বইঃ বিজিতা
লেখকঃ তাবারক হোসেন
প্রকাশনীঃ অবসর প্রকাশনা সংস্থা
প্রচ্ছদঃ মাসুম রহমান
গায়ের মূল্যঃ ৩০০ টাকা
পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ১৫০
লেখক পরিচিতিঃ________________________
উয়িং কমান্ডার মোঃ তাবারক হোসেন বিমানবাহিনী থেকে ২০০৫ সালে অবসর গ্রহণ করেন। অবসরপ্রাপ্ত এই উয়িং কমান্ডার চিত্রনাট্য, গল্প, উপন্যাসের মাধ্যমে পাঠকপ্রিয়তা এবং দর্শকপ্রিয়তার মাধ্যমে সমাদৃত। শিক্ষা ও কর্মজীবনেও রয়েছে তার ব্যাপক সাফল্য। লেখালেখির ঝুলিতে রয়েছে মোট সাতটি গ্রন্থ ‘শ্বেতপদ্ম’ ‘ব্রেসলেট’ ‘অণু’ ‘একরাত্রি’ ‘নিষ্পত্তি’ ‘মোটিভেশন প্রতিদিন’ যার প্রতিটিই বেশ পাঠকপ্রিয়।
বই সম্পর্কেঃ______________________________
“বিজিতা” বইটি তাবারক হোসেনের সপ্তম গ্রন্থ এবং এটি প্রকাশিত হয় ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে।
প্রচ্ছদ এবং নামঃ__________________________
উপন্যাসের প্লট অনুযায়ী প্রচ্ছদ এবং নাম বেশ উপযোগী। নাম এবং প্রচ্ছদ দেখে মনে হতে পারে উপন্যাসটা একটা মেয়ের। কিন্তু না, এটি একজন লেখকের জীবন গল্প এবং পরিণতি।
ফ্ল্যাপ থেকেঃ______________________________
“জীবনে যদি কোন দিন এমন সময় আসে যে তোমার মায়ের সাথে আমার বিবাদ শুরু হয়। তোমরা শর্তহীনভাবে মায়ের পক্ষ নেবে। এখানে কোন যুক্তি খুঁজতে যাবে না। তিনি তোমাদের মা, এর চেয়ে বড় যুক্তি পৃথিবীতে নেই।….”
ফ্ল্যাপের এই কথাটুকু পড়েই আমি বইটা কেনার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি।
বইটির বিষয়বস্তুঃ__________________________
জীবনে চলার পথে একজন মানুষের কোনো কথা-মতামত, অবজ্ঞা-প্রত্যাখ্যান না করা একজন মানুষ হঠাৎ করেই তার নিজ একটি মতামত নেওয়ার ফলে তার সম্পূর্ণ জীবন বদলে যাওয়া একটা গল্প।
এবং এর সাথে জড়িয়ে যায় আরেকটি বিজাতীয়া মেয়ের জীবন। একজন ব্যক্তির, জীবনের প্রথম এবং শেষ ভাগের পরিণতির কথাই বলা হয়েছে গল্পটিতে। উঠে এসেছে মানুষের মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার সমূহ, দুঃখের খেলা, সুখের পরশ এবং সামাজিক কিছু দিক।
বইয়ের চরিত্রসমূহঃ__________________________
চরিত্র সংখ্যা ১২ জন বা অধিকও হতে পারে।
জগলুল হায়দার (মূল চরিত্র)
মমতাজ বেগম (জগলুল- স্ত্রী)
তামিশা (জগলুল- মেয়ে)
অনিক (জগলুল- ছেলে)
শ্রাবন্তী (পাঠিকা)
জালাল উদ্দীন (জগলুল- বন্ধু)
মূলত এই ছয়টা চরিত্রকে ঘিরেই উপন্যাসটা একটা গাছ। তারপর কথার প্রেক্ষিতে বিভিন্ন চরিত্র আসে ডাল-পালার মতো, যাতে উপন্যাসটি একটা রূপ পায়।
চরিত্র সমূহের সংলাপঃ_____________________
একটা গল্পে চরিত্র এবং তার থেকে পরিস্থিতি অনুযায়ী সঠিক বক্তব্য অতি গুরুত্বপূর্ণ। চরিত্রের বক্তব্য দ্বারাই একজন পাঠক হাসে এবং কখনও কাঁদে। সেক্ষেত্রে গল্পটির প্রতিটি চরিত্রের বক্তব্য, চিত্রায়ণ এবং পরিস্থিতির দৃশ্যায়ন বেশ ভালো ছিলো।
তবে সংলাপে এরকমটা অধিকবার ব্যবহার করার ফলে আমার বিরক্ত লেগেছে।
আর…
আর কী?
