বই: একটি সাইকেল এবং কয়েকটি ডাহুক পাখি
লেখক: হুমায়ূন আহমেদ
প্রকাশক: কাকলী প্রকাশনী
মুদ্রিত মূল্য: ১৬০/=
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ১১২
cover Image |
কবি রুস্তম আলী দেওয়ানের একমাত্র প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘রু আদের সাইকেল’। কাব্যগ্রন্থের সবগুলো কবিতাই কীট-পতঙ্গ নিয়ে। প্রচ্ছদটাও অদ্ভূত। উল্টো করে রাখা সাইকেলের চাকায় নীল রঙের আহত পাখি বসা। ডানা থেকে রক্ত ঝরছে। আর পাশে এক কাপ ধূমায়িত চা। তার চিন্তা-ভাবনা বা কথাবার্তায় সুস্থ স্বাভাবিক বলে মনে হওয়াটা বিচিত্র না। কিন্তু আদতে সে বাস্তব জগতের পাশাপাশি এক ভ্রমের জগতে বাস করে। আর এটাকে সে আলাদা করতে পারে না। তার কাছে সবই বাস্তব।
তার বাড়িটাও বিচিত্র সব মানুষে ভর্তি। অনেককে সে চেনেই না। তারা কিভাবে এ বাড়িতে জায়গা পেল তাও পরিষ্কার না। সেই নাকি তাদের এনেছে। এদের একজন মুনিয়া। তাকে ঠিক বুঝতে পারে না রুস্তম। মেয়েটার প্রতি মায়া অনুভব করে। আরেকজন ফিটবাবু হয়ে ঘুরে বেড়ায়। চাকরি পেলেই নাকি চলে যাবে। চন্ডিবাবু নামের একজন সারাদিন বেকার বসে থাকে। কোনকিছুই স্বাভাবিক নয় এই বাড়ির। একজনের অসুস্থতা বুঝি সবাইকে প্রভাবিত করছে।
রুস্তমের বাবা স্ত্রী হত্যার অভিযোগে জেলে। সেখান থেকে সে চিঠি পাঠায়। লোক বিশেষ সুবিধার নয়। বোন সামিনাও উদ্ভট কান্ডকারখানা করে বেড়ায়। মাঝখান থেকে দুলাভাই বেচারা বিপাকে। লোকটা তাকে খুব পছন্দ করে। তার যত্ন নেয়। এই ভালো মানুষটার উপর তাহলে সামিনার এত ক্ষোভ কেন?
এতকিছুর ভীড়েও রুস্তম আনন্দে থাকার চেষ্টা করে। তার চিকিৎসক তাকে এভাবে থাকতে বলেছেন। সে সেটাই মেনে চলছে। সমস্যা শুরু হবার পর স্ত্রী তাকে ফেলে চলে গেছে। একমাত্র পুত্রকেও তার কাছে আসতে দেয়া হয় না। একাকী সময়টাতে তাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকা। আর্ট টিচারের কাছ থেকে সে ছবি আঁকা শিখছে। পাশাপাশি চলছে উপন্যাস লেখা। কিন্তু নায়কের মৃত্যুটাকে কোনভাবেই গুছিয়ে আনতে পারছে না। বর্তমানে তারই চেষ্টা চলছে আর সাথে চলছে সাইকেল চালানো। অবাস্তব জীবনটাই এখন একমাত্র বাস্তবতা।
একটি সাইকেল এবং কয়েকটি ডাহুক পাখি পিডিএফ ডাউনলোড⤵️
হুমায়ূন আহমেদের লেখা দিয়েই আমার উপন্যাস পড়া শুরু। তবে অতি দুঃখের বিষয় হচ্ছে তার শুরুর দিকের লেখাগুলোতে ভাবনার যে গভীরতা আর লেখনীর ধরণটা ছিল সেটা পরে হারিয়ে গেছে। ঘুরেফিরে একই ধরনের চরিত্র, একই ধরনের সিকোয়েন্স, হালকা রসিকতায় একঘেয়ে হয়ে গেছে।
