বইয়ের নামঃ কষ্টিপাথর
লেখকঃ ডা শামসুল আরেফীন
শারঈ সম্পাদক- আলী হাসান উসামা
প্রকাশনীঃ শুদ্ধি
ধরনঃ সুন্নত ও বিজ্ঞান
প্রকাশকালঃ ফ্রেব্রুয়ারি ২০১৮
কলেবরঃ ১৭৬ পৃষ্ঠা (পেপারব্যাক)
মুদ্রিত মূল্যঃ ২০০ টাকা।
কষ্টিপাথর বইটি ডাউনলোড করতে বইয়ের ছবির উপর ক্লিক করুন |
প্রাক কথন- ইসলামের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি টাইপের বই পড়তে সবসময়ই নিরুৎসাহী ছিলাম। কারণ, অধিকাংশ বইয়েই ইসলামের বিধানকে টেনেহিঁচড়ে সমসাময়িক বিজ্ঞানের মোড়ক পরানোর চেস্টা করা হয়। অথচ ইসলাম শাশ্বত আর বিজ্ঞান নিয়ত পরিবর্তনশীল। কিন্তু এ বইটি যেন ব্যাতিক্রম। লেখক সুন্নতের কষ্টিপাথরে ঘষেছেন বিজ্ঞানকেই। বিজ্ঞান দিয়ে সুন্নত নয়, বরং সুন্নত দিয়ে দেখিয়েছেন তা বিজ্ঞান থেকেও কতই না এগিয়ে। খুব অল্প কিছু বইতেই আপনি প্রত্যেক পাতায় মুগ্ধতা অনুভব করবেন। টানা পড়ে যেতে ইচ্ছে করবে। এটি ছিলো তেমনই এক বই।
.
বিষয়বস্তু- নবীজির (স) সুন্নত মেনে চললে দুনিয়া-আখিরাত উভয় জাহানেই শান্তি। যুক্তির বিচারেও এটি দাবী রাখে যে এই বিশ্বজাহানের মালিক যিনি, যিনি সৃষ্টি করেছেন সকল বস্তু ও উপায়ান্তর; তাঁর দেখানো পথেই পাওয়া যাবে প্রভূত কল্যাণ। আখিরাতের শান্তির ব্যাপার নাহয় বুঝা গেলো, কিন্তু দুনিয়াতে সুন্নাহসম্মত জীবনবিধান কীভাবে আমাদের শান্তিময় ও সুস্বাস্থ্যময় জীবন কাটাতে সাহায্য করতে পারে?
এটিই হচ্ছে এই বইয়ের আলোচ্য বিষয়।
.
বইয়ের প্রথম ভাগে লেখক খুবই উপযোগী কিছু ডিসক্লেইমার দিয়ে রেখেছেন। লেখক কেন বই লিখেছেন আর আমরা কেনইবা এ বই পড়বো- এ নিয়ে সুন্দর নাতিদীর্ঘ আলোচনা হয়েছে। যদিও এ বইয়ে সুন্নাহসম্মত অভ্যাসের স্বাস্থ্যগত উপকারিতা আলোচিত হয়েছে; কিন্তু শুধু এ কারণে সুন্নত মানলে আমরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবো, কেবল দুনিয়াই পাবো। আখিরাতও পেতে হলে সুন্নতের অনুসরণ করতে হবে শুধু এ কারণে যে- এটি আমার প্রিয় নবির সুন্নত। যে নবিকে অনুসরণের আদেশ দিয়েছেন স্বয়ং আল্লাহ সুবহানাহুওয়াতা’লা।
.