তাছাড়া…
তাছাড়া কী?
তবে…
তবে কী?
এছাড়াও মমতাজ বেগমের সংলাপ খুবই কম ছিলো। গল্পের প্রধান সমস্যাটা তার সৃষ্টি তো আমি অধিক ক্ষেত্রে তার সাথে সংলাপ আশা করেছিলাম। যদিও এটা লেখকের ইচ্ছা।
দৃশ্য এবং অনুভূতিঃ_________________________
আপনি যদি একটা গল্প পড়ে সেসব মূহুর্ত কল্পনা করতে অক্ষম হন। তাহলে সেটাকে আমি লেখকের ব্যর্থতা হিসেবেই ধরি। তাবারক হোসেনের ‘বিজিতা’ গল্পটি পড়ার সময় আপনি পুরো গল্পটির মাঝে ডুবে থাকতে পারবেন কি-না জানি না। তবে কিছু কিছু মূহুর্ত আপনি সত্যিই অনুভব করবেন।
আপনি দৃশ্যায়নে ব্যর্থও হতে পারেন। কারণ, লেখক প্রতিটা পাতায়ই পরিস্থিতির মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার নিয়ে ব্যাখা করেছেন। দৃশ্যায়নে ব্যর্থ হলেও আপনি কিছু বার্তা পাবেন।
কাহিনী সংক্ষেপ ও পর্যালোচনাঃ____________
মানুষ তার মন এবং মস্তিষ্ক দ্বারা পরিচালিত। মন যখন একজন ব্যক্তি সম্পর্কে কিছু ধারণা পোষণ করে, তখন তা একই নিয়মে চলে।
কখনও মমতাজ বেগমের অবাধ্য, অমত না করা তার স্বামী জগলুল হায়দার যখন চিকিৎসা পেশা ত্যাগ করে সাহিত্যে মননিবেশ করার সিদ্ধান্ত নেন, তখন তার স্ত্রী কিছুতেই তা মেনে নিতে পারে না। এ যেন ছিলো তার মনে বিশাল এক পাথর নিক্ষেপ। যার ফলে প্রেমের বিয়ে থাকা সত্ত্বেও দুই সন্তান সহ এত বছরের সংসারে সে তার স্বামীকে গৃহত্যাগ হতে বাধ্য করে।
গৃহত্যাগী এই চরিত্রকে নিয়ে লেখক দেখান নিচ তলার মানুষের প্রতি উপর তলার মানুষের দৃষ্টি। বেকার যুবকদের পরিস্থিতির শিকার হয়ে কী অবনতি।
এরপর গৃহত্যাগী জগলুল হায়দার উঠেন তার বন্ধু জালাল উদ্দীনের বাসায়। সেখানেও দেখা যায় অন্য এক জীবনের গল্প। ব্যারিস্টার জালাল উদ্দিন তার একাকিত্ব জীবনে আসা রেশমাকে দূরে ঠেলে দেয় এবং তার হৃদয়ের গভীরে তার অনুপস্থি তাকে আবেগপ্রবণ করে তুলে। বিভিন্ন কথোপকথনের মাঝে লেখক বুঝিয়েছেন, মানুষের জীবনে কিভাবে নতুন অধ্যায় আসে, কিভাবে সম্পর্কে জড়িয়ে যায়, কিভাবে শূন্যস্থান পূরণ হয়ে যায়।
এ দৃষ্টিতে জগলুল হায়দারের জীবনের শেষ অংশও এর মাঝেই পরে। নতুন অধ্যায়, সম্পর্ক, শূন্যস্থান পূরণ।
