তিতাস একটি নদীর নাম – রিভিউ | Titas Akti Nodir Naam

রিভিউ: তিতাস একটি নদীর নাম।

অদ্বৈত মল্লবর্মণ রচিত ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসটি নিম্নজীবী মানুষের এক অনুভবী বাস্তবতার নাম, যেখানে ফুটে উঠেছে বাস্তুচ্যুত শিল্পীর যন্ত্রণা

অদ্বৈত মল্লবর্মণ রচিত ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসটি নিম্নজীবী মানুষের এক অনুভবী বাস্তবতার নাম, যেখানে ফুটে উঠেছে বাস্তুচ্যুত শিল্পীর যন্ত্রণা
অদ্বৈত মল্লবর্মণ রচিত ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসটি নিম্নজীবী মানুষের এক অনুভবী বাস্তবতার নাম, যেখানে ফুটে উঠেছে বাস্তুচ্যুত শিল্পীর যন্ত্রণা
অদ্বৈত মল্লবর্মণ বাংলা উপন্যাসের একজন অকৃত্রিম শিল্পী। স্বীয় জীবনের অভিজ্ঞতাই তাঁর শিল্পের সারাৎসার। গোকর্ণঘাটের তিতাস তীরবর্তী অঞ্চল যেখানে তিনি জন্মেছিলেন সেই মালোপাড়াই তাঁর উপন্যাসের পটভূমি। তাই উপন্যাসটিতে ঘিরে রয়েছে শিল্পীর নিজস্ব জগতের এক গভীর অভিব্যক্তি। শুধু ঘটনা লিপিবদ্ধ করার জন্য নয় মালোজীবনের গভীর ও গোপনতম ব্যথা ও বেদনার সুর এ- উপন্যাসকে বাংলাসাহিত্যে বিশিষ্ট করে তুলেছে। পটভূমির সত্যতা ব্যতিরেকেও মালোসমাজের অভ্যন্তরীণ মানুষের আবিষ্কার, পরিবেশগত ঘনিষ্ঠতা, সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবনের নানামাত্রিক রূপায়ণ এ-উপন্যাসে ঘটেছে। মানুষের জীবন ও জীবিকার সীমাহীন সংগ্রাম, দুষ্ট-খল সমাজজীবনের ঘূর্ণিপাকে মানবিকতার বিরাট পরাজয়ও সেখানে বৃহত্তর ব্যাপ্তি লাভ করেছে। অদ্বৈত মল্লবর্মণ দেখিয়েছেন- মানুষের জীবনের বিপুল সম্ভাবনা থাকলেও অমোঘ প্রকৃতি ও প্রবহমান কালের সত্য তার ট্র্যাজিক জীবনের মূল। এই ট্র্যাজেডি আবার ব্যক্তিমানুষের একার নয়; সমগ্র সমাজব্যাপী এক নিরুচ্চার সত্যের প্রতিনিধিত্ব করে সে ক্রমশঃ ব্যক্তিমানুষেরই বেদনায় অভিষিক্ত। অবশ্য ব্যক্তিজীবনের বোধ এ-উপন্যাসে থাকলেও তা ব্যক্তিসর্বস্ব হয়ে ওঠে না। মধ্যবিত্তিক জীবন কাঠামোর বাইরে তা এক নিরেট বাস্তবতার প্রতিচ্ছায়া। নিম্নজীবী মানুষের কণ্ঠস্বরকে বাহ্যিক অর্থে নয় বরং অভিজ্ঞতার আলোকে শিল্প রচনার এক অনুভবী বাস্তবতার নাম ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাস।

এক নজরে ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ পর্যালোচনা
অল্প কথায় অদ্বৈত মল্লবর্মণ পরিচিতি
পর্যালোচনায় ‘তিতাস একটি নদীর নাম’
তিতাসের বুকে ইতিহাস নাই, সে শুধু একটা নদী
হাসির নামে কত বিষাদ
তিতাস একটি নদীর নাম এবং মানবিক উত্থান-পতনের এক সার্বজনীন ইতিবৃত্ত
তিতাস নদীর তীরের কৃষিজীবী
ভূমিহীন চাষীর কাছে প্রেম-ভালোবাসা
অন্তর্জীবনের যন্ত্রণা
তিতাস নদীর পাড়ের মালোসম্প্রদায়
জেলেরাই পায় না বড়ো মাছের স্বাদ
ধান থাকলেও চাষীদের জোটেনা গামছা
‘রাতের ঝড়ে পাখির যে ডানা ভাঙ্গিল, সে ডানা আর জোড়া লাগিল না।’
অনন্তর মা বাসন্তীর ঘরভুক্ত
মালোজীবনের শত দারিদ্র্য আর যন্ত্রণা
ঘরের মালিক হলেও জমির মালিক নয়
ধুতির দামে বিক্রি হয় মালো সমাজের মানুষ
আত্মমর্যাদাবোধে প্রতিবাদী মালোসমাজ
আত্মবিক্রয় এবং মালোসমাজ ধ্বংসের একজন অনুঘটক
কায়েতের সঙ্গে মিশিতেছ বলিয়া তারা তোমাকে কায়েত বানাইবে না।
মাছের মতো জন্ম, আবার মাছের মতোই মৃত্যু
পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা
বিশ্বাস সংস্কার
সরলমনা সুবল, মালিকশ্রেণি এবং বাসন্তী
বাসন্তী আর অনন্তর মা
কিশোর ও অনন্তর মায়ের মৃত্যু
অনাথ অনন্ত
অনাথ অনন্ত এবং বাসন্তী
অনন্ত বুঝল মা ছাড়া কেউ আপন নয়
তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসের নারী চরিত্রগুলো বেদনাময় জীবনের শিকার
বাসন্তীর অনুধাবন: মা একমাত্র সত্য
প্রতিবাদী নারী বাসন্তী
ষড়যন্ত্র ও সর্বনাস
মালোদের সাংস্কৃতিক শুদ্ধতার রক্ষা
তিতাসের পাড়ের মালো সংস্কৃতির পরাজয় ও মোহনের কান্না
তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিচ্যুতি এবং আরও কিছু কথা
মালোরা জলের মালিক, মাটির মালিক নয়
সর্বশান্ত তিতাস নদীর পাড়ের মানুষ
‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসের নায়ক এবং অন্যান্য প্রসঙ্গ
শেষ কথা
অল্প কথায় অদ্বৈত মল্লবর্মণ পরিচিতি
অদ্বৈত মল্লবর্মণ ১ জানুয়ারি, ১৮৯১ সালে তৎকালীন ত্রিপুরা রাজ্যের অন্তর্গত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উপকণ্ঠে তিতাস তীরের মালোপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা অধরচন্দ্র মল্লবর্মণ, মায়ের নাম অনাবিষ্কৃত।

