- বই: নজরের হেফাজত – সফলতার হাতিয়ার
- লেখক: ড. শাইখ মাহমুদ মিসরি
- প্রকাশনী: মুহাম্মদ পাবলিকেশন
- বিষয়: আত্মশুদ্ধি ও অনুপ্রেরণা
- পৃষ্ঠা: 96, কভার : পেপার ব্যাক
- Review Credit: ফাহমিদা আফরিন
নজরের হেফাজত : সফলতার হাতিয়ার
আপনি মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন দৃষ্টি নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাজত করে। এতে তাদের জন্য রয়েছে অধিক পবিত্রতা। নিশ্চয়ই তারা যা করে আল্লাহ তা জানেন। [সূরা নুর: ৩০]
ইমাম ইবনুল কাইয়িম রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘দৃষ্টিই যৌন লালসার উদ্বোধক। কাজেই দৃষ্টি নিয়ন্ত্রণ ও সংরক্ষণ মূলত যৌনাঙ্গের সংরক্ষণ।
তাছাড়া বর্তমানে ইন্টারনেট ও স্যাটেলাইট প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে মুক্তচিন্তার নামে সর্বত্র নষ্টামি ও নোংরামির যে চর্চা শুরু হয়েছে, তা মানুষকে লাজ শরম ভুলে বেহায়াপনায় লিপ্ত করছে। যুবকদের দেহমনে লাগিয়ে দিচ্ছে যৌবনের আগুন। এর ফলে তারা সরে যাচ্ছে আল্লাহকে সন্তষ্ট করার পথ থেকে, নিমজ্জিত হচ্ছে পাপাচারে। যুবকদেরকে নোংরামির অতল গহ্বর থেকে টেনে উঠিয়ে আনতে হবে। নাহলে পুরো সমাজব্যবস্থায় ধ্বংস নামবে।
পাঠসজ্জা নিয়ে কিছু কথা:
ড. শাইখ মাহমুদ মিসরি রচিত এবং আল-আমিন ফেরদৌস কতৃক অনুবাদকৃত বই ❝ নজরের হেফাজত -সফলতার হাতিয়ার ❞। বইটিতে ছোট-বড় মিলিয়ে মোট ছাব্বিশটির মতো টপিকে আলোচনা রয়েছে নজরের হেফাজত সম্পর্কে।
তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো:-
- দৃষ্টি সংযম কী?
- ️দৃষ্টি ও বাক অসংযম
- চোখ হৃদয়ের প্রধান কপাট
- ️কুরআনে বর্ণিত কয়েকটি দলিল।
- ️এই আদেশ নারী-পুরুষ উভয়ের প্রতি।
- যৌনাঙ্গের আগে চক্ষু হেফাজতের আদেশ কেন?
মূল্যায়ন: ❝নজরের হেফাজত- সফলতার হাতিয়ার❞ বইটি আকারে ছোট হলেও এর ভেতরে যে কথাগুলো আছে সেগুলো খুবই মূল্যবান। একজন মুমিনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ হলো তাঁর নজরের হেফাজত করা। কারণ দৃষ্টি-ই হৃদয়ের প্রধান কপাট।
বইটিতে নজরের হেফাজত সম্পর্কে আকর্ষণীয় সব শিরোনাম দিয়ে কিছু আলোচনা তুলে ধরা হয়েছে। যেগুলোতে নজরের হেফাজত না করার কুফল, নজরের হেফাজত করার কৌশল ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে বলা হয়েছে।
দৃষ্টি সংযত রাখার উপায় গুলো বেশ ভালো লেগেছে। কুরআনের দলিল, হাদিসের দলিল দিয়ে দৃষ্টি সংযত রাখার উপকারীতা – অপকারীতা সম্পর্কে বোঝানো হয়েছে। নবী ইউসুফ আলাইহি ওয়াসাল্লামের দোআ হাইলাইট করা হয়েছে বইটিতে।
প্রচ্ছদ, পৃষ্ঠাসজ্জা ও বাইন্ডিং সবকিছুই ভালো হয়েছে। বানান ভুল বা টাইপ মিস্টেক চোখে পড়েছে যেমনঃ- ৫০ নং পৃষ্ঠার একটি শিরোনাম “ কুদৃষ্টির পরিণাম” হবে কিন্তু বইটিতে দেওয়া হয়েছে ‘কুদৃষ্টির পরিমাণ’।
সবমিলিয়ে এই বইটিকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি বই বলতে পারি।
পছন্দের কিছু অংশ-
- দৃষ্টি সংযত রাখতে আল্লাহর সাহায্য কামনা।
- দৃষ্টি সংযত রাখতে আল্লাহর ভয় অন্তরে সর্বদা বিরাজমান রাখা।
- নজর হেফাজতের উপকারিতা জানা।
- নজর হেফাজত না রাখার ক্ষতি জানা।
- পরকাল নিয়ে চিন্তাভাবনা করা।
কেন পড়বেন বইটি?
