ইলাল উখতিল মুসলিমা – কেন পড়বেন? লেখক : মাজিদা রিফা | Ilal Ukhtil Muslima : Majida Rifa

মুসলিম বোনের প্রতি’ জীবন ও জগৎজুড়ে অসংখ্য গল্প। নারীর জীবনজুড়ে যত গল্প, তার সবচেয়ে উৎসাহী পাঠক হয় তার বোন। কী শৈশব, কী কৈশোর, সংসার, সন্তান, সমাজ নিয়ে জীবনযুদ্ধের ময়দান; সবখানেই একজন বোনের মতো দরদি শ্রোতা কোথায় পাওয়া যায়! কে আছে বোনের মতো যে জীবনের ফেলে দেয়া পাণ্ডুলিপি তুলে এনে সুন্দর পরামর্শ দিয়ে সহজ রাস্তার রঙিন ছবি এঁকে দেয় ধূসর কাগজে।
এর কারণ হয়তো এই যে সমাজ ও পরিবেশে একটি কন্যাসন্তান বেড়ে ওঠে, ঠিক একই প্রাপ্তি ও প্রতিকূলতা নিয়ে নারী হয়ে ওঠে তার বোনটিও। ‘ইলাল উখতিল মুসলিমা’ বইটি বলছে তার দৈনন্দিন জীবনের বোধ ও অস্তিত্বের গল্প। আহ্বান করছে এক অসীম অালোক উন্নত জীবনের দিকে, যেখানে নারী পুরুষ নির্বিশেষে সুশোভিত হয়ে আছে রবের দেওয়া অনন্য এক মর্যাদায়। সৃষ্টির সেরা মর্যাদা। রব বলেন, যারা ইমান আনে ও সৎকর্ম করে, তারাই সৃষ্টির সেরা।
অতি ক্ষুদ্র এ পৃথিবীর পরমাণু বিষয়-সমস্যা নিয়ে মানুষজাতির যে জীবন, সে ছোট্ট, অতি ছোট্ট জীবনের ক্ষুদ্রতার মাধ্যমেই এ মহাবিশ্বের লক্ষ কোটি সৃষ্টির সেরা হওয়ার কুরআনি প্রচেষ্টা হলো— ‘ইলাল উখতিল মুসলিমা’

  • বই : ইলাল উখতিল মুসলিমা
  • লেখক : মাজিদা রিফা
  • প্রকাশনী : প্রত্যয়
  • বিষয় : ইসলামী জ্ঞান চর্চা, ইসলামে নারী,
  • আত্মশুদ্ধি ও অনুপ্রেরণা
  • পৃষ্ঠা সংখ্যা: ৩০৪
  • হার্ড কভার
অর্পন…
নক্ষত্রের সঙ্গ ছেড়ে রাত নেমে আসতেই বুকের পাঁজরে আওয়াজ তোলে পরিযায়ী পাখির জীবন। চুলের ফিতা, ভাতের হাড়ি সরিয়ে রেখে তাকিয়ে দেখি মাথার ওপর আকাশ নেই। আমার ঘরজুড়ে তোমার জানালা। যেদিকে পালাই তোমার মেঘ। তুমিও তাকিয়ে দেখো রহমতের মতো মেঘে ভাসে তোমার জীবন। আমাদেরও ইচ্ছে করে নক্ষত্রের চিহ্ন খুঁজে পাখির মতো ফিরে যাই রবের শহরে।

প্রিয় হাদিল সালাহ হাশলামুন, আপনার মকবুল শাহাদাতের প্রার্থনায় সমৃদ্ধ হোক আমাদের জীবন। মাজলুম বোন ড. আফিয়া সিদ্দিকি, আপনার নামে আন্দোলিত হোক আমাদের সুবাসিত ভোরগুলোর বুনিয়াদ।
সন্ধের বুকের কাছে দাঁড়িয়ে আছে এক টুকরো মলিন অন্ধকার। এই সময় অদ্ভুত এক বিষণ্নতা পেয়ে বসে আমাকে। স্মৃতিগহ্বরে হু হু করে ইকো শোনায় অতীত। আহা, সেই সব ওড়াওড়ির দিন। কুয়াশায় আচ্ছন্ন সকাল, মিঠে রোদের দুপুর আর নিঝুম সন্ধ্যার পর বাইরের উঠানে দাঁড়িয়ে বিস্ময়াভিভূত হয়ে দেখতাম, নিস্তব্ধ রাত গ্রামটির গায়ে মেখে দিয়েছে অনন্ত বিশ্বলোকের জ্যোতির্ময় শব্দহীন বার্তা। সে ছবি বুকের ভেতরের প্রতিটি লহরে কেমন অদ্ভুত ভালোলাগা আর অলৌকিক শান্তি ছড়িয়ে দিতো, তা আজও চোখ বন্ধ করলে উপভোগ করা যায়। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, সে জীবনটা এখন আর কিছুতেই খুঁজে পাই না। 
