কিছু বই আছে পড়তে বসে পুরোটা শেষ করার আগেই আগ্রহ চলে যায়, পড়াই হয়ে ওঠে না আর। আবার কিছু কিছু বই আছে বারবার পড়ার পরও মনে হয় আবার পড়ি। কাহিনী পুরো মনে থাকলেও বহুবার পড়েও যেন মন ভরে না। মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি আমার কাছে এমনই একটা বই। এই বই কতোবার পড়েছি আমি নিজেও হিসেব রাখি নি, আমার তো মনে হয় বাংলা কিশোর সাহিত্য যাদের পছন্দ তাদের দুই দলে ভাগ করা যায় একদল এই বই পড়েছে, অন্য দল পড়ে নি। পাল্লাটা কোন দলে ভারি হবে তা অবশ্য জানি না।
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ছোটদের জন্য লিখতেন না। আনন্দমেলার সম্পাদক নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর অনুরোধে প্রথমে একটি গল্প লিখেছিলেন আনন্দমেলার পাতায়, তারপর ধারাবাহিক ভাবে এই উপন্যাস। এই উপন্যাস দিয়েই পরবর্তীতে শুরু হয় দারুণ মজার জনপ্রিয় এক কিশোর সাহিত্যের সিরিজ, অদ্ভুতুড়ে সিরিজ। ভূতপ্রেত, ডাকাত, চোর, দারোগা, রাজা আরও নানা বিটকেল লোকজন, এমনকি ভিনগ্রহের প্রাণী কি নেই এই সিরিজে।
সিরিজের প্রথম বই মনোজদের অদ্ভুত বাড়িতে অবশ্য ভূতপ্রেত নেই, যদিও পুরোহিত সতীশ ভরদ্বাজের পোষা ভূত হাঁদু ভুদুর কথা আছে তবে তারা তখন ছুটি নিয়ে দেশের বাড়িতে গেছে। ভূত না থাকুক অদ্ভুত মানুষের তো কমতি নেই। বুড়ি ঝি কিরমিরিয়া, সারাদিন বিলাপ করা যার নেশা সুযোগ পেলেই হলো। পিসিমা, যার কাজ হলো দিনে একবার আছাড় খাওয়া। গানের শিক্ষক গণেশ ঘোষাল, যিনি মাসে দুই তিনবার আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। গৃহশিক্ষক দুঃখহরণ বাবু, উবু হয়ে বসতে না পারলে যিনি ভুলভাল পড়ান। পাড়ার লোক শ্রুতিধরবাবু, নামের সাথে এনারও চরিত্রে কোন মিল নেই। সবসময়ই তার কোন একটা কথা মনে পড়তে পড়তেও মনে পড়ে না। এমনই অদ্ভুত অদ্ভুত সব লোকজন আছে পুরো উপন্যাসের পাতা জুড়ে। আছেন গোয়েন্দা বরদাচরণ; গরু চুরির কেস সমাধানে নামডাকওয়ালা শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের আরেক বিখ্যাত সৃষ্টি বরদাচরণও এই উপন্যাসের এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। সাথে আছেন তার ঘোরতর প্রতিদ্বন্দী মনোজের ছোটকাকা হারাধন ; একাধারে তিনি বিজ্ঞানী, ব্যায়ামবীর, জুডো, কারাটে এক্সপার্ট তিনি আর বরদাচরণের সাথে তার সম্পর্কটাও আদায় কাঁচকলায়। মেজকাকা ভজহরির কথা না বললে হয়? এমনিতে বেজায় ভিতু অথচ দুর্দান্ত বাজারু ভজহরি, বাজার করাকে রীতিমতো আর্টের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন তিনি। আছে দিনে মাছওয়ালা আর রাতে ডাকাত কানাই, ভীতু দারোগা নিশিকান্ত এমনি আরো বেশ কিছু মজার মজার চরিত্র। আছেন হরিণগড়ের রাজা গোবিন্দনারায়ণ। রাজা হলে কি হবে, ইনি আবার বেজায় কিপটে। সারাদিন কেবল শসা খান, আর মন খারাপ হলে চোরাকুঠুরিতে বসে নিজের অচল টাকা গুনে মন ভালো করেন। রাজমাতা হেমময়ীর কথাও বলতেই হয়। তিনি ঘুঁটের ব্যবসা করেন, আর রাজার একমাত্র ছেলে কন্দর্পনারায়ণ; যে সেই ছোটবেলায় হারিয়ে গেছে আর তাকে কোত্থাও খুঁজেই পাওয়া গেল না। কন্দর্পনারায়ণ চুরি হবার সাথে সাথে চুরি হয়ে গিয়েছিল তার সব পুরোনো ছবিও। আছে মনোজ, তার দাদা সরোজ আর দিদি পুতুল। তাদের রাশভারী বাবা রাখোহরি বাবু, আর পাগলাটে গরু হারিকেন, আর একটি অসমাপ্ত ক্রিকেট ম্যাচও। এই সব চরিত্র আর ঘটনা তো আছেই আর আছে দুর্দান্ত সব হাসির মুহূর্ত।
মনোজদের বাড়ির ফটো এলবামেই আছে একটা অচেনা ছেলের পুরোনো একটা ফটোগ্রাফ। সেটাই কি হারিয়ে যাওয়া কন্দর্পনারায়ণ এর কোন ছবি? কে জানে। এরমধ্যে আবার কন্দর্পনারায়ণকে খুঁজে বের করার কেসটা নিয়েছেন বরদাচরণ। চারিদিকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন কন্দর্পনারায়ণের কোন ফটোগ্রাফ। তারপর ? তারপর কি হলো তা তো যারা বইটা পড়েছেন জানেনই। যারা পড়েন নি, তাদের জন্য সাসপেন্সটা থাকুক। পুরো উপন্যাসের সময়কাল মোটে গোটা একটা দিন আর একটা রাত। এর মধ্যেই কতো না মজার কান্ড ঘটে গেল মনোজদের অদ্ভুত বাড়িতে আর আশেপাশে। আর শেষ করছি হরিণগড়ের রানিমার বানানো গাওয়া ঘিয়ের লুচির কথা দিয়ে। লুচি জিনিসটা আমার বিশেষ পছন্দের না, তবু মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি বইটা যখন পড়তে বসি হরিণগড়ের রানিমা অম্বিকার বানানো গাওয়া ঘিয়ের লুচির গন্ধ তখন ঘরে বসেই পেয়ে যাই, তখন ভীষণ ক্ষিদে পেয়ে যায়। কেমন সেই গন্ধ ? উহু সেটা বলা যাবে না। স্রেফ কল্পনা করে নিতে হবে।
বই- মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি
লেখক – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
প্রকাশ -আনন্দ পাবলিশার্স