জীবনে রোদ্দুরে লেখক : সাবের চৌধুরী | Jiboner Roddure : Saber Chowdhury

বই : জীবনে রোদ্দুরে

লেখক : সাবের চৌধুরী
প্রকাশনী : পুনরায় প্রকাশন
বিষয় : বিবিধ বই
পৃষ্ঠা : 224, কভার : পেপার ব্যাক, 
সংস্করণ : 1st Published, 2022

“এসব ঠিক স্মৃতিকথা নয়। স্মৃতিকথা লেখবার বয়স তো হয়নি এখনো। এ বরং সেই যে শৈশবে জীবন ও পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে অবাক হয়েছিলাম, এখানের সমস্ত শব্দ মূলত এ বিস্ময়েরই নানারূপ প্রতিধ্বনি।”
আমার মনে হয়েছে শিশুদের জীবনপরিক্রমাটি অসাধারণ সুদীর্ঘ একটি কবিতার মতো, যাকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রূপে আবিষ্কার করা যায়। ব্যবধান এই যে, একটি কবিতা আমরা পাঠ করি স্থির অবয়বে এবং অনুভব করতে চেষ্টা করি মন-মস্তিষ্ক দিয়ে স্মৃতি ও অভিজ্ঞতার আলোকে; কিন্তু এই কবিতাটি আমাদের জীবনের ভেতর জীবন্ত ও সচল এবং একে আমরা অনুভব করি আমাদের সমগ্র সত্তা দিয়ে। মুক্তোদানার মতো ছোট ছোট কথা, শিশিরমাখা চাহনি, কোমল পদসঞ্চারণ ও শরীরের অদ্ভুত সুন্দর যে ভাষা, যে আবেগ ও আকুলতা এবং ঠোঁটভাঙা অভিমান, এই সমস্ত কিছু আমাদের জীবনে স্বর্ণরেণুর মতো ছড়িয়ে থাকে, ফুলের পাড়ির মতো সুগন্ধ ছড়ায়।
আমার মনে হয় কোনো ধরনের কষ্ট ছাড়া সবচেয়ে বড় যে বইটি লিখতে পারব, তা হচ্ছে শিশুদের নিয়ে। শিশুদের প্রতি আমার এত বেশি মুগ্ধতা, এত বেশি অবলোকন ও অনুভব, আমার হৃদয় ও চিন্তা যেন উপচে পড়ে। তাদের প্রতি স্নেহ ও দুঃখবোধ হৃদয় নদীর দুকূল ছাপিয়ে প্রবাহিত হয়। একটা শিশু তার বিদ্যমানতা, অবয়ব ও আচরণে এত বৈচিত্র্য ও আনন্দ-বিস্ময় জাগানিয়া প্রবণতাকে ধারণ করে, নীরবে একটু সময় একটি শিশুর দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে আপনি টের পাবেন।
একটা শিশু যখন একা থাকে, খুব নীরবে সে কী করে? কীভাবে তাকায়? কী মায়াময় তার প্রতিটি পদ বিক্ষেপ। দুটো শিশু যখন একসাথে হয়ে যৌথভাবে নানা কাজ করে, ঘুরে বেড়ায়, তাদের পারস্পরিক আচরণগুলো অসাধারণ এক কাব্যবোধের জন্ম দেবে আপনার ভেতরে।
দুই বছর বয়সী একটা শিশু কাপড়চোপড় পরে এক ঘর থেকে ছোট্ট পথটুকু পেরিয়ে অন্য ঘরে যাচ্ছে তার বয়সী আরেকটি শিশুর খুঁজে, দুজনের সাক্ষাৎ হওয়ার পর তারা হাসছে এবং পরস্পর হাত ধরাধরি করে হেঁটে যাচ্ছে, এর চেয়ে স্বর্গীয় দৃশ্য আর কী!
আমার খুব মনে আছে, আমাদের দ্বিতীয় সন্তান যখন হলো, বারীরার বয়স তখন আড়াই বছর। এ সময় বারীরার জন্য আমাদের খুব মন খারাপ হচ্ছিল। নতুন অতিথির জন্য বেচারি মায়ের কোলটি আর এককভাবে দখল করতে পারছে না। নতুন অতিথিকে নিয়ে সকলের ব্যস্ততা একটু বেশি। হঠাৎ উদ্ভূত এই পরিস্থিতিতে সে কিছুটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছে। কিছু বলে না; মন খারাপ করে আশপাশে ঘুরে বেড়ায়, এর ওর কোলে ওঠে। তার চেহারায় খানিকটা অসহায়ত্ব ছিল, আকুলতা ও অভিমান ছিল। এই দৃশ্যগুলো আমরা দুজন কয়েক দিন যাবৎ খেয়াল করছিলাম এবং যথাসম্ভবত তার প্রতি আলাদা মনোযোগ ও যত্ন নেওয়ার চেষ্টা করছিলাম।
কিন্তু, তবু, আমাদের বুক যেন ভেঙে আসত তার এই আচরণগুলো দেখে। তা ছাড়া সে আমাদের প্রথম সন্তান হওয়ার কারণে এতদিন আমাদের অপত্য স্নেহ, আদর ও মনোযোগের সবটুকু ছিল তাকে ঘিরেই। এখন সেই হৃদয়রাজ্যে এসেছে নতুন অতিথি। আমরা দুজনকেই আকুল হয়ে ভালোবাসছি, কিন্তু বারীরার এই অসহায়ত্ববোধ, আমরা যতই কোম্পানি দেওয়ার চেষ্টা করছি, থেকেই যাচ্ছে—এই বিষয়টা আমাদের ভেতরে ভেতরে ভেঙে দিচ্ছিল।
