দেয়৷
চলবে……
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?