কেমন হতো, যদি এমন কিছু আসলেই ঘটতো? যে বই পড়ছি, তার ভেতরে গিয়ে সকল চরিত্রের সঙ্গী হলে মন্দ হয় না বোধহয়। কিন্তু বাস্তবে যে এমন কিছু সম্ভব নয়। তাতে কী? কল্পনায় তো হারিয়ে যাওয়া যায়! বইয়ের মাঝে, চরিত্রগুলোর সাথে।
▪️কাহিনি সংক্ষেপ :
নিশ্চিন্তপুরের মানুষজন কোনো ঝুট ঝামেলা ছাড়াই নিশ্চিন্তে দিন কাটায়। এই শান্ত শহর অবশেষে অশান্ত হলো। একে একে তিনজনের নিখোঁজ হয়ে যাওয়া ভালো লক্ষণ না। যেই শহরে সামান্য চুরির মতো অপরাধ ঘটে না, সেই শহরের একজন ছাত্র আর দুইজন শিক্ষকের হারিয়ে যাওয়া বড়ো ঘটনা বটে! এ নিয়ে ঘুম হারাম শহরের বাসিন্দাদের। এর পর কার পালা?
শহরে নতুন বইয়ের দোকান হয়েছে। একজন বুড়ো মতন মানুষ চালায় দোকানটা। তার বয়স আন্দাজ করা শক্ত। সব ধরনের বইয়ের সমাহার সেখানে। কোনো বই না থাকলেও কীভাবে কীভাবে যেন মিলে যায়! আর মিলিয়ে যায়…. থাক! সে বিষয় পরে আলোচনা করা যাবে।
মুশফিক উজ জামান চৌধুরীর ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ে। মুশফিক নামটা ছোটো করে মশা বলেই ডাকে বন্ধুরা। মুশফিকের রাগ হয় খুব। তবুও ছোটো মামা যে কেন ডাকে! শহরের নিখোঁজ হওয়া রহস্যের সমাধান করতে চান রঞ্জুমামা। সাথে ভাগনে মশা। হবে কি এর সমাধান? না কি নতুন কোনো অভিজ্ঞতা অপেক্ষা করছে তাদের জন্য?
নিশ্চিন্তপুর শহরে নতুন আরেক রহস্যময় চরিত্রের আবির্ভাব। নাম খিজির আলী। কালো আলখাল্লা পরনে। মাথায় টুপি, চোখে রোদচশমা। যেই চশমা রাতের অন্ধকারেও খুলে না। মামা-ভাগনে গোয়েন্দা যুগলের সন্দেহের তীর তার-ই দিকে। বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে শহরে খিজির আলী-ই কি আসল কালপ্রিট? বোঝা যাচ্ছে না।
▪️পাঠ প্রতিক্রিয়া :
“অদ্ভুতুড়ে বইঘর” লেখক শরীফুল হাসানের ফ্যান্টাসি ঘরানার কিশোর উপন্যাস। বাংলা সাহিত্য কিশোর উপন্যাসে দারুণ সমৃদ্ধ হলেও বর্তমান সময়ে শিশুকিশোরদের জন্য মানসম্মত লেখা খুব একটা পাওয়া যায় না। এদিক দিয়ে “অদ্ভুতুড়ে বইঘর” উপন্যাসিকা সত্যি অসাধারণ বলতেই হয়। আমি অনেক আগে থেকেই লেখক শরীফুল হাসানের বর্ণনার ভক্ত। এই বইয়েও লেখক সেই মুগ্ধতা ধরে রেখেছিলেন। ছোটো ছোটো বর্ণনায় লেখক পুরো নিশ্চিন্তপুর শহরকে চোখের সামনে ফুটিয়ে তুলেছেন।
“অদ্ভুতুড়ে বইঘর”-এর প্লট অসাধারণ। সেই সাথে লেখকের সাবলীল লেখনশৈলী বই শেষ না হওয়া পর্যন্ত পাঠককে ধরে রাখবে। বর্ণনায় কোনো বাহুল্য চোখে পড়েনি। যেখানে যতটুকু প্রয়োজন ছিল, ঠিক ততটাই রয়েছে। ছোটো ছোটো অধ্যায়ে বিভক্ত বইটির কাহিনিও যথেষ্ট গতিশীল। শুরু থেকেই মূল কাহিনি এগিয়ে গিয়েছে। প্রতিটি অধ্যায়ের শেষে লেখকের যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তার ছাপ পাওয়া যায়, যা পাঠককে পরবর্তী অধ্যায়ের জন্য আগ্রহী করে তোলে। প্রতিটি অধ্যায়ের শুরুতে একটি করে ছবি আছে, যা সেই অধ্যায়ের মূল চরিত্র কে হবে, তা বুঝতে সাহায্য করে।
