
“সা‘ঈদ আল-খাতির” বইতে ইবন আল-জাওযি কিছু অসাধারণ কথা বলেছেন:
“অনেক ‘আলিমকেই কাছ থেকে দেখেছি। উনাদের একেক জনের জ্ঞানের গভীরতা ছিল একেক রকম। তাঁদের পারিপার্শ্বিক অবস্থাও ছিল ভিন্ন। এঁদের মধ্যে যাঁরা তাঁদের জ্ঞানানুযায়ী কাজ করেছেন তাঁদেরকেই আমার কাছে সবচেয়ে কল্যাণকর মনে হয়েছে। অন্যান্য অনেক ‘আলিমদের থেকে হয়তো তাঁদের জ্ঞান কম ছিল, কিন্তু তারপরেও এঁদেরকেই সবচেয়ে ভালো মনে হয়েছে।
হাদীস বিশেষজ্ঞ একদল বিদ্বানদের সাথে একবার দেখা হয়েছিল। তাঁরা অনেক হাদীস মুখস্থ করেছিলেন; এবং এগুলোর অনুপুঙ্খ বর্ণনাতে পারদর্শী ছিলেন। কিন্তু এরপরও তাঁরা জার্হ ও তা‘দিল (বর্ণনাকারীদের সমালোচনাবিদ্যা)-এর অজুহাতে পরনিন্দাকে অনুমতি দিতেন। অর্থের বিনিময়ে হ়াদীস় বর্ণনা করতে তাঁরা। (লোকের চোখে) নিজের সম্মান ও মর্যাদা হারানোর ভয়ে তড়িঘড়ি করে তাঁরা বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতেন। এমনকি যদি সেই উত্তর ভুল হতো, তবুও।
‘আবদ আল-ওয়াহহাব আল-আনমাতি নামের একজন ‘আলিমকে পেয়েছিলাম, যাঁর আচারব্যবহার ছিল পূর্বসূরিদের (সালাফ) মতো। হাদীস বর্ণনার জন্য তাঁর জমায়েতগুলোতে কখনোই অন্যের দুর্নাম শোনা যায়নি। অর্থের জন্য তিনি কখনো হাদীস শোনাননি (বা বর্ণনা করেননি)। তাঁকে যখন আমি কোনো প্রাণজুড়ানো হাদীস শোনাতাম তখন তাঁর চোখ বেয়ে জলের ধারা দেখতে পেতাম। তাঁর এই চোখের পানি আমার মনকেও আবেগাপ্লুত করে তুলত—তখন ছিলাম কৈশোরে; ক্ল্যাসিকাল বইগুলোতে আমরা ‘আলিমদের যেসব বর্ণনা শুনতাম তিনি ছিলেন ঠিক তেমনই।
আরও একজন শাইখ ছিলেন, তাঁকেও খুব ভালো লাগত: আবু মানসুর আল-জাওয়ালিকি। বেশ কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের জন্য আলাদা একটা খ্যাতি ছিল তাঁর। তিনি ছিলেন অল্প কথার মানুষ। কথা বলার মধ্যে বেশ সতর্কতা অবলম্বন করতেন। তাঁর জ্ঞান ছিল নির্ভুল। শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে সত্যতা বজায় রাখতেন। কখনো কখনো তাঁকে এমন কোনো প্রশ্ন করা হতো যার উত্তর হয়তো একটা বাচ্চাও জানে, কিন্তু এরপরও তিনি হুটহাট কোনো উত্তর দিয়ে বসতেন না। যতক্ষণ না তিনি উত্তরটার (সঠিকতার) ব্যাপারে নিশ্চিত না হচ্ছেন, ততক্ষণ কোনো কথা বলতেন না। অনেক সিয়াম পালন করতেন। নীরব থাকতেই বেশি পছন্দ করতেন তিনি।
অন্য যেকোনো ‘আলিমদের চেয়ে এই দুজন ‘আলিমের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয়েছি। তাঁদের আচার-আচরণ ও ব্যবহার থেকে বুঝতে পেরেছি যে,
“শুধু কথা বলে বলে মানুষকে যতটা দিকনির্দেশনা দেওয়া যায়, তার চেয়ে বেশি দেওয়া যায় নিজের কাজের মাধ্যমে। এটা মানুষকে আরও বেশি অনুপ্রাণিত করে।”
এমন অনেক ‘আলিমদের দেখেছি, যাদের নির্জনতা অবলম্বন ছিল নিছক খেলতামাশা। ফলে এগুলোর প্রতিই তাঁদের মন ঝুঁকে গিয়েছিল। যে জ্ঞান তাঁরা অর্জন করেছিলেন তার সবই নষ্ট হয়ে গেছে। তাঁরা যতদিন জীবিত ছিলেন, খুব কম লোকই তাঁদের দ্বারা উপকৃত হয়েছেন। মৃত্যুর পর তাঁরা হয়ে পড়েছেন বিস্মৃত। তাঁদের লেখালেখি আর কাজ লোকে আর মনে রাখেনি।
এজন্য বলি,
“জ্ঞান প্রয়োগের ক্ষেত্রে আল্লাহকে ভয় করুন। কারণ আল্লাহ-ভীতিই সবকিছুর মূল বুনিয়াদ। সবচেয়ে নিঃস্ব তো সেই লোক, যে-লোক জ্ঞান অর্জনের পিছে নিজের জীবনকে ‘নষ্ট’ করেছে। কেননা, সে তাঁর অর্জিত জ্ঞান অনুযায়ী কাজ করেনি। ফলে সে এই দুনিয়ার সুখ থেকে যেমন বঞ্চিত হয়েছে, তেমনি হারিয়েছে পরকালের শান্তি। সর্বস্বান্তের মতো পরকালের পথে যাত্রা শুরু করে সে: নিজের কৃতকর্মের বিরুদ্ধে প্রমাণের বোঝায় জর্জরিত একজন।”
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?