উম্মতে মুহাম্মাদির অনন্য বৈশিষ্ট্য এই যে, আল্লাহ তাআলা এই উম্মতের দীন ও শরিয়াতের উৎস কুরআন ও সুন্নাহকে কিয়ামত পর্যন্ত অবিকৃত ও অপরিবর্তিত রাখার জিম্মাদারি নিয়েছেন। তিনি ইরশাদ করেছেন,
اِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَ اِنَّا لَهٗ لَحٰفِظُوْنَ.
‘বস্তুত এই কুরআন আমিই অবতীর্ণ করেছি এবং আমিই এর রক্ষাকর্তা।’১
অতঃপর এই সংরক্ষণের প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার জন্য রাব্বুল আলামিন কিছু সুসংহত ঐশী নিজাম প্রবর্তন করেছেন। প্রথমত এমন এক কাফেলা সৃজন করেছেন, দীনের ব্যাপারে যাদের আমানতদারিতা ও আত্মত্যাগের কোনো নজির ইতঃপূর্বে নেই। বুঝ ও মেধাশক্তিতে যাদের তুলনা নেই। শরিয়াহ সংরক্ষণের জন্য যাদের থেকে উত্তম মানবকাফেলা আর হতে পারে না। তারা নিজেদের সর্বস্ব বিনিয়োগ করে এই দীন সংরক্ষণের গুরুদায়িত্ব আনজাম দিয়েছেন এবং পরবর্তীদের কাছেও পূর্ণ আমানতদারিতার সঙ্গে পৌঁছে দিয়েছেন। পরবর্তী প্রজন্মও একই ধারাবাহিকতায় শরিয়াহর মর্ম বোঝা, সংরক্ষণ করা এবং পৌঁছে দেওয়ার আমানত রক্ষা করেছেন।
তারা শরিয়াহর নুসুসকে প্রতিটি শব্দ-বাক্যসহ যেমন রপ্ত করেছেন, তেমন এই নুসুসের ব্যাখ্যা ও অন্তর্নিহিত মর্মও সংরক্ষণ করেছেন। সুতরাং শব্দের বাহ্যিক দিকটি যেমন রক্ষিত, শব্দের ভেতরগত ফাহমও সংরক্ষিত। তাই কুরআন ও সুন্নাহর এমন কোনো নতুন ব্যাখ্যার অবকাশ নেই, সালাফ থেকে যা উদ্ধৃত নয়, কিংবা সালাফের প্রমাণিত মূলনীতির আলোকে সুবিদিত নয়।
প্রখ্যাত সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘যদি তোমরা অনুসরণ করতে চাও, তাহলে আসহাবে মুহাম্মাদের পথ অবলম্বন করো। অন্তরের দিক থেকে যারা ছিলেন উম্মাহর পবিত্রতম পুরুষ। ইলমের দিক থেকে সুগভীর, যাবতীয় কৃত্রিমতা থেকে মুক্ত; সততা-স্বচ্ছতা ও হেদায়াতের ক্ষেত্রে উম্মাহর মূর্তপ্রতীক। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গী হিসেবে, দীনে ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য যাদেরকে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন নির্বাচন করেছেন। সুতরাং তোমরা তাদের মর্যাদা উপলব্ধি করো, তাদের পথ অনুসরণ করো। কেননা সিরাতে মুস্তাকিমের ওপর তারা ছিলেন অটল-অবিচল।’২
বিখ্যাত সাহাবি হুজাইফা ইবনুল ইয়ামান রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘হে কুরআন পাঠকারী সমাজ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং তোমাদের পূর্ববর্তীদের (সাহাবিদের) দেখানো সোজা পথ অবলম্বন করো। আল্লাহর শপথ! যদি তোমরা তাদের পথে দৃঢ় অবিচল থাকতে পারো, তাহলে অনেক দূর অগ্রসর হবে। আর যদি ডান দিকে কিংবা বাম দিকে ছিটকে পড়ো, তাহলে সুদূর গোমরাহিতে পতিত হবে।’৩