এক রাতে, পিচ্চিদুটো পাশাপাশি গভীর ঘুমে নিমজ্জিত। আমরা বারীরার দিকে তাকিয়ে আছি, এবং একটু পর বোকার মতো দুজনে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলাম। এই কান্নার অর্থ কী, এর বিশেষ কোনো ব্যাখ্যা আমি আজও খুঁজে পাই না।
এই শিশুগুলোই যখন চার-পাঁচ বছর বয়সী হয়, তখন তার চঞ্চলতা আরও বাড়ে, এবং সুস্পষ্টভাবে অভিমান করতে শিখে। একটু খারাপ আচরণ পেলে মন খারাপ করে বিষণ্ন হয়ে বসে থাকে এবং আদর করতে গেলে না তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলে—‘আমি কারও সাথে কথা বলি না’। চেহারাটি অন্যদিকে ফিরিয়ে নেয় এবং নিঃসঙ্গ হয়ে একা হেঁটে বেড়ায়। এবং একটা সময় গিয়ে প্রবল অভিমানটি ছোট্ট বুকের ভেতর আর ধরে রাখতে পারে না। ঠোঁট ভেঙে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। একজন বাবা-মায়ের জন্য সন্তানের এই কান্নার দৃশ্যটি বড় নির্মম। বিশ্বাস করেন বুক ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।
আহারে শিশু! আহারে মায়াময় শৈশব!
আমার মনে আছে, যখন চিল্লার সফরে ছিলাম, একটি ঘটনা আমাকে মোহাবিষ্ট করে রেখেছিল। এই ঘটনাটি আমি আমার স্ত্রীর কাছে লিখিত পত্রে উল্লেখ করেছি; কিন্তু যে ঘটনাটি আমি চিঠিতে লেখিনি, সেটিও সেই বিকেল বেলায়ই ঘটেছিল। মধ্যবয়সী এক লোক। উদোম গায়ে সে তার সুন্দর লাল গাভিটিকে ঘাস খাওয়াতে নিয়ে এসেছে, জংলাভরতি ছোট পুকুরটির পাড়ে। আমার থেকে একটু দূরেই, রাস্তার ওপাশে। একটি দৃশ্যকে তার সমস্ত অনুষঙ্গ-সহ সুন্দরভাবে অবলোকন করার জন্য যতটুকু দূরত্ব দরকার, আমি ঠিক ততটুকু দূরে বসে আছি। লোকটির পেছন পেছন চার-পাঁচ বয়সী ফুটফুটে কন্যাটি আনন্দ নিয়ে ঘুরছে। যেন প্রজাপতি, বিকেলের একটু রোদে উড়ছে।
গরুটা মাথা নিচু করে একমনে ঘাস খাচ্ছে আর বাপ-মেয়ে টুকটুক করে গল্প করছে। তাদের সামনে বিস্তৃত জলাশয়, ওপারে আবিররাঙা আকাশ। গাছের পাতাগুলো নড়ছে। আমি মাঝে মাঝে কুরআন শরিফ বন্ধ করে দৃশ্যটার দিকে তাকিয়ে থাকি। একটু পরই লোকটির নয়-দশ বছর বয়সের ছেলেটা এসে পথের মাঝখানে উদয় হলো। মাদরাসা থেকে পালিয়ে এসেছে এবং লোকটি তাকে খুব জোরালোভাবে মাদরাসায় ফিরে যেতে অনুনয়-বিনয় করে বোঝাচ্ছে। ছেলেটা হয়তো প্রায়ই এমন করে এবং পিতাটি তার সাথে কোনোভাবেই পেরে ওঠে না।
আমি সে সময় পিতার চেহারার অভিব্যক্তিটি দেখেছি। খুব অসহায় এবং করুণ। একটু পর সে একদমই ভেঙে পড়ে এবং কেঁদে দিয়ে ছেলেটাকে প্রহার করে। ছেলেটা কোনোভাবে ছুটে পালিয়ে যায়।
লোকটা পুনরায় গাভির কাছে ফিরে যায় এবং আকাশের দিকে ফিরে দুহাত হাঁটুতে রেখে বসে থাকে। ছোট্ট মেয়েটা চুপ হয়ে গেছে। পিতার পেছনে দাঁড়িয়ে চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। আমি পরিষ্কার টের পাচ্ছিলাম সন্তানের প্রতি অপত্য স্নেহ বেদনা ও বিষণ্নতায় তার ভেতরটা ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে। আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল কাছে গিয়ে তার পিঠে হাত রেখে জিজ্ঞেস করি—পিতা! খুব কি কষ্ট হচ্ছে? সন্তানের প্রতি অদম্য মায়ায় বুক ভেঙে আসছে কি?
একটা শিশু, সে দুই বছরের হোক বা আট বছরের, বড় বেশি মায়ার কাঙাল এবং খুব বেশি অসহায়। সে নিজেকে রক্ষা করতে পারে না, নিজের মৌলিক প্রয়োজনগুলো নিজে নিজে সংগ্রহ করতে পারে না। তার সবটুকু নির্ভরশীল আমরা বড়দের ওপর। কল্পনা করতে পারেন, আমরা বড়রা যখন তাকে প্রহার করি, বকা দিয়ে, ধমক দিয়ে, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে আঘাত করি, তার তখন কেমন লাগে? কেমন অসহায়ত্ব বোধ করে তখনকার নিঃসঙ্গ সেই পৃথিবীতে!
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?