যুবক-যুবতীদেরকে দৃষ্টি সংযত রাখতে হলে জানতে হবে এর সুফল এবং দৃষ্টি অসংযত রাখার কুফল সম্পর্কে। এইসব জানতে বইটি বেশ উপকারী হবে বলে বিশ্বাস করি। তাই সকল যুবক-যুবতীদের এই বইটি পড়া উচিত। যেন ভবিষ্যতে আফসোস করতে না হয় যে,কেন নজরের হেফাজত করলাম না!
লেখক পরিচিতি
শাইখ আবু আম্মার মাহমুদ মিসরি। আরববিশ্বে সাড়াজাগানো লেখক ও দাঈ। ১৯৬২ সালে মিসরের কায়রো জেলায় ঐতিহ্যবাহী মিসরি ধার্মিক পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। শিক্ষাজীবনে প্রথমে তিনি হলওয়ান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজসেবা বিষয়ে স্নাতক সম্পন্ন করেন। এরপর শুরু হয় তাঁর সুদীর্ঘ ইলমি সফর।
নিজের ইলমি সফর সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমার এ সফর একটু বিলম্বে শুরু হয়েছিল। আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহে আমি কুরআন কারিমের হিফজ সম্পন্ন করেছি। এরপর আমি ‘সহিহুল বুখারি’ ও ‘সহিহ মুসলিম’সহ বেশ কয়েকটি হাদিসগ্রন্থ মুখস্থ করেছি। কুরআন কারিমের অধিকাংশ তাফসিরগ্রন্থ পাঠ করেছি। এ ছাড়া ফিকহ ও সিরাতসহ ইসলামি জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় বিচরণ করেছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি কখনোই আমার প্রতি আমার উস্তাদ—শাইখ মুহাম্মদ আবদুল মাকসুদ,
শাইখ মাহমুদের ইলমি সফর শুধু মিসরেই সীমাবদ্ধ ছিল না। ইলমের তৃষ্ণা নিবারণে তিনি পাড়ি জমিয়েছেন সৌদি আরবে। সেখানে তিনি একাধিক ইসলামিক স্কলারের সান্নিধ্যে থেকে ইলম অর্জন করেন। শাইখ মুহাম্মদ ইবনু ইসমাইলের কাছ থেকে ‘কুতুবে সিত্তাহ’সহ ইলমে দ্বীনের সকল শাখার ইজাযত লাভ করেন। তিনি কায়রোতে অবস্থিত আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট’ বিষয়ে ডক্টরেট ডিগ্রিও লাভ করেন।
ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর প্রকাশিত মূল্যবান গ্রন্থ সংখ্যা ছিয়াশিটি। সেসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো— ‘সিরাতুর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’, ‘আসহাবুর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’, ‘কাসাসুল কুরআন, ‘সাহাবিয়াতু হাওলির রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’, ‘রিহলাতু ইলা দারিল আখিরাহ’, ‘ইরশাদুস সালিকিন ইলা আখতাইল মুসলিহিন’ ইত্যাদি।
দৃষ্টিসংযম কী?