একটি দেহে দুটি মানুষের আত্মা বসবাসের একটি গল্প পড়েছিলাম। ইদানীং নিজেকেও তাই মনে হয়। একই দেহে দুজন মানুষ বেঁচে আছে। একজন খাচ্ছে, ঘুমুচ্ছে, জানালার কাচে ধুলো জমলে পরিষ্কার করছে, বাচ্চাদের খাবার তৈরি করছে, পরিবারের সাথে হাসিমুখে গল্প করছে, আর অন্যজন…! অন্যজনের পৃথিবী একদমই অন্যরকম। সেখানে দিবানিশি শোনা যায় এক ভয়ংকর চিৎকার, দাজ্জালের পদধ্বনি, ফেতনার প্রলয়, সিরিয়ার রক্তক্ষরণ; আর দিনেরবেলা ইয়ামানের ক্ষুধার্ত শিশুদের ছবি দেখে রাতে পূর্ণিমা চাঁদকে তারও ঝলসানো রুটি বলে মনে হয়। কেন যেন তার পড়া সকল কবিতার নাম হয়ে ওঠে দুঃখ। অকারণে সহজ-সরল হাসিমুখগুলোও হয়ে ওঠে তার বিরক্তির কারণ। পৃথিবীকে তার ভীষণ ভয়ংকর বলে মনে হয়।
এক অদ্ভুত সময় উপস্থিত হয়েছে সময়ের দোরগোড়ায়, অনুমতির তোয়াক্কা না করে ঢুকে পড়েছে পৃথিবীর অন্দরে। যেভাবে পথনির্দেশক রাতের তারা দিন হলে সূর্যের জাঁকজমকে হারিয়ে যায় আকাশের নীল রুমালে, ঠিক সেভাবে দুনিয়ার জাঁকজমকে হারিয়েছে মানুষের জীবনবোধ, জীবনের মাকসাদ। দিশেহারা মুসাফিরের তাই কেবলই মনে হতে থাকে কোন পথ সিরাতে মুসতাকিম আর কোন পথ শয়তানের কালো প্রাসাদে গিয়ে পৌঁছেছে, কাফেলার কেউ আর তা জানে না। 
যারা ছিলেন উম্মাহর পথপ্রদর্শক, তাদের অধিকাংশের একে একে চলে যাওয়ার পর নির্দিষ্ট যে পথটি ছিল চিরপরিচিত, বিভিন্ন মানহাজের বহুরূপী মানদণ্ডের আঁকিঝুঁকিতে তাতে হঠাৎ যেন তৈরি হয়েছে অসংখ্য বাঁক। ঠিক কোনদিকে যে মোড় নিতে হবে, কোন বাঁকটা যে গন্তব্যে পৌঁছে দেবে তা নিয়ে উম্মাহ হয়ে পড়েছে দ্বিধাবিভক্ত! একটা সময় সালাফদের পদরেখা অনুসরণ করেই খালাফরা মানুষের জীবনের সফর আরও সমৃদ্ধ, আরও তথ্যবহুল করার চেষ্টা করেছেন; যে কারণে উম্মাহর ফিকহি ইখতেলাফগুলো রহমতরূপে গণ্য করা হতো। কিন্তু এখন ইখতেলাফ পরিণত হয়েছে ইফতিরাকে।
ইখতেলাফ-মতভেদের ব্যাপারে আল্লামা কুরতুবি রহ. ও আল্লামা সুয়ুতি রহ. নবিজির এ হাদিস বলেন : “আমার উম্মতের মতভেদ রহমতস্বরূপ।’ আর ইফতিরাক-বিচ্ছিন্নতা ও বিভক্তি সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,

“তোমরা তাদের মতো হয়ো না, যারা তাদের নিকট স্পষ্ট নিদর্শন আসার পরে বিচ্ছিন্ন হয়েছে এবং মতভেদ করেছে, তাদের জন্য রয়েছে মহা শাস্তি।

