বিভ্রম – যে জালে সহস্র হারিয়েছে ঈমান
লেখক : ইয়ামিন সিদ্দিক নিলয়
প্রকাশনী : রাইয়ান প্রকাশন
বিষয় : ইসলামি আদর্শ ও মতবাদ
পৃষ্ঠা : 152, কভার : পেপার ব্যাক
ভাষা : বাংলা
product summary….
তাওহীদের ওপর জন্মলাভ করা মানবশিশু, যার নেই অক্ষর জ্ঞান; অথচ সে অক্ষরের সঙ্গে পরিচিত হবার পূর্ব থেকেই শুনে শুনে বড় হয় নানান প্রকার ভ্রান্ত বিশ্বাস ও মতবাদ। ফলশ্রুতিতে শিশু বড় হতে থাকে আর ভ্রান্তির মায়াজালে জড়িয়ে তাওহীদ হতে দূরে সরতে থাকে। হারিয়ে যায় নানান প্রকার ভ্রান্ত বিশ্বাস ও মতবাদের বিভ্রমে। পড়াশুনা করে না বৃত্তের বাহিরে, ফলে ধীরে ধীরে তলিয়ে যায় ঘনঘোর আঁধারের অতল গহ্বরে। মিছে ও নকল মনিবদের দাসত্বের অলিখিত চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করে বিকিয়ে দেয় নিজ বিবেক, আর ক্রয় করে নেয় হেদায়াতের বিনিময়ে পথভ্রষ্টতা।
তাওহীদের ওপর জন্মলাভ করা মানবশিশু, যার নেই অক্ষর জ্ঞান; অথচ সে অক্ষরের সঙ্গে পরিচিত হবার পূর্ব থেকেই শুনে শুনে বড় হয় নানান প্রকার ভ্রান্ত বিশ্বাস ও মতবাদ। ফলশ্রুতিতে শিশু বড় হতে থাকে আর ভ্রান্তির মায়াজালে জড়িয়ে তাওহীদ হতে দূরে সরতে থাকে। হারিয়ে যায় নানান প্রকার ভ্রান্ত বিশ্বাস ও মতবাদের বিভ্রমে। পড়াশুনা করে না বৃত্তের বাহিরে, ফলে ধীরে ধীরে তলিয়ে যায় ঘনঘোর আঁধারের অতল গহ্বরে। মিছে ও নকল মনিবদের দাসত্বের অলিখিত চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করে বিকিয়ে দেয় নিজ বিবেক, আর ক্রয় করে নেয় হেদায়াতের বিনিময়ে পথভ্রষ্টতা।
এভাবেই ধীরে ধীরে গড়ে উঠে এক অন্ধকারাচ্ছন্ন জনপদ। যাতে তিল পরিমাণ অস্তিত্ব থাকে না আলোর। সে জনপদে একদিন কোথা হতে আগমন ঘটে এক আলোকচ্ছটার। যার পরশে মুহূর্তেই দূরীভূত হয়ে যায় সমস্ত আঁধার। রহমত স্বরূপ আবির্ভূত হওয়া সেই আলোকচ্ছটা সুবহে সাদিকের ন্যায় আলোকিত করতে থাকে চারিপাশ। ঘুচে যেতে থাকে সমস্ত শক্তি দিয়ে জনপদ গ্রাস করে রাখা নিগূঢ় তমানিশার ন্যায় সেই ঘুটঘুটে অন্ধকার। লেজ গুটিয়ে পলায়ন করতে থাকে আঁধারের ফেরিওয়ালারা। যারা নিজেদের মস্তক বিক্রি করে দেয়ার দরুন হারিয়ে ফেলেছে সত্য উপলব্ধির ক্ষমতা। রচিত হতে থাকে সত্য ও শুভ্রতার শত গল্প। যার পদতলে চাপা পড়ে ধ্বংস হয়ে যায় মিথ্যা ও আঁধারের কুৎসিত সমস্ত গল্প।
——————————————————
শুভঙ্করের ফাঁকি
ঠান্ডা দু-চোখ। এলোমেলো চুল। ফ্যাকাশে, জং-ধরা মুখ। হিম শীতল হাওয়া। নিঝুম কালো রাত। নিস্তব্ধ আকাশ। পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ। ক্রমশ ভার হয়ে আসা আবরারের মন।
গত বছর এই তারিখেই আবরারের ছোট ভাই মৃত্যুবরণ করেছে। সে এখনো ছাঁদে দাঁড়িয়ে তার ভাইয়ের মৃত্যুর ঘটনাটি স্মরণ করে। বড় ভাই যে সে। চেষ্টা তো কম করেনি ছোট ভাইটাকে মানুষ করার। এখন ছোট ভাইটা যদি মানুষ না হয়ে পশু পাখির মতো মৃত্যুবরণ করে তাহলে তার আর কীই-বা করার!