লেখক মূল আলোচনা শুরু করেছেন দাড়ি না কাটার স্বাস্থ্যগত উপকারিতা নিয়ে। এই অধ্যায় পড়ে মনে হতে পারে, তাহলে যৌনকেশ কেন কাটতে বলা হলো ইসলামে? যেন আপনার মনের কথাই বুঝতে পেরে পরের অধ্যায়ে লেখক যৌনকেশ কাটার বৈজ্ঞানিক কারণ আলোচনা করেছেন।
এর পরের অধ্যায়গুলোতে একে একে আলোচিত হয়েছে-
• গোফ ছোট রাখার স্বাস্থ্যগত উপকারিতা
• ডান দিক দিয়ে সকল ভালো কাজ শুরু করার মানসিক সুফল
• বাম পা দিয়ে বাথরুমে ঢুকার একটি বৈজ্ঞানিক কারণ
• শুধুমাত্র উযু করে ঘুমানোর মাধ্যমে যেভাবে ভালো ঘুম অর্জন করা যায়, মানসিক শান্তি পাওয়া যায় ও রোগ-বালাই থেকে দূরে থাকা যায়
• ডান কাত হয়ে ঘুমানোর উপকারিতা
• ঢোলা কাপড় পরার কারণে কীভাবে মুসলিমগণ বেঁচে যাচ্ছে শত স্বাস্থ্য ঝুঁকি থেকে
• সাদা কাপড়, ঢিলে পাজামা ও টুপি পরার উপকারিতা
• মিসওয়াকের গুণাগুণ
• সুন্নাহসম্মত উপায়ে খাওয়ার সুফল
• মাঝে মাঝে রোজা থাকার উপকারিতা
• নবজাতকের হাইপোগ্লাইসোমিয়া থেকে বাঁচাতে তাহনীকের সুন্নাহ
• পানীয়তে মাছি পড়লে ভালো করে ডুবাবো কেনো
• মলত্যাগের স্বাস্থ্যসম্মত উপায়
• কুলুখ নেয়ার যুক্তিসঙ্গগত কারণ
• জীবাণু দূরীকরণে মাটির ভূমিকা
• উজু করলে কীভাবে নামাজে মনোনিবেশ বাড়ে
• ঝাড়ফুঁক এরও কি বিজ্ঞানসম্মত কারণ থাকতে পারে
• যেকারণে আজ আধুনিক বিজ্ঞানও আঁশযুক্ত খাবার খেতে বলে
• রাগ দূর করার নববী পন্থার দিকেই বিজ্ঞান কিভাবে ঝুকলো
প্রত্যেক অধ্যায়কেই দুই অংশে ভাগ করা যায়। একদিকে খ্যাতনামা সব পশ্চিমা রিসার্চ জার্নালে প্রকাশিত সুন্নাহসম্মত অভ্যাস নিয়ে লেখা গবেষণাপত্র আর সংবাদপত্রের রিপোর্টকে অবলম্বন করে এগুলোর স্বাস্থ্যগত গুণাবলি তুলে ধরা হয়েছে। আবার অন্যদিকে এই অভ্যাসগুলো যে সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত তাও উল্লেখ করে উপযোগী রেফারেন্স ও হাদিসও যুক্ত করা হয়েছে।
অতঃপর লেখক একটি হেলথ চার্ট দিয়ে দেখিয়েছেন বড়ো বড়ো রোগবালাই কী কী কারণে হয়ে থাকে আর কীভাবে সকল সুন্নাহকে মেনে চললে সুন্নাহ নিজেই একটি প্রেভেন্টিভ মেডিসিন হয়ে যায়।
.
বইয়ের সবচেয়ে সুন্দর কিছু অংশ-
বইয়ের শেষের অংশগুলো ছিলো অসম্ভব সুন্দর, ভালোলাগা অংশ। পড়ে পুলকিত হবেন, সুন্নতের প্রতি আকর্ষণ যেনো আরো বাড়বে। এগুলোসহ বইয়ের ভালোলাগা কিছু জিনিস এখানে তুলে ধরবো-
• ‘কাকতালীয়’ অধ্যায়ে লেখক নাস্তিকদের বিশ্বাসের ভিত্তিমূলেই আঘাত হেনেছেন। এতক্ষণ তো কথা হচ্ছিল সুন্নতের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নিয়ে। এ অধ্যায়ে লেখক কুরআনের ১৪ টি মুজিযা নিয়ে এসেছেন। প্রশ্ন তুলেছেন, নবীজি যদি তাদের মতে ক্ষমতালোভী নেতাই হয়ে থাকতেন, তবে এতকিছু কেন শেখাতে গেলেন আর আজ বিজ্ঞান কেনই বা সেগুলো মেনে নিচ্ছে।
.
সুন্নতি জীবনযাপনের দাওয়াত দিতে গেলেই কিছু প্রশ্ন আসে। কেউ কেউ শুধু জায়েয নিয়েই পড়ে থাকে, আবার কেউ কেউ বলে খিলাফাহ নিয়ে কথা না বলে সুন্নত নিয়ে কথা বলবেন না। লেখক তাদের জন্য চিন্তার খোরাক দিয়েছেন ‘প্রলাপ’ অধ্যায়ে। সকল দ্বীনি মেহনতের জন্য উপকারী কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। কীভাবে মতভেদ ভুলে কমনগ্রাউণ্ডে কাজ করবো, কিভাবে সমাজ ও রাস্ট্র ব্যাবস্থার ইসলামীকরণের পাশাপাশি নিজেদের শরীরেও, জীবনেও সবক’টি সুন্নত নিয়ে আসবো সেসব জিনিস নিয়ে কথা বলেছেন।
শুধু আরামের সুন্নতের কথা বলে রাষ্ট্র পরিচালনার সুন্নত তরিকার ব্যাপারে উদাসীন হওয়া যাবেনা, চেস্টা করতে হবে। আবার শুধু খিলাফাহ খিলাফাহ বলে টং এর দোকানে দাঁড়িয়ে সিগারেট না টেনে নিজেকেও রাঙ্গাতে হবে আল্লাহর প্রিয় নবির রংয়ে।আমাদের করণীয় কী সে মর্মে একটি গাইডলাইন দেয়ার চেস্টা করেছেন।
.
