বইয়ের নাম- কাগজের জাদুকর (রিভিউ)
লেখক- পলাশ পুরকায়স্থ
জনরা- প্যারাসাইকোলজিক্যাল থ্রিলার।
❝যাদুকর! তুমি কাগজ দিয়ে কী বানাও?
যাদুকর ফিসফিস করে বলে,
আমি ভয়ের শরীর তৈরি করি,
তুমি খেলবে?!❞
বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবচেয়ে দুর্বোধ্য এবং ব্যাখাতীত রহস্য হলো মানুষের ‘মন’। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পরিবর্তন মানুষের চিরায়ত বাস্তবতাকে ভেঙ্গেচুরে খান-খান করে দেয়, উন্মত্ত করে তোলে অন্তর্নিহিত দানবকে। মনের সেই স্বাভাবিক বেড়াজাল ভেঙ্গে গহীনের দানবকে যদি নিয়ন্ত্রণ করে কেউ, কী হবে? গল্পটা সেই দানবের মুক্ত হওয়ার, চিরচেনা বাস্তবতা পেরিয়ে প্রতিশোধের, সর্বোপরি গল্পটা ‘কাগজের জাদুকর’-এর।
★কাহিনী সংক্ষেপ-
জাপানফেরত কঙ্কার টনক নড়ল, যখন সে নিজের একমাত্র কন্যার মাঝে অতিপ্রাকৃত কিছু ব্যাপার লক্ষ্য করল। আট বছর বয়সী শিশু রেবেতীর কথাবার্তা বড়দের মতন, কাগজের অরিগ্যামি তার বেশ প্রিয়। কিন্তু অরিগ্যামি গুলোয় কোনো সত্তা আছে কি, সেগুলোকে কেন জীবন্ত লাগে? কেন এক বৃদ্ধার ছায়ার হাসি শোনা যায় রেবতীর একান্তে। কী অন্ধকার অধ্যায় চাপা পড়ে আছে সুদূর জাপানে, যার প্রভাবে একের পর এক নৃশংস খুন হচ্ছে ঢাকায়। প্রতিটা খুনের সাথে জড়িত অরিগ্যামি, প্রতিটা খুনে এক নাম ধোঁয়াশা তৈরি করছে–কাগজের জাদুকর! কে এই সত্তা? অতিপ্রাকৃত নাকি যৌক্তিক ধাঁধা। শিবলী আর সাজ্জাদ পারবে কি হিংস্র খুনগুলির রহস্য ভেদ করতে?
★পাঠপ্রতিক্রিয়া-
গল্পের প্লটটা বেশ ইন্টারেস্টিং, বইয়ের শুরু থেকেই একরাশ রহস্য রেখে কাহিনীর প্রারম্ভ ঘটে, এক কথায় পার্ফেক্ট স্টার্টিং! স্টার্টিংটাই আমার আগ্রহের পারদ তুঙ্গে উঠিয়েছিল। স্বভাবতই একটানে পড়ে যাবার তাড়না অনুভব করছিলাম। গল্পে কোনো বাহুল্য নেই, তাই প্রচুর দ্রুত কাহিনী এগিয়ে গেছে–যা আমার কাছে পজিটিভ দিক ঠেকেছে। বইয়ের ব্যাক কভারে একাধিক চরিত্র দেখে শঙ্কা জেগেছিল, এতগুলো চরিত্র ঠিকমত এগোবে কি? তালগোল পাকাবে নাতো? কিন্তু আমার চিন্তা অমূলক ছিল, প্রতিটা চরিত্র ক্রমানুসারে উপস্থিত হয়েছে, এবং তাদের কর্ম যথাযথভাবে পালন করেছে। চরিত্রগুলো পার্ফেক্টলি গোছানো হয়েছিল, বিন্দুমাত্র অভিযোগ নেই। মাঝের ৪/৫ পৃষ্ঠায় একঘেয়েমি আসছিল, কিন্তু পরে আবার আগ্রহের পাল্লা ভারী হয়ে যায়। শেষের দিকে গল্পের