আবরার। মা-বাবার বড় ছেলে। বর্তমানে একমাত্র ছেলে। ঢাকা ভার্সিটি থেকে ম্যাথমেটিকস্-এ অনার্স-মাস্টার্স শেষ করে বর্তমানে একটি বেসরকারি কলেজে শিক্ষকতা করছে। আবরার ছোটবেলা থেকেই বেশ বিচক্ষণ একজন ছেলে। বর্তমানে বেশ দায়িত্বশীলও। সে পছন্দ করে মা-বাবার সঙ্গে থাকতে, তাদের সেবা-শুশ্রূষা করতে, জ্ঞানার্জন করতে এবং অর্জিত জ্ঞানটুকু সকলের মাঝে ছড়িয়ে দিতে।
ছোটবেলা থেকেই আবরার মিতব্যয়ী। অর্থ, সময়, শক্তি—কোনো কিছুই অপচয় করা সে ভীষণ রকম অপছন্দ করে। তার বাবার বিশাল সম্পত্তি ও প্রতিপত্তি থাকা সত্ত্বেও তার জীবনযাপন অতি সাধারণ।
সেদিন জয়নাল স্যারও সমুচা খেতে খেতে আবরারের দিকে ইঙ্গিত করে পিকেডি স্যারকে বলছিলেন, ‘কী জীবন তার! ফজর পড়ে সকালবেলা কলেজে আসে, ক্লাস শেষ করে কলেজের মসজিদে যুহর পড়ে, খাওয়া-দাওয়া করে কিছুক্ষণ তার
ছাত্রদের সমস্যা শোনে, তারপর আমাদের সঙ্গে গল্প করতে করতে বাসায় চলে যায়। তার পরদিন আবার সেই একই রুটিন। পেরেশানিহীন, দুশ্চিন্তাহীন।
সমস্যা যে তার জীবনে আসে না- তা না, সমস্যা আসে। কিন্তু সে-সমস্যাগুলো যেন তাকে একটু নাড়াতেও পারে না। সে তার মতোই হাসিখুশি, বেদনাহীন। আর আমাদের জীবন….
‘ধুর মিয়া! সে আলাপ তুলিয়েন না তো।’ পিকেডি স্যার থামিয়ে দেন জয়নাল স্যারকে।
জয়নাল স্যার হাসতে থাকেন, আর বলতে থাকেন, ‘ঈর্ষা হয় স্যার, বুঝলেন? ঈর্ষা হয়।’
পিকেডি স্যার কলেজের বিশাল বটগাছটিতে থাকা পাখির ঐ ছোট্ট বাসাটির দিকে চেয়ে থাকেন। আর ভাবতে থাকেন গতরাতের কথা। গতরাত পিকেডি স্যার তার স্ত্রীর এক্সট্রা ম্যারিটাল অ্যাফেয়ার আবিষ্কার করেছেন। আর এই বিষয়টিই তাকে গতরাত থেকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে।
হঠাৎ জয়নাল স্যার হাঁক দেন, ‘আবরার স্যার! এ আবরার স্যার! এই যে এদিকে।
পিকেডি স্যার আবরারের হাস্যোজ্জ্বল মুখটার দিকে তাকান, আর সে কাছে আসতেই নিজের কষ্ট আড়াল করে মুখে একটি মুচকি হাসি টেনে নেন।
‘কী? আপনারা যাবেন না বাসায়? আজ না বেলা একটা পর্যন্তই ক্লাস ছিল??