মতভেদ মানবীয় প্রকৃতি। সোনালি যুগের সমাজ, রাষ্ট্র, এমনকি সাহাবিদের মাঝেও মতভেদ ছিল। সাহাবিদের যুগ থেকে মুসলিম উম্মাহর ইমাম ও আলেমদের মধ্যে মতভেদ বা ইখতেলাফ ছিল, কিন্তু তাঁদের মধ্যে দলাদলি, বিচ্ছিন্নতা বা ইফতিরাক ছিল না। পূর্ববর্তী ফকিহদের মতভেদ উন্মাহকে প্রশস্ততা দান করেছে এবং তাদের মতভেদের কারণেই উম্মাহ সঠিক ও সহজ পন্থায় দ্বীন পালন করতে পারছে। তাদের পথ ছিল ভিন্ন, কিন্তু মঞ্জিল ছিল এক। দুনিয়াবি শান-শওকত, মান সম্মানের কোনো সম্পর্ক তাদের ইখতেলাফের সাথে জড়িত ছিল না। হাদিসে বর্ণিত প্রকৃত উম্মাহ তারাই। কিন্তু বর্তমান যুগে নামধারী কিছু মুজতাহিদ উম্মাহর বহুরূপী ইফতিরাক ইখতেলাফের নামে ফেতনার বাহনে পরিণত হয়েছে। এই ইখতেলাফ/ইফতিরাকের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে সাধারণ মানুষের হয়েছে দলছুট শাবকের অবস্থা। রাসুলের উম্মতের তেয়াত্তর মিল্লাতে বিভক্ত হওয়া এবং একটি ছাড়া সবগুলোর জাহান্নামি হওয়ার হাদিস আমরা জানি। কিন্তু কোন দলটা যে আল্লাহর রাসুলের বর্ণিত ‘মা আনা আলাইহি ওয়া আসহাবি’, তা জানা আমাদের জন্য কঠিনই বটে।
বিগত শতাব্দীর আলেমগণ উপমহাদেশে দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য যে অসামান্য খেদমত আঞ্জাম দিয়ে গেছেন, তার রূপ ও মাকসাদ ধরে রাখার চেষ্টায় বর্তমান সময়ের আলেমগণ এখনো সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। কিন্তু শিক্ষিত শ্রেণির সাধারণ মানুষ ফেতনার জালে এমনভাবে জড়িয়ে আছে যে, আলেমদের কাছে দ্বীন শেখার ও বুঝার পরিবর্তে তারা আলেম-উলামাসহ অন্যদের উপর কাদা ছোড়াছুড়িতেই বেশি ব্যস্ত। ফলে বিশৃঙ্খলার জাল ছিন্ন করে নতুনের সাথে পুরাতনের, আলেমের সাথে আওয়ামের তেমন সেতুবন্ধন তৈরি হচ্ছে না। এদিকে মুসলিম সমাজের বড় একটা অংশ নামে মুসলিম হলেও আদতে দ্বীনের মৌলিক বিধান ব্যতীত কোনো বিষয়ে তাদের জ্ঞান নেই। আর মৌলিক বিধানের জ্ঞান থাকলেও আমল নেই। তাদের কাছে নিজের বর্তমান অবস্থান থেকে আরেকটু ভালোভাবে বেঁচে থাকার নামই জীবন। আর তাদের সন্তানের জন্য পাশ্চাত্যের অনুকরণে লেটনাইট পার্টি, বন্ধু, আড্ডা, ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, স্নাপচ্যাট, ফেইক লাক্সেরিয়াস লাইফের শো অফ ইত্যাদির নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে জীবন। আবার উঠতি প্রজন্মের একটা অংশ নৈরাজ্যবাদে আক্রান্ত। নিহিলিস্টদের জীবনের বিশেষ কোনো অর্থ, গুরুত্ব বা উদ্দেশ্য নেই। নৈতিকতা এবং নীতিগত মূল্যবোধ নেই। দিনশেষে সকল সমাজসৃষ্ট নীতিবিদ্যাই তাদের কাছে বিমূর্ত এবং অকার্যকর। তাদের কাছে জীবন একটা কৌতুকের মতো। দ্বীনের প্রতি উদাসীন জীবন তারা কতদূর টেনে নিয়ে যাবে কে জানে, কিন্তু এ ব্যাধির পরিণতি কী হতে পারে তা যেহেতু মুসলিম বিশ্বের বর্তমান অবস্থার দিকে তাকালেই দেখতে পাওয়া যায়; আমরা ভয় পাই। এ সমাজে যে বাস করি আমিও, বাস করে আমার সন্তানটিও!