তিন ভাই এক বোনের পরিবার তাদের। অল্প বয়সেই তাঁর সব ভ্রাতা মৃত্যুবরণ করে। একমাত্র বোন বিধবা হন অল্প বয়সে। অদ্বৈতর বাবা-মাও মারা যান তাঁর অপরিণত বয়সেই। এরপর সারাজীবন ধরে শুধু দুঃখ আর সংগ্রামের সঙ্গে তাঁর গাঁটছড়ার বাধন।

অন্যের অর্থানুকূল্যে হাইস্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে ভর্তি হলোেও প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া অসম্পূর্ণ রেখেই তিনি কলকাতা পৌঁছালেন জীবিকারোহনের আশায়।

‘ত্রিপুরা’, ‘নবশক্তি’, ‘মোহাম্মদী’, ‘আজাদ’ প্রভৃতি নানা পত্র-পত্রিকায় কাজ করে শেষ পর্যন্ত সাগরময় ঘোষের সহায়তায় ১৯৪৫ সালে তিনি ‘দেশ’ পত্রিকায় যোগ দেন।

অদ্বৈত মল্লবর্মণের কলকাতার জীবন নিরবচ্ছিন্ন শান্তির ছিল না। ফেলে আসা শিকড়ের প্রতি তাঁর ছিল অসম্ভব টান। কলকাতার মেসবাড়িতে থাকার সময় আত্মীয়কৃত্য আর বই কেনার কাজে তার জীবনের সমুদয় অর্থ তিনি ব্যয় করেছেন।

১৯৫০ সালের দিকে অদ্বৈত ক্ষয় রোগে আক্রান্ত হন। প্রথমবার চিকিৎসা নিলেও সাগরময় ঘোষের চেষ্টায় দ্বিতীয়বারের মত কাঁচড়াপাড়া যক্ষা হাসপাতালে তাঁকে ভর্তি করা হলোেও সেখান থেকে তিনি পালিয়ে আসেন। অবশেষে ১৯৫১ সালের ১৬ই এপ্রিল কলকাতার ষষ্ঠীতলার বাসায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

তিতাস নদীর মতই এ-শিল্পী অভিমানী। তিতাসের গোপন গভীর ষড়যন্ত্রের কথা হয়ত তিনি কান পেতে শুনতে পেয়েছিলেন। তাই জীবনের ছন্দে প্রবহমান অথচ কালগর্ভে বিলীনপ্রায় তিতাসের পরাজয় মাল্য বরণের মত এক অপচয়ের বোধ তাঁর ব্যক্তিজীবনেও যেন তিনি বহনের দায়ভার গ্রহণ করেছিলেন।

পর্যালোচনায় ‘তিতাস একটি নদীর নাম’
তিতাসের বুকে ইতিহাস নাই, সে শুধু একটা নদী
তিতাস নদীর বর্ণনা লেখকের তুলিতে শান্ত মধুরতা দিয়ে শুরু হয় কিন্তু কালের পরিণামী গ্রাস এখানকার মানুষকে করে পর্যুদস্ত। গোকর্ণঘাট গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া শান্ত স্নিগ্ধ ও অথৈ জলে দুকূল উপচে পড়া এক নদী তিতাস। তিতাস ছোটো নদী; অদ্বৈত মল্লবর্মণের জন্যই আজ তা পরিচিত। কোনো ইতিহাস কিংবা রাষ্ট্রবিপ্লবের খাতায় তিতাসের নাম খুঁজে পাওয়া যাবে না। রচয়িতার ভাষায়, “তিতাসের বুকে তেমন কোন ইতিহাস নাই। সে শুধু একটা নদী’। এ-নদীর পাড়ে বসবাসরত অবহেলিত অবজ্ঞাত শিক্ষা ও আধুনিক জীবনের সুবিধা-বঞ্চিত গ্রামীণ মানুষের জীবনযাপন। তিতাসকে কেন্দ্র করেই তাদের কষ্ট-বেদনা-হাসি-কান্না-ভালোবাসা উত্থিত হয় আবার মিলিয়ে যায়। এটাই এ-নদীর বিশেষত্ব। পদ্মা মেঘনার বিশালতা প্রচণ্ডতা এ-নদীর নেই। লেখকের বর্ণনায় :

“তিতাস কত শান্ত। তিতাসের বুকে ঝড়-তুফানের রাতেও স্বামী-পুত্রদের পাঠাইয়া ভয় করে না। বউরা মনে করে স্বামীরা তাদের বাহুর বাঁধনেই আছে, মায়েরা ভাবে ছেলেরা ঠিক মায়ের বুকেই মাথা এলাইয়া দিয়া শান্ত মনে জাল গুটাইতেছে।”

 

তিতাস নদী বৃহত্তর কোনো ইতিহাসের অংশীভূত না হলোেও নিজস্ব বিকাশের পথ তার রুদ্ধ নয়। পৃথিবীর লিখিত ইতিহাসের অংশ না হলোেও জীবনধর্মের সত্য উচ্চারণে, নিম্নজীবী মানুষের আবেগের ভাষা ধারণে এবং অবহেলিত জেলে সমাজের কথকতায় তা পরিপূর্ণ। ফলে তিতাস তথাকথিত মূলধারার ঐতিহাসিক উপকরণ-সমৃদ্ধ না হলোেও লেখকের বর্ণনায় ধ্বংসপ্রাপ্ত গ্রামীণ মানুষের বাস্তবতার তা চরম সাক্ষী। তাই :

