“এখানে সব কিছুই ছিল। আবার অনেক কিছুই ছিল না। সুখ ছিল। দুঃখ ও ছিল। আনন্দ ছিল। ছিল বেদনাও। কিন্তু ছিল না স্বাধীনতা। “
“হারেম” শব্দটি আরবি “হারাম” শব্দ থেকে আগত, যার আক্ষরিক অর্থ “নিষিদ্ধ”। তিন অক্ষরবিশিষ্ট ছোট্ট এই শব্দের কাঠামোগত আকৃতি যতই ক্ষুদ্র হোক না কেন, এর ব্যবহারিক ব্যপ্তি কিংবা গুরুত্ব ইতিহাসের পাতায় যে কতটা বিশাল ও চাঞ্চল্যকর, তাই তুলে ধরেছেন শ্রীপান্থ তার “হারেম” নামক চমৎকার এই বইটিতে।
বইটির সিংহভাগ জুড়ে তুর্কী হারেমের চমকপ্রদ বর্ণনা থাকলেও মুঘল, চৈনিক, লক্ষ্ণৌ এমনকি হিন্দু ও জৈন হারেমের পৃথক পৃথক বর্ণনা দিতেও ভোলেননি লেখক। প্রতিটি হারেমই সেই সুনির্দিষ্ট সমাজব্যবস্থা, সভ্যতা ও সংস্কৃতির আলোকে গড়ে উঠা ইতিহাসের স্বাক্ষরস্বরূপ। রাজ্যের ভেতরকার আরেকটি রাজ্য, কিংবা পৃথিবীর বুকে গড়ে উঠা একটি কৃত্রিম বিলাসবহুল স্বর্গই যেন হারেম, যেখানে কোন সুখশান্তিরই অভাব ছিলো না শুধুমাত্র স্বাধীনতার সুখ ছাড়া।
হারেম- ঐতিহাসিকদের মতে, একটি বিশেষ সামাজিক সিস্টেম বা ব্যবস্থা হলেও ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, এটি সেই সিস্টেমের আলোকে গড়ে উঠা একটি প্যারাডক্স। কারো কাছে হারেম স্বর্গ, তো কারো কাছে নরক। কারো কাছে সাফল্যের চাবিকাঠি, তো কারো কাছে ব্যর্থতারই নামান্তর; কেননা লেখক নিজেই বলেছেন, সাফল্য ও ব্যর্থতা এখানে পাশাপাশি চলে। হারেমে গাঁথা প্রতিটি ইটের পাঁজরে প্রতিধ্বনিত হয় কারো নিষ্ঠুরতা মাখা অট্টহাসি, তো অপরদিকে সেই হারেমেরই প্রতিটি কোণ সাক্ষী হয়ে আছে কারো কান্নাবিজড়িত আর্তনাদ আর মৌন হাহাকারের।
হারেমের অন্ধকারাচ্ছন্ন ইতিহাসের সাথে কি না জড়িয়ে আছে! প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, ক্ষমতার লোভ, বিকৃত রুচির চরিতার্থকরণ, মানবতার অবক্ষয়, প্রতিশোধস্পৃহা, বিদ্রোহ– ইত্যাদি ইত্যাদি! এ সবই হয়ত তৎকালীন ক্ষমতাশালীদের প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির দোলাচলে দুলতে থাকা দ্বিধাদ্বন্দ্ব কিংবা তাদের নিছক খেয়ালীপনারই ফল!
শ্রীপান্থ শুধু হারেমের অন্ধকারাচ্ছন্ন অংশটুকুই তুলে ধরেননি, তুলে ধরেছেন রাজরাজড়াদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, নারীদের ক্ষমতায়ণ, খোজাদের মনস্তত্ত্ব , হারেমের হামামের বিবরণ সহ ক্ষমতার উত্থান পতনের অবিমিশ্র এক অধ্যায়ও। এখানে যেমন রয়েছে সাধারণ বাঁদী থেকে “সুলতানা ভালিদ” হবার নজীর, তেমনি রয়েছে শুদ্ধতম ভালবাসার স্বীকৃতি না পাবার করুণ ইতিহাসও, যা বয়ান করে হারেমের গহ্বরে অনেক তাজা প্রাণের সাথে সাথে চাপা পড়ে যাওয়া অনেক স্বচ্ছ অনুভূতি আর উপলব্ধিরও।
সবশেষে এটুকুই বলতে পারি, ইতিহাসের পাতা থেকে ঘুরে আসার জন্য হারেম এক “রোমাঞ্চকর এবং সাবলীল” যাত্রা হতে পারে আমার মত ইতিহাসে আগ্রহী পাঠকদের জন্য।
হারেম
শ্রীপান্থ
ধরনঃ নন ফিকশন, ঐতিহাসিক গ্রন্থ
প্রথম প্রকাশঃ ১৯৬৭
প্রকাশনীঃ দে’জ পাবলিশিং
মোট পৃষ্ঠাসংখ্যাঃ ১১৪