টাইম ট্রাভেলের অভিজ্ঞতা আছে কারো? না থাকলে নিঃসন্দেহে সানজাক-ই উসমান বইটা নিয়ে বসে যেতে পারেন। গ্যারান্টি দিচ্ছি, আশপাশ থেকে কেও ধাক্কা না দিলে ঘোর ভাঙতে যথেষ্ট দেরি হবে।
সানজাক-ই উসমান আপনাকে নিয়ে যাবে ১১৬২ সালে ইতিহাস কুখ্যাত চেঙ্গিস খানের জন্মের মুহূর্ত থেকে পঞ্চদশ শতাব্দির পর ইউরোপিয়ান রেঁনেসার আগ পর্যন্ত একটা দীর্ঘ সময়ের পরিভ্রমণে। মাঝে পাবেন ক্ষুদ্র পরিসর থেকে মহাশক্তিধর উসমানীয় সালতানাত বা অটোম্যান সাম্রাজ্যের গড়ে ওঠার দমবন্ধ করা গৌরবময় ইতিহাস। বইটা আপনাকে হাজির করবে ইতিহাসের রক্তক্ষয়ী সব যুদ্ধের ময়দানে।
অনেক আগে, যখন তিন গোয়েন্দা পড়তাম তখন এমন অচেতনের মত পড়ে থাকতাম বইয়ের ভেতর। গোসল খাওয়ার সময় কখন যেতো টের পেতাম না। আম্মার ধমক খেয়ে ঘোর ভাঙতো।
সর্বশেষ দ্য দা ভিঞ্চি কোড আর আমাজনীয়া পড়ার সময় ও অনেকটা ডুবেই গেছিলাম। কিন্তু সানজাক-ই উসমান আমাকে অনেকটা নতুন অভিজ্ঞতা ই দিলো। নিরেট ইতিহাসের বর্ণনা, কিন্তু হার মানিয়েছে যেকোন থ্রিলার উপন্যাসের কাহিনীর বর্ণনাকে।
সাধারণত প্রথাগত ঐতিহাসিকেরা একের পর এক সাল, বাহারি সব নাম আর ইতিহাসের গৎবাঁধা ঘটনার বিবরণ লিখে এমন এক ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করেন যে সাধারণ মানুষ ইতিহাসের বই দেখলেই চেষ্টা করে যতটুকু সম্ভব দূরে থাকার।
এই বইটা ঠিক সেসব সাধারণ মানুষের জন্যই।
ইতিহাসের গৎবাঁধা বিবরণের চেয়ে এখানে যথাসম্ভব বিশ্লেষণমূলক বিবরণ দেয়া হয়েছে।
আর লেখকের সহজ ভাষায় ঘটনার বর্ণনা দেবার অসাধারণ দক্ষতা আপনাকে সত্যিই একটা টাইম ট্রাভেলে নিয়ে যাবে।
কাহিনী সূত্র:
“কিয়ামত ততদিন পর্যন্ত সংগঠিত হবে না, যতদিন না লাল মুখওয়ালা, ছোট ছোট তির্যক চোখ ও চ্যাপ্টা নাকবিশিষ্ট তাতারেরা তোমাদের ওপর চড়াও হবে। তারা পূর্বদিক থেকে আসবে এবং তারা পশম লাগানো চামড়ার জুতা পড়বে, তাদের মুখ হবে ঢালের মত প্রশস্ত। তারা তোমাদের এমনভাবে আচ্ছন্ন করে ফেলবে, যেমন করে পঙ্গপালের ঝাঁক আকাশকে ঢেকে দেয়।”
– সহীহ বুখারি- ২৭৭০
এই ভবিষ্যৎবাণী মিথ্যে হয় নি। সত্যি সত্যিই রাসুল (সা.)- এর ওফাতের সোয়া ছয়’শ বছর পর পূর্বদিকে এক ঝড় ওঠে। চেঙ্গিজ খানের তলোয়ারের ধারে বদলে যেতে থাকে দুনিয়ার মানচিত্র।
১২০৬ সালে মঙ্গোলিয়ার স্তেপে আধাবুনো, অর্ধসভ্য কিছু যাযাবর উপজাতিকে নিয়ে চেঙ্গিজ খান যে সাম্রাজ্যের সূচনা করেন, তা পরবর্তী কুড়ি বছরে পৃথিবী জুড়ে নিয়ে আসে কেয়ামতের আগেই আরেক কেয়ামত। চীন, তুর্কীস্তান, আফগানিস্তান, খোরাসান, ইরান হয়ে ককেশাস থেকে রাশিয়া পর্যন্ত চেঙ্গিজ খান খুন করেন কয়েক কোটি মানুষকে। কায়েম করেন এক আতঙ্কের সাম্রাজ্য।