• আল্লাহ মানুষকে একটি গুণ দিয়েছেন। তা হল সে না দেখে বিশ্বাস করতে পারে। আর এই গুণ থাকার কারণেই মানুষ হাইপোথিসিস দাঁড় করিয়ে গবেষনা শুরু করে। এটিই বিজ্ঞানের ভিত্তি। সুতরাং, বিজ্ঞানের কোন ক্রেডিট নেই। সবই তো স্রস্টার দান।
.
• আধুনিক বিজ্ঞানেরও কিছু সমালোচনা করেছেন। পুঁজিবাদী সমাজে গবেষণা প্রচুর হয়, কিন্তু সামনে আসে সেগুলোই যেগুলোতে আপনার পকেট খসানো যায়। অথচ সুন্নাহসম্মত জীবনযাপন করলে আপনার রোগবালাইয়ের বিরুদ্ধে তা প্রেভেন্টিভ মেডিসিন হিসেবে কাজ করবে। আপনাকে রক্ষা করবে কতশত দূরারোগ্য ব্যাধি থেকে।
.
লেখনী- লেখক বইটি লিখতে যথেষ্ট ঘাটাঘাটি করেছেন। Researchgate, Sciencedirect সহ বিশ্বখ্যাত সব জার্নালের থেকে প্রচুর পরিমাণে গবেষণাপত্র ঘেটেছেন। পশ্চিমা সব বাঘা বাঘা পত্রিকার রিপোর্ট ও ব্যাবহার করেছেন। এমন বইয়ের ভাষা গুরুগম্ভীর হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিলো। কিন্তু না, লেখক স্বীয় মুন্সিয়ানার দ্বারা বইকে অসম্ভব সুখপাঠ্য করে রচনা করেছেন। সুযোগ পেলেই ব্যাবহার করেছেন হিউমারের, আবার কখনো অল্প কথায় বিবেককে ধাক্কা দিয়েছেন।
.
লেখক নিজে একজন ডাক্তার, আর সে কারণেই হয়তবা বর্ণনাশৈলী আরো বেশি সাবলীলতা পেয়েছে, যুক্ত হয়েছে মানবদেহের নানা অভ্যান্তরীণ অঙ্গের কার্যপ্রণালীর ছবিও। সর্বোপরি লেখক সমস্ত বইটি এমন বৈঠকি ঢংয়ে লিখে গেছেন যে মনে হবে লেখক আপনার পরিচিত কেউ, একসাথে বসে চা খেতে খেতে আড্ডা দিচ্ছেন।
.
শেষকথা- আপনি যদি পড়ে না থাকেন, বইটি অবশ্যই পড়বেন। সুন্নতের প্রতি আপনার ভালোবাসা বৃদ্ধি পাবে। বইয়ের পেজ সেটআপ, বানান, প্রচ্ছদ সবকিছুই বেশ ভালো ছিলো।
.
প্রথমদিকে যখন জেনারেল লাইনের লোকেরা ইসলাম নিয়ে লেখায় আসতে শুরু করলো, অনেকের মনে একটা আশংকা কাজ করতো।যারা আলেম নন, তারা যদি আবার আলেমদের মতো ফাতওয়া দিতে শুরু করেন! কিন্তু না, জেনারেল লাইনের ভাইয়েরা নিজেদের সীমা চিনে নিয়েছেন। যিনি যে অঙ্গনে দুনিয়াবি বিচারে দক্ষ, সেখানে থেকেও লব্ধ জ্ঞানের আলোকে ইসলামের সৌন্দর্য নিয়ে লেখা যায়। ফাতওয়া দেয়া বা ইলমি কাজগুলো আলেমদের হাতেই ন্যাস্ত থাকুক। আলহামদুলিল্লাহ্, ভাইয়েরা নিজেদের গণ্ডি চিনে নিয়েছেন।
.
এই বইটি এমন এক বই যা ইংরেজী ভাষায় প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক বাজারে ছাড়া হলে ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা পাবে বলেই বিশ্বাস করি। সেই লেভেলের একটা কাজ হয়েছে।
.
শেষ করবো লেখকের কিছু আকুতি দিয়ে-
• এতিম নবিকে নিজের পরিবারে, শরীরে, ব্যাবসায়, আচার-প্রথায় জায়গা দিবেন এমন কেউ আছেন?
• আছেন কি এমন কোনো আল্লাহর বান্দা যিনি চব্বিশ ঘন্টা নবীর সুন্নতে সাজাবেন নিজেকে?
• সকল বাঁধা ডিঙ্গিয়ে ব্যাক্তি ও পরিবারজীবনে, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে সুন্নতের পাবন্দ করতে কী পারবো আমরা?
পথিকশপ_বইয়ের_রাজ্য_রিভিউ_প্রতিযোগিতা