আবরার জিজ্ঞেস করে।
জয়নাল স্যার তার হাতে থাকা অবশিষ্ট অর্ধেক শিঙাড়াটি জলদি জলদি মুখে পুরে অস্পষ্ট ভাষায় বলতে থাকেন, ‘আপনারই অপেক্ষায়। চলুন। চলুন।’
পিকেডি স্যার কোনো রা করেন না। চুপচাপ নিজের বাদামি রঙের ল্যাপটপ ব্যাগটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ান। তারপর তিনজনই চলতে থাকেন। হঠাৎ আবরারের চোখ যায় পিকেডি স্যারের দিকে। সে দেখতে পায় পঞ্চাশোর্ধ্ব এই মানুষটার মুখে যেন বিষণ্নতার ছাপ তার বয়সের ছাপকেও ছাপিয়ে গেছে। ভীষণ মনমরা দেখাচ্ছিল তাকে। তাই আবরার পিকেডি স্যারের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করে, ‘স্যার? কিছু হয়েছে কি?
প্রশ্নটি শুনে পিকেডি স্যার কেমন যেন একরকম চমকে ওঠেন। মুখে হাসি প্রদর্শনের বৃথা চেষ্টা করে তিনি বলতে থাকেন, ‘কই? না তো। কিছু হয়নি তো। আমাকে দেখে কি মনে হচ্ছে কিছু হয়েছে? আসলে কিছুই হয়নি। আমি মানুষটা দেখতেই এরকম।’
পিকেডি স্যার সেদিন যেন একটু বড় উত্তরই দিয়েছিলেন প্রশ্নের। তার উত্তর শুনে জয়নাল স্যারের কাছেও মনে হয় পিকেডি স্যার কোনো কারণে পেরেশান। তাই জয়নাল স্যার, আবরার ও পিকেডি স্যারকে পাশের একটি রেস্টুরেন্টে নিয়ে যান। তারপর পিকেডি স্যারকে বলেন, ‘এবার বলুন কী সমস্যা।’
পিকেডি স্যার তখনো কিছু বলছেন না। শুধু কথা ঘোরানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন। পিকেডি স্যার কিছু বলতে চাইছেন না দেখে আবরার জয়নাল স্যারকে বলে, ‘বাদ দিন স্যার। তিনি যখন বলতে চাইছেন না, তখন থাক। আমরা আর জোরাজুরি না করি।’
তারপর সবাই চুপ। আশপাশও যেন খুব নীরব। আর এ নীরবতা থাকে বেশ কিছুক্ষণ। তারপর নীরবতা ভেঙে পিকেডি স্যারই আবরারকে প্রশ্ন করেন, ‘আচ্ছা, তোমাদের ধর্মগ্রন্থে যে জাহান্নামের কথা আছে, তুমি কি সে জাহান্নামে বিশ্বাস করো?’ জয়নাল স্যারের দিকে তাকিয়ে ‘জয়নাল স্যার, আপনি?’
দুজনেই সমস্বরে উত্তর দেন, ‘হ্যাঁ, করি।’
পিকেডি স্যার দুজনের দিকেই কিছুক্ষণ কেমন করে যেন তাকিয়ে রন। তাকে দেখে মনে হচ্ছিলো তার চোখজোড়া যেন দাবানল। আবরার প্রশ্ন করে, ‘স্যার, হঠাৎ?
পিকেডি স্যার কোনো উত্তর দেন না, পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘ভগবান নরক বানিয়ে ভুল করেছেন মনে হয় কি কখনো? মনে হয় কি কখনো তাকে নিষ্ঠুর??
‘না।’ আবরারের সরল উত্তর।
‘আসলেও তিনি নিষ্ঠুর নন। বরং নরক বানানোটা তার ন্যায়পরায়ণ ও সুবিচারক হওয়ারই প্রমাণ দেয়।’ ক্ষুব্ধ পিকেডি স্যার বলেন।
জয়নাল স্যার চুপচাপ। মনে মনে ভাবতে থাকেন আজ হলো কী পিকেডি স্যারের! তিনি তো ধর্ম নিয়ে কথা বলার লোক নন। বরং তিনিই তো প্রগতিশীলতার নামে মাঝেমধ্যেই নাস্তিকতার বুলি আওড়ান। আজ তবে… হিসাব মেলাতে পারেন না জয়নাল স্যার। তাই তিনি নীরব দর্শকই বনে রন।
‘হয়েছে কী স্যার?’ আবরারের প্রশ্ন।
‘আমার কিছু হয়নি। হয়েছে এ সমাজের নারীদের। কেমন করে আজকাল মন বিলি করে বেড়ায় দেখো না??
পিকেডি স্যার কখনো আবরারের সামনে এমন ধারার কথা বলেন না। আজ স্যারের মুখে এমন কথা শুনে আবরার কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খায়। তবু স্যারের মন হালকা করার আশায় সে স্যারের সঙ্গে কথোপকথন চালিয়ে যায়।
‘মানে?’
