সুনাম-সুখ্যাতির প্রতি সালাফগণের অনীহা..
এক
হাবীব ইবনু আবি সাবিত রাহিমাহুল্লাহ বলেন, আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ রাযিয়াল্লাহু আনহু একবার কোথাও যাচ্ছিলেন। কিছু মানুষ তার পেছনে পেছনে হাঁটছিল। তিনি তাদের উদ্দেশ্য করে বললেন, আমার কাছে তোমাদের কোনো প্রয়োজন আছে? তারা বলল, না; কিন্তু আমরা আপনার সাথে কিছুক্ষণ হাঁটতে চাই। তিনি বললেন, তোমরা ফিরে যাও। কারও পেছনে পেছনে হাঁটা, এটা অনুসারীদের জন্য অপমান। আর অনুসৃত ব্যক্তির জন্য ফিতনা |[১][২]
দুই
হারিস ইবনু সুওয়াইদ রাহিমাহুল্লাহ বলেন—আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ বলতেন, আমি আমার সম্পর্কে যা জানি, তোমরা যদি তা জানতে, তাহলে (আমার প্রতি ঘৃণাবশত) তোমরা আমার মাথায় মাটি ছুড়ে মারতে।
তিন
বিসতম ইবনু মুসলিম রাহিমাহুল্লাহ বলেন, মুহাম্মাদ ইবনু সীরীন রাহিমাহুল্লাহ যখন দেখতেন, কেউ তার সাথে সাথে হাঁটছে, তখন তিনি দাঁড়িয়ে যেতেন। আর বলতেন, ভাই, আমার কাছে কি আপনার কোনো প্রয়োজন আছে?
যদি কোনো প্রয়োজন থাকত, তাহলে তিনি তা পূরণ করতেন। এরপরও যদি লোকটি তার সাথে হাঁটতে থাকত, তখন বলতেন, আপনার আর কোনো প্রয়োজন আছে কি?[১]
চার
হাসান[] রাহিমাহুল্লাহ বলেন, একদিন আমি আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারকের সাথে ছিলাম। তিনি আমাকে নিয়ে একটি কূপের নিকট সেন। মানুষ সেখান থেকে পানি উঠিয়ে পান করছিল। আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারকও পানি পান করার জন্য কূপের নিকটে যান; কিন্তু লোকেরা তাকে চিনতে না পারায় তার সাথেও ধাক্কাধাক্কি করে।
অতঃপর তিনি ভিড় থেকে বের হয়ে এসে বলেন, এটাই জীবন। অর্থাৎ যেখানে
আমাদের কেউ চিনবে না, সেখানে আমাদের কেউ সম্মানও করবে না।
হাসান বলেন, আমরা একবার কুফায় অবস্থান করছিলাম। তখন আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারকের সামনে ‘কিতাবুল মানাসিক’ পড়া হচ্ছিল। একপর্যায়ে এমন একটি হাদীস সামনে আসে যেটির শেষে লেখা ছিল— আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক বলেন, ‘এটিই আমাদের মত।’ তখন আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক জিজ্ঞেস করেন, ‘আমার এই উক্তি কে লিখেছে?’ আমি বললাম, “এই কিতাব যার—তিনিই লিখেছেন।’ আমার এ কথা শুনে তিনি পাঠদান শেষ হওয়া পর্যন্ত তার হাত দিয়ে খুঁটে খুঁটে সেই লেখাটুকু তুলতে থাকেন। সেই সঙ্গে পাঠদানও অব্যাহত রাখেন। এরপর বলেন, ‘আমি এমন কে যে, আমার কথা কিতাবে লিখতে হবে?’