দ্বীন মেনে চলার চেষ্টা করেন এমন মানুষ সমাজে আছেন প্রচুর। কিন্তু তারাও তো একরকম বিচ্ছিন্ন। যেমন : কেউ আছেন দ্বীন জানেন, দ্বীনের শিক্ষা আছে, নামাজ-রোজা আদায় করেন, ক্ষেত্রবিশেষে সুন্নাহর অনুসরণও করেন, কিন্তু দ্বীনের প্রতিষ্ঠা নিয়ে কোনো ভাবান্তর নেই। তাদেরকে স্রেফ আলসে বলা গেলেও কেউ কেউ নিজের অজান্তে সাহিত্যচর্চা ও ক্ষেত্রবিশেষে মডার্নিজমের নামে সেকুলারিজমের জালে আটকে গেছেন বলেই প্রতীয়মান হয়, যেন তাদের কোনো পরিচয় নেই। না এখানকার, না ওখানকার। নিজের আত্মাটা যে ঠিক কোথায় আছে, তারা নিজেরাও হয়তো জানেন না।
আরও আছেন শান্তিবাদী মুসলমান। ইসলাম যদিও শান্তিরক্ষার ধর্ম, কিন্তু কথিত শান্তিবাদের ব্যাখ্যা আলাদা। তারা ‘ইসলাম’ শব্দের অর্থ ‘শান্তি’ মনে করেন। মুসলিম-কাফের সবাইকে খুশি রাখতে চান। জিহাদকে জঙ্গিবাদ আখ্যা দেন। রাসুলকে মনে করেন এমন এক ব্যক্তি, যিনি শুধু দাওয়াত ও হেকমতের মাধ্যমে মদিনারাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ধরে রেখেছিলেন। এদের মধ্যে যারা কাজ করছেন, কেউ শুধু দাওয়াতকেই দ্বীন প্রতিষ্ঠার একমাত্র হাতিয়ার বানিয়ে নিয়েছেন আর কেউ ইসলামি হুকুমত কায়েমের অন্যতম হাতিয়ার জিহাদ-কিতাল বাদ দিয়ে গণতান্ত্রিকভাবে ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। কিন্তু বিগত শতাব্দীর ইসলামি গণতান্ত্রিক দলগুলোর ইতিহাস পর্যালোচনা করলেই বেরিয়ে আসে, যতক্ষণ না তারা প্রান্তিক ইসলাম বাদ দিয়ে সামগ্রিক ইসলাম আঁকড়ে ধরছেন, তাদের কষ্ট ও সমস্ত শ্রম অনর্থক! তারা রাসুলের প্রকৃত আদর্শ বাদ দিয়ে ‘সুদূরপ্রসারী’ চিন্তার দোহাই দিয়ে তাগুতের পা চাটা গোলামে পরিণত হচ্ছেন এবং পরিস্থিতির যাঁতাকলে আপন কথা ও কর্মের বদৌলতে দিন যাচ্ছে, ততই নিজের গলদেশ থেকে গোলামির এ জিঞ্জির খুলে ফেলার সমস্ত কড়া সিলগালা করে ফেলছেন।
আর যারা আছেন তারা হলেন প্রকৃত আলেম ও ময়দানের মুজাহিদ; যারা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঠিক আদর্শ লালন করেন, তাঁর প্রকৃত আদর্শ সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল। দাওয়াত, জিহাদ ও মেহনতের মাধ্যমে খেলাফত প্রতিষ্ঠা বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বড় দাবি তা জানেন ও মানেন। মিডিয়ার আগ্রাসী ছোবল ও সুযোগের অভাব থাকার পরও যতটুকু সম্ভব যে