উপরিউক্ত বাণীসমূহের মতো আরও প্রয়োজনীয় এবং নির্দেশনাপূর্ণ বাণী পূর্বসূরি সালাফদের থেকে বর্ণিত হয়ে এসেছে। যার উদ্দেশ্য হলো, ইসলামি শরিয়াহ বোঝা, উপলব্ধি করা ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা এবং পালন করার ক্ষেত্রে পূর্বসূরি সালাফদের বিকল্প নেই। বস্তুত দীনের প্রতিটি বিষয় পরম্পরাগত সূত্রে আবদ্ধ। বর্ণনা ও সংরক্ষণের এই ধারা যুগ পরম্পরায় সূত্রের মাধ্যমে চলে আসছে। এখানে নতুন কোনো বিষয় অনুপ্রবেশের সুযোগ নেই।
কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, ‘মাসাদিরে শরিয়াহ’র ক্ষেত্রে পূর্বসূরি সালাফদের এই চিন্তা ও দর্শন বারবার ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছে। কখনো শত্রুর বেশে, কখনো ইসলামের ছদ্মনামে। স্বাভাবিকভাবে সাধারণ মানুষ ও অপরিপক্ব জ্ঞানের অধিকারীরা এই ফিতনায় পতিত হয়ে যায়। এজন্য তাদেরকে জাগ্রত ও সচেতন করা সময়ের প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বক্ষ্যমাণ গ্রন্থটি এই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই রচিত হয়েছে। লেখক এখানে সালাফদের অনুসরণের বিষয়টি যথেষ্ট বিশ্লেষণ করেছেন এবং বিভিন্নভাবে প্রমাণিত করেছেন। এ ব্যাপারে মোটাদাগে যে আপত্তিগুলো এসে থাকে, সেগুলোর নিরসনও করেছেন। বইটি পড়ার পর আমার মনে হয়েছে, এই বইয়ের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি অংশই উপকারী ও প্রয়োজনীয়। চলমান সময়ে চিন্তার স্বাধীনতা বা ইলম আহরণের ক্ষেত্রে বাধাহীন বিচরণের শিরোনামে যে বিভ্রান্তিগুলো তৈরি হচ্ছে, সেগুলো মোকাবিলা করা এবং নিজের অবস্থান সঠিক রাখার ক্ষেত্রে বইটি বিরাট ভূমিকা রাখবে, ইনশাআল্লাহ।
একজন সম্পাদক হিসেবে যে পরিমাণ ইলম, পাণ্ডিত্য ও গভীরতার প্রয়োজন, তার কিছুই আমার নেই। কেবল দীনি সম্পর্ক ও হৃদ্যতার খাতিরে এবং নিষ্ঠাপূর্ণ একটি কাজের সাওয়াব অর্জনের তাগিদে বইটি দেখার সুযোগ হয়েছে।
সর্বোপরি আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে অবনত মস্তকে হেদায়াত প্রার্থনা করছি। যাবতীয় গোমরাহি থেকে তাঁর কাছে পানাহ চাই। তিনি যেন ইখলাস দান করেন এবং আমাদের আমলগুলো কবুল করেন। আমিন।
১.সুরা হিজর, আয়াত ৯
২.জামিউ বায়ানিল ইলম, ১৮১০
৩.জামিউ বায়ানিল ইলম, ১৮০৯
মাওলানা মুহাম্মাদ মাসরুর
লেখক। সম্পাদক
- বই : ফাহমুস সালাফ : দীন বোঝার কষ্টিপাথর
- গ্রন্থনা : মাওলানা ইফতেখার সিফাত
- সম্পাদনা : মাওলানা মুহাম্মাদ আফসারুদ্দীন, মাওলানা মুহাম্মাদ মাসরুর
- পৃষ্ঠা সংখ্যা : ১৬০
- মুদ্রিত মূল্য : ২৩০৳
- বাঁধাই : পেপারব্যাক
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?