গ্রীষ্মের বিকেলে ঝরে পড়া কৃষ্ণচূড়া
১৫তম পর্ব
©মারুফ হুসাইন
হাসপাতাল থেকে ফোন আসে। শরিফুল মাত্রই বালিশে মাথা রেখেছিল। চোখ লেগে আসছিল। ঠিক তখনি ফোন আসে। তারা কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে যায়। বিরক্ত হয়ে ফোন রিসিভ করে। কিন্তু ওপাশের কথা শুনে চাপা ব্যথা এসে বিরক্তিকে গ্রাস করে নেয়। বিলকিস আপা মারা গেছেন৷
শরিফুল কী করবে, বুঝে উঠতে পারে না৷ মৃত্যু তার খুব আপন। অল্প সময়ে বেশ কিছু আপনজনের মৃত্যু সে দেখেছিল। প্রথমে বাবার মৃত্যু। তার বছর খানেক পার না হতেই মায়ের মৃত্যু। যা তার বর্তমান ভবিষ্যৎ দুটাকেই লন্ডভন্ড করে দিয়েছিল। সেই সময় সে পার করে এসেছে। নিজেকে শক্ত করে গড়ে তুলেছে। তাদের মৃত্যু এবং মুনাকে হারিয়ে তার আর আপনজন বলতে কেউ ছিল না। তার ভালো মন্দ চিন্তা করার জন্য কেউ ছিল না। তারপর বিলকিস আপার সাথে পরিচয়। বিলকিস আপা তাকে আপন করে নিল। নিজের ছোট ভাইয়ের মতো দেখতে লাগল। তার জন্য চিন্তা করত। সে চাইত তার এই ভবঘুরে জীবনের অবসান হোক। এ জীবনটা সুন্দর করে গুছিয়ে নিক। মাঝে মাঝে তার এই ভবঘুরে জীবনের জন্য বশ বকাঝকা করত। কিন্তু শরিফুল কখনোই তার কথা শুনেনি। তার কষ্ট হচ্ছে। আপনজন হারানোর পুরানো সে কষ্ট। সে নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করে।
বিলকিস আপার লাশের পাশে পাখি দম ধরে বসে আছে। কাঁদতে কাঁদতে তার চোখ গাল ফুলে উঠেছে। তার পাশেই লোকটা দাঁড়িয়ে আছে, যাকে বিলকিস আপার দেখাশোনা করতে বলেছিল।
শরিফুলকে দেখতে পেয়ে পাখি দৌড়ে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল। ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠল, ‘মামা আম্মায়….’ পাখি কান্নার জন্য কথা শেষ করতে পারে না।
শরিফুল তাকে শক্ত করে ধরে বলে, ‘কাঁদিস না মা! কেউই চিরদিন থাকে না।’ শরিফুলের গাল বেয়েও পানি ঝরে পড়ে।
পর দিন সকাল আটটার মধ্যে বিলকিস আপার শেষকৃত্য শেষ হয়ে যায়। শরিফুল পাখিকে নিয়ে তার মেসে ফিরে। তার সাথে আরো দু জন রুমমেট আছে। তাই পাখিকে মেসে রাখা যাবে না৷ সে ভাবতে থাকে মেয়েটাকে কোথায় রাখা যায়! ক’দিন পর হোস্টেলে দিয়ে দিবে। তার আগ অবধি তো তার জন্য একটা সেফ জায়গার ব্যবস্থা করা দরকার।
প্রথমে তার মুনার কথা মনে হয়। মুনার বাসায় কয়েক দিনের জন্য পাখিকে পাঠিয়ে দেয়া যেতে পারে। কিন্তু পরবর্তীতে মনে হয়, সেটা ঠিক হবে না। মুনার হাজবেন্ড আছে৷ তাকে জবাবদিহিতা করতে হতে পারে৷ তাই সব কিছু বিবেচনা করে তার মনে হলো, নূহাকে বলা যেতে পারে৷ কিন্তু নূহা নিজেই বাচ্চা মেয়ে। সে এর মর্ম কতটুকু বুঝবে সেটাও ভাবার বিষয়।
কোনো বন্ধু বা বান্ধবীর কাছেও পাঠানো যেতে পারে। কিন্তু মুনা বা নূহা পাখিকে যতটা আপন মনে করে স্থান দিবে অন্যরা তা করবে না৷ তারা অনেকটা পথ শিশুর মতো করেই দেখবে।
সব ভেবে নূহাকে বলবে বলেই শরিফুল সিদ্ধান্ত নেয়। সে ঘড়ি দেখে। এই সময়ে মেয়েটার স্কুলে থাকার কথা। পর মুহুর্তে মনে পড়ে, মেয়েটার বেশ ক দিন আগে টেস্ট পরীক্ষা শেষ হয়েছে৷ এখন স্কুল বন্ধ। তাই বাসাতেই থাকার কথা।
‘বাহ! আপনি নিজে থেকে আমাকে ফোন দিয়েছেন! ব্যপার কী!’ ফোন ধরেই নূহা বলে ওঠে।
‘দেখা করতে পারো? একটু জরুরী দরকার আছে!’
