- বই : সফলতার পথ ও পাথেয়
- লেখক : মাওলানা ওয়াহিদুদ্দিন
- অনুবাদ : মওলবি আশরাফ
- প্রকাশনী : চিলেকোঠা পাবলিকেশন
- জনরা : আত্মউন্নয়নমূলক বই
আত্মউন্নয়নমূলক বই বা মোটিভেশনাল বই আমার অপছন্দের। মূলত এককালে আমাদের এ দেশে ডেসটিনির ভাইয়ারাই মূলত প্রথম মোটিভেশনাল কথা বার্তা বলতেন, তেনাদের প্রতি ব্যাপক বিরক্তি থেকেই আসলে এ অপছন্দের ব্যাপারটা তৈরি হয়েছে। তারা অতীতে আমার অনেক সময় নষ্ট করেছেন। যদিও তারা ইনভেস্ট করার জন্য যথেষ্ট মোটিভেট করতে পারেন নাই ,
তবে ‘সফলতার পথ ও পাথেয়’ বইটাকে স্রেফ মোটিভেশনাল বই বললে বোধহয় ভুল হবে। এ বইয়ে মাওলানা ওয়াহিদুদ্দিনের যে সকল রচনা একত্রিত করা হয়েছে সেসবের মধ্য দিয়ে মাওলানা মূলত বলতে চেয়েছেন, সাফল্য মানুষের হাতেই আছে আসলে। এটা আকাশ থেকে পড়ে না। সাফল্য দীর্ঘ প্রস্তুতি ও পরিশ্রমের পর আসে। ট্রেডিশনাল মোটিভেশনাল স্পিকারদের সাথে মাওলানার পার্থক্য হল, ট্রেডিশনাল স্পিকাররা গম্ভীর মুখে বলেন তুমিও পারবা, তোমার ভেতর জন্তু… থুক্কু বাঘ ঘোড়া হাতি সিংহ ঘুমায়।
মাওলানা এসব মোটিভেশনের গোড়ায় পানি ঢেলে দিয়ে বলেন, দূর মিয়া কী কন না কন। মানুষরে তিনি বলেন, আপনি অবশ্য পারবেন না, আপনি ব্যর্থ হবেন। তবে সেটা কখন? যখন আপনি চেষ্টা না করেন, নিজেকে না বদলান, যখন পরিস্থিতি না বোঝেন, বাস্তবতা উপলব্ধি করতে না পারেন। তখন আপনার জন্য ব্যর্থতাই অপেক্ষা করছে।
কর্ম করলে সফলতা এটা মাওলানা এ বইয়ে বারবার বলেছেন এবং সেসব ভাল কথাই মোটামুটি। কিন্তু আমি তারে বিনা সমালোচনায় ছেড়ে দিতে চাই না।
এ বইয়ে মাওলানার যেসব প্রবন্ধ রয়েছে, সেসব মূলত পুঁজিবাদের প্রভাবে পুষ্ট। এটা এক প্রকারের ধর্মীয়-আত্মিক উন্নয়নের বই হলেও, মাওলানা বোধহয় খেয়ালও করেননি পুঁজিবাদ তার কলমে-জবানে ভর করেছিল। ভারত সরকারের কাছের মানুষ হয়ে মাওলানা জগতকে যেভাবে দেখেছেন, ভারতের আর সব মানুষ কী সে চোখে জীবনকে দেখে? এ উত্তর মাওলানার লেখায় নেই। ভারত সরকারে সুনজরে বাস করে মাওলানা চারপাশের জগতকে যেভাবে দেখেছেন, ভারত সরকারের অপছন্দের মানুষেরা চারপাশের জগতকে সে চোখে নিশ্চয় দেখেন না।
ও, বলছিলাম পুঁজিবাদের প্রভাবের কথা। পুঁজিবাদ যেভাবে বলে- আরও খাটো, আরও ছোটো, নাকে-মুখে পরিশ্রম করো, আরও বড় হও, আরও উন্নতি করো, থেমো না ছুট… ছুট… ছুট…মাওলানাও ওই একই সুরে গেয়েছেন বলেই মনে হল।
আমি বিশ্বাস করি, সফল হওয়াই মানুষের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হতে পারে না। মানুষের একটা বিচিত্র নিজস্ব জগত থাকে। সে জগতে সে ফুল-পাখি বা বৃষ্টি কিংবা জোছনা দেখেও আলস্যে সময় পার করে দিতে পারে, সে অধিকার মানুষের আছে। সে ইচ্ছা প্রতিটা মানুষেই ঘুমায়। আজকাল জীবনে উন্নতি করার ছবক শুনলে আমার তাকে বলতে ইচ্ছে করে, জীবনে উন্নতি না করাটাও একটা দারুণ বিষয়। মানুষের ভেতর এ জিনিসটা জাগিয়ে তোলা উচিত। এ বিষয়েও কিছু মোটিভেশনাল জ্ঞান ছড়ানো দরকার!
