“নাচের ফাঁকে ফুড স্টলে মোদি নিয়ে বসলাম। কলাপাতায় দিয়েছে এক খণ্ড নরম মাংস যাকে বলে স্টেক, পাঁজরের হাড়, চর্বি, পাকনালী, চামড়া, লিভার অর্থাৎ শরীরের বিভিন্ন অংশ বুনো পাতা দিয়ে রান্না, এই পদের নাম মোদি। মোদির সঙ্গে খাচ্ছি লাল লংকার আচার। স্থানীয়রা বলে রাজা মির্চ। আর সঙ্গে পানীয় খে। এটা দেখতে হলদেটে সবুজ। রাইস বিয়ার। নন স্টিকি রাইস দিয়ে তৈরি। গাছের ছাল বেটে মেশানো থাকে।” নাগাল্যান্ডের প্রিয় খাদ্য মোদিকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেলেন মৈত্রী রায় মৌলিক। রানিগঞ্জের রানি ভাবতে বসেছেন, রানিগঞ্জ তুমি কার? “পীরের মেলায় এলাম আর খাজা খেলাম না… এ হয় না। মাজার শরিফ থেকে বেরিয়ে চড়কের মাঠের দিকে যেতে সারি সারি দোকান দুপাশে। পরোটা কাবাব বিরিয়ানি তন্দুরি পোলাও ফিরনি যেমন আছে তেমনি আছে নানান মিঠা ও নমকিন সবই মোঘলাই পারসিক খানা। এখানকার রাজা আসলেই ছিল বর্ধমানের নবাবের আধিকারিক। এখানে খাঁটি পারসিক ও তাতার সিপাহীদের বংশধরদের এখনও পাওয়া যায় নীলাভ চোখ দুধেআলতা গা আর কটা চুল তাদের। নামে খাঁটি আরবি ছোঁয়াচ যদিও অবস্থা বেশ পড়তির দিকে তবুও খানদানি আরবীয়ানা তাদের আদব কায়দায়। মেলার মূল উদ্যোক্তা তাঁরাই। তাঁরা কিন্তু পরধর্মসহিষ্ণু থেকেছেন বরাবরই। এই প্রাচীন ইসলামীরা ছাড়াও এখানে রকমারি হিন্দু শিখ জৈন বৈষ্ণব আর খ্রিস্টানদের বাস। মেলায় সবাই আসে পীরবাবার সঙ্গে দেখা করে মানসিক রাখে। মোঘলাই খানায় অনেকেরই দ্বিধা আছে কিন্তু খাজায় কারোর কোনও দ্বিধা নেই। খানার দোকান শেষ হতেই খাজা ও মিঠাইয়ের দোকান শুরু। থরে থরে খাজা গম্বুজ করে সাজানো… মস্ত গোলাকার পাগড়ির মতো তার সোনালি-হলুদ গা থেকে মধুর মতো শিরা গড়িয়ে পড়ছে। ঘিয়ে ভাজা তেলে ভাজা বনস্পতিতে ভাজা হরেক খাজা তাদের দামও ভিন্ন আর স্বাদও। এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়ালেই দোকানি পছন্দ জেনে নিয়ে শালপাতায় এক টুকরো ভেঙ্গে এগিয়ে দেবে “কিনবো কি কিনবো না” জানতে না চেয়েই। তখন দেখা যাবে পাগড়ির মতো খাজার ভেতরে কাগজের মতো পাতলা পাতলা মিহি পরতের পর পরত রসে তুরতুর খাস্তা মুচমুচ করছে… মুখে দিয়ে জিভ আর টাকরার মাঝে খানিকক্ষণ ধরে রাখলে আপনিই গলে মিলিয়ে যায়। কিছুতেই একটু খেয়ে মন ওঠে না।” মালয়ালি পানীয়প্রীতি নিয়ে সবিস্তার প্রগতি চট্টোপাধ্যায় “কুলবারের মেনুকার্ডে সম্প্রতি সংযুক্ত হয়েছে ‘কুলিক্কি সরবত’। ‘কুলিক্কি’ অর্থাৎ ভাল করে ঝাঁকিয়ে নেওয়া। সরবতের প্রধান উপকরণে বিশেষ বৈচিত্র। কাঁচা আমের কুচি থেকে লংকার কুচি, আদার টুকরো, পোস্তদানা, ডাবের শাঁস, আনারসের টুকরো সব কিছুই থাকতে পারে কুলিক্কি সরবতে। সবকিছু মিশিয়ে খুব ভাল ভাবে ঝাঁকিয়ে নেওয়া। জেমস বন্ডের মার্টিনির মতন ‘shaken not stirred’। সব রকমের পানীয়প্রীতি মলয়লিদের একচেটিয়া। সকালের দিকে যদি কুলিক্কি সরবত বা সাধারণ লাইম সোডা হয় প্রথম পানীয়, ‘কাল্লুশপ’ বা দেশি মদের দোকানে গাঁয়ে-গঞ্জে কম ভিড় হয় না সূর্য ডোবার আগেও। এখানে অনুপান হিসেবে যে খাবার পাওয়া যায়, তা বেশ স্বাদের। অনেকেই