শরিফুলের কন্ঠ শুনেই নূহা বুঝতে পারে, কিছু একটা হয়েছে। তাই আর সে বাড়তি কিছু বলে না, ‘ঠিক আছে, আমি আসছি!’
নূহা শহিদকে গাড়ি বের করতে বলে। সে দেরী করে না। অল্প সময়ের রেডি হয়ে বের হয়ে যায়। সে শরিফুলের মেসের কাছাকাছি এসে তাকে ফোন দেয়।
মেসে কেউ নেই। শরিফুল বের হবে। পাখিকে ভালো করে বুঝিয়ে দেয়, সে না আসা অবধি যেন বের হয় না হয়। কেউ নক করলে যেন গেটও না খুলে।
‘কোথাও গিয়ে বসি?’ শরিফুল গাড়িতে উঠতেই নূহা বলে।
‘না, কোথাও যাব না!’
‘কী হয়েছে আপনার? এমন দেখাচ্ছে কেন?’
‘বিলকিস আপা মারা গেছেন!’
নূহারও মনটা খারাপ হয়ে যায়। সে জানে, শরিফুল বিলকিস আপাকে কতটা ভালোবাসে৷ শরিফুলের জন্য তার মায়া হয়। তাকে কী বলে সান্ত্বনা দিবে, সে বুঝতে পারে না।
‘নূহা আমার একটা হেল্প লাগবে! করবে?’
‘এভাবে কেন বলছেন! আমি আপনার কোনো প্রয়োজনে আসতে পারলে বরং আমারই ভালো লাগবে।’
‘পাখির তো আর কেউ রইল না। ওকে ক’দিন পর হোস্টেলে দিব। আমি কয়েকজনের সাথে মেসে থাকি। ওখানে তো আর ওকে রাখা যায় না। ওকে হোস্টেলে দেয়া অবধি তোমার সাথে রাখতে পারবে?’
‘এই আপনি এভাবে বলেন কেন! বলবেন যে নূহা পাখিকে তোমার সাথে ক’দিন রাখো!’ বলে একটু থেমে নূহা যোগ করে, ‘যে অধিকার আপনার আছে, সে অধিকার খাটাবেন, বুঝলেন!’
কথাটা শরিফুলের ভালো লাগলেও তার দুঃখ লাগে। মেয়েটা তাকে কতটা ভালোবাসে। কিন্তু সে তার বিন্দু পরিমাণও ফেরত দিতে পারে না। বরং মেয়েটাকে সে অবহেলা করে।
আজ বেশ কয়েকটা টিউশন ছিল৷ কিন্তু একটাতেও শরিফুল পড়াতে যায়নি। নূহার কাছে পাখিকে বুঝিয়ে দিয়ে সে মেসে এসে ঘুম দিয়েছে৷ এক ঘুমে সন্ধ্যা। এর মাঝে বেশ কয়েকবার নূহার ফোন এসেছিল। মিসডকল উঠে আছে। সে ব্যাক করে।
‘এই আপনি ফোন ধরছিলেন না কেন?’
‘ঘুমিয়ে ছিলাম।’
‘আপনি ফোন না ধরায় আমি চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম।’
‘তুমি ভালো করে পড়াশুনা করো। আমার জন্য চিন্তা করতে হবে না।’ একটু থেমেই যোগ করে, ‘রাখলাম!’ বলে শরিফুল ফোন কেটে দেয়।
মুনাও বেশ কয়েকবার ফোন দিয়েছিল৷ কিছু না বলে পড়াতে যায়নি বলে তারও মনে হয়েছে, হয়তো কোনো অসুবিধা হলো কিনা! তাই-ই হয়তো ফোন করেছিল। শরিফুল আর ব্যাক করার কথা ভাবে না। মোবাইল সাইলেন্ট করে পকেটে ঢুকিয়ে রাখে। এখন কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।
শরিফুল রাস্তার ফুটপাত ধরে হাঁটছে। তার কোনো গন্তব্য নেই। যেদিকে চোখ যাচ্ছে সেদিকেই হাঁটছে। বারবার বিলকিস আপার কথা মনে পড়ছে। এইতো সেদিনের কথা, সে রাস্তায় পড়ে গিয়েছিল। যখন জ্ঞান ফিরেছে তখন নিজেকে ছনের ঘরে পেয়েছে। দু দিন তার কোনো জ্ঞান ছিল না। এই দু দিন অপরিচিত এক মহিলা তার সেবা করে তাকে বাঁচিয়ে তুলেছে।
মায়ের মৃত্যু, মুনাকে হারিয়ে সে যখন দিশেহারা তখন বিলকিস আপাই তাকে আপন করে নিয়েছিলেন। সে বিলকিস আপাও আজ চলে গেলেন।
শরিফুলের টংয়ে বসে সিগারেট ধরায়। তার চোখ পানিতে টলমল করছে৷ ভাবছে, বারবার তারই কেন আপনজন হারাতে হয়!
চলবে……