—শয়তান সরাসরি খারাপ কাজের আদেশ দেয় না। সে চাতুরতার পথ অবলম্বন করে। প্রথমে ব্যক্তির মনে পাপকে সুশোভিত করে উপস্থাপন করে। যেমন: ফজর আযানের সময় শয়তান মুসলিম ব্যক্তির কানের কাছে এসে বলে, ‘এখনও অনেক রাত বাকি আছে, নিশ্চিন্তে ঘুমাও।’ এভাবে পাপকে সুশোভিত করে তোলে।
—মানব মনে সন্দেহের বীজ বোনে শয়তান। এই বীজ যখন বড় হতে হতে এক পর্যায় সন্দেহ দৃঢ় বিশ্বাসে রূপ নেয়। তখন ব্যক্তি হারাম কাজকে হালাল ভাবতে শুরু করে, আর হালালকে হারাম। ফ্লাট ক্রয়ের জন্য যখন সুদে ঋণ নেবার মনঃস্থির করে, শয়তান বোঝায় “এটা হারাম না। কারণ, তুমি পরিচিতদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে তাদেরকে বিপদে ফেলছো না। বরং তুমি ও তোমার পরবর্তী প্রজন্ম যেন ভালভাবে বসবাস করতে পারো, সেজন্যই এটা নিচ্ছ। কাজেই এখানে হারামের কিছু নেই।” এভাবে সে হারামকে হালাল বলে চালিয়ে দেয়।
(৩) বিলম্বিত করায়
—মানুষকে দীর্ঘ আশায় ভুলিয়ে রাখে। উদাহরণস্বরূপ, যে ব্যক্তি তাওবা করার দৃঢ় সংকল্প করে, শয়তান তাকে বলে “আরে তাওবা তো একদিন করবেই। এতো তাড়াহুড়ো কীসের? আগে পড়াশোনা শেষ করো। বিয়ে-শাদী করো। বিয়ে দ্বীনের অর্ধেক। বিয়ের পর তাওবা করে নিও।” এভাবে ব্যক্তির চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন আশা জাগিয়ে তাওবা করতে বিলম্ব করে, কখনও-বা আজীবনের জন্য পিছিয়ে দেয়।
(৪) পাপকে তুচ্ছজ্ঞান করায়
—ইবলিশ এই বলে আত্মতুষ্টিতে ভোগায়, “তাওবা কেন করতে হবে? তুমি যে পাপ করেছো, মানুষ এর চেয়েও খারাপ কাজ করে বেড়াচ্ছে। তুমি তো তাদের মতো নও। তাদের চেয়ে হাজার গুণে ভাল।” ফলে সে ব্যক্তি পাপকে তুচ্ছজ্ঞান করতে থাকে।
(৫) তাওবাকারীর পথ রুদ্ধ করার চেষ্টা করে
—আমরা সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধ থাকি। এজন্য শয়তান কখনো ভয় দেখায়, “তাওবার ওপর অটল থাকা জরুরী। আর এই দৃঢ়তা তোমার জন্য কঠিন বিষয়। তাছাড়া এমনটা করলে তোমার সাথে অন্যদের সুসম্পর্ক নষ্ট হবে, শত্রুতা তৈরি হতে পারে। কেন শুধু শুধু নিজেকে বিপদে ফেলবে? অযথা বন্ধুদের সাথে সম্পর্ক নষ্ট করবে? যদি এটা করো, তাহলে সবাই তোমার থেকে দূরে সরে যাবে; তোমাকে নিয়ে হাসা-হাসি করবে…”
(৬) হতাশ করে তোলে
—সে বলে, “দেখো, কত্ত পাপ করেছো তুমি! কীভাবে আল্লাহ্ তোমার তাওবা কবুল করবেন?! অথচ এমন এমন জঘন্য কাজ করেছো..” এভাবে শয়তান সেই ব্যক্তির সম্মুখে পাপের ফিরিস্তি মেলে ধরে এবং একপর্যায় নিরাশ করে দেয়।
(৭) রাগান্বিত মুহূর্তে ধোঁকা দেয়
—শয়তান কখনো কখনো জ্ঞানী ব্যক্তিকেও কাবু করে। কীভাবে? বিচক্ষণ এবং মধ্যমপন্থা থেকে তাকে ছিটকে ফেলে। পূর্ববর্তী এক নবির থেকে বর্ণিত আছে, একবার তিনি ইবলিসকে জিজ্ঞেস করেন “কোন সময়ে তুমি আদম সন্তানের ওপর বিজয় লাভ করতে পারো?” সে বলল, “রাগান্বিত অবস্থায় এবং যখন সে প্রবৃত্তির তাড়নার ভুগে।”
(৮) আশা ও সম্পদের ধোঁকায় ফেলে
—এটা হচ্ছে শয়তানের একটা অন্যতম অস্ত্র। আল্লাহ্ বলেন, “সে তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দেয় এবং তাদের হৃদয়ে মিথ্যা বাসনার সৃষ্টি করে। আর শয়তান তাদেরকে যে প্রতিশ্রুতি দেয়, তা ছলনামাত্র।” [সূরা নিসা, ১২০] কিয়ামতের দিন মানব জাতির উদ্দেশে শয়তান বলবে, “..আমার তো তোমাদের ওপর কোনো আধিপত্য ছিল না। আমি শুধু তোমাদেরকে আহ্বান করেছিলাম এবং তোমরা আমার আহ্বানে সাড়া দিয়েছিলে। সুতরাং তোমরা আমার প্রতি দোষারোপ করো না, তোমরা তোমাদের নিজেদের প্রতিই দোষারোপ করো।” [সূরা ইবরাহীম, ২২] বদর যুদ্ধে কুরাইশদের সে ধোঁকা দিয়েছিল এই বলে “…যখন দু’দল পরস্পর দৃশ্যমান হলো তখন সে পিছনে সরে পড়ল এবং বলল, ‘নিশ্চয় আমি তোমাদের থেকে সম্পর্কমুক্ত। নিশ্চয় আমি এমন কিছু দেখেছি যা তোমরা দেখতে পাও না।'”[সূরা আনফাল, ৪৮]