উপন্যাসের অর্ধেক শেষ হবার পরই জগলুল হায়দারের লেখার একনিষ্ঠ ভক্ত শ্রাবন্তীকে দেখা যায়। যে কি-না জগলুল হায়দারের মেয়ে তামিশার থেকেও ছোট তাকে নিয়ে সন্দেহ করেই সংবাদ পত্রিকায় সব ইনিয়েবিনিয়ে বলা শিরোনাম। এখানে সংবাদপত্র সম্পর্কে সাধারণ ধারণা পাওয়া যায়, যারা কি-না, ব-হলে ক-লিখে সংবাদ ছাপায়।
শ্রাবন্তীর সাথে ইন্টারভিউে জানা এবং শেখা যায় বিভিন্ন কিছু।
একসময় মমতাজ বেগম তার স্বামীকে ডিভোর্স লেটার পাঠায়! লেখক তার একমাত্র মেয়ের বিয়েতে তাকে ছুঁয়ে না দেখার বেদনা বুকে আটকে রাখে।
একসময় শ্রাবন্তী হয়ে যায় জগলুল হায়দারের একাকিত্ব জীবনের একমাত্র সঙ্গী।
সুখ সাময়িক। সুখ থেকে মানুষের জীবনে দুঃখই বেশি। আর দুঃখ অতিক্রম করতে হয় ত্যাগ দ্বারা। মানুষের উচিত সাময়িক সেই সুখের কথা ভেবেই নিজেকে খুশি রাখা। উপন্যাসের পরবর্তী অংশে এরকম বার্তাই দেওয়া।
উপন্যাসটিতে দেখা যায়, একজন নামীদামী লোক হওয়া সত্ত্বেও জীবনের বিপর্যয়ে কাউকে পাশে পাওয়া যায় না। সবাই কিছু থাকলেই কেবল কিছু দেয়। লেখকের অসুস্থতায় তার কোনো পাঠক সহায় ছিলো না, তখন কোনো পত্রিকার সংবাদ ছিলো না। কিন্তু যখনই একজন মানুষ একটা ভুল করে বসে তার সাথে কোনো সন্দেহ যায় তখনই দেশজুড়ে চলে তোলপাড়। কোনোকিছুর বিস্তারিত, গোড়া থেকে না জেনে আমরা তাকে নিয়ে তখন কুৎসা রটাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি।
শিক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও চাকরির অভাবে মানুষ করে ফেলে অসামাজিক কাজকর্ম।
টাকার হিসেব করে আমরা সমাজ পরিচালনা করি। যার যত টাকা সে তত সম্মানিত।
মানুষের বর্তমান যেরকম আছে ভবিষ্যতেও সেরকম থাকবে এমন ভেবে রেখেই মানুষ মূর্খতার পরিচয় দেয়। মানুষ পরিবর্তনশীল। মানুষ পরিস্থিতি এবং মন অনুযায়ী পাল্টে যায়।
সমালোচনাঃ___________________________
মূল গল্পটি অনেক ছোট, কিন্তু প্রতিটি ক্ষেত্রের বড় বড় ব্যাখায় গল্পটি বড় আকার ধারণ করেছে। গল্পে বেশকিছু বার্তা আছে। তবে শৈল্পিক ছোঁয়া কম ছিলো। অত্যাধিক মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখার কারণে মূল অংশগুলো দূরে সরে যাচ্ছিলো। তবে ব্যাখাগুলো ব্যক্তি জীবনের সাথে পারস্পরিক ছিলো, যা ছাড়া হয়তো ভালোও হতো না। কিন্তু, অল্প কথায় বড় ম্যাসেজ দিলে ঘোরটা আরও শক্ত হতো।
ত্রুটি সমূহঃ____________________________