শুরুটা ভালোই ছিল। কিন্তু কিছুদূর এগিয়েই সেই একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি। চরিত্রগুলোতেও বিশেষত্ব ছিল না, গতানুগতিক। শেষ করে অনুভূতির রেশ থাকে না। তবে উনার লেখনীর একটা সহজাত বৈশিষ্ট্য হচ্ছে একবার ধরলে পুরোটা পড়তে হয়। আবার পড়া শেষে আফসোস করতে হয়।এই লেখাগুলো পড়লে ভাবতে কষ্ট হয় শঙ্খনীল কারাগার, নন্দিত নরকে, মাতাল হাওয়া, মধ্যাহ্ন, জোছনা ও জননীর গল্প, দেয়াল-এর মত উপন্যাস লেখকের লেখা।
যাই হোক উনি আমার পছন্দের লেখকদের একজন। তার উল্লেখযোগ্য রচনার সংখ্যাও নেহাত কম নয়।
নামের সাথে প্রচ্ছদ বা গল্পের তেমন মিল নেই। প্রকাশনীর কাগজ, বাঁধাই বেশ ভালো। প্রিন্টিং মিস্টেকও তেমন নেই। হালকা ধাঁচের কিছু পড়তে চাইলে চেষ্টা করে দেখতে পারেন।
Review Credit 💕 Mostanoor Sarkar Moon
রু আদে। রুস্তম আলি দেওয়ান। এই গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র। নিঃসঙ্গ ও অপ্রকৃতস্থ একজন মানুষ। রুস্তম আলি দেওয়ান তার নামকে সংক্ষেপ করে ( রু আদে) একটি কবিতার বই প্রকাশ করেছেন। কবিতার বইয়ের নাম রু আদের সাইকেল। একজন অপ্রকৃতস্থ মানুষ হিসেবে তার বিচিত্র কল্পনা থেকে তিনি কীটপতঙ্গ নিয়ে তার এই কবিতার বইয়ে চল্লিশটি কবিতা লেখেন। পিপড়া, মশা আবার কখনোবা উইপোকা। তার এই কবিতার বইয়ে” অন্ধ উইপোকা ” শিরোনামে একটি কবিতা জনপ্রিয়তা লাভ করে। রুস্তম আলি ঠিক করেন এখন তিনি একটি অতিপ্রাকৃত উপন্যাস লিখবেন। উপন্যাসের নাম ঝিঝি।
এই উপন্যাসের প্লটও তার ঠিকমতো এগোয় না। শেষপর্যায়ে ঠিক হয় নায়কের আকস্মিক মৃত্যুর মাধ্যমে তিনি তার উপন্যাসের সূচনা করবেন। উপন্যাসে নায়কের নাম দেন প্রনাশ। নামের মধ্যেই একটা মৃত্যুময় ব্যাপার দিয়ে পাঠক কে বিভ্রান্ত করতে চান।আর্থিকভাবে বিত্তবান রুস্তম আলি বিরাট বাড়িতে অনেক আশ্রিতের মাঝেও একা থাকেন। তার স্ত্রী মদিনা তাকে পাগল আখ্যায়িত করে ডিভোর্স দেয় এবং একমাত্র ছেলে বিভাসকে নিয়ে আলাদা থাকে। রুস্তম আলির ধুরন্ধর শশুড় গোলাম মাওলার এখন অন্যতম প্রধান লক্ষ হলো কৌশলে তার সকল সম্পত্তি হাতিয়ে নেওয়া।
রুস্তম আলির বাবা এস. আলি সাহেব একজন যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামী। স্ত্রী হত্যার দায়ে তিনি এখন জেলে। আদৌও তিনি তার স্ত্রীকে হত্যা করেছেন কিনা এই ব্যাপারটা খোলাশা হয়না। এস.আলি সাহেবের এখন প্রধান কাজ চিঠির মাধ্যমে ছেলের সাথে যোগাযোগ করা এবং তার জামিনের ব্যবস্থা করার জন্য ছেলেকে অনুরোধ করা। একজন ভারসাম্যহীন মানুষ হিসেবে রুস্তম আলি এ ব্যাপারে অনেকটাই খামখেয়ালি। রুস্তমের এখন কাছের মানুষ বলতে তার একমাত্র বোন সামিনা আর দুলাভাই আমিন সাহেব। আমিন সাহেব একজন বড় ব্যবসায়ী। ব্যবসায় হল তার সকল ধ্যানজ্ঞান। ঘুমের মধ্যেও ব্যবসায়ীক চিন্তাচেতনা নিয়ে অদ্ভুত সব কর্মকাণ্ড করেন, একা একা বিড়বিড় করেন।