মোড়, চরিত্রগুলোর মানসিক টানাপোড়ন, উত্থান-পতন এবং রহস্য সমাধান অনবদ্য ছিল, পুরোটা সময় গল্পে ডুবে ছিলাম, বইয়ের সমাপ্তি বেশ এঞ্জয় করেছি। একাধিক চরিত্র থাকলে সমাপ্তি নিয়ে অনেক সময় অভিযোগ থাকে, কিন্তু এক্ষেত্রে সমাপ্তি সব চরিত্রের জন্যে পার্ফেক্ট লেগেছে। চাইলে সামনে এই কনসেপ্ট নিয়ে আরও কাজ করা যাবে, এভাবেই লেখক সমাপ্তি টেনেছেন।
★চরিত্রায়ন-
বইয়ে অনেক চরিত্র বিদ্যমান। প্লটটার ভিত্তি বলা চলে ‘চরিত্রায়ন’। মূলত রেবতী, কঙ্কা(রেবতীর মা), শিবলি, বুরা সাজ্জাদ, মতিন–এই চরিত্রগুলোই ফোকাসে ছিল। তবে যে এই গল্পের গোড়পত্তন ঘটায়, যাকে কেন্দ্র করে সব রহস্যের সূচনা, সেই ‘রেবতী’-কে প্রচণ্ড অনুভব করেছি। এই চরিত্রটা ১০০% নিখুঁত ছিল তা হলফ করে বলতে পারি। প্রতিবার ওর আগমন ছমছমে অনুভূতির সৃষ্টি করত। এই চরিত্র মনে গেঁথে থাকবে বহুদিন। এছাড়া গল্পের প্রতিটা মোড়ের সাথে সাথে চরিত্রগুলোর মনস্তাত্তিক পরিবর্তন চিন্তার খোরাক জুগিয়েছিল। মতিনের চরিত্র, চিন্তাভাবনা, কর্মকাণ্ড বাস্তবিক অর্থেই জটিল ছিল।
★ভালো-মন্দ দিকগুলি-
প্রথমেই বলতে হয় গল্পের কনসেপ্টটা দারুন। প্যারাসাইকোলজি অর্থাৎ প্যারানরমাল সাইকোলজি নিয়ে ভিন্নধর্মী এক মৌলিক। গল্পের শেষ অবধি সন্দিহান থাকাবেন যৌক্তিক না কি অতিপ্রাকৃত গল্প এটা। মাঝে মাঝে দৃশ্যগুলো মানসপটে ভাসলে শিউরে উঠবেন। এতগুলো চরিত্র সাজিয়ে এত ফাস্ট গল্প লেখায় লেখক প্রশংসার দাবি রাখে। গল্পের মন্দ দিক বলতে গেলে–বেশ কিছু বানান ভুল ছিল, বিশেষ করে কি আর কী এর ব্যবহারে অসংগতি দৃষ্টিকটু ছিল। এছাড়া বলল/বললেন এর পর সংলাপের আগে কমা অনুপস্থিত। তাছাড়া সংলাপে মাঝে মাঝে শুদ্ধ এবং অশুদ্ধের মিশ্রণ ঘটিয়েছেন লেখক, যেকোন একটা ধরে চরিত্র এগিয়ে নিলে বেশ হতো।
পরিশেষে, ভিন্নধর্মী কনসেপ্টে লেখা দারুণ মৌলিক ‘কাগজের জাদুকর’। কাহিনীটা শেষ অবধি আপনায় আচ্ছন্ন রাখবে, মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়নের ও আবেগের সাথে অতিপ্রাকৃত আখ্যান পড়ে বেশ উপভোগ করবেন নিশ্চিত। বইটার প্রোটাগনিস্ট শিশু হলেও বইটা অবশ্যই প্রাপ্তবয়স্কদের জন্যে, শিশু নির্যাতন নিয়ে বেশ শিক্ষণীয় এক মেসেজ আছে বইটায়।
বইয়ের নাম- কাগজের জাদুকর
লেখক- পলাশ পুরকায়স্থ
জনরা- প্যারাসাইকোলজিক্যাল থ্রিলার
প্রকাশনী- কুহক কমিক্স এণ্ড পাবলিকেশন
মুদ্রিত মূল্য- ৩৫০ টাকা মাত্র