“পুঁথির পাতা পড়িয়া গর্বে ফুলিবার উপাদান এর ইতিহাসে নাই সত্য, কিন্তু মায়ের স্নেহ, ভাইয়ের প্রেম, বৌ-ঝিয়ের দরদের ইতিহাস এর তীরে তীরে আঁকা রহিয়াছে। সে ইতিহাস কেউ জানে, কেউ হয়ত জানে না। তবু সে ইতিহাস সত্য। এর পাড়ে খাঁটি রক্তমাংসের মানুষের মানবিকতা আর অমানুষিকতার অনেক চিত্র আঁকা হইয়াছে।”

হাসির নামে কত বিষাদ
এ-উপন্যাসের ৪টি পর্ব ও ৮টি উপপর্বের প্রথম অংশের নাম ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। উপন্যাসের নামেই এ- অধ্যায়ের শিরোনাম লিখিত। এ-অংশে অবজ্ঞাত নদী তিতাসের বর্ণনার মোহনীয় ভাষাভঙ্গি গভীর দার্শনিক এক উপলব্ধি সঞ্চার করে পাঠক মনে। সে-সঙ্গে তিতাসকে কেন্দ্র করে মানুষের বাঁচা-মরার প্রসঙ্গ এবং জীবন-জীবিকার সীমাহীন জটিলতার আখ্যান হয়ে ওঠে তা। ’ওল্ডম্যান অ্যান্ড দ্য সী’র মত বিশালতর সংগ্রামের কথা এখানেও আছে তবে তা ব্যক্তি মানুষের সংগ্রাম নয়। নদীর নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহের মতই এক কালিক প্রবহমানতা এখানে বিশালায়তনিক গোষ্ঠীজীবনের সামূহিক বাস্তবতার অংশ বলে পরিগণিত। মানুষের জন্ম এখানে অবহেলায়, বেড়ে ওঠা কষ্ট ও যাতনায়। জন্মে কোনো পাপ না থাকলেও জেলেপাড়ার শিশুরা বৈষম্যমূলক পৃথিবীর দেনার জালে ঋণগ্রস্ত। আগাছার মত মানব জন্ম এখানে। তাই আগাছার মতই প্রকৃতি সেগুলোকে ছাটাই-বাছাই করে। মানুষের শত মরণ ও কান্নার রোল তিতাসের চাপা বাতাস আর জলের সঙ্গে একাকার হয়। লেখক নিগৃহীত তিতাসপাড়ের মানুষের জন্মের ইতিবৃত্ত তুলে ধরেন :

“সে দেখিয়াছে কত শিশুর জন্ম, দেখিয়াছে আর ভাবিয়াছে। ভাবী নিগ্রহের নিগড়ে নিবদ্ধ এই অজ্ঞ শিশুগুলি জানে না, হাসির নামে কত বিষাদ, সুখের নামে কত ব্যথা, মধুর নামে কত বিষ তাদের জন্য অপেক্ষা করিয়া আছে।”

তিতাস একটি নদীর নাম এবং মানবিক উত্থান-পতনের এক সার্বজনীন ইতিবৃত্ত
তিতাস নদীর তীরের কৃষিজীবী
তিতাসের তীরে জেলে ছাড়াও আছে কৃষিজীবী মানুষের বাস। লেখক তাদেরও জীবন-জীবিকার জটিলতাকে ধারণ করেছেন সব্যসাচী শিল্পীর তুলিতে। উপন্যাসের প্রথম পর্বেই গৃহস্ত জোবেদ আলীর বাড়িতে কাজ করতে আসা দু জন মুনীশের পারিবারিক কষ্টের বিবরণের মধ্যে সে-বিষয়টি স্পষ্ট হয়। সীমাহীন না পাবার যন্ত্রণায়ও তাদের বিবেক জাগ্রত থাকে সবার ওপরে। এজন্যই খাওয়ার পর গামছায় মুখ মুছতে মুছতে বন্দেআলী তার পরিবারে অভুক্ত থাকা স্ত্রীর কথা ভাবে। ‘ভাই করমালী নিজে ত খাইলাম ঝাগুর মাছের ঝোল। আমার ঘরের মানুষের একমুঠ শাক-ভাত আজ জুটল নি, কি জানি?’

ভূমিহীন চাষীর কাছে প্রেম-ভালোবাসা

নিম্নশ্রেণীর মানুষের আরেকটি সংকট উপস্থিত হয় আর তা হলো বন্দেআলীর দৃষ্টিতে করমালীর প্রেমিক মন নিষ্ঠাহীন। কারণ তার কাছে এসব পারিবারিক প্রেম-ভালোবাসার কোন স্থান নেই। বস্তুত ভূমিহীন চাষীর কাছে এসবের কোনো দাম নেই। জীবনে ভাল থাকা যাকে বলে তারা তার অংশীদার নয়। এজন্যই লেখক বলেন :

“জীবনে যদি বসন্ত আসে তবেই এসবের দাম চোখে ধরা পড়ে। তাদের জীবনে বসন্ত আসে কই।”

অন্তর্জীবনের যন্ত্রণা
দেখা যায় নারীর অন্তর্জীবনের যন্ত্রণাও তিতাসের পাড়ে আঁছড়ে পড়ে। বস্ত্রাচ্ছিত নৌকায় চড়ে ‘যে বউ স্বামীর বাড়ি যায়, তার এক চোখে প্রজাপতি নাচে, আরেক চোখে থাকে জল’। শত বেদনার ইতিহাসে অঙ্কিত তাই তিতাসের বুক।

অভিধানের পাতায় তাই তিতাস নদীর নাম না থাকলেও এর অন্তর্গত সুখ-দুঃখের ইতিহাস, ‘সত্যের মত গোপন হইয়াও বাতাসের মত স্পর্শপ্রবণ’। ফলে তিতাস নদী নিজেই রচনা করে চলে এক অনন্য ইতিহাস। সে ইতিহাস বাংলাদেশের নদী বিধৌত শত শত জনপদের নিম্নজীবী মানুষের বাঁচা-মরার ইতিহাস। তাই আঞ্চলিক কাহিনী-কাঠামোতেও সে ধারণ করে মানবিক উত্থান-পতনের এক সার্বজনীন ইতিবৃত্ত।