‘দৃষ্টিসংযম হলো ইসলামি শরিয়ত অনুযায়ী যা দেখা হারাম, তা থেকে দৃষ্টি সংযত রাখা, যা দেখা হালাল, কেবল সেদিকেই দৃষ্টিপাত করা। হারাম সবকিছু উপেক্ষা করে যাওয়ার ব্যাপারেও এই হুকুম প্রযোজ্য। কিন্তু এরপরও যদি আকস্মিক এবং অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে হারাম কিছু চোখে পড়েই যায়, তবে তৎক্ষণাৎ চোখ ফিরিয়ে নিতে হবে। [১]
আমরা জানি, জিনা-ব্যভিচারের মতো জঘন্য ও অশ্লীল কাজের সূত্রপাত ঘটে অসংযত দৃষ্টিপাত থেকে। কিন্তু এই ছোট্ট, অথচ ভয়ংকর রোগে আজ পুরো জাতি আক্রান্ত৷ অধিকাংশ মুসলিম আজ অশ্লীলতা ও বেহায়াপনায় লিপ্ত। অথচ, এই নোংরামো ও নির্লজ্জতার কারণে চারদিকে শত্রুতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, ঝগড়াবিবাদ লেগে থাকছে, অবৈধ সন্তান জন্ম নিচ্ছে, বংশ-পরম্পরা নষ্ট হচ্ছে; কিন্তু সে খবর কে রাখে?
কুদৃষ্টি থেকে হয় অগণিত গুনাহের উৎপত্তি
আল্লামা ইবনুল কাইয়িম রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘মানুষ যত গুনাহে লিপ্ত হয়, তার অনেকগুলোর মূলে থাকে কুদৃষ্টির প্রভাব। কারণ, চোখের দেখা থেকেই প্রথমে মানব-মনে ‘কুমন্ত্রণা’ সৃষ্টি হয়। এরপর সেই কুমন্ত্রণা থেকে সৃষ্টি হয় ‘কুচিন্তা’। কুচিন্তা থেকে আবার জন্ম নেয় ‘কুপ্রবৃত্তি’। এবার এই কুপ্রবৃত্তি মনের ভেতরে ‘আকাঙ্ক্ষা’ তৈরি করে। এরপর সেই আকাঙ্ক্ষা রূপ নেয় ‘দৃঢ় সংকল্পে’। অতঃপর যা ঘটার, তো সে ঘটিয়েই ফেলে, যদি-না তাকে কেউ বাধা দেওয়ার থাকে। এজন্য বলা হয়, নজরের হেফাজত যতটা কঠিন, তারচেয়ে অনেক বেশি কঠিন কুনজর-ঘটিত বিপদ থেকে বাঁচা বা তাতে ধৈর্যধারণ করা।’
অধিকাংশ গুনাহের কারণ অসংযত দৃষ্টি ও বাক অসংযম
সাধারণত অধিকাংশ গুনাহের সূত্রপাত ঘটে কথার আধিক্য এবং যত্রতত্র দৃষ্টিপাত থেকে। শয়তান এ-দুটি হাতিয়ার ব্যবহার করে মানুষকে সবচেয়ে বেশি পথভ্রষ্ট করে। কারণ, খাবার খেয়ে পেটের ক্ষুধা দূর করা যায়। কিন্তু অনিয়ন্ত্রিত জবান ও অসংযত চোখের ক্ষুধা করার কোনো উপায় এ জগতে নেই। তাই এ-দুটিকে সংযত না রাখা গেলে, দেখা ও বলার চাহিদা কখনোই শেষ হয় না। ঠিক যেমন লোকমুখে প্রচলিত আছে—চারটি চাহিদা কখনো শেষ হবার নয় : এক. দেখার প্রতি চোখের চাহিদা, দুই. তথ্য-উপাত্ত শোনার প্রতি কানের চাহিদা, তিন. বৃষ্টির প্রতি শুকনো ভূখণ্ডের চাহিদা, চার. পুরুষের প্রতি নারীর চাহিদা।
আজ পত্র-পত্রিকা, রাস্তা-ঘাট, হাট-বাজার, মোবাইলের স্ক্রিন ও টিভির মনিটরসহ সবখানে অশ্লীল দৃশ্যের ছড়াছড়ি। মানুষ এসবের নেশায় বুঁদ হয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে। অথচ কী ছিল তাদের রবের প্রতিশ্রুতি। আফসোস! হায় আফসোস!!