‘মানে আবার কী? দেখো-না, একজনের সঙ্গে সম্পর্কে থাকার পরও মেয়েরা কীভাবে আরো দশজনের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ায়? এমনকি বিয়ের পরও! একটুও যে লজ্জা লাগে না তাদের, একটুও যে বিবেকে বাধে না! তুমি কি দেখো না??
‘এটা কি দোষের স্যার??
‘তোমার মাথা ঠিক আছে? এটা কেন দোষের হবে না??
‘কেন? আপনিই-না কিছুদিন আগে শাহবাগে কিছু ম্যাডামদের আন্দোলনে প্রধান বক্তার ভূমিকা পালন করেছিলেন, যেখানে তাদের মূল বার্তাই ছিল- My body, My mind, My choise. To Marry or not to marry. To have sex before marriage, To have sex outside of marriage; My choise. এটাই তো নারী স্বাধীনতা স্যার। আপনি কি তবে নারী স্বাধীনতার বিরোধিতা করছেন এখন??
পিকেডি স্যার চুপ হয়ে যান। এবং অনেকক্ষণ চুপ হয়ে থাকেন। তারপর তার টাক মাথাটা খানিক চুলকিয়ে বলতে থাকেন, আসলে আমার উচিত হয়নি সেসব অসভ্যদের আন্দোলনে যোগদান করা। আমি এখন আর মোটেও তাদের সঙ্গে একমত নই। মানুষের মধ্যে বিশ্বস্ততা বলতেও একটি বিশেষণ আছে। আর সেটি সবারই বজায় রাখা উচিত। স্বাধীনতার মানে তো এই না যে, আমি অন্যজনের
বিশ্বাসকে খুন করে ফেলবো কিংবা সমাজে অশ্লীলতা ছড়িয়ে, যুবকদের উত্তেজিত করে কোনো প্রকার দুর্ঘটনার শিকার হলে পরে ‘আমি নিরীহ, আমি নিষ্পাপ’ বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলবো। এটা ভণ্ডামি, এটা স্বাধীনতা নয়।’
‘আপনি কি তবে ধর্ষণ ও ইভ-টিজিং এর জন্য নারীদের পোশাক এবং উশৃঙ্খল চলাফেরাকে দায়ী করছেন?’
‘না, স্রেফ সেটিকেই দায়ী করছি না। এসব অপরাধ সংঘঠিত হওয়ার পেছনে অনেকগুলো কারণ আছে। কিন্তু আমি বলছি সেটিও সে অনেকগুলো কারণের মধ্য থেকে একটি কারণ। আর সেটি মোটেও অন্যান্য কারণগুলোর চেয়ে কম ভূমিকা রাখে না এসব অপরাধ সংঘঠিত হওয়ার পেছনে। তোমার যদি মানতে কষ্ট হয়, তাহলে তুমি বলো, আমি কোথা থেকে এর প্রমাণ দিবো যে, এটিও এমন অপরাধ সংঘঠিত হওয়ার পেছনে একটি অন্যতম বড় কারণ! বাইবেল থেকে? কুরআন থেকে? যাত্রাপুস্তক থেকে? বেদ থেকে? না বিজ্ঞান থেকে? বলো!’
‘বাব্বাহ! আপনি এত কিছু জানেন? তারপরও ফারজানা ম্যাডামদের সঙ্গে গিয়ে গলা ফাটিয়ে স্লোগান দেন!’ হাসতে হাসতে জয়নাল স্যার বলেন।
‘হাসিও না। হাসিও না। জানি বহুত কিছুই, কিন্তু তাদের যুক্তিগুলো বেশ মানবিক মনে হতো এতদিন। আর তাদের যুক্তির বিরুদ্ধে কোনো একটি শব্দও অমানবিক। কিন্তু বাস্তবতা আসলে ভিন্ন। এখানে মুখরোচক স্লোগান, ভণ্ডামি কিংবা দ্বিচারিতার দাম নেই। এখানে দাম আছে বিশ্বস্ততার, সুশৃঙ্খল ও শালীন চলাফেরার, এবং নারী পুরুষ উভয়ের সংযত জীবন যাপনের। আর এটিই সঠিক।’
‘আপনি কি কুরআন সম্পূর্ণ পড়েছেন স্যার?’ আবরারের প্রশ্ন।
‘আপনার উপলব্ধিগুলো কুরআনে আগে থেকেই উল্লেখ করা আছে। প্রায় সাড়ে চৌদ্দশ বছর আগে।’
‘এই! এখন খিদে পাচ্ছে ভাই। কেউ কিছু অর্ডার করো।’ দুই হাত দিয়ে পেট চেপে জয়নাল স্যার বলেন।
‘মিয়া! আপনি-না কলেজে বসেই গুনে গুনে ৪ টা সিঙাড়া আর ৫ টা সমুচা পেটে ভরলেন? তারপরও?’ জয়নাল স্যারকে বলেন পিকেডি স্যার।
‘খিদের কি শেষ আছে স্যার?’