মানুষ হিসেবে আমিন সাহেব ভালো হলেও স্ত্রী সামিনা ঠিক করেন তাকে কঠিন শাস্তি দিবেন।সামিনা তার স্বামী আমিন সাহেবকে বলেন তার শরীর থেকে পাঠার গন্ধ বের হয় এবং এক সকালে আমিন সাহেবের বন্ধু আফতাব খানের সাথে মালয়েশিয়া পালিয়ে যায়। epliptic সিজার বা শর্ট ট্রাম মেমোরি লস অর্থাৎ বাস্তব আর কল্পনার জগৎকে মিলিয়ে ফেলার অদ্ভুত রোগে আক্রান্ত রুস্তম আলির বাড়িতে বিচিত্র সব মানুষ বসবাস করে। যাদের কাউকেই রুস্তম চেনে না। যেমন- তার ছবি আকার শিক্ষক নেশাগ্রস্ত হোসেন মিয়া ছবি আকা শেখানোর নাম করে তার বাড়িতে আরাম আয়েশে বসবাস করে, হাসপাতালের আয়া অসম্ভব রূপবতী মুনিয়া সেবার নামে তার বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া।
হোসেন মিয়ার এখন অন্যতম আগ্রহ মুনিয়া মেয়েটার একটা নগ্ন পোট্রেট আকবেন। সহজ-সরল, খামখেয়ালি মুনিয়ার একমাত্র লক্ষ হল যেকোনো ভাবে রুস্তমের সামনে যাওয়া। অধিকাংশ সময় মধ্যরাতে পাতলা ফিনফিনে গাউন পড়ে রুস্তমের ঘরে যেয়ে স্যার আপনার কিছু লাগবে কি না? এই কথা বলে বিব্রত করা। আরো বিচিত্র উদ্ভট সব মানুষ রুস্তমের বাড়িতে থাকে। যেমন:- ফিটবাবু, যে সবসময় স্যুট- টাই পরিধান করে থাকে, রুস্তমের ড্রাইভার, বাবুর্চী মরিয়ম, যে কথায় কথায় পাক কোরআনের কসম খায়। ভাড়াটে খুনি বিরানী ছগির, কোন এক বিচিত্র কারনে সে বিরানী ছাড়া কিছু খায় না এবং খুব সস্তায় মানুষ খুন করে। তার এখন প্রধান কাজ পাগলা তেল মালিশ করে রুস্তমের পাগলামি দূর করা।
akti cycle abong koyekti dahuk Pakhi pdf download⤵️ link
বাস্তব আর কল্পনার জগৎকে মিলিয়ে ফেলা রুস্তম অদ্ভুত সব বিষয়ে আচ্ছন্ন থাকেন। যেমন কখনো দেখেন লাঠি পড়ে গেলে মুসা আলায়হেস (সা:) এর লাঠির মতে সাপ হয়ে যায়, আবার কখনো দেখেন তার কবিতার বইয়ের প্রচ্ছদে সাইকেলের ছবিতে কয়েকটা ডাহুক পাখি বসে থাকার ছবি থাকলেও তারা একসময় নিচে নেমে চা খাচ্ছে। এমন অদ্ভুত সব বিষয়। এমন চমৎকার সব চরিত্র নিয়েই এই উপন্যাস।মোটকথা এই উপন্যাসে হুমায়ূন আহমেদ বলতে চেয়েছেন অসংলগ্ন কল্পনার মানুষকে আমরা কিভাবে দেখি, সমাজ তাদেরকে কিভাবে মূল্যায়ন করে। সবকিছু মিলিয়ে এই উপন্যাস এক নিঃসঙ্গ মানুষের হাহাকার, পিতা- পুত্রের ভালোবাসা,একজন সন্তানের পাগল বাবার প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধা। কিছু স্বার্থপর মানুষের চলে যাওয়া আবার কখনোবা দিনশেষে কিছু মানুষের ফিরে আসা। কখনো এক মানুষ অন্য মানুষের আশ্রয়দাতা হিসেবে এগিয়ে আসা। সবকিছু মিলিয়ে এক অন্যকরকম ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ।