মানুষের প্রকৃতি অনুযায়ী সে ধোঁকাপূর্ণ প্রতিশ্রুতি দেয়। তাদের চাহিদা এবং আকাঙ্ক্ষা অনুপাতে সে ফাঁদ তৈরি করে এবং সঙ্গ দেয়। ধনীদেরকে দরিদ্রের ভয় দেখায়, যখন তারা দান-সদকার নিয়ত করে। এভাবে সে ধনসম্পদের ধোঁকায় ফেলে রাখে।
(৯) ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রতি সীমাতিরিক্ত ঝোঁক তৈরি করে
—এই ঝোঁক ব্যক্তিকে উপকারী ইলম চর্চা থেকে বিরত রাখে এবং নেককার আলিমদের সোহবত থেকেও দূরে রাখে। জীবনভর শুধু দুনিয়া কামানোর পিছু ছুটতে গিয়ে পরকালের প্রস্তুতি নেবার সময়টুকু পায় না।
(১০) মধ্যপন্থা ও ন্যায়-নিষ্ঠার বিপরীতে পরিচালিত করে
পূর্ববর্তী নেককারগণ বলতেন, ‘আল্লাহ তাআলা যা কিছুর নির্দেশ দিয়েছেন, শয়তান সেসবের ব্যাপারে সর্বদা দুইভাবে আগ্রহ দেখায়: বাড়াবাড়ি করো নতুবা ছাড়াছাড়ি। এই দুটোই তার মূল পদ্ধতি। পূর্ববর্তী নবিদের উম্মত ছাড়াছাড়ির পথ অবলম্বন করেছিল। ফলে তাদের বৃহৎ সংখ্যক নবিদের অস্বীকার করে এবং হত্যা করে। অপরদিকে আরেক দল আনুগত্যের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে একপর্যায় নবিদের কবর পূজা শুরু করে দেয়। যারা ন্যায়ের দিকে আহ্বান করে, তাদের হত্যা করে। আবার এক শ্রেণীর অনুসারী নেককার বুজুর্গদের নিয়ে বাড়াবাড়িতে জড়ায়। আরেক শ্রেণী তাদেরকে সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করে চলে।”
শয়তানের ফাঁদ বা চক্রান্ত সম্পর্কে কতটুকু জানেন? কখনো চিন্তা করেছেন–শয়তান কীভাবে আমাদেরকে ধোঁকা দেয়!? আমাদের রগরেশায় শয়তান কীভাবে ঢুকে পড়ে!?
শয়তানের সবসময়ের কাজই হলো মানুষকে সত্যপথ থেকে বিচ্যুত করা। তাদেরকে নানা কৌশলে ধোঁকা দিয়ে পথভ্রষ্ট করা। আমাদেরকে জাহান্নামে নিতে শয়তান ওঁৎ পেতে বসে থাকে। নানা রকম ফন্দি আঁটে।
❝শয়তানের চক্রান্ত❞ বইটিতে লেখক অত্যন্ত সুন্দরভাবে শয়তানের গতিপ্রকৃতি, বিভিন্ন কূটচাল এবং চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। আমাদেরকে সতর্ক করেছেন।
ভুল পথ থেকে ফিরে আসতে এবং গুনাহ থেকে বেঁচে থাকতে, সর্বোপরি সত্য, সুন্দর ও সরল পথে অবিচল থাকতে শয়তানের কবল নিরাপদ থাকা অত্যন্ত জরুরি। সুতরাং, শত্রুর (শয়তান) ফাঁদ থেকে বেঁচে থাকার জন্য শত্রুকে চিনে নিই। শয়তানের চক্রান্তকে জেনে নিই ভালোভাবে।
কুরআনের ভাষ্যমতে শয়তান আমাদের প্রকাশ্য শত্রু। সে সব সময়ই চায় নানান রকম চক্রান্তের ফাঁদ পেতে আল্লাহর বান্দাদের গোমরাহ করতে। সেজন্যই শয়তানের চক্রান্ত সম্পর্কে হুঁশিয়ার থাকা প্রতিটি মুমিনের কর্তব্য।
ইমাম ইবনু আবিদ দুনইয়া রাহিমাহুল্লাহ সেই দিকে লক্ষ করেই রচনা করেন মাকায়িদুশ শাইতান নামক পুস্তিকাটি, যেখানে তিনি শয়তানের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডকে কুরআন-হাদিসের আলোকে তুলে ধরেন।
সেই পুস্তিকাটিরই অনুবাদ বাংলাভাষী পাঠকদের সামনে পেশ করা হচ্ছে।
এই পুস্তিকার সাথে বিভিন্ন পাপাচারের নিন্দা করে লেখকের রচিত আরেকটি পুস্তিকার অনুবাদও সংযুক্ত করা হয়েছে। কারণ, সেগুলোও একধরনের শয়তানি কর্মকাণ্ড; যার মধ্যে নাচ-গান-পাশা-জিনা-সমকাম ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
দুই পুস্তিকার এই সমন্বিত অনুবাদ আশা করি পাঠকদের মনে দোলা দেবে। শয়তানের শয়তানি সম্পর্কে সচেতন থাকতে তাদেরকে সাহায্য করবে।