‘নজর’ হৃদয়ে নিক্ষিপ্ত এক বিষাক্ত তির
সত্যিকার অর্থেই কুনজর মানুষের মনে বিষাক্ত তিরের মতো বিদ্ধ হয় এবং হৃদয়ের সবটুকু জুড়ে এর বিষক্রিয়া ছড়িয়ে যায়। শয়তান মানুষকে বিপথে নেওয়ার জন্য যত রকম পাঁয়তারা করে, এ-নজ্বর তারমধ্যে অন্যতম। নজরকে যে অসংযত রাখে আল্লাহর কসম তার বালা-মুসিবতের কোনো শেষ থাকে না।
মনে রাখতে হবে, শয়তান একদিকে পরনারীকে পুরুষদের চোখে আকর্ষণীয় করে দেখাতে চেষ্টা করে; অপরদিকে আর নিজ স্ত্রীর প্রতি অনীহা সৃষ্টি করে— যদিও সে হোক-না অপরূপা সুন্দরী। তাই আসুন, পরনারীর প্রতি চোখ পড়ামাত্রই আমরা আমাদের দৃষ্টি ফিরিয়ে নিই এবং আল্লাহর কাছে বিতাড়িত শয়তান থেকে অবিরত আশ্রয় প্রার্থনা করি।
‘চোখ’ হৃদয়ের প্রধান কপাট
ইমাম কুরতুবি রাহিমাহুল্লাহ বলেন, “অন্তরের গভীরে প্রবেশ করার সবচেয়ে বড় দরোজা হলো চোখ। অনুভূতিকে প্রকম্পিত করে তোলার অন্যতম উপায়ও এটি। ফলে মানুষের অধিকাংশ পদস্খলন ঘটে এই চোখের কারণে। এজন্য এ বিষয়ে খুবই সতর্ক থাকা চাই। যাবতীয় হারাম বিষয়, এমনকি ফিতনা সামান্য আশঙ্কা রাখে—এমন সবকিছু থেকে নজরকে হেফাজত রাখা চাই। [৩]
অসংযত দৃষ্টি মানুষের মান-সম্মান ক্ষুণ্নকারী
একজন সম্মানী ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রে যত্রতত্র দৃষ্টিপাত— নিঃসন্দেহে তার সম্মানের জন্য হানিকর। জেনে অবাক হবেন, জাহিলি যুগের সেই বরবর মানুষদের মধ্যেও এই ধারণা প্রচলিত ছিল যে, উন্নত চরিত্রের কোনো পুরুষ কখনো পরনারীর দিকে তাকায় না। এ প্রসঙ্গে আল্লামা কাহতানি রাহিমাহুল্লাহ বলেন
‘পরনারীর প্রতি যাদের থাকে দৃষ্টি লোভাতুর, তারা তো মাংস নিয়ে কাড়াকাড়ি করা কুকুর। কিন্তু অত্যন্ত আফসোস ও পরিতাপের বিষয় এই যে, এ যুগের অধিকাংশ মুসলিম পরনারীদের থেকে নিজেদের দৃষ্টি সংযত রাখেন না, রাখার প্রয়োজনও মনে করেন না। অনেক যুবকের তো রাস্তা-ঘাটে নারী-দর্শনের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা অভ্যাসেই পরিণত হয়ে গিয়েছে। দুঃখ নিয়ে বলতে হয়, পরনারীর দিকে দৃষ্টিপাত গর্হিত কাজ জেনে জাহিলি যুগের মূর্খরা যে কাজটি করত, সভ্যতা ও ভদ্রতার দাবিদার এই আমাদের পক্ষে আজ সেটুকুও সম্ভব হয় না।
দৃষ্টিসংযম আবশ্যক হওয়ার দলিল
হারাম জিনিস থেকে নজর হেফাজত করা ওয়াজিব এ মর্মে কুরআন কারিম ও হাদিসে অসংখ্য দলিল-প্রমাণ বিদ্যমান রয়েছে। আল্লাহর কসম—দৃষ্টিসংযম সম্পর্কে কুরআন-সুন্নাহে যদি একটি দলিলও বর্ণিত না হতো, তবুও একজন মুসলিমের চারিত্রিক পবিত্রতা তাকে এমন অশুভ কাজ থেকে বাধা দেওয়ার কথা ছিল।