তিতাস নদীর পাড়ের মালোসম্প্রদায়
‘ধনুকের মত বাঁকা’ তিতাসের তীর ঘেঁষে দক্ষিণপাড়ায় ছোটো ছোটো ঘর বেঁধে বাস করে মালোসম্প্রদায়। লেখকের বর্ণনায় :

“ঘাটে বাঁধা নৌকা, মাটিতে ছড়ানো জাল, উঠানের কোণে গাবের মটকি, ঘরে ঘরে চরকি, টেকো, তক্লি- সুতা কাটার, জাল বোনার সরঞ্জাম। এই সব নিয়াই মালোদের সংসার।”

নদীভিত্তিক সমাজের পরিবেশগত বাস্তব পরিচয়ে চিহ্নিত এই মালোপাড়া। তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসের দ্বিতীয়পর্ব ‘প্রবাসখণ্ড’ এভাবেই মালোদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার দৃশ্যপট উন্মোচন করে। সঙ্গে সঙ্গে মালোজীবনের গভীর সত্য ও বৃহত্তর সংগ্রামী জীবনের ইঙ্গিত এ-পর্বকে বিশিষ্ট করে তোলে। কিশোর, বাসন্তী ও সুবলকে ঘিরে কারুণ্যময় যে জীবন তা এখানে আভাসে প্রকাশিত।

বাসন্তীর জন্য সুবল-কিশোর দু জন মিলে ‘চৌয়ারি’ বানালেও সুবলকে তার অধিকার ছেড়ে দেয়া কিশোরের পরিণামী বাস্তবতার সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ। পরবর্তী কালে বাসন্তীর মনে কিশোরের জন্য সে অনুভবি সত্তার আবিষ্কার পাগল কিশোরের প্রতি ভাবনায় ও অনন্তের মার প্রতি বাসন্তীর তীব্র মমত্ববোধে ভিন্নতর এক বাস্তবতা সৃষ্টি করেছে। তবুও এ-উপন্যাসে প্রেম কোনো মুখ্য ব্যাপার নয়। জীবন-সংগ্রামে নিয়ত যোদ্ধা মালোদের গভীরতম এক সত্যের কথাই এ-উপন্যাস উচ্চকিত। জেলেজীবনের কর্মকঠোর মলিন এক বাস্তবতা অন্যদিকে উৎসব মুখরতায় শান্ত-নিরপদ্রুপ জেলেজীবনে কিঞ্চিৎ আনন্দপ্রাপ্তির কথা তাই ‘প্রবাসখণ্ড’ পর্বে অঙ্কিত হয়েছে।

সুবল কিশোরদের লেখাপড়ার পাট চুকে যায় বাল্য বয়সেই। অন্যের নৌকায় জীবিকারোহনের জন্য প্রবাসযাত্রা তাদের এ-পর্বেই। মালোজীবনের নিয়ত সংগ্রামের শুরুও এখান থেকে। নৌকা চালনার পথে ভৈরবে গিয়ে সন্ধ্যা হলো রাত্রির আশ্রয়প্রার্থী তাদের চোখে ধরা পড়ে মালোজীবনের আরেক বাস্তব। তারা আবিষ্কার করে যান্ত্রিক পৃথিবী ও নাগরিক জীবনের সুবিধাপ্রাপ্ত ভৈরবের মালোরা তাদের চেয়ে অগ্রগামী। তাদের না পাবার কথা নিচের বাক্যগুচ্ছে স্পষ্ট হয় :

“এ গায়ের মালোরা গরীব নয়। বড় নদীতে মাছ ধরে। রেলবাবুদের পাশে থাকে। গাড়িতে করিয়া মাছ চালান দেয়। তারা আছে মন্দ না।”

ভৈরবের মালোসমাজে দর্শনীয় এ-অবস্থার পেছনেও যে একটি অশুভ শক্তির অপতৎপরতা আছে তা বুঝতে বাকি থাকে না। নাগরিক সভ্যতা কর্তৃক গ্রাম বিনাশের যন্ত্রণা এবং গ্রামীণ সংস্কৃতি নষ্ট হবার কষ্ট সুবল, কিশোর আর তাদের নৌকার সঙ্গী বৃদ্ধ তিলকও বুঝতে পারে। মালোদের অনেক জায়গা রেল কোম্পানি নিয়ে নিয়েছে। ফলে ‘বৃহত্তর প্রয়োজনের পায়ে ক্ষুদ্র আয়োজনের প্রয়োজন অগ্রাহ্য হইয়া গিয়াছে।’ তারা এ-সত্য বুঝতে পারে বলে সুবলের ভাবনায় উঠে আসে নাগরিক ডেভেলপমেন্টের এক অন্তর্বাস্তব। সুবল তাই বলে :

“কিশোর দাদা ভৈরবের মালোরা কি কাণ্ড করে জান নি? তারা জামা জুতা ভাড়া কইরা রেল কোম্পানির বাবুরার বাসার কাছ দিয়া বেড়ায়, আর বাবুরাও মালোপাড়ায় বইয়া তামুক টানে আর কয়, পোলাপান ইস্কুলে দেও- শিক্ষিৎ হও শিক্ষিৎ হও।”

এই শিক্ষিত হয়ে ওঠার পেছনে জীবনের অপ্রাপ্তি আর অনাদায়ী এক চরম বাস্তবতা সঙ্গে সঙ্গে আঘাত হানে বৃদ্ধ তিলকের বুকে। কারণ সে জানে বৈষম্য ঘুচানোর অর্থ শুধু শিক্ষিত হওয়া নয়। মনুষ্যত্ববোধের অঙ্কুর ঘটাতে হয় মানুষের সজীব হৃদয়েই। তাই সে ক্ষেপে উঠে বলে- ‘হ শিক্ষিৎ হইলে শাদি সম্বন্ধ করব কি না। আরে সুবলা তুই বুঝবি কি! তারা মুখে মিঠা দেখায় আর চোখ রাখে মাইয়া-লোকের উপর।’ কিশোরের আরেকটি রসিকতা সমাজকৃত বৈষম্যের মূলে আঘাত করে। সে হেসে বলে, ‘না তিলকচাঁদ না। চোখ রাখে বড় মাছের উপর।’

