বইঃ মৃত্যুক্ষুধা
লেখকঃ কাজী নজরুল ইসলাম
ধরণঃ উপন্যাস
পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ৮০
প্রকাশনীঃ মাওলা ব্রাদার্স
কবি যখন উপন্যাস লেখে তখন গদ্য আর ছন্দে একাকার হয়ে যায় ভাব ও অনুভূতির বয়ান। এই উপন্যাসটা তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। প্রথম দিকে একটা ধাক্কা খেয়েছি ভাষার এই ব্যবহারে। গদ্যের মধ্যে যেমন ছন্দের মিশেল তেমনি মজলিশি কায়দায় উপন্যাসের যে বর্ণনা তার সাথে মানিয়ে নিতে কিছুটা সময় লেগে যায়।
উপন্যাসের পটভূমি হলো বৃটিশ শাসিত বাংলা। দারিদ্র আর দুর্ভিক্ষে পীড়িত মানুষ, খেটে খাওয়া শ্রমিক শ্রেণীর মানুষেরা। একটা গ্রামের মানুষের চিত্রের মাধ্যমে কবি ফুটিয়ে তুলেছেন সে সময়ের সারা বাংলার অবর্ণনীয় দুঃখ কষ্ট আর দুর্দশাকে। এখানে যেমন মুসলিম খৃষ্টানে ঝগড়া বাধে তেমনি এরাই দিনশেষে বিপদাপদে এক হয়ে যায়। বুঝা যায় ধর্মান্তরের মাধ্যমে যে আলাদা শ্রেণী তৈরির চেষ্টা চলছিলো তা কতখানি অদ্ভুত।
এর মধ্যে অন্যতম চরিত্র মেজ বউ। প্যাকালের আর তিন ভাই মারা যাওয়ায় পুরো সংসারের ভার পড়ে প্যাকালের উপর। তার মা-ও কাজ করে সাহেবের বাড়িতে। শ্বশুরবাড়ি থেকে চলে আসা বোন আর তিন ভাবী ও তাদের সন্তানদের নিয়ে এই ঘর। মেজ বউকে আটকে রাখতে তার শ্বাশুড়ির চেষ্টা, যা প্যাকালেকে ঘর ছাড়া করে। কিন্তু মেজ বউ, যার মাধ্যে রয়েছে এক অদ্ভুত বন্যতা বা স্বাধীন সত্তা তাকে আটকে রাখা যায় না। যার খেয়ালি মন বা সাহস দুই-ই চমকপ্রদ।
আনসার এ উপন্যাসের নায়ক। কম্যুনিস্ট বিপ্লবকে বঞ্চিত ও সর্বহারাদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়াই যার ব্রত। শিক্ষিত যুবক তার নিশ্চিত সুন্দর ভবিষ্যৎ ছেড়ে দিয়ে এই অজানা পথে ঘুরে বেড়ায় বিপ্লবী এক মন নিয়ে। আপাত রুক্ষ আনসারের ভিতরে লুকিয়ে আছে প্রেম মায়া দয়া ইত্যাদি কোমল গুণগুলো। ঠিকমতো কেউ যদি তাকে বুঝতে পারে তাহলে সে তাকে ভালোবেসে ফেলবে।
রুবি যে কি না বড়লোকের মেয়ে, অল্প বয়সে পিতামাতার ইচ্ছা এবং নিজের অনিচ্ছায় যাকে বিয়ে করতে হয়। বিয়ের পরপরই বিধবা সেই মেয়ে রুবি। ক্ষ্যাপাটে মেজাজ আর রক্ষণশীল বাঙালী মনে আঘাতকারী তার কথাবার্তা সমাজের এদিকটায় আঘাত করেছে।
বইটাতে যেমন দুঃখ কষ্ট অভাবের কথা এসেছে। সেই সাথে এসেছে প্রেম ভালোবাসা আর বিপ্লব আর বিরহ। সুন্দরের পাশাপাশি কদর্যের যে সহাবস্থান তা এই বইতে পরিস্ফুটিত হয়ে উঠেছে। এখানে একই সাথে নাটকীয় করুণ কাহিনির অবতারণাও ঘটেছে। বইয়ে কথ্য ভাষা আর মজলিশি কায়দায় কাহিনির বর্ণনা একে অভিনবত্ব দিয়েছে। নজরুলের বিখ্যাত উপন্যাস মৃত্যুক্ষুধা খুবই চঞ্চল আর দুরন্ত। সমাজের বাস্তবতা আর নিম্ন শ্রেণীর একতা-বিরোধ আর কুসংস্কার ও দারিদ্রের এক নিখুঁত চিত্র এই উপন্যাস।