“মীর মশাররফ হোসেন ও কাজী নজরুল ইসলামের পরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাঙালি মুসলমান লেখক হলেন আহমদ ছফা।” – সলিমুল্লাহ খান।
২০১৬ সালের কথা। আমি তখন নতুন পাঠক। ফেসবুকের বই সংশ্লিষ্ট একটি গ্রুপে ‘যদ্যপি আমার গুরু’ নামে একটি বইয়ের সন্ধান পাই। লেখকের নাম আগে কখনো শুনিনি। ভাবলাম সবাই যেহেতু ভালো বলছে আমিও পড়ি। বইটা স্থানীয় লাইব্রেরিতে অর্ডার দিয়ে আনালাম। বইটি পড়তে ৩-৪ দিন সময় লেগেছিল। এতটাই মুগ্ধ হলাম যে লেখকের বাকি বইগুলো পড়ার আগ্রহ জন্মালো। যেহেতু বইটি জীবনীমূলক ছিল তাই সেখানে অনেক ঘটনারই অবতারণা করেছিলেন লেখক। প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাকের প্রতি মনের অজান্তেই শ্রদ্ধা জন্মে গেল। এমন একজন মাটির মানুষের সাথে লেখকের স্মৃতিচারণ অসাধারণ করে তুলেছিল বইটিকে। আহমদ ছফার উপন্যাস, প্রবন্ধ, ছোটগল্প, সাক্ষাতকার আস্তে আস্তে পড়লাম। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় আমার বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলেছিলেন; তবে আমাকে ভাবতে শিখিয়েছেন আহমদ ছফা। কিছু কিছু লেখা আছে বারবার পড়ার মতো। যদ্যপি আমার গুরু, বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস, বাঙালি মুসলমানের মন, অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী তেমনই কিছু বই।
মৌলবি আহমদ ছফার জন্ম ১৯৪৩ সালের ৩০ শে জুন চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার হাশিমপুর ইউনিয়নের গাছবাড়িয়া গ্রামে। কৃষক পরিবারের সন্তান ছিলেন। লেখকের ভাষায়, “আমি কৃষি পরিবার হতে উঠে এসেছি।” ছাত্র বয়সে বিপ্লবের সাথে যুক্ত হয়ে আত্মগোপন করেও বেরিয়েছেন কিছুদিন। আহমদ ছফার প্রথম কবিতা ছিল রামচন্দ্রকে নিয়ে এবং সেই কবিতা তিনি পাঠ করেছিলেন জুম্মার নামাজের পর মসজিদে দাঁড়িয়ে। এমন ঘটনাগুলোই আহমদ ছফাকে প্রতিবাদী হতে সাহায্য করেছেন।
আহমদ ছফা নন্দিত এবং নিন্দিত একজন লেখক। ছিলেন সাহিত্যের বিশ্লেষণী সমালোচক। আহমদ ছফার উপন্যাসের চাইতে প্রবন্ধের ভাষার জোর বেশি বলে আমি মনে করি। ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ বইটিতে তিনি বাঙালি মুসলিমদের দীর্ঘদিনের মানসিকতার বর্ননা করেছেন। ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ প্রবন্ধে বুদ্ধিজীবীদের নগ্ন রূপ উন্মোচন করেছেন। “আগে বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানি ছিলেন, বিশ্বাসের কারণে নয়-প্রয়োজনে। এখন অধিকাংশ বাঙালি হয়েছেন-সেও ঠেলায় পড়ে।” এমন লাইন শুধু আহমদ ছফার কলম হতেই জন্ম নেয়। ‘একজন আলি কেনানের উত্থান-পতন’ উপন্যাসে দেখতে পাই কীভাবে মাজার ব্যবসার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি উপরে উঠে যায়। আবার ‘গাভী বিত্তান্ত’ উপন্যাসে পচে যাওয়া সিস্টেমের প্রতিফলন ফুটিয়ে তুলেছেন সুচারুভাবে।
বন্ধুদের সাথে বাজি ধরেছিলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় এর লেখার মতো একটি উপন্যাস লিখবেন। তারই ফলশ্রুতিতে লিখেছিলেন ‘সূর্য তুমি সাথী’। বইটা সেরকম হয়েছিল কিনা জানা নেই, তবে সুন্দর একটি উপন্যাস আমরা পেয়ছিলাম। কুমিল্লায় বিয়ের দাওয়াতে গিয়ে সেখান হতে রাগ করে ঢাকায় হেঁটে চলে এসেছিলেন। জ্বরের ঘোরেই একটি উপন্যাসের আইডিয়া পেলেন তিনি; ওঙ্কার। হুমায়ূন আহমেদ, ফরহাদ মাজহার, সলিমুল্লাহ খানসহ আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ ছিলেন তাঁর গুনমুগ্ধ ভক্ত। সময়ের ব্যবধানে হয়তো সম্পর্কের উষ্ণতা কমে এসেছিল, কিন্তু মনে ছিল তাদের প্রতি স্নেহ ও ভালোবাসা।
মুক্তিযুদ্ধের সময় গিয়েছিলেন ভারতে। অংশ নিতে চেয়ছিলেন যুদ্ধে। কিন্তু বামপন্থী রাজনীতির সমর্থক হওয়াতে সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। তবে তিনি বসে থাকেননি। কলম দিয়ে চালিয়েছেন যুদ্ধ এবং জন্ম নেয় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রকাশিত বই ‘জাগ্রত বাংলাদেশ’। কলকাতায় থাকার অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে লিখেছেন ‘অলাতচক্র’ উপন্যাস। সম্প্রতি উপন্যাসটি অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়েছে। অবশ্য ‘ওঙ্কার’ নিয়েও একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছিল।
স্বাধীন হওয়ার পর দেশে ফিরলেন। চারদিকে তখন বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি। বঙ্গবন্ধু সরকারের সমালোচনা করায় পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে তাকে। আবার বঙ্গবন্ধু হত্যার পর রাস্তায় এসে প্রতিবাদও করেছেন এই আহমদ ছফা। লিখেছেন কবিতা। আহমদ ছফা ছিলেন প্রতিবাদী, একগুঁয়ে। কখনো কোনো পুরষ্কারের আশা করেন নি। লিখেছেন, লিখতে সাহায্য করেছেন, প্রতিভার বিকাশে মন-প্রাণ নিয়োজিত করেছেন। জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের বই প্রকাশের ক্ষেত্রেও সহযোগিতা করেছেন এবং যখন হুমায়ূন আহমেদকে সরকারি কোয়ার্টার হতে বের করে দেওয়া হলো তখন আহমদ ছফা প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। শিল্পী এস এম সুলতানকে বাংলাদেশের মানুষের মাঝে পরিচয় করানোর দায়িত্বটাও নিয়েছিলেন আহমদ ছফা।
ব্যক্তিজীবনে ছিলেন চিরকুমার। অসংখ্য নারীর সাথে সম্পর্ক ছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সর্বহারা পার্টির নেতা সিরাজ শিকদারের বোন শামীম শিকদার এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সুরাইয়া খানম। বিয়ে করতে চেয়েছিলেন । তবে শেষ পর্যন্ত এই কাজটি আর করা হয়ে উঠেনি। সুশীল সিংহ নামে একটি পালক পুত্র ছিল তাঁর। বড় ভাইয়ের ছেলে নূরুল আনোয়ারকেও পুত্রসম বিবেচনা করতেন।
ক্রেডিট ; Sanowar Hossain