যার অবস্থানে কাজ করে যাচ্ছেন। নেতৃত্বশূন্য এ পৃথিবীর প্রায় শতবর্ষ পূর্ণ; তাই একজন নেতার আশায় পথ চেয়ে আছেন। যারা জিহাদ করছেন না, তারা জিহাদের আকাঙ্ক্ষা বুকে লালন করছেন। উম্মাহকে লেখা ও বক্তৃতায় কাফেরদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সতর্ক করছেন। তারাই রাসুলের প্রকৃত অনুসারী। শয়তান কোনোদিনই সংশোধনযোগ্য নয়। আর শয়তানের অনুসারী মানুষ নামের কিছু দানবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ব্যতীত পৃথিবীতে শান্তি স্থাপন সম্ভব নয়। তাই সময় এলে তারাই হয়ে উঠবেন হযরত মাহদি ও নবি ইসা আলাইহিস সালামের সহযোগী; কিন্তু সাধারণ মানুষ তাদেরকে চেনার চেষ্টা করে কম। আর বিভ্রান্তির এ পৃথিবীতে তাদের অনুসরণ করা আরও কঠিন।
তাই বর্তমান সময়ের মুসলিম তরুণ প্রজন্ম সবাই যার যার মতো। কেউ কারও নয়। কেউ কারও ব্যাপারে সন্তুষ্টও নয়। কেউ কারও কাছে সঠিকও নয়। একে অপরকে কাফের, খারেজি, আশআরি মাতুরিদি, মুরজিয়া, মাদখালি, মডারেট ইত্যাদি ট্যাগ দিচ্ছে আর সবাই নিজের বুদ্ধিতে সন্তুষ্ট হয়ে বসে আছে। অন্যের ওপর ভরসা নেই। সকলে মিলে এক হওয়ার কোনো বাসনা নেই। দ্বীনি হুকুমত কায়েমের স্বার্থে দলান্ধ বিতর্ক ছাড়ার কোনো ইচ্ছা নেই। অতএব পৃথিবীর বুকে আন্দোলন করতে থাকা এ সময়কে অদ্ভুত না বলে উপায় কী! আর এই অদ্ভুত অস্থির সময়ের ভেতরে দাঁড়িয়েই আমি ভাবছি আমার কথা। 
আমি অতি ক্ষুদ্র, অতি তুচ্ছ এক সাধারণ মানুষ। নারী আমি — যে নিতান্তই একজন গৃহিনী। যার তুচ্ছ ভাবনার সাথে পৃথিবীর প্রকৃতির হয়তো কোনো মিল নেই। কিন্তু আমি তো বেঁচে আছি এই পৃথিবীতেই। বেঁচে আছি আমার সংসার নিয়ে। আমার বাবা-মা, স্বামী-সন্তান নিয়ে। অন্তত এটুকু তো দেখতে পাচ্ছি, ইসলামের মজবুত কোনো দুর্গ এ পৃথিবীতে নেই, খিলাফাহ নামের কোনো সুরক্ষা প্রাচীর নেই। সুতরাং কাফের দস্যুরা যে দশা করেছে ইরাক, সিরিয়া, বার্মা, ফিলিস্তিন ও ইয়ামানে, তা যে আমার নগরীতেও ঘটবে না, আমার ঘরও যে ধসে যাবে না, আমার সন্তানও যে ভুখা মরবে না, তার নিশ্চয়তা কে আমাকে দেবে! [আল্লাহুম্মাহফাজনা ফাইন্নাকা খাইরুল হাফিজিন!] তাও পৃথিবীর
দুঃখ-দুর্দশা আমরা মেনে নিতে পারি, কিন্তু অসুস্থ এ পৃথিবীতে বসবাস করে আমি ও আমার প্রিয়জনরা যে সুস্থ দেহ-মন নিয়ে চিরকালের জগতে ফিরে যেতে পারব তার নিশ্চয়তা আমাকে কে দেবে?