কুরআনে বর্ণিত কয়েকটি দলিল
প্রথমে আমরা কুরআন কারিমে উল্লিখিত এমন কিছু আয়াত পেশ করছি, যা থেকে দৃষ্টিসংযম আবশ্যক হওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট হয়।
প্রথম দলিল : আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন—
قل للمؤمنين يغضوا من أبصارهم ويحفظوا فروجهم ذلك أزكى لهم إن الله خبير بما
আপনি মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাজত করে। এতে তাদের জন্য রয়েছে অধিক পবিত্রতা। নিশ্চয় তারা যা করে আল্লাহ তা জানেন। [সুরা নুর আয়াত : ৩০]
এখানে আমরা লক্ষ করছি যে, আল্লাহ তাআলা আয়াতে কারিমায় কেবল মুমিনদের সম্বোধন করেছেন। কেননা, মুমিন ও মুত্তাকিরাই আল্লাহর ডাকে সাড়া দেয়, কারণ তাদের অন্তর থাকে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের ভালোবাসায় পরিপূর্ণ।
আল্লামা ইবনু কাসির রাহিমাহুল্লাহ উল্লিখিত আয়াতের তাফসির করতে গিয়ে বলেন, ‘এ আদেশ আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে তাঁর মুমিন বান্দাদের প্রতি—তাদের জন্য যা দেখা হারাম করা হয়েছে, তা থেকে তারা নজর হেফাজত করবে। তারা নিষিদ্ধ কোনোকিছুর দিকে তাকাবে না; হারাম সবকিছু থেকে নজরকে হেফাজত করবে; যদি অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে হারাম কিছু চোখে পড়েই যায়, তবে তৎক্ষণাৎ চোখ ফিরিয়ে আল্লামা সা’আদি রাহিমাহুল্লাহ উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘অর্থাৎ, আপনি মুমিনদের নির্দেশনা দিন, তাদের বলুনযারা ঈমানদার, তারা যেন ঈমানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিষয়াবলি থেকে বিরত থাকে। তারা যেন অন্যের সতর, বেগানা নারী এবং ফিতনার কারণ হতে পারে এমন সুশ্রী বালকদের থেকে নিজেদের দৃষ্টিকে সংযত রাখে। তা ছাড়া এমন চাকচিক্যময় জিনিস থেকেও নজরকে হেফাজতে রাখা চাই, যা দেখার কারণে গুনাহে নিপতিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’
‘তারা যেন অবৈধ উপায়ে কোনোরকম সম্ভোগে লিপ্ত না হয়—হোক তা যোনিপথে, পায়ুপথে কিংবা ভিন্ন কোনো উপায়ে। পাশাপাশি, তারা যেন পরনারীকে স্পর্শ করা কিংবা দেখা থেকে বিরত থাকে। চোখ ও যৌনাঙ্গের এই সংযম তাদের জন্য অধিক পবিত্রতা ও পরিশুদ্ধির কারণ হবে; তাদের আমলকে বৃদ্ধি করবে। কারণ, যে ব্যক্তি নিজের চক্ষু ও যৌনাঙ্গ সংযত রাখবে, সে এমনিতেই অশ্লীল কাজ থেকে বেঁচে থাকবে। একই সাথে নফস যে-সকল মন্দ কাজের প্রতি প্ররোচিত করে, তা থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে তার আমলও পরিশুদ্ধ হবে।’
‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় সামান্য ত্যাগও স্বীকার করবে, আল্লাহ তাকে তার ত্যাগের চেয়ে উত্তম বিনিময় দান করবেন। আর যে ব্যক্তি নজরের হেফাজত করবে, আল্লাহ তার অন্তর্দৃষ্টি খুলে দেবেন। কারণ, যে বান্দা প্রবৃত্তির কামনা-বাসনা উপেক্ষা করে হারাম সবকিছু থেকে নিজের চোখ ও যৌনাঙ্গ হেফাজতে রাখে, অন্যান্য খারাপ কাজ থেকে তো সে এমনিতেই দূরে থাকে।’
‘একারণে আল্লাহ তাআলা ‘হেফাজত’ বা ‘সংরক্ষণের’ কথা বলেছেন। কেননা, ‘মাহফুজ’ তথা সংরক্ষিত কিছু হেফাজতের পেছনে যদি হাফিজ তথা সংরক্ষণকারীর কোনো ভূমিকাই না থাকে; সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় উপায় অবলম্বনের ব্যাপার যদি নাই ঘটে, তবে তো আর সেটাকে হেফাজত বলা যায় না। নজর ও যৌনাঙ্গ হেফাজতের বিষয়টি ঠিক তেমনই। অপরদিকে বান্দা যদি এ-দুটি অঙ্গ হেফাজতের পেছনে সচেষ্ট না হয়, তবে এগুলো তার জন্য ভীষণ বিপদ ও মারাত্মক ফিতনার কারণ হয়ে যেতে পারে। [৫]
উলামায়ে কিরাম বলেন, ‘আয়াতে কারিমায় Ig’ শব্দটি ‘বিবৃতিমূলক ক্রিয়া’ হলেও এর আগে একটি ‘অনুজ্ঞামূলক ক্রিয়া’ উহ্য রয়েছে৷ আর এখানে অনুজ্ঞামূলক ক্রিয়াটি উল্লেখ না করে কেবল বিবৃতিমূলক ক্রিয়া উল্লেখ করার কারণ হলো—মুমিন তো এমনই হবে তাকে দৃষ্টিসংযমের আদেশ করামাত্রই সে তা পালন করবে।’
এ হিসেবে আয়াতের মূলরূপ দাঁড়াবে এমন—ngaliji Iran Irac… অর্থাৎ, ‘আপনি মুমিনদের বলুন, তোমরা দৃষ্টি সংযত রাখো, অতঃপর তারা দৃষ্টি সংযত রাখে…।’ সর্বোপরি মুমিনের শান তো এমনই হওয়া উচিত, যেমনটি কুরআন কারিমে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন—
وما كان لمؤمن ولا مؤمنة إذا قضى الله ورسوله أمرا أن يكون لهم الخيرة من أمرهم ومن يعص الله ورسوله فقد ضل ضلالا
আল্লাহ ও তাঁর রাসুল কোনো কাজের আদেশ করলে কোনো ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারীর সে বিষয়ে নিজস্ব কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ নেই। আর যে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আদেশ অমান্য করে সে প্রকাশ্য পথভ্রষ্টতায় পতিত হয়। [সুরা আহযাব, আয়াত : ৩৬]
এই আদেশ নারী-পুরুষ উভয়ের প্রতি
কেউ যেন এমনটি মনে না করে যে, দৃষ্টিসংযমের আদেশ কেবল পুরুষদের প্রতি। বিষয়টি মোটেও এমন নয়। কারণ, আল্লাহ তাআলা পুরুষদের আদেশ করার পরপরই নারীদের উদ্দেশে ইরশাদ করেন।
وقل للمؤمنات يغضضن من أبصارهن ويحفظن فروجهن..