জেলেরাই পায় না বড়ো মাছের স্বাদ
প্রবাসযাত্রা শেষে উজানিনগরের খলায় বাঁশিরাম মোড়লের বাড়িতে উপস্থিত হয় সুবল-কিশোর। এখানে যা রান্না হয়েছে সব বড়ো মাছের। মোড়ল ও মোড়ল গিন্নীর যত্ন সত্ত্বেও কিশোরদের মনের গোপন অথচ নির্মম সত্যের এক অনুভবী ভাষা লেখক দান করেন। তারা জেলে হলেও বড়ো মাছের স্বাদ জীবনে খুব একটা পায় না। বড়ো মাছ তাদের জালে ধরা পড়লেও পয়সার জন্য বেঁচে দিতে হয়। অথচ জলই তাদের জীবন-মরণ, জীবনের অন্যতম রোমান্সও এই নদীর রহস্যে উৎপাদিত।

ধান থাকলেও চাষীদের জোটেনা গামছা
মালোজীবনের রূপ ও তার জটিলতাকে লেখক সরল ভাষিক বন্ধনে আবদ্ধ করেছেন। জেলেদের পাশাপাশি যে চাষীরা এখানে বাস করে তারাও জীবন-জীবিকার জটিলতায় আক্রান্ত। লোন কোম্পানির টাকা নিয়ে তারা কখনোই শোধ করতে পারে না। ঘরে ধান থাকলেও তাদের কোমরে একখানা গামছা জোটে না। ঋণের টাকা পরিশোধ করতে গিয়ে অনেক চাষীই জমি পর্যন্ত বিক্রি করে সর্বস্বান্ত হয়। জোঁয়ার-ভাটার কারসাজিতে জলের ওপর তাদের ভরসা কম। ফলে মাটিই তাদের কাছে খাঁটি। আর এজন্য বাহারুল্লাকে রামপ্রসাদ শোনায়- ‘মাটির সাথে সম্বন্ধ ছাড়া মানুষের জীবনের কোন বিশ্বাস নাই, বাহারুল্লা ভাই।’ মালোপাড়ার কৃষকশ্রেণির মাটির অবলম্বনটুকু থাকলেও জেলেজীবনে তা-ও নেই। তারপরও জেলেজীবনের সঙ্গে চাষীদের আর্থ-সামাজিক দৈন্য, তাদের মধ্যে সমধর্মিতা ও সহমর্মিতার জায়গাটি লেখক আবিষ্কার করেন।

‘রাতের ঝড়ে পাখির যে ডানা ভাঙ্গিল, সে ডানা আর জোড়া লাগিল না।’
সুবল ও কিশোর এ দুই চরিত্রে কিছুটা বৈপরীত্যের চিহ্ন আছে। কিশোর স্বভাবগতভাবেই সূক্ষ্ম শিল্পবোধসম্পন্ন অন্যদিকে সুবলের ভেতরে যৌবনের উত্তাপ কিছুটা পরিমার্জনাহীন। উজানিনগরের প্রবাসে প্রেমের দেবতা তাই কিশোরের জন্যই ফাঁদ পাতে। পঞ্চদশী এক মেয়ের সঙ্গে কিশোরের ভাব তৈরি হয়। মোড়ল গিন্নির হাত থেকে ফুলের মালা নিয়ে তাদের মালাবদল করা হয়। অন্যদিকে বাসন্তীর দায়িত্ব সুবলের হাতে ছেড়ে দেয় কিশোর। কিন্তু নতুন স্ত্রীকে আবিষ্কার করতে না করতেই কিশোরের জীবনে নেমে আসে ভয়াবহ যন্ত্রণার অগ্নিবাণ। রাতের অন্ধকারে ডাকাত দল নিয়ে যায় তাদের মুনাফার দুইশত টাকা। স্ত্রীকে হারায় কিশোর। সুবল ও তিলকের আপ্রাণ চেষ্টায় নৌকার গতি সামলে নেয়া গেল কিন্তু কিশোর হলো পাগল। লেখকের ভাষায়- ‘রাতের ঝড়ে পাখির যে ডানা ভাঙ্গিল, সে ডানা আর জোড়া লাগিল না।’ লেখকের এ-কথা ইঙ্গিতময়; কিশোর ও অনন্তর মায়ের পরিণামী বাস্তবতার নির্দেশক।

নিত্যানন্দ আর গৌরাঙ্গের আশ্রয়ে থাকার চার বছর পর ‘নয়াবসত’ পর্বে অনন্তের মা কিশোরের খোঁজে বের হয়। এতদিন পর কিশোরকর্তৃক তাকে না চেনার ভীতি তখন তার বুকে।

“মনে পড়ে নৌকাতে যখন মাচানের তলায় ছিলাম বন্দী, তার বন্ধু আসিয়া খাওয়াইত, কিন্তু সে থাকিত দূরে দূরে। বন্ধুকে সে বলিয়াছিল, আমি দেখিতে কেমন সে তা ভুলিয়াই গিয়াছে। আমার নয় চাহিতে বাধা, তার চাহিতে বাধাটা ছিল কোথায়। এত ভাল যার মন, সেকি এখনো দেখিলে চিনিতে পারিবে?”

আসলে সমাজ-সংস্কারের ভয় ছিল অনন্তের মার মনে। আবার ডাকাত দল যাকে অপহরণ করেছিল তাকে সে বিশ্বাস করবে কীনা এ-নিয়েও সংশয় ছিল। ঘাটে নৌকা ঠেকবার কিছুক্ষণের মধ্যে তার চোখে ভাসল করুণ এক দৃশ্য। এক পাগলকে দুই বুড়োবুড়ি টানাটানি করে ঘাটের দিকে নিয়ে আসছিল। জলে নামবে না বলে বৃদ্ধ লোকটি প্রথমে তাকে শাস্তি দিল আর উচ্চস্বরে কান্না করে গলাগলি ধরে পানিতে নামল। কিন্তু বুড়ির চোখে কোন অশ্র” ছিল না। মায়ের চরমতম মানসিক যাতনার ভাষাকে লেখক নিরবতা দিয়ে ঢেকেছেন- ‘সব কান্না তা শুকাইয়া গিয়া বুঝিবা জমাট বাধিয়াছে।’ হতভাগ্য সন্তানের কষ্ট দেখে অনন্তের মা আতঙ্কিত; তাই অনন্তকে বুকে চেপে ধরে সান্তনা খোঁজে। কিন্তু অনন্ত কি শেষ পর্যন্ত পারবে মায়ের আঁচলের তলার নিবিড় শান্তিটুকু অনুভব করতে? ভাগ্য তাকে শেষ পর্যন্ত যেখানে গিয়ে ঠেকাবে তা এক বিপর্যস্ত মানুষের চরম বেদনায় সমাহিত।