পাঁচ
হুসাইন ইবনুল হাসান আল-মাররুযী রাহিমাহুল্লাহ বলেন—আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক বলেন, নিজেকে সবসময় সুনাম-সুখ্যাতির আড়ালে রাখার চেষ্টা করবে। সেই সঙ্গে তুমি যে সুনাম-সুখ্যাতি পছন্দ করো না—সেটা বলে বেড়ানো থেকে বিরত থাকবে। নিশ্চয় যে নিজেকে ‘যাহিদ[১]’ বলে দাবি করে, সে ‘যুদ’-এর চৌহদ্দি থেকে বেরিয়ে যায়। কেননা, ‘যাহিদ’ বলে বেড়ানোর অর্থই হলো মানুষের প্রশংসা ও স্তুতিবাক্য কামনা করা![২]
ছয়
ইবনু মুহাইরিয রাহিমাহুল্লাহ বলেন, একদিন আমি ফুযালা ইবনু উবাইদকে বললাম, আমাকে উপদেশ দিন। তিনি বললেন, কিছু গুণ আছে, সেগুলো অর্জন করতে পারলে আল্লাহ এর দ্বারা তোমাকে উপকৃত করবেন।
(১) সম্ভব হলে এমনভাবে থাকার চেষ্টা করবে যে, তুমি মানুষকে চিনবে; কিন্তু
মানুষ তোমাকে চিনবে না।
(২) তুমি শুধু শুনবে, কিছু বলবে না।
(৩) তুমি অন্যের মজলিসে বসবে, কিন্তু তোমার মজলিসে কেউ বসবে না।[৩]
সাত
জনৈক ব্যক্তি থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা আমি আবু আব্দিল্লাহ[৪]-এর চেহারায় দুশ্চিন্তার ছাপ দেখতে পাই। কারণ, জিজ্ঞেস করলে জানা যায়, কেউ একজন তাঁর প্রশংসা করে বলেছিল, আল্লাহ তাআলা ইসলামের পক্ষ থেকে আপনাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন। তার এই দুআর উত্তরে তিনি বলেছিলেন, বরং আল্লাহ তাআলা আমার পক্ষ থেকে ইসলামকে উত্তম বিনিময় দান করুন। আমি এমন কে যে, মহান আল্লাহ আমাকে ইসলামের পক্ষ থেকে প্রতিদান দেবেন![১]
আট
মুহাম্মাদ ইবনুল মুনকাদির রাহিমাহুল্লাহ বলেন, মসজিদে নববীতে একটি খুঁটি ছিল। আমি রাতের বেলা খুঁটিটির পাশে সালাত পড়তাম। তাতে হেলান দিয়ে বিশ্রাম নিতাম। একবারের ঘটনা, মদীনায় সে-বছর মারাত্মক খরা দেখা দেয়। বৃষ্টির জন্য খোলা মাঠে এসে মানুষ প্রার্থনা করে; কিন্তু বৃষ্টি নামে না। এরপর সেই রাতে আমি ইশার সালাত আদায় করে মসজিদে নববীর ওই খুঁটির নিকট এসে হেলান দিয়ে বসি। এমন সময় একলোক আসেন। দেখতে কালো। একটা হলদে রঙের চাদর জড়ানো। ছোট একটা কাপড় তার কাঁধে চাপানো। সে আমার এবং আমার সামনে থাকা খুঁটির মাঝে এসে দাঁড়ায় এবং আমাকে পেছনে ফেলে দুই রাকাত সালাত আদায় করে। এরপর ওপরের দিকে দু’হাত তুলে কায়মনোবাক্যে বলে—
হে আমার প্রভু, আজ তোমার নবীর সম্মানিত শহরের মানুষেরা ময়দানে নেমেছিল, বৃষ্টি প্রার্থনা করেছিল; কিন্তু তুমি বৃষ্টি বর্ষণ করোনি। আমি তোমাকে দোহাই দিয়ে বলছি, তুমি তাদের ওপর অবশ্যই বৃষ্টি বর্ষণ করো!
ইবনুল মুনকাদির বলেন, আমি মনে মনে বললাম, লোকটা পাগল নাকি! অতঃপর সে হাত নামাতেই আকাশে মেঘের গর্জন শুনতে পেলাম। আর এমন মুষলধারে বর্ষণ হলো যে, বাড়িতে পরিবারের লোকদের জন্য দুশ্চিন্তা হচ্ছিল।
এদিকে লোকটা বৃষ্টির আওয়াজ শুনতে পেয়ে আল্লাহ তাআলার প্রশংসায় এমন কিছু বাক্য বলে—যা আমি ইতিপূর্বে কখনও শুনিনি। এরপর সে বলে, হে আমার রব, আমি এমন কে যে, আমার আহ্বানে সাড়া দিলে? কিন্তু হ্যাঁ, আমি কেবল তোমার প্রশংসা করেছি এবং তোমারই আশ্রয় চেয়েছি।
অতঃপর সে উঠে দাঁড়ায়। যে-কাপড়টা সে লুঙ্গি হিসেবে ব্যবহার করেছিল সেটাকে খুলে গোটা শরীরে জড়িয়ে নেয় এবং তার পিঠে ঝুলে থাকা কাপড়টা বিছিয়ে তার ওপর সালাত পড়তে শুরু করে। এভাবে ফজরের আগ পর্যন্ত সালাত পড়তে থাকে।