আপনি ঈমানদার নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাজত করে। [সুরা নুর, আয়াত : ৩১]
‘এটি যেমন মুমিন নারীদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে আদেশ, তেমনি তাদের স্বামী তথা মুমিন বান্দাদের জন্য আত্মমর্যাদারও বিষয়। অপরদিকে এটিই তাদের ও জাহিলি যুগের মুশরিক নারীদের মধ্যে অন্যতম পার্থক্যরেখা। [৬]
আর এ-বিষয়টি অনস্বীকার্য যে, নারীর প্রতি পুরুষের যেমন দুর্বলতা রয়েছে, তেমনি পুরুষের প্রতিও রয়েছে নারীর দুর্বলতা। পুরুষ যেমন নারীর প্রতি আসক্তি অনুভব করে, তেমনি নারীর মনেও জাগে পুরুষের প্রতি কামনা-বাসনা। আর এই আসক্তি ও কামনা-বাসনা নিয়ন্ত্রণে না থাকলেই মূলত সমাজে বিশৃঙ্খলা ও বেহায়াপনা ছড়িয়ে পড়ে। এসব থেকে রক্ষা করতেই আল্লাহ তাআলা দৃষ্টিসংযমের আদেশ দিয়েছেন, যা এক্ষেত্রে ঢালস্বরূপ।
যৌনাঙ্গের আগে চক্ষু হেফাজতের আদেশ কেন?
কুরআন কারিমে গোপনাঙ্গ সংযত রাখার পূর্বে চোখ হেফাজতে রাখার আদেশ করা হয়েছে। এর কারণ হলো— চোখ বা নজর মূলত জিনা-ব্যভিচারের অগ্রদূত হিসেবে কাজ করে। যেহেতু জিনা-ব্যভিচার মারাত্মক অপরাধ। আবার সুযোগ পেলে তা থেকে বেঁচে থাকাও অধিক কঠিন, তাই এসবের উদ্দীপক কুদৃষ্টি থেকেই বেঁচে থাকতে আদেশ দেওয়া হয়েছে৷ কেননা, কুদৃষ্টিই মূলত পাপাচারে লিপ্ত হওয়ার প্রথম ধাপ। আর দৃষ্টিসংযম অন্তরস্থ রোগ প্রতিরোধে বেশ কার্যকরী।
দুটি সূক্ষ্ম বিষয়
প্রথমত, আল্লাহ তাআলা দৃষ্টিসংযম ও যৌনাঙ্গ হেফাজতের বিষয় দুটি পাশাপাশি উল্লেখ করেছেন। কারণ, প্রতিটি অশ্লীল কাজ সাধারণত কয়েকটি ধাপে সম্পন্ন হয়। যার প্রথম ধাপ হলো দৃষ্টির অসংযত ব্যবহার। একজন পুরুষ যখন পরনারীর দিকে বেপরোয়া দৃষ্টিপাত করে, তখন তার মনে সেই নারীর রূপসৌন্দর্য নানারকম জল্পনা-কল্পনা তৈরি করে। হৃদয়ের গভীরে এই জল্পনা-কল্পনা চলতে থাকে নিরবচ্ছিন্নভাবে। একপর্যায়ে সে আর নিজেকে সংবরণ করতে না পেরে লিপ্ত হয় পাপাচারে, অশ্লীল কাজে। একারণে আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের সতর্ক করে দিয়ে বলেন—
يا أيها الذين آمنوا لا تتبعوا خطوات الشيطان ومن يتبع الخطوات الشيطان فإنه يأمر بالفحشاء والمنكر.