জয়নাল স্যারের এমন উত্তর শুনে সকলেই হো হো করে হেসে ওঠে। পিকেডি স্যারের মনটাও কিছুটা হালকা হয়। তারপর দুপুরের খাবার অর্ডার করা হলে পিকেডি স্যার খেতে খেতে জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনাদের জানা এমন কোনো বই বা লেখা আছে কি, যেটি পড়ে নারী হোক, পুরুষ হোক—যারাই স্বাধীনতার নাম দিয়ে বিশ্বাসঘাতকতা করে, উশৃঙ্খল ও অশালীন চলাফেরার মাধ্যমে সমাজের অন্যান্যদের ক্ষতি করে, তারা যেন একটু সংশোধন হয়??
‘না, স্যার। আমার জানা নেই।’ খেতে খেতে জয়নাল স্যার উত্তর দেন।
আবরার বলে, “আমার জানা আছে স্যার। আমি আগামীকাল আপনাকে এমন একটি বই এনে দিব, ইন শা আল্লাহ। তবে আমাদের হাতে কিন্তু সুযোগ আছে একটি সুন্দর প্রজন্ম গড়ে তোলার মাধ্যম হওয়ার।’
‘কীভাবে?’
‘এই যে দেখুন না, আমাদের কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা কীভাবে অবাধ মেলামেশা করছে! কথিত প্রগতিশীলরা এটিকে যতই আধুনিকতা বলুক না কেন, এটি কিন্তু দিন শেষে তাদের জন্য ক্ষতিই বয়ে নিয়ে আসছে। আমরা কিন্তু নিজেদের অবস্থান থেকে যতটুকু সম্ভব ততটুকু তাদেরকে এসব অবাধ মেলামেশা থেকে বিরত রাখতে পারি, তাদেরকে এসবের কুফল বর্ণনা করতে পারি, তাদের মধ্যে এ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করতে পারি।’
জয়নাল স্যার খাওয়া ধীর করে একটু নড়েচড়ে বসেন। তিনি আবরারের কথাগুলো মনোযোগ সহকারে শোনার জন্য কান দুটো খাড়া করে রাখেন। পিকেডি স্যার প্রশ্ন করেন, “…এটি কিন্তু দিন শেষে তাদের জন্য ক্ষতিই বয়ে নিয়ে আসছে—কীভাবে? ছেলে-মেয়ে একসঙ্গে পড়াশোনা করাতে ক্ষতি কী? তারা তো স্রেফ পড়াশোনাই করছে। আর পড়াশোনার প্রয়োজনেই একে অপরের সঙ্গে মিশছে। তারা সংযত থেকে পরস্পরের সঙ্গে মিশলে ক্ষতির কী আছে?
পিকেডি স্যারের এমন প্রশ্ন শুনে আবরার কিছুটা হতাশ হয়। সে একবার নিচের দিকে তাকায়, তারপর বেদনা মিশ্রিত এক হাসি হেসে মাথা তুলে পিকেডি স্যারকে প্রশ্ন করে, ‘স্যার, এই যে ছেলে-মেয়েরা একসঙ্গে ক্লাস করছে, টিফিন পিরিয়ডে পরস্পরের সঙ্গে আড্ডা ও দুষ্টুমি নামক বেহায়াপনায় মেতে উঠছে, কলেজ ছুটি হলে হুড়োহুড়ি করে নামতে গিয়ে কিছু অপরাধ করছে, আবার অনেক সময় কলেজে আসার নাম করে অভিভাবকদের থেকে টাকা নিয়ে অন্যকোথাও কজন মিলে ঘুড়তে চলে যাচ্ছে, বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ড-জাস্টফ্রেন্ড নামক পশু সভ্যতায় জড়িয়ে যাচ্ছে, নানান রকম দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে, আমরা কি তা দেখতে পাচ্ছি না? নাকি দেখতে চাচ্ছি না? এগুলো কোন মেকানিজমের ফসল, স্যার?’