অনন্তর মা বাসন্তীর ঘরভুক্ত
কালোর মা কম দামে একখানি ভিটে ছেড়ে দেয়। সেখানে ওঠে অনন্তর মার ঘর। বর্ষিয়সী রঙিনী মহিলারা অনন্তের মার সঙ্গে দেখা করতে আসে কিন্তু তারা তার মন পায় না। কারণ ঠাট্টা-তামাশা করা সে ভুলে গিয়েছে। তারা মনে করে, ‘এ নারী অনেক দূরের। এইত একমুঠা মেয়ে তাকেও দলে পাইবে না। এত দেমাক।’ কালোর মা তাকে আশ্রয় দিলেও দুঃখের ভাগী হয় না। কিন্তু অনন্তের মার মনের ভাষা বুঝল যে নারী সে আর কেউ নয়- সুবলার বউ বাসন্তী। অল্প বয়সে বিধবা এই নারীর সঙ্গে তিতাসের ঘাটে তার সাক্ষাৎ হয়। তার সমবেদনার নিঃশ্বাস অনন্তের মাকে মুগ্ধ করে। লেখকের ভাষায়- ‘হরিণী যেমন নিজের কস্তুরীর গন্ধ অনুভব করে, সুবলার বউয়ের আবির্ভাবও অনন্তের মা তেমনি করিয়া গ্রহণ করিল।’ ভারতের বাড়িতে সভা বসলে বাসন্তী তাকে নিজের ঘরের মানুষ করে নেয়। কোনো কোনো আদিবাসী সমাজের মত মালোপাড়ায় নতুন কোন ব্যক্তি এলে তাকেও কারো না কারো পরিবার তথা সমাজে দলভুক্ত হয়ে থাকতে হয়। অনন্তর মাও তাই বাসন্তীর ঘরভুক্ত হয়ে বাস করতে থাকে।

মালোজীবনের শত দারিদ্র্য আর যন্ত্রণা
বহুভঙ্গিম সমাজের বাস্তবতা থেকে মালোসমাজ দূরে নয়। তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসে দেখায় যায় প্রতিষ্ঠাহীন মালোজীবনের শত দারিদ্র্য আর যন্ত্রণা তাদেরকে সভ্যতার অন্তরালবর্তী মানুষ করে রাখে। শিক্ষিত মানুষদের প্রতি তাই তাদের কোন আস্থা নেই। কিশোর যখন উজানিনগরে তখন তার হবু আত্মীয়কুটুমদের একজন বলেছিল- ‘আপনার দেশ নাকি সুদেশ। দেখতে ইচ্ছা করে। কায়স্থ আছে, ব্রাহ্মণ আছে, শিক্ষিত লোক আছে। বড় ভালো দেশে থাকেন আপ্নেরা।’ তখন কিশোরের অস্ফূট অভিব্যক্তিকে লেখক নিজে প্রকাশ করেন- ‘শিক্ষিৎ লোকের দেশে থাকার যে কি কষ্ট, আর এদের মত দেশে থাকার যে কি সুখ, এ কথাগুলি যুক্তিপ্রমাণ দিয়া বুঝাইয়া দিবার কিশোরের সময় নাই।’ শিক্ষিত মানুষের প্রতি বিশ্বাসহীনতার বিষয়টি কৃষক কাদির মিয়ার ভেতরেও লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। শিক্ষিত করে তুলবার জন্য কৃষক ছাদির মিয়া তার পুত্র রমুকে মক্তবে পড়াতে চাইলেও দাদা কাদির মিয়া বাধ সাধে।

“…কাদির বলিল, ‘দে, তোর পুতেরে মক্তবে দে, কিন্তু কইয়া রাখলাম, যদি মিছা কথা শিখে, যদি জালজুয়া চুরি শিখে, যদি পরেরে ঠকাইতে শিখে, তবে তারে আমি কিছু কমু না, শুধু তোমার মাথাটা আমি ফাটাইয়া দিমু ছাদির মিয়া।”

সমাজের শিক্ষিত মানুষগুলোর প্রতি কৃষক কাদিরের এ-অনুভব ঈর্ষা নয়। সে তার ক্ষুদ্রগণ্ডি থেকেও নিজের যন্ত্রণা আর জীবনাভিজ্ঞতার প্রবল অনুভবের আলোকে সভ্য মানুষের এক ন্যাক্কারজনক অস্তিত্ব টের পেয়েছে। তাদের সম্পর্কে যে পরিচয় সে পেয়েছে তাকেই ধর্তব্য বলে ভেবে একটি সাধারণীকরণ করেছে। শিক্ষিত মানুষের ঘুষ খাওয়া, দুর্নীতি করার বিষয়টি তার আত্মীয় বেয়াই তথা ছেলের শ্বশুর মুহুরিকে সামনে এনেছে। বেয়াই মুহুরি অসৎ মানুষের প্রতিনিধি তাই কাদিরের কাছে শিক্ষিত মানুষ মাত্রই জাল জুয়াচোর নষ্ট খল। তাই নাতিকে মাঠে পাঠিয়ে নিরক্ষর করে রাখতেও সে রাজি আছে কিন্তু ইস্কুলে পাঠাতে রাজি নয়। তার কথায় :

আর ইস্কুলে পাঠাইলে, তোর শ্বশুরের মত মুহুরী হইতে পারিবে আর শাশুড়ির বিছানায় বউকে ও বউয়ের বিছানায় শাশুড়িকে শোয়াইয়া দিয়া দুরে সরিয়া ঘুষের পয়সা গুণিতে পারিবে। কাজ নাই বাবা অমন লেখাপড়া শিখিয়া।