“অদ্ভুতুড়ে বইঘর” উপন্যাসিকায় লেখকের উপস্থাপনা প্রশংসা করার মতো। নানান জায়গায় যথেষ্ট হিউমার মেশানোর চেষ্টা করেছিলেন। গল্পের খাতিরে সেসব দারুণ লেগেছিল। সাথে সংলাপের প্রশংসা করতেই হয়! সংলাপগুলোই পুরো বইটিকে জীবন্ত করে রেখেছিল। সেই সাথে মশা ও রঞ্জুমামার নানান কাণ্ডে যে সব হাস্যরসের সৃষ্টি হয়েছিল, তাতে না হেসে থাকা যায় না। এমন সব অনুভূতি ছাপার অক্ষরে ফুটিয়ে তোলাও লেখকের দক্ষতা।
বইটির সবচেয়ে আকষর্ণীয় দিক রহস্য উন্মোচন পর্যায়। এই গল্পে রহস্য বলতে যা ছিল, যা ধীরে ধীরে এগিয়ে যায়। শুরু থেকেই পাঠক বুঝতে পারবে কী হচ্ছে, কে করছে। তারপরও একটা আকর্ষণ গল্পের শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে, শেষে কীভাবে এর সমাধান হয় তা জানার অপেক্ষা। এই সমাধান লেখক যেভাবে মঞ্চায়িত করেছেন, আমার কাছে এক কথায় তৃপ্তিদায়ক। এক পর্যায়ে প্রেডিক্ট করতে পেরেছিলাম কী হতে যাচ্ছে। তবুও এই বইয়ের শেষটা এমন না হলেই খারাপ লাগত।
▪️চরিত্রায়ন :
ছোটো এক উপন্যাসিকায় অনেক চরিত্রের আনাগোনা ছিল। লেখক দক্ষ হাতে সব চরিত্রকে সামাল দিয়েছেন। একটি চরিত্রকেও বাড়তি মনে হয়নি। মনে হয়েছে, এরা না থাকলেই হয়ত গল্পের ধার কমে যেত। তারচেয়েও লেখক দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন চরিত্র বিন্যাসে। অনেকগুলো চরিত্র, যেখানে সবার চরিত্র ডেভেলপ করার প্রয়োজন ছিল না। লেখক সে চেষ্টাও করেননি। অল্প কথায় সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। যেখানে অল্প কথায় কাজ হয়, সেখানে বেশি কথার প্রয়োজন খুব একটা নেই।
এই গল্পের প্রধান দুই চরিত্র মশা ও রঞ্জুমামাকে লেখক যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন, তা প্রশংসা করার মতো। একজন কিশোর তো এমনই হয়। এছাড়াও আকাশ স্যার, হারান স্যার, বাশার স্যার, আশফাক খান, ওসি আজমত, খিজির আলী, রহস্যময় বুড়ো; প্রত্যেকেই স্বতন্ত্র। একেক জনের স্বভাব, চালচলন একেক রকম। লেখক প্রত্যেককেই নিজস্ব বুদ্ধিমত্তা দিয়ে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন।
▪️বানান, সম্পাদনা, প্রচ্ছদ, প্রোডাকশন :
বানান ভুল খুব একটা চোখে পড়েনি। ‘কীভাবে’-কে কিভাবে লেখা আর কি/কী এর ভুল ব্যবহার ছিল দুয়েক জায়গায়। এক দুইটা মুদ্রণ প্রমাদ ছিল। কিছু জায়গায় সম্পাদনার প্রয়োজন অনুভব করেছি। এছাড়া প্রোডাকশন কোয়ালিটি যথেষ্ট ভালো ছিল। অন্যধারা প্রকাশনীর কাগজ, বাঁধাইয়ের মান নিয়ে অভিযোগ করার অবকাশ নেই।
এই প্রচ্ছদটা আমার খুব ভালো লাগছে। প্রচ্ছদে থাকা প্রত্যেকে আলাদা ও স্বতন্ত্র চরিত্র প্রকাশ করে। বইয়ের ভেতরের ছবিগুলো আছে। পাঠক পড়ার সময় প্রতিটি চরিত্রকে আলাদা করে নেবে।
▪️পরিশেষে, মশা ও রঞ্জুমামার যুগলবন্দী আমার বেশ লেগেছে। শুনেছি তাদের নিয়ে লেখক আবার লিখবেন। আমার মনে হয় এমন লেখা আরও হওয়া উচিত। রঞ্জু আর মুশফিক উজ জামান চৌধুরী আবার যদি কোনো রহস্য সমাধানে হাজির হয়, তাহলে মন্দ হয় না।
Original Copy Collect