চেঙ্গিজ খানের মৃত্যুর পরও মোঙ্গলরা থামেনি। একে একে তারা দখল করে নেয় পুরো মধ্যপ্রাচ্য। ১২৫৮ সাল নাগাদ তারা দখল করে নেয় ইসলামী সভ্যতার সবচেয়ে সমৃদ্ধ শহর বাগদাদ। চালায় নৃশংস হত্যাজজ্ঞ।
তারপর মুসলিমদের পবিত্রভূমি মক্কা-মদীনার পতন এবং ইসলামের নাম নিশানা মুছে যাওয়া ছিলো সময়ের ব্যাপার।
এবং সেদিকেই এগোতে থাকে মোঙ্গলরা…. তারপর হঠাৎ ই তারা মুখ থুবড়ে পড়ে মিশরে গিয়ে।
দীর্ঘ সময়ে প্রথমবারের মত রুকুনুদ্দিন বাইবার্স এবং সুলতান সাইফ উদ্দিন কুতুজের নেতৃত্বে মিশরীয় মামলুকদের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয় মোঙ্গল শক্তি।
মামলুকরা জীবণ বাজি রেখে মোঙ্গলদের হাত থেকে রক্ষা করে সিরিয়া-মিশর ও মক্কা মদীনাকে।
আইন জালুত আর হোমসের যুদ্ধের পর পালটে যেতে শুরু করে ইতিহাসের স্রোতধারা।
মোঙ্গলদের হাত থেকে পালিয়ে যাওয়া তুর্কী মুসলিমরা তুরষ্কের আনাতোলিয়াতে গড়ে তুলতে থাকে নতুন সভ্যতা। এদের মধ্যেই একজন ছিলেন আরাতুরুল বে’র ছেলে উসমান।
আনাতোলিয়ার সবথেকে ছোট আমিরাতের সুলতান ছিলেন তিনি।
এখান থেকে শক্তিশালী অটোমান সালতানাতের শুরু।
তখন ইউরোপিয়ানদের অবস্থা যথেষ্ট ই করুণ। একের পর এক ক্রুসেডে পরাজয়, পোপের সাথে সম্রাটদের বিবাদ, রোগ বালাই, কুসংস্কার, সামাজিক অসংগতি সেই সাথে জলবায়ূ পরিবর্তন আর মহামারী ইউরোপের উপর মরণ আঘাত হানে।
ব্ল্যাক ডেথ আর দুর্ভিক্ষে উজার হয়ে যায় ইউরোপের জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ।
এদিকে চতুর্দশ শতাব্দীর শেষ দিকে এশিয়ায় আবির্ভাব ঘটে আরেক দিগবিজয়ীর। যিনি পুরো এশিয়াকে এক কবরস্থানে পরিণত করেন। তার নাম আমির তাইমুর, ইতিহাস কুখ্যাত তাইমুর লং।
একটা সাম্রাজ্যের গড় আয়ু হয় সাধারণত একশ থেকে দেড়’শ বছর পর্যন্ত। কিন্তু এক শতাব্দী ধরে বেড়ে ওঠা অটোমান সালতানাতের ভেঙে পড়ার কোন লক্ষণই দেখা যাচ্ছিলো না। তাইমুরের আক্রমণে বিধ্বস্ত হওয়ার পরও টিকে যায় অটোমানরা। তাদের টিকে থাকার মূলমন্ত্র ছিলো সুশাসন, ইনসাফ আর পুরোনোকে লালনের সাথে সাথে নতুনকে গ্রহণ করার মানসিকতা। এভাবেই পঞ্চদশ শতাব্দীতে অটোমানরা পরিণত হতে থাকে এক বিশ্বশক্তিতে।
১৪৫৩ সালে অটোমান সুলতান মুহাম্মাদ আল ফাতিহ এর নেতৃত্বে তারা বাস্তবে রূপদান করে মহানবী (সা.) এর আরেকটি ভবিষ্যৎবাণী; কনস্টান্টিনোপল বিজয়।
মোঙ্গলদের আক্রমণে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়ার দুই শ বছরের মাথায় ইসলামী সভ্যতার হাল ধরে অটোমানরাই।