এছাড়াও, বইয়ে জাপানিদের বেশ প্রশংসাই করলেন মাওলানা। কিন্তু জাপানিদের বিষয়ে গভীর ধারণা তার ছিল বলে মনে হয় না।
আমি কিছুদিন একটা গবেষণামূলক কাজের জন্য জাপান বিষয়ে পড়াশুনা করেছিলাম। যেসব তথ্য আমি পেয়েছি তা ভয়াবহ। জাপানি পুরুষরা নারীদের প্রতি অনেক এগ্রেসিভ। এ তথ্য আরও বেশি শকিং ছিল এ কারণে যে, জাপানের সিংহভাগ মানুষ সেক্যুলার। ধর্মের গণ্ডীর বহু বাইরে তাদের বাস। ফলে, নারীর প্রতিএগ্রেসিভনেসটা রীতিমত স্টাডি করে দেখা দরকার। মিলিয়ে দেখা দরকার, আমাদের সমাজের সেক্যুলারদের চরিত্রও ওই একইরকম কিনা।
যাই হোক, ছোট্ট কিউট একটা বই। পড়তে বসলেই শেষ হয়ে যায়। ভাল বই সেটা বলতে দ্বিধা নেই। সংগ্রহে রাখার মতই বই। কেউ কেউ হয়ত এ বই থেকে বৈষয়িক ও আত্মিক উন্নয়নের পথ খুঁজে পেলেও পেতে পারেন।
অনুবাদটা অনেক প্রাঞ্জল। অনুবাদক মওলবি আশরাফের ভাষা বেশ ঝরঝরে। পড়ে আরাম পাওয়া যায়। যদিও সরাসরি উর্দু থেকে অনুবাদ করেছেন বলে কতটা ভাল অনুবাদ করেছেন সেটা যারা উর্দু জানেন তারাই বলতে পারবেন। কিন্তু আমার পড়তে ভালই লেগেছে।
সুখী হবার লক্ষ্য এই জগতে সবার। কিন্তু এই লক্ষ্যই যে আসল লক্ষ্য নয়, এই কিতাবখানা আমাদের মাঝে সেই বোধ জন্মাবে।
সুফিবাদে যেমন বলা হয় পরমপ্রিয়’র সাথে মিলন নয়, বরং মিলনের অভিলাষে কদম ফেলাই সবচেয়ে বড় ব্যাপার; ঠিক সেভাবেই গল্পের গাঁথুনিতে কিংবা চমৎকার কোনো উদাহরণ টেনে মওলানা বলবেন, ‘কর্মতৎপরতাই সাফল্যের মূল।’ সাফল্যকে তিনি কোনো নির্দিষ্ট ধারণায় আটকে দেননি।
পৃথিবী এক খোলা ময়দান, এখানে যেকোনো লোক যেকোনো পন্থা অবলম্বন করে সফল হতে পারে। ব্যক্তিগতভাবে আমি বিশ্বাস করি, মওলানার লেখা সূত্র যদি কেউ বাস্তবজীবনে প্রয়োগ করে, অবশ্যই অবশ্যই সে সুখ ও সফলতার দেখা পাবে।
সফলতার পথ ও পাথেয়
মওলানা ওয়াহিদুদ্দিন খান এর ‘রাঁহে বন্দ নাহীঁ’ ও নির্বাচিত বক্তব্যের অনুলেখ
by মাওলানা ওয়াহিদুদ্দিন খান
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?