হে ঈমানদারগণ, তোমরা শয়তানের পদাঙ্ক
অনুসরণ করো না। যে শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করবে, তখন তো শয়তান অশ্লীলতা ও মন্দ কাজের আদেশ করবেই। [সুরা নুর, আয়াত : ২১]
শয়তান সর্বদা মানুষের জন্য তার জীবনের প্রতিটি বাঁকে বাঁকে ওঁত পেতে আছে। এজন্য পদে পদে যে ব্যক্তি ফিতনার দিকে উঁকি দেয়, ফিতনা তাকে একদম তলানিতে নিয়ে যায়।
দ্বিতীয়ত, আল্লাহ তাআলা কেন বললেন, — Supril jis P দরী in Indian দেখুন, আল্লাহ তাআলা يعضوا [9] দৃষ্টিসংযমের বেলায় ‘এ’ তথা, ‘থেকে’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। অপরদিকে যখন NAFT+] বলে যৌনাঙ্গ হেফাজতের আদেশ দিয়েছেন, তখন আর ‘এ’ শব্দটি ব্যবহার করেননি। কিন্তু কেন?
এ প্রশ্নের জবাবে বলা হয়, মুসলিমদের ওপর
কুরআন থেকে দ্বিতীয় দলিল আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন—
يعلم خائنة الأعين وما تخفي الصدور
তিনি জানেন—চোখ যে খেয়ানত করে এবং অন্তর যা গোপন করে রাখে। [সুরা গফির, আয়াত :
আল্লাহ তাআলা এ আয়াতে কারিমায় জানিয়ে দিলেন যে, তিনি ছোট-বড়ো, দূরে-কাছে, ক্ষুদ্র-বৃহৎ, সূক্ষ্ম-ভারি, তুচ্ছ দামি—সবকিছু সম্পর্কে সম্যক অবগত। এ-বিষয়টি খেয়াল করে যেন বান্দা আল্লাহর অবগতির ব্যাপারে সতর্ক থাকে; তাঁর প্রতি লজ্জাবনত থাকে; তাঁকে যথাযথভাবে ভয় করে এবং মনে রাখে তিনি স্পষ্টভাবে তাকে দেখছেন। এ ছাড়াও তিনি চোখের খেয়ানত সম্পর্কে জানেন, যদিও কেউ আমানতদার সাজতে চায়। তিনি অন্তরে লুক্কায়িত বিষয়াবলি সম্পর্কেও জানেন, যদিও সে তা গোপন রাখতে চায়।
চোখের সকল খেয়ানত আল্লাহ তাআলা খুব ভালো করে জানেন। চোখের খেয়ানত কী, তা স্পষ্ট করেছেন হজরত আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু। (তিনি বলেন) ‘চোখের খেয়ানতের উদাহরণ হলো ওই ব্যক্তির দৃষ্টিপাতের মতো, যে লোকজনের উপস্থিতিতে কোনো বাড়িতে প্রবেশ করল। আর সেখানে সকলের সামনে দিয়ে অতিক্রম করল কোনো সুন্দরী নারী। এমতাবস্থায় লোকেরা তার থেকে অমনোযোগী হলেই সে নারীটির দিকে তাকায়, আবার মনোযোগী হলে দৃষ্টি নামিয়ে নেয়। অনুরূপভাবে, তারা বেখেয়াল থাকলেই সে ওই নারীর দিকে তাকায়, আবার খেয়াল করলেই না দেখার ভান করে।’
প্রিয় ভাই ও বোনেরা আমার! আপনি কি কখনো এভাবে ভেবে দেখেছেন? আপনি কি কখনো অনুধাবন করেছেন কোনো নারীর দিকে আপনার দৃষ্টিপাত আল্লাহ তাআলা এতটা ভালোভাবে দেখেন; এমনকি আপনি যা অন্তরে লুকিয়ে রাখেন তাও তিনি জানেন।
হজরত জুনাইদ বাগদাদি রাহিমাহুল্লাহকে দৃষ্টি সংযত রাখার উপায় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন,
আমরা যারা অবৈধ জিনিস দেখি, তারা কি একবারও চিন্তা করেছি, আমাদের দৃষ্টিপাতের আগেই তা আল্লাহ নজরে ধরা পড়ে যায়। কসম আল্লাহর, এভাবে ভেবে দেখলে লজ্জায় আমাদের মস্তক অবনত হয়ে আসবে। 💕 আরো পড়তে অথবা দেখতে অনুগ্রহ করে Hardcopy ক্রয় করুন।