প্রশ্নটা জয়নাল স্যার এবং প্রাণ কৃষ্ণ দাস ওরফে পিকেডি স্যারের বিবেক সমীপে রেখে আবরার উত্তরের অপেক্ষায় চুপচাপ বসে রয়। কিন্তু পিকেডি স্যার বলেন, ‘কথা আরো স্পষ্ট করো আবরার। আর আমি কিন্তু ছেলে-মেয়েদের পরস্পরের সঙ্গে মেশার কথা বলার সাথে সাথে তাদের সংযত থাকার কথাও বলেছি।’
‘স্যার, এটি খুবই অবাস্তব আশা হবে যে আমরা ছেলে-মেয়েদের ফ্রি-মিক্সিংয়ের সুযোগ করে দিবো, আর আশা করব তারা সবাই খুব করে সংযত থাকবে এবং তাদের মধ্যে কোনো প্রকার অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটতে পারবে না। এমনকি যখন তাদের মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশের অধিকের পরিচয় হয়ে গেছে পর্নোগ্রাফির সঙ্গে।
আপনি জানেন কি, বাংলাদেশের একটি বেসরকারি সংস্থা ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’ ২০১৩ সালে শুধু অষ্টম থেকে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের নিয়ে একটি জরিপ করেছিল। যে জরিপে দেখা গেছে, ঢাকার স্কুল পড়ুয়া ছাত্রদের মধ্যে প্রায় ৭৭ ভাগ ছাত্রই পর্নোগ্রাফি দেখে?
স্যার, আপনি কি চিন্তা করতে পারেন, বর্তমানে আমরা কোন অবস্থায় আছি?
আমাদের এই সমাজ, এই সিষ্টেম প্রতিটি পদে পদে তাদেরকে যৌনতার সামনে চ্যালেঞ্জ করে। এমতাবস্থায় অভিভাবকরা তাদের ছেলে-মেয়েদের ফ্রি মিক্সিং, হ্যাং আউট এবং স্লীপ ওভার করার জন্য ছেড়ে দিবে; কিন্তু একই সঙ্গে মস্তবড় সেই আশাও করবে—তাদের মধ্যে কোনো প্রকার অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটতে পারবে না। এটি কি বোকামি নয়, স্যার?
আপনি কি জানেন, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গুটম্যাকার ও বাংলাদেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠান অ্যাসোসিয়েশন ফর প্রিভেনশপ অব সেপটিক অ্যাবরশন বাংলাদেশ-এর ২০১৭ সালে প্রকাশকৃত জরিপ অনুয়ায়ী ২০১৪ সালে বাংলাদেশে ১১ লাখ ৯৪ হাজার অনিরাপদ গর্ভপাত হয়েছে? এ হিসেবে গড়ে এক দিনে ৩ হাজার ২৭১ টি গর্ভপাত হয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটি এবং হোস্টেলগুলোর ডাস্টবিনগুলোতে প্রায়শই মিলছে নবজাতকের লাশ। যার সংখ্যা দিন দিন কেবল বেড়েই চলেছে। এগুলো কি দুঃখজনক নয়, স্যার? এর বাহিরেও তো ছেলে-মেয়েদের অবাধ মেলামেশা থেকে নানান প্রকার অপরাধ ও দুর্ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটেই চলেছে, যা আমরা পত্র-পত্রিকা খুললে হর-হামেশাই দেখতে পাই। সেগুলো কি মর্মান্তিক নয়, স্যার??
কিছুক্ষণ চিন্তা-ভাবনা করেন পিকেডি স্যার। তারপর বলেন, ‘হুম, বুঝলাম। কিন্তু এর জন্য আমরা কী করতে পারি?’
‘ঐ যে বললাম, আমরা নিজেদের অবস্থান থেকে যতটুকু সম্ভব ততটুকু তাদেরকে এসব অবাধ মেলামেশা থেকে বিরত রাখতে পারি, তাদেরকে এসবের কুফল বর্ণনা করতে পারি, তাদের মধ্যে এ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করতে পারি। যেহেতু এর বেশি আর কিছু করা আমাদের পক্ষে সম্ভব না।’
‘এর বেশি আর কী করা যায়?