প্রথম দিকে পড়ার সময় আমার হাল্কা বিরক্ত আসছিলো। কারণ, প্রতিটা লাইনের শেষেই ‘ছে’ বা এ-কার দিয়ে শেষ হয় এমন বাক্য।
চলছে, উঠছে, ছাপবে, উঠেছে,, বাজছে।
এছাড়াও অনেকক্ষেত্রে কমা এবং ও-কারের ব্যবহার হয় নি।
আছ–আছো
বল–বলো
জানলে–জানতে (১২২)
বইটি যে কারণে পড়তে পারেনঃ______________
১) মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপারগুলো বোঝার জন্য।
২) নিঃস্ব এবং একলা পরিস্থিতিতে মানুষ কতোটা দুর্বল জানার জন্য।
৩) দেশভাগ নিয়ে সামান্য আলোচনা জানবেন।
৪) ঢাকার রাস্তায় ডাকাতদের কিছু টেকনিক জানতে পারবেন।
৫) কাউকে সবটুকু দেওয়ার পর অল্প না দেওয়ার পরিণাম সম্পর্কে জানবেন।
প্রিয় লাইনঃ____________________________
👉গরিব মানুষকে আগে থেকেই শালীন থাকার অভ্যাস তৈরি করতে হয়।
👉অন্যের সমস্যায় বড় বড় পজেটিভ কথা বলা যতটা সহজ, নিজের বেলায় তা বলা ততটাই কঠিন।
👉জীবনে যা ঘটে সময়ের প্রয়োজনেই ঘটে।
👉কেয়ারিং মানে অন্যকে তার মতো বিকশিত হতে ও স্বপ্ন বাস্তবায়নে সহায়তা করা।
ব্যক্তিগত অনুভূতিঃ________________________
রেটিং হিসেবে, ৮.৫/১০
প্রথম দিকের বর্ণনা অনুযায়ী ভেবেছিলাম, জগলুল হায়দার হয়ত শ্রাবন্তীর সাথে ভালোবাসার সম্পর্কে জড়াবেন না। কিন্তু তারা একসময় ভালোবাসায় আবদ্ধ হয়, সংসার করে, জমজ দুটো মেয়েও হয়। গল্প শেষে লেখক প্রশ্ন রেখে যায় ‘কে বিজিতা আর কে বিজয়িনী, শ্রাবন্তী নাকি মমতাজ?’
আমি মনে করি শ্রাবন্তীই আসল বিজয়িনী। যৌবন আগমন বয়সের সে সময় এবং জগলুল হায়দারের মৃত্যু পরও তার অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে এবং নিজেকে নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে হয়েছে শুধু জগলুল হায়দারের ভালোবাসা নিয়েই।
আবার মমতাজেরও প্রথম সময়ে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। স্বামীর সামান্য ডিসিশন মেনে নিলেই হয়তো গল্পটা ভিন্ন হতো এবং মমতাজ বিজিতা না হয়ে হতো বিজয়িনী।
সবশেষে, গল্পটা পড়ে হতাশ হই নি। লেখক ছোট ছোট পর্ব করে গল্পটা সুন্দরভাবে এগিয়ে নিয়েছেন।
মন্তব্যঃ________________________________
আমরা নিজেরা যে সমস্যা তৈরী করি,
আমরা নিজেরাই সে সমস্যার সমাধান করতে পারি।
নামঃ কাওছার তালুকদার
ঠিকানাঃ টাঙ্গাইল
পেশাঃ শিক্ষার্থী