কাহিনী সংক্ষেপ:
গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র রুস্তম অালি দেওয়ান। যিনি রু অাদে ছদ্ম নামে একটি কবিতার বই বের করেছেন অার দ্বিতীয় চেষ্টা হিসেবে একটা উপন্যাস শুরু করছেন। সাধারন মানুষের কাছে কিছুটা অপ্রকৃতস্থ এ রু অাদে নিঃসঙ্গ একজন মানুষ। বাবা জেলে, মায়ের খুনের অভিযোগে। প্রতিবার জেল থেকে তিনি ছেলেকে চিঠি লেখেন তার জামিনের ব্যবস্থা করার জন্য।
স্ত্রী, পুত্র তাকে রেখে অালাদা হয়ে গেছেন তার অপ্রকৃতস্থ অাচরনের কারনে। ধূর্ত শ্বশুড় অাছে সম্পত্তি হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টায়।
একমাত্র বোন অার দুলাভাইয়ের সাথে কিছুটা যোগাযোগ অাছে। কিন্তু দুলাভাইয়ের ব্যবসায়িক ব্যস্ততা বোনের ছোট্ট সংসার জীবনে, বোনের কাছে যেন দায়িত্বের অবহেলা মনে হয়, তাই তার বন্ধুর সাথে চলে যায়। এদিকে বোন অার দুলাভাই দু’জন দু’জনকে শায়েস্তা করার জন্যই রুস্তমের সাথে পরামর্শ করে। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে একা থেকেও রুস্তমের বাড়িতে লোকজন ভর্তি। নানা বয়সের নানা পেশার কয়েকজন লোক থাকে তার বাড়িতে। অথচ এদের কাউকেই সে ঠিকমত চেনে না। অার্ট শিক্ষক হোসেন মিয়া, ফিটবাবু বা মুনিয়া মত অসম্ভব সুন্দর মেয়ে কী করে তার বাড়িতে এল, তা তারা জানা নেই। হয়ত নিজেই নিয়ে এসে ভুলে বসে অাছে কিংবা অন্য কেউ নিয়ে এসেছে। এসব উটকো মানুষে বাড়ি ভর্তি থাকার কারনে দুলাভাই অতিষ্ট হয়ে তাদের বাড়ি থেকে বের করে দেয়। অাবার ঘটনাচক্রে একে একে ফিরেও অাসতে থাকে।
epileptic seizure এ অাক্রান্ত রু অাদে সাহেব, বাস্তব অার কল্পনার জগৎটাকে প্রায় সময়ই মিলিয়ে ফেলেন। কখনো বা মনে হয় তার একমাত্র ছেলে তার পাশে বসে গল্প করে, কবিতা শুনে, ছবি অাঁকে। অাবার কখনোবা মুনিয়ার সাথে অনেক কথা হয়। চোখ বুজে স্পর্শ নেওয়ার চেষ্টা করেন। তার কল্পনা অার বাস্তব জগৎ ঘিরে বসবাস করা এইসব মানুষদের নিয়েই এ গল্প।
নিজস্ব মতামত:
কিছু কিছু মানব মনের কল্পনা হয়ত সাধারন মানুষের কাছে অসংলগ্নতার মত। তাদের থেকে দূরত্ব স্থাপন করে পাগল নামে অভিহিত করেই অামারা খালাস। অথচ তাদের প্রতিভার মূল্যায়ন কখনো করার চেষ্টা অামরা করিনা। বেশ ভালো লাগছে বলব না তবে একদম খারাপ লাগেনি বইটা। নিঃসঙ্গ এই মানুষ গুলোর মানসিক অবস্থা বোঝার জন্য তাদের একটু ভালোবাসার মত মানুষের জন্য সে হাহাকার লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন সেদিক থেকে বিবেচনায় ভালো ছিল বইটা।