জ্ঞ্যান বিজ্ঞান আর শিক্ষা সুশাসনে অটোমানরা ছিলো এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।
পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ দিকে দারিদ্রপীড়িত ইউরোপ ধীরে ধীরে আড়মোড়া ভেঙে উঠতে থাকে। হাজার বছর ধরে চেপে থাকা অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার আর দুঃশাসনের মাঝেও ইউরোপে জন্ম নিতে থাকে কালজয়ী সব চিন্তাধারা ও চিন্তাচেতনা। এখান থেকেই শুরু ইউরোপীয় রেঁনেসা।
সানজাক-ই উসমান মোট ৭ টা অধ্যায়ে বিভক্ত। এখানে পাঠকরা তিনটা সময়ের বিস্তারিত বিবরণ পাবেন।
১) চেঙ্গিজ খানের হাত ধরে মোঙ্গলদের পরাশক্তি হবার গল্প। তারপর মিশরে তাদের পরাজিত হওয়া, এবং নিজেদের অস্ত্রই বুমেরাং হয়ে ধীরে ধীরে তারা নিজেরাই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে মুসলিম হয়ে যাওয়া।
আরো দেখা পাবেন জালাল-উদ-দীন নামে এক ২১ বছরের তরুণ বীরযোদ্ধার। যিনি একাই সমানে সমান তালে লড়াই করেন চেঙ্গিজ খানের মত ঝানু যোদ্ধার বিরুদ্ধে।
২) উসমানের হাত ধরে অটোমান সাম্রাজ্যের উত্থান। সুলতান মুরাদ, এবং বায়েজিদের এক হাতেই ইউরোপিয়ান আগ্রাসন এবং ক্রুসেড ঠেকিয়ে দিয়ে অটোমান সাম্রাজ্যকে দিনকে দিন আরো সমৃদ্ধশালী করা। বায়েজিদের হেঁয়ালিপূর্ণ আচরণের ফলে আরেক পরাক্রমশালী তৈমুর লং এর সাথে হওয়া যুদ্ধে সব এলোমেলো হয়ে যাওয়া।
তারপর আবার আরেক সুলতান মুরাদ এবং সুলতান মুহাম্মাদ আল ফাতিহের হাত ধরে আগের থেকেও শক্তিশালী রুপে হাজির হওয়া।
মহানবী (সা.) এর ভবিষ্যৎবাণী সত্যি করে ১৪৫৩ সালে সুলতান মুহাম্মাদ আল ফাতিহ এর কনস্টান্টিনোপল বিজয়।
দেখা হবে ড্রাকুলার মত আধিভৌতিক পিশাচ চরিত্রের সাথে।
মাওলানা জালালুদ্দিন রুমির বিবরণ।
তরুণ সুলতান মুহাম্মাদ এবং তার প্রেয়সী গুলবাহারের প্রেম আপনাকে নিয়ে যাবে আরেক জগতে।
৩) পঞ্চদশ শতাব্দীর পর একদম বিধ্বস্ত অবস্থা থেকে ইউরোপের নবজাগরণ বা রেঁনেসার বিবরণ
কলোনাইজেশন এবং গ্লোবালাইজেশন কিভাবে শুরু হলো, আর সেটার ভাল মন্দ প্রভাব, সেটাও পাবেন তৃতীয় অংশে।
বিস্তারিত জানতে অবশ্যই পড়তে হবে সানজাক-ই উসমান: অটোমানদের দুনিয়ায়।
বইটার ব্যাপারে মজার একটা তথ্য, ৪৩২ পৃষ্ঠার বিশাল বইটি তরুণ লেখক Muhammad Sajal ভাই মোবাইলে টাইপ করে লিখেছেন। উনার ২ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল এই অসাধারণ বই।
আল্লাহর কাছে উনার আরো সমৃদ্ধি এবং কল্যাণের জন্য দোয়া করি, যাতে আমরা উনার কাছ থেকে আরও এমন মাস্টারপিস বই হাতে পেতে পারি।