ফুড-ব্লগ, ফুড-ভ্লগ থেকে খুজে পেতে এদের ঠিকানা দেখে পরখ করতে আসেন। তবে টেক-আউট হিসেবেই বেশি। ‘টোডি শপ’ বা তাড়ির দোকানেও একই ধরনের খাবার। তবে একটু নরম গোত্রের বাতাবরণ। ‘কাল্লুশপে’র উগ্র পুং-প্রবণতা এখানে একটু কম। পরিবার নিয়ে খাওয়া -দাওয়া শান্তির। এবং সারা কেরালা জুড়ে এদের খাবারের খুব রমরমা। মধ্য কেরালার কুট্টুনাড অঞ্চলে, নদীনালা, ব্যাক ওয়াটারের পাড় ঘেঁষে এমন অনেক টোডি শপ আছে, তার মধ্যে বেশ জনপ্রিয়, ‘নিউ ইয়র্ক টোডি শপ’। প্রধান পদ হাঁসের রোস্ট, ‘ইডিয়াপপ্পম (চালের গুঁড়ো দিয়ে তৈরি সরু সেমাই, ভাপিয়ে নেওয়া)।”
শিলঙের বাজার অঞ্চলে যারা কেতলি হাতে, ঝুড়ি কাঁধে চা আর খাবার বিক্রি করে, তাদের ঝুড়ির ঢাকা সরালেও দেখা যাবে চাউমিন, পকোড়া, কেক, পিঠে, ক্রিম বন সব মিলেমিশে বিক্রির অপেক্ষায় বসে আছে। গোটা শহরে যখন নিত্য নতুন বিশাল বিশাল রেস্তোরাঁ খুলছে, জাপানি সুশি থেকে ইতালিয়ান পাস্তা সবই নিজের জায়গা করে নিচ্ছে, তখনও ক্যাফে ভর্তি শহরে প্রতিদিন সন্ধ্যায় কয়লার আগুনে ভুট্টা সেঁকার গন্ধ এ শহরের অকৃত্তিম খাওয়ার দোকানগুলোর বেঁচে থাকা জানান দেয়। আগরতলা সেভাবে মেট্রোপলিস নয়। শান্ত, ছিমছাম শহর। ধীর, আনন্দময়। মানুষ কেবল হাসে, কেবল গায় আর খায়। শটিপাতায় মুড়ে কলাগাছের বাসনা দিয়ে বেঁধে ভাপায়। সঙ্গে কিছু আদাকুচি, সবুজ লঙ্কা। সেদ্ধ হয়ে গেলে সেই আঠা আঠা ভাতের নাম হয় বাঙুই। পাতা খুলুন, সঙ্গে তঅহান মসডেং। হর্নবিল উৎসব যে গ্রামে হয় তার নাম কিসামা। একটা আস্ত শুয়োর, গরু কিম্বা মিথুন কেটে বুনো লতাপাতা দিয়ে রান্না হবে। রান্নায় জল দেওয়া হবে না পশুর রক্তে রান্না। তার পর কলাপাতায় পরিবেশন করা হবে মোদি। কোড়ুবেলে হল ডালের চাকতি এর পর তাকে ভেঙেচুরে, তার সঙ্গে বিভিন্ন রকমের চাটনি তৈরি করা এক অতি উপাদেয় চাট-মসালা। বেশ শস্তায় রাস্তার ধারের হকারের ট্রলিতে ব্যাঙালোরের নব প্রজন্মের কাছে খুব জনপ্রিয়। ‘তাট্টুকাডা’ শব্দটি আসছে দুই শব্দের মিলনে — ‘তাট্টু’ অর্থাৎ নারকেলের পাতা দিয়ে ঘেরা ঝুপড়ি, আর ‘কাডা’ অর্থে, দোকান। ঝোপড়ি-স্টাইলের খাওয়ার দোকান। রান্না এক কোণে, খাওয়ার জায়গায় দুটো রিকেটি বেঞ্চি। স্টিলের থালার ওপর সাদা কাগজ দেওয়া, কেরালার অতি প্রসিদ্ধ স্বাস্থ্যসচেতনতার চিহ্ন। খাবার বলতে সাদা দোসা, যা সাধারণ দোসার মতন কুড়মুডে, সোনালি রঙের নয়। সঙ্গে নারকেল আর শুকনো লংকার ঝোল-ঝোল ‘চামন্থি’ বা চাটনি-বাটা। এই দোসার নাম মলয়লমে ‘তাট্টুদোসা, সঙ্গে নানারকম ‘কারি’ (আদতে শব্দটি দ্রাবিড়ীয়)। ‘মুট্টাকারি’ বা ডিমের রসা ও বিফ-ফ্রাই —-এই দুটিই ভীষণ রকমের আদরের। আম মলয়লি জিহ্বার অতি পক্ষপাতিত্বের মোড়কে রাখা বিফ-ফ্রাই। যদি এই গোলালো দোসা না থাকে, থাকতে পারে অবশ্যই জনমনরঞ্জনী ‘কেরালা পরোটা’। যা ভাঁজে ভাঁজে এমন খুলে আসে, যেন মনে হবে জাদুকর তিন-চারটি রিং নিয়ে রিং জুড়ে দেওয়ার খেলা দেখাচ্ছেন।
ফুডপ্যাথি ৪
ভারত জোড়া পথের খাবার ২
সম্পাদনা- সামরান হুদা, দামু মুখোপাধ্যায়
স্মারক রায় চিত্রিত
৯ঋকাল বুকস
মোট ছয় খণ্ডে সমাপ্ত, প্রতি খণ্ড ৫০০ টাকা মাত্র