লেখাপড়া জানা মানুষগুলোর প্রতি এই অবিশ্বাস আর সন্দেহের বিষবাষ্প রাষ্ট্র ও সমাজের কোন এক গোপন স্থানে আঘাত হানে। বর্ণমালা চেনা মানেই মানবিক হয়ে ওঠা- এমন নীতির বির”দ্ধবাদিতা এদের তীব্র রোষের ভাষায় রূপান্তরিত হয়।

ঘরের মালিক হলেও জমির মালিক নয়
আন্তরিকতা নয় বরং বুদ্ধির জোরে যারা জিতে যায় তারাই মালোসমাজে প্রতিনিধিত্ব করে। ভারতের বাড়ির সভার মধ্যেও একটি চাপাগুঞ্জনে সে-সত্যের ইঙ্গিত মেলে। লেখকের ভাষায়- ‘প্রতিষ্ঠাহীন জীবনের সাহসের স্বভাব-সুলভ অভাবই এদেরকে যুগে যুগে দাবাইয়া রাখে।’ তাই মালোরা ঘরের মালিক হলোেও মাটির মালিক তারা নয়। প্রজা উচ্ছেদ হলোও তাই নতুন প্রজা আসে। জমিদাররা সংখ্যায় কম কিন্তু তারাই উৎপীড়ক:

“তারা সত্য নয় বলিয়াই তারা সংখ্যায় কম। মানুষের মধ্যে তারা ব্যতিক্রম। রায়তেরাই সত্য। তাই ঘুরিয়া ফিরিয়া মাটির মালিক হয় তারাই। কাগজপত্রের মালিক নয়, বাস করার মালিক। সেইরূপ তিতাসের মালিক জেলেরা। কাগজপত্রের মালিক আগরতলার রাজা। মাছ ধরার মালিক মালোরা।”

ধুতির দামে বিক্রি হয় মালো সমাজের মানুষ
একসময়ের জমিদারী ব্যবস্থায় বছরে একবার প্রাচীনকালের নিয়মে মালোদেরকে দশভার মাছ দিতে হতো। কিন্তু মৎস্যপ্রাপ্তি অনিশ্চিত বিষয় হওয়ায় সকলে যার যার ‘মাথট’ তুলে রাজার কাছে পৌঁছে দেবে এই নিয়ম প্রবর্তিত হয়। অন্যদিকে সমাজ পরিবর্তনের সূত্রেই তৈরি হয় বাজার-ব্যবস্থা। শহরে মাছ বিক্রেতাদেরকে নতুন মাশুল গুণতে হয়। আনন্দবাজারে মাছ বিক্রি করতে আসা মালোদের কাছ থেকে ভার পিছু দু আনা করে মাশুল চায় জমিদারের লোকেরা। ফলে পুঁজির নতুন আগ্রাসন বেড়ে চলে বাজার-ব্যবস্থাকে ঘিরে। পুঁজির অসুস্থ প্রতিযোগিতার কালো ছায়াবাজির শিকার হয় মালোপাড়ার দরিদ্র মানুষ। জগৎবাবু ও আনন্দবাবু শহরের দুই গণ্যমান্য জমিদার নিজেদের নামে বাজার বসায়। পুঁজির অন্তর্গ্রাসী ক্ষমতায় মালোসমাজের প্রত্যেকটি মানুষ বিক্রি হয় পঁচিশ টাকা নগদ আর একটি ধুতির দামে। আনন্দবাবুর বাজার ফুলে ফেঁপে ওঠে। আনন্দবাবু আজ না থাকলেও তার লোকেরা মালোদের কাছে খাজনা চায়।

আত্মমর্যাদাবোধে প্রতিবাদী মালোসমাজ
আত্মমর্যাদাবোধ গোকর্ণঘাটের মালোদেরকে প্রতিবাদী করে তোলে কখনো কখনো। তাই যুগযুগ ব্যাপী শোষণে জর্জরিত মালোসমাজের মানুষ এখন আর নির্বিচারে সব কিছু মেনে নিতে চায় না। অর্থগৃধ্নু ব্যবসায়ী আর জমিদার বাবুকে তারা তাদের আবেগসুলভ প্রতিবাদ জানায় : “শুন বেপারী, বাবুরে সাফ সাফ কইয়া দিও, মালোরা মাছ বেঁচতে কোন সময় মাশুল দেয় নাই, দিবেও না। জায়গা দেউক আর না দেউক। মালোরা বাজার জমাইতে যেমুন জানে, ভাঙতেও জানে। তারা যেখানে যায়, আ-পথে পথ হয়, আ-বাজারে বাজার হয়।”

আত্মবিক্রয় এবং মালোসমাজ ধ্বংসের একজন অনুঘটক
মালোপাড়ায় তামসীর বাপই কেবল বাজারের কায়েতদের সঙ্গে মিশে মালোপাড়ার মানুষের নিজস্ব সংস্কৃতিতে আঘাত হানে। তামসীর বাপ নিজেও সে-বিষয়টি বুঝতে পারে। তামসীর বাপকে বাজারের কায়েতরা খাতির করলেও এ-কথা সত্য যে, মালোদেরকে তারা কখনোই আপন করবে না। নিজেকে অপরাধী করে নিজের মনেই তার সে-ভাবনার উদ্গীরণ হয় : “সত্যই ত, পাড়ার মধ্যে ঐক্য রাখা ও পাড়ার স্বার্থ দেখাই সর্বাগ্রে কর্তব্য। তারা আমার কে? তারা মালোদের ঘরে নেয় না, মালোরা কোনো জিনিস ছুঁইলে তারা অপবিত্র মনে করে। পূজা-পার্বণে মালোরা তাদের বাড়ির প্রসাদ খাইলে এঁটো পাতা নিজে ফেলিয়া আসিতে হয়। সে পাতা ওরা ছোঁয় না, জাত যাইবে।”