‘এর বেশি ছেলে-মেয়েদের জন্য পৃথক পৃথক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি করা যায়, আল্লাহর নির্দেশ মেনে মেয়েদের পর্দা করানো যায়, আল্লাহর নির্দেশ মেনে ছেলেদের দৃষ্টি অবনত বা সংযত রাখার প্র্যাক্টিস করানো যায়, ছেলে-মেয়ে উভয়কে মাহরাম, নন-মাহরাম মেইন্টেইন করে চলার প্র্যাক্টিস করানো যায়, ছেলে-মেয়ে ম্যাচিউরড হওয়ার পরপর তাদের বিয়ে করিয়ে দেয়া যায়[১], কুরআনের আইন অনুযায়ী অপরাধীদের রাষ্ট্রীয়ভাবে শাস্তি প্রদান করা যায়। যা আমাদের পক্ষে সম্ভব না, যেহেতু আমরা শাসকও না, অভিভাবকও না। তবে আমরা তাদেরকে
[১] এক্ষেত্রে ছেলে পড়াশোনার পাশাপাশি কোনো হালাল জব বা টিউশনি করবে, যেন ছাত্রাবস্থায় অন্তত নিজের এবং নিজের স্ত্রীর খরচ নিজে বহন করতে পারে। পরে পড়াশোনা শেষে কোনো ফুল টাইম হালাল জবে কিংবা বিজনেসে ইনভলভ হয়ে পুরো পরিবারের খরচ বহন করতে পারবে, ইন শা আল্লাহ।
বিষয়গুলো জানানোর মাধ্যমে আমাদের চেষ্টাটুকু করতে পারি। শিক্ষক হিসেবে তো চোখের সামনে এতগুলো ছাত্র-ছাত্রীকে বিপথে চলে যেতে দিতে পারি না। তাদের ভালোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।’
‘অবশ্যই। কিন্তু মাহরাম, নন-মাহরামের বিষয়টি বুঝে আসেনি। কাইন্ডলি আমাকে একটু বুঝিয়ে বলো।’
‘যে সকল নারীদের দিকে তাকানো পুরুষদের জন্য ইসলামী শারীয়াহতে বৈধ নয়, একইভাবে যে সকল পুরুষদের সামনে যাওয়া নারীদের জন্য ইসলামী শারীয়াহতে বৈধ নয়; এবং যাদের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া বৈধ তাদেরকে গায়রে মাহরাম বলে। তবে একান্ত অপারগ হয়ে যদি কখনো গায়রে মাহরাম কারো সামনে যেতেই হয়, তবে নারী পরিপূর্ণ পর্দা করে এবং পুরুষ তার দৃষ্টি অবনত করে যাবে। আর কথাবার্তার ক্ষেত্রে নম্র কণ্ঠ ও ইনিয়ে বিনিয়ে কথা বলা পরিহার করে স্রেফ প্রয়োজনীয় কথাটুকু বা আসবে এক্ষেত্রেও তারা নির্জনতা অবলম্বন করবে না, নির্জনতা পরিহার করবে। আর মাহরাম হলো তারা, যাদের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া বৈধ নয়। যেমন: বাবা/মা, চাচা/ফুফু, মামা/খালা, দাদা/দাদি, নানা/নানি। কুরআন-হাদীসে এমন ১৪ জনের কথা বলা হয়েছে যারা মাহরাম। মূলত এর বাহিরে বিশ্বে যত পুরুষ/নারী আছে সবাই গায়রে মাহরাম। আর ইসলামের এ বিধান শুধু পরকালেরই নাজাতের উপায় নয়; বরং আমাদের দুনিয়ার জীবনের শান্তি, স্বস্তি এবং পবিত্রতারও রক্ষাকবচ।’
‘ওহ।’ একটু থেমে ‘সুন্দর।’
হঠাৎ জয়নাল স্যার প্রশ্ন করেন, কিন্তু আবরার স্যার, আপনি কি মনে করেন না, বড় বড় লেখক, বুদ্ধিজীবী, নাট্যকার এবং সাহিত্যিকদের দেয়া মত অনুযায়ী বেশি বেশি যৌনতার আলোচনা হলে, প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সেক্স-এডুকেশন শুরু করা হলে, সেক্স নিয়ে বেশি বেশি আলোচনা করা হলে যৌনতার ব্যাপারে ছেলে মেয়েদের মধ্যকার ভ্রান্তি দূর হয়ে যাবে? আপনি কি মনে করেন না, তাদের বাতলে দেয়া পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করলে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা বা ধর্ষণসহ এ জাতীয় অসংখ্য দুর্ঘটনা ও অপরাধগুলো সমাজ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে?’
