বাংলা সাহিত্যে প্রেত অশরীরী অপদেবতা নিয়ে প্রচুর ভালো ভালো লেখা আছে। কিন্তু বিভূতিভূষণ এতকিছুর মাঝেও যেনো ব্যতিক্রম। তাঁর লেখনীতে আত্মা প্রেত অশরীরীর পাশাপাশি যে জিনিসটা এসেছে সেটা হলো অপার্থিব পরিবেশ। প্রতিটি গল্পেই তিনি আশপাশের পরিবেশ, আলোছায়া, গাছপালা, গ্রামবাংলা, অরণ্যকে এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন যেন সেই প্রকৃতির বর্ণনাও মনে শিহরণ এনে দেয়।
এপ্রসঙ্গে “আরক” গল্প থেকে একটি উদ্ধৃতি দেয়া যেতে পারে-
“রাত্রি ক্রমে গভীর হল। অপূর্ব জ্যোৎস্নালোকে হ্রদের জল, মরুভূমির নোনা বালি রহস্যময় হয়ে উঠেছে, কোনো শব্দ নেই কোনোদিকে। ঠাকুরদাদা যথেষ্ট দুঃসাহসী হলেও তাঁর যেন গা ছমছম করে উঠল- জ্যোৎস্নার সে ছন্নছাড়া অপার্থিব রূপে…”
কিংবা ” বোমাইবুরুর জঙ্গলে” থেকে
“দিন কতক তো এমন হইল যে, কাছারিতে একলা নিজের ঘরটিতে শুইয়া বাহিরের ধপধপে, সাদা, উদাস, নির্জন জ্যোৎস্নারাত্রির দিকে চাহিয়া কেমন এক অজানা আতঙ্কে প্রাণ কাঁপিয়া উঠত; মনে হত কলকাতায় পালাই, এসব জায়গা ভালো নয়। এর জ্যোৎস্নাভরা নৈশপ্রকৃতি রূপকথার রাক্ষসি রাণীর মতো, তোমাকে ভুলাইয়া বেঘোরে লইয়া গিয়া মারিয়া ফেলিবে….”
এই যে প্রকৃতির অপার্থিব গা ছমছমে ভাব, এটা বিভূতিভূষণ খুব চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলতেন। বইটা পড়তে গিয়ে কয়েকবার গায়ে কাঁটা দিয়েছে অস্বীকার করবোনা।
বিভূতিভূষণের হরর আসলেই আসবেন তারানাথ তান্ত্রিক এবং তা স্বাভাবিকও। সনাতন ও বৌদ্ধ ধর্মের অংশ এই তন্ত্রসাধনার আলোকিত ও আঁধার রূপ – দুটোকেই আধুনিক লোকের চোখে চিনিয়েছেন বিভূতিই। তবে তারানাথের পিছনে সমান সমান ক্রেডিট তাঁর সুযোগ্য পুত্র তারাদাস বন্দোপাধ্যায়েরও। এই বইটিতে মূলত বিভূতিভূষণের মূল যে দুটি গল্প তারানাথকে নিয়ে, সে দুটি আছে। এর বাইরে আছে বিভূতিভূষণের বাকি ৩২ টি গল্প। এবং এই গল্পগুলোই তাঁর মূল প্রতিভার স্বাক্ষর। মূল আকর্ষণ।
আমার ব্যক্তিগত পছন্দ (এই কয়েকটি গল্পের বিশেষ বিশেষ জায়গায় গা কাঁটা দিয়েছিলো আসলেই) তিরোলের বালা, বোমাইবুরুর জঙ্গলে, হাসি, আরক, ছায়াছবি, মেডেল, মায়া, খুঁটি দেবতা, পৈতৃক ভিটা ও অশরীরী। এর মাঝে যারা আরণ্যক পড়েছেন বোমাইবুরুর জঙ্গলের সেই সাদা কুকুরের গা শিউরে উঠা গল্প সবারই জানা।
বিশেষ করে আরক, মেডেল, মায়া ও খু্ঁটি দেবতা – এই চারটি গল্প একদমই অপার্থিব। পরিবেশের সাথে রহস্য, রহস্যের সাথে ভৌতিকতা – মিলেমিশে একাকার।
তিরোলের বালা-য় সেই হতভাগিনী মেয়েটি কিংবা পৈতৃক ভিটার সেই ছোট্ট স্বজনহারা বালিকার বর্ণনা মন খারাপ করাবে। আবার খুঁটি দেবতা গল্পটি মনে জাগাবে কৌতুহূল – আসলেই কি বিশ্বাসের জোরে সব হয়?
অশরীরীর সেই কালো মেয়েটিই বা কে ছিলো? কোনো দেবী? কোনো শুভাকাঙ্ক্ষী? জানতে চেয়েও উত্তর মিলবেনা।
হাসি গল্পটি পড়ে রাতের সুন্দরবনকে দেখবেন অন্য চোখে।
কিংবা রাজায় রাজার শত্রুতা যে প্রাসাদের ইটপাথরকেও কলুষিত করে, অভিশপ্ত গল্পটি তারই প্রমাণ।
ফ্র্যাংকলি বললে সবকটা গল্প দশে দশ পাবার মত নয়। কিছু সাধারণ, ভয়হীন গল্পও আছে। তবে আর দশজন লেখকের মত গল্পের মাঝে জোর করে হাসি মশকরা, মামদো ভুতের ছা আর মেছো ভুতের নাকি সুর ঢুকিয়ে দেয়া হয়নি- এটুকু নিশ্চিত।
বইয়ে অজস্র চমৎকার ছবি ও স্কেচ আছে। যদিও বেশিরভাগই গল্প সংশ্লিষ্ট নয়। এটা একটা নেগেটিভ সাইড।
“বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় ভয় সমগ্র” – প্রকাশক বুক ফার্ম, গায়ের দাম ২৭০ টাকা। বাংলাদেশে বাতিঘর থেকে কিনেছি ১.৭ রেটে ৪৫৯ টাকায়।
বিখ্যাত রাইটারদের নিয়ে বুক ফার্মের ভয় সমগ্র সিরিজ বের করা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। বিভূতিভূষণ দিয়ে যাত্রা শুরু করলাম, দেখা যাক একে একে শেষ করবো সবকটি বই।
রেটিং ৪.৫/৫। হ্যাপি রিডিং।