আত্মবিক্রয়ের স্বার্থে তাই দুষ্ট খল হলোও তামসীর বাপের মধ্যেও এক ধরনের শুভবোধ জাগ্রত হয়। উপন্যাসের শেষপর্য়ন্ত অবশ্য তা টিকে থাকে না। প্রকৃতপক্ষে মালোসমাজ ভাঙনের জন্য সে একজন অনুঘটক। তার বাড়িতেই বাজারের কায়েতদের আড্ডা বসে যা মালোসমাজের বন্ধনের মূলে আঘাত করে। গভীর এক আন্তরিকতার বন্ধন মালোপাড়ার মানুষদেরকে পরস্পরের সঙ্গে অন্বিত করে রেখেছিল। যতদিন তারা একে অপরেরর প্রতি সহমর্মী থাকতে পেরেছে ততদিন মালো সমাজে ভাঙন দেখা যায়নি। কায়েতরাই তাদের সর্বনাশ করে। তাই শিক্ষিত মানুষ সম্পর্কে নিগৃহীত মালো-হৃদয়ে ঘৃণার ভ্র”কুটি সঞ্চারিত হয়। নিম্নশ্রেণির মানুষের উচুশ্রেণির মানুষ সম্পর্কে উষ্মার ভাষাকে অদ্বৈত ধারণ করেন :

“এরা মালোদেরকে কত ঘৃণা করে। মালোরা লেখাপড়া জানে না, তাদের মত ধুতি-চাদর পরিয়া জুতা পায়ে দিয়া বেড়ায় না। কিন্তু তাই বলিয়া কি তারা ছোঁয়ারও অযোগ্য। মালোরা মালো বলিয়া কি মানুষ নহে।”

কায়েতের সঙ্গে মিশিতেছ বলিয়া তারা তোমাকে কায়েত বানাইবে না।
অদ্বৈতর মল্লবর্মণের আত্মার প্রতিফলনই যেন এ-ভাষায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বহমান সুদূর অতীত থেকে সমাজ-বৈষম্যের যে পাকাপোক্ত ভিত গড়ে উঠেছে সেখানে ধূলির ঝড়ের মত কাঁপন লাগে। অস্পৃশ্য মানুষের মানবিক যাতনা সশব্দে উচ্চারিত হয়। দয়ালচাঁদ নিগৃহীত মালোসমাজের আরেকটি নির্মম সত্যের দুয়ার খুলে দেয়। সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে তামসীর বাপকে শুনিয়ে কায়েতদেরকে উদ্দেশ্য করে সে উচ্চারণ করে :

“বাজারের কাছে তোমার বাড়ি। বাজারের কায়েতরা তোমার বাড়িতে আসিয়া নাকি তবলা বাজায় আর মেয়েদের দিকে নজর দেয়। ভাবিয়া দেখ, কায়েতের সঙ্গে মিশিতেছ বলিয়া তারা তোমাকে কায়েত বানাইবে না। তুমি মালোই থাকিবে। তারা তোমার বাড়ি আসিলে যদি সিংহাসন দাও, তুমি তাদের বাড়ি গেলে বসিতে দিবে ভাঙা তক্তা। তুমি রূপার হুকোতে তামাক দিলেও, তোমাকে দিবে শুধু কল্কেখানা।”

মাছের মতো জন্ম, আবার মাছের মতোই মৃত্যু
মানুষের জীবনে জন্ম মৃত্যু বিবাহ- এ-তিন খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ। এই তিন বিষয়ে মালোরা সামর্থ্য থাকলে পয়সা খরচ করতে কার্পণ্য করে না। তবে তাদের সবার জীবনে অবশ্য এমন সৌভাগ্য আসে না। কখনো মৃত্যুর দেবতা আগেই এসে মালোশিশুর জীবনপ্রদীপ নিভে দেয়। মাছের ঝাঁকের মতই তারা জন্মায় আবার মাছের পোনার মতই কেউ কেউ অজান্তে হারিয়ে যায়। তরুলতার শুষ্ক পত্রগুচ্ছের মতই মালো-প্রজন্মের পরিণতি। লেখক তাই বলেন :

“একবার যে জন্মিয়াছে সে একদিন মরিবেই। কাজেই যে ঘরে মানুষ আছে মৃত্যু সে ঘরে ঘটিবেই। কিন্তু ঘরে মানুষ আছে বলিয়াই এবং সে ঘরে মৃত্যু একদিন ঘটিবে বলিয়াই জন্ম ও বিবাহও সে ঘরে ঘটিবেই এ কথার অর্থ হয় না।”

পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা
মালোপাড়ার সবশিশু ভাগ্যবান না হলেও সম্পন্ন কালোবরণের ঘরে জন্মানো শিশুদের ‘অন্নপ্রাশন’ হয় অনেক জাঁকজমকভাবে। অর্থভিত্তিক সামাজিক স্তরবিন্যাসের সঙ্গে আরেকটি নগ্ন সত্য এখানে প্রতিভাত হয়, তা হচ্ছে- পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার আধিপত্য। পুরুষ ও নারী শিশুর মধ্যেও তা ব্যবধান তৈরি করে। ফলে সন্তান জন্মানোর সময় তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিতে হয়- ‘ছাইলা হইলে পাঁচ ঝাড় জোকার, মাইয়া হলে তিন ঝাড়।’

বিশ্বাস সংস্কার
জেলেজীবনের বিশ্বাস সংস্কার তথা জীবনাচারের অনেক গভীর সত্যের ইঙ্গিত অদ্বৈত মল্লবর্মণ দিয়েছেন তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসের ‘জন্ম মৃত্যু বিবাহ’ নামক এ-পর্বে। ছ দিনের দিন শিশুর ঘরে দোয়াত কলম দেয়া হয়। রাতে চিত্রগুপ্ত এসে দোয়াত থেকে কালি তুলে কলম দিয়ে শিশুর ভাগ্যলিপি লিখে যায়। সুবিধা-বঞ্চিত মালোরা অবচেতনে সভ্য হবার অর্থ খোঁজে। তাই মনে মনে শিক্ষিত মানুষকে ঘৃণা করলেও শিক্ষিত হবার মূল্য তারা বোঝে। অন্যদিকে ভাগ্য তাদেরকে প্রবঞ্চিত করলেও ভাগ্যকে তার?

Leave a Reply 0

Your email address will not be published. Required fields are marked *