সুবহে সাদিকের আগ দিয়ে বিতরের সালাত পড়ে।
এরপর ফজরের দুই রাকাত সুন্নাত আদায় করে এবং সবশেষে সাধারণ মানুষের সাথে সাথে ফজরের জামাআতে অংশগ্রহণ করে। তার সাথে আমিও জামাআতে অংশগ্রহণ করি।
ইমাম সাহেব সালাম ফেরানোর পর সে উঠে বেরিয়ে যায়। আমিও তার পিছু পিছু হাঁটতে থাকি। একপর্যায়ে সে মসজিদের গেইট পর্যন্ত চলে আসে এবং কাপড় কিছুটা ওপরে উঠিয়ে পানির ওপর দিয়ে চলতে থাকে। আমিও তার মতো চলতে থাকি; কিন্তু কিছুক্ষণ পর হঠাৎ সে কোথায় যেন হারিয়ে যায়; তাকে আর খুঁজে পাই না।
দ্বিতীয় রাতে মসজিদে নববীতে ইশার সালাত আদায় করে ওই খুঁটির পাশে এসে বসি। খুঁটিটিকে বালিশের মতো ব্যবহার করে শুই। এ সময় লোকটি আবার আগমন করে। যে-কাপড়টা সে লুঙ্গি হিসেবে ব্যবহার করছিল সেটাকে ভালো করে গোটা শরীরে জড়িয়ে নেয়। আর কাঁধে ঝুলিয়ে রাখা কাপড়টা বিছিয়ে তার ওপর সালাত পড়তে শুরু করে। এভাবে ফজরের আগ পর্যন্ত সালাত আদায় করতে থাকে। এরপর বিতরের সালাতের পর ফজরের দুই রাকাত সুন্নাত আদায় করে। সবশেষে মানুষের সাথে সাথে ফজরের জামাআতে অংশগ্রহণ করে। তার সাথে আমিও জামাআতে অংশগ্রহণ করি।
ইমাম সাহেব সালাম ফেরানোর পর সে উঠে বেরিয়ে যায়। আমিও তার পিছু পিছু হাঁটতে থাকি। একপর্যায়ে সে একটি ঘরে প্রবেশ করে। মদীনায় বসবাস করার দরুন আমি ঘরটি ভালো করেই চিনতাম। ঘরটি দেখে আমি মসজিদে নব্বীতে ফিরে আসি।
সূর্যোদয়ের পর নফল সালাত আদায় করি। তারপর সেই ঘরের উদ্দেশ্যে রওনা করি। সেখানে গিয়ে দেখি, সে বসে বসে মোজা সেলাই করছে। অর্থাৎ পেশায় সে একজন মুচি। আমাকে দেখেই সে চিনে ফেলল এবং ঈষৎ হেসে বলল—’হে আবু আব্দিল্লাহ, তোমাকে স্বাগতম! তোমার কি সেলাইযোগ্য কোনো মোজা আছে? থাকলে দিতে পারো।’
আমি তার পাশে বসতে বসতে বললাম, তুমি কি প্রথম রাতে আমার সাথে থাকা সেই ব্যক্তি নও? এ কথা শুনতে-ই তার চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল। চিৎকার করে বলল, ওহে ইবনুল মুনকাদির! ওইটার সাথে তোমার কী সম্পর্ক? এ কথা বলে সে প্রচণ্ড রেগে গেল!
অতঃপর আমি তাকে এই বলে বেরিয়ে গেলাম যে, আল্লাহর শপথ! আমি এখনই তোমার এখান থেকে বেরিয়ে যাচ্ছি!
তৃতীয় রাত। আমি এশার সালাত মসজিদে নববীতে পড়ে ওই খুঁটির নিকট এসে হেলান দিয়ে বসে আছি; কিন্তু আজ আর ওই লোকটি এলো না। আমি মনে মনে বললাম, ইন্না লিল্লাহ! আমি কোনো সমস্যা করে ফেলিনি তো? সকালবেলা তার ঘরে গিয়ে দেখলাম, ঘরের দরজা খোলা এবং ঘর একেবারেই খালি। সেখানে মানুষ তো দূরের কথা; কোনো তৈজসপত্রও নেই।
ঘরের মালিক আমাকে বলল, হে আবু আব্দিল্লাহ, গতকাল তোমার এবং তার মাঝে কী হয়েছিল? আমি বললাম, কেন? কী হয়েছে তার? সে বলল, তুমি চলে যাওয়ার পর সে ঘরে ঢোকে তার চাদরটি মেঝেতে বিছায়। এরপর চামড়া, জুতা, মোজা এবং সেলাইয়ের যন্ত্রপাতিসহ প্রয়োজনীয় সবকিছু সেখানে রাখে। অতঃপর চাদরটি পেঁচিয়ে পিঠে করে নিয়ে চলে যায়। জানি না, সে কোথায় গেছে!
মুহাম্মাদ ইবনুল মুনকাদির বলেন, মদীনার এমন কোনো ঘর নেই—যেটাতে আমি তার অনুসন্ধান করিনি; কিন্তু তাকে কোথাও খুঁজে পাইনি। আল্লাহ তার ওপর রহম করুন![১]
আরো পড়তে অথবা দেখতে :- অনুগ্রহ করে Hardcopy ক্রয় করুন।
We Respect Every Author Hardwork – boipaw.com™