অন্তহীন জগতের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশঙ্কায় আমার বুকের ভেতর বইতে থাকে পরিচিত প্রশ্নের দ্রোহী লাভা — আমি কি সমাজের বিভ্রান্ত আসনজুড়ে অকর্মার পুতুল সেজে পড়ে থাকব আজীবন? আল্লাহ তাআলা তো আমাকে প্রাণ দিয়েছেন। আমি তো জন্মেছি এই সময়ে। আমি এক নারী বলে সমাজের এ দুর্গতি, এ অন্ধকারে আমার কি কোনো কাজ নেই? পৃথিবী সংশোধনের দায়িত্ব কি শুধু আলেমগণের ওপর? সাধারণ মানুষের কি কোনো দায়িত্ব নেই? সমাজ সংশোধনের সব দায়িত্ব আলেম-উলামার; আর আমি সাধারণ বলে আমার কোনো দায় নেই এ তো ইনসাফের কথা নয়। আমিও তো মুসলিম। 
সমাজ থেকে তো বিচ্ছিন্ন নই আমি। বিচ্ছিন্ন কোনো প্রজাতিও নই। আমার অবস্থান অনুযায়ী আমাকেও তো করতে হবে কোনো না কোনো কাজ। রাষ্ট্রের ভিক্ষুক থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত সকলের সাথে অসংখ্য অদৃশ্য বন্ধনে বেষ্টিত আমার নারীসত্তাও। সমাজের প্রতিটি স্তরে জড়িয়ে আছে নারীর রান্নাঘর, থালা-হাড়ি-বাসন, চুলের ফিতা, চোখের কাজল, বারান্দার টবে ফোটা গোলাপ ফুল। নারী ঘরের রানি, পদচারণা তার ঘরের ভেতর হলেও বিচরণ তো জগৎজুড়ে। পিতার পাঠশালায়। ভাইয়ের চিন্তায়, অনুপ্রেরণায়। ছেলে-মেয়ের বেড়ে ওঠায়। স্বামীর কর্মে, কারখানায়। হ্যাঁ, আমি একজনই। অস্তিত্ব আমার একটাই। তাতে কী, জীবনও তো আমার একটা। যুগও আমার একটা। সময়ও এই একটাই; যা এই মুহূর্তে তরতর করে বয়ে যাচ্ছে। 
সুতরাং আমার কাজ আমাকেই করতে হবে। যা আমি করব এ জীবনে করব। এ সময়ে করব। এরপর আমার জন্য আর কোনো যুগ আসবে না, কোনো সময় আসবে না। আমার সময়ে আমার সমাজের জন্য যা করণীয়-বর্জনীয় তা যদি না করি তবে শেষ বিচারে কী নিয়ে দাঁড়াব? নিষ্কর্মা জীবনের কি কোনো অর্থ থাকবে? পৃথিবীতে এলাম, খেলাম, ঘুমালাম, সাজ-গোজ করলাম, ঘর গোছালাম, তারপর একদিন চলে গেলাম; এই হতে পারে৷ এই-ই তো হচ্ছে। নিশ্চিন্ত জীবন, কিন্তু চলে যাওয়ার পর কী হবে? যাওয়াটা ঠিক কোথায় হবে? সেখানে নিশ্চিন্তে খেতে পারব তো? আনন্দে থাকতে পারব তো? কী অপেক্ষা করছে মনজিল শেষে? পুরস্কার নাকি যন্ত্রণা? সুসংবাদ নাকি লাঞ্ছনা?
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?