‘না স্যার। আমি মনে করি না। আপনি একটু সময় নিয়ে ভাবুন, যৌনতা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা, সাহিত্য, বিনোদন, আর্ট, কালচার, কথিত সেক্স-এডুকেশন, ফ্রি-মিক্সিং, কিংবা কথিত সুশীল-প্রগতিশীলদের কোনো পরিকল্পনা কি ধর্ষণ কিংবা এ জাতীয় আরো নানান দুর্ঘটনা বা অপরাধগুলোকে সামান্য পরিমাণেও কমাতে পেরেছে? পশ্চিমা বিশ্ব কিংবা আমেরিকার চাইতে বেশি উদারমনা, বেশি প্রগতিশীল আর কারা আছে? কথিত সেক্স-এডুকেশন, উদারমনা সাহিত্য-সংস্কৃতি-বিনোদন চর্চা আমেরিকার চাইতে আর কোন দেশে বেশি হয়? অথচ দেখুন, দেশটির বৃহত্তম যৌন সহিংসতা বিরোধী সংস্থা RAINN অর্থাৎ Rape, Abuse & Incest National Network এর জরিপ অনুযায়ী সুশীল-প্রগতিশীল আমেরিকাতে প্রতি ৭৩ সেকেন্ডে একটি যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে এমন প্রথম দশটি দেশের মধ্যে আমেরিকার নাম।যে
আমরা ইভ-টিজিং, যৌন নির্যাতন এবং ধর্ষণ থেকে পরিত্রাণের জন্য ঐ সমস্ত অপ্রকৃতিস্থদের সেক্স-এডুকেশনের থিওরি কিংবা ফ্রি-মিক্সিংয়ের থিওরিতে বিশ্বাসী হতে পারি, কিন্তু আল্লাহর বলে দেয়া বিধানে বিশ্বাসী হতে পারি না। আল্লাহর বলে দেয়া ফর্মুলা বিশ্বাস করতে পারি না। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিখিয়ে দেয়া পদ্ধতি অনুসরণ করতে পারি না। আমরা নিজেদের এই প্রশ্ন করি—আমাদের ছেলে-মেয়েদের এসব ব্যাধি থেকে নিরাপদ রাখার জন্য কোন এডুকেশন বেশি কার্যকরী? কুরআনের এডুকেশন? নাকি নির্লজ্জের মতো কোমল মতি শিশু কিশোরদের মনোজগৎ বিকৃত করে দেয়া সেক্স-এডুকেশন? এ ব্যাপারে কার বলে দেয়া ফর্মুলা অধিক কার্যকরী? যা কিছু আল্লাহ বলে দিলেন তা? নাকি যা কিছু ঐ স্বার্থ লোভী সুবিধা ভোগীরা বাতলে দিল তা!
এই সুবিধা ভোগীরা প্রচার করে বেশি বেশি যৌনতার আলোচনা হোক, সেক্স নিয়ে সেক্স-এডুকেশনের নামে কথা হোক, খোলামেলা আড্ডাবাজি হোক, ছোট পোশাকের ব্যাপারে আলোচনা হোক, আলোচনা হোক স্বাধীনতার নামে অবাধ যৌনতার। তারা প্রমাণ করতে চায় এভাবে যৌনতার ব্যাপারে ভ্রান্তি দূর হবে। ইভ টিজিং, যৌন নির্যাতন, ধর্ষণের মতো সামাজিক ব্যাধিগুলো দূর হবে। বেশ তো। তবে আপনিই বলুন না, তাদের সমস্ত তত্ত্ব বাস্তবায়নের পরেও এসব অপরাধ কেন।
আরো পড়তে অথবা দেখতে :- অনুগ্রহ করে Hardcopy ক্রয় করুন।
Buy Hardcover From Wafilife Or Rokomari
অনুরোধঃ– বই : যে জালে সহস্র হারিয়েছে ঈমান এর প্রি অর্ডার চলছে … তাই যে জালে সহস্র হারিয়েছে ঈমান বইটি PDF Free Download চাহিয়া লেখকদের নিরুৎসাহিত করিবেন না।
We Respect Every Author Hardwork – boipaw.com™
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?