- বই : হীরামানিক জ্বলে
- লেখক : বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
- প্রকাশনী : কবি প্রকাশনী
পূর্বকথাঃ “আমার দিন শেষ হয়ে এসেছে, কাল যে সূর্যদেব উঠবে আকাশে, তা আমি চোখে বোধহয় দেখতে পাব না…” এ কথা বলে মৃত্যুর সন্নিকটে চলে আসা বৃদ্ধ নটরাজন ছোট চামড়ার একটি ব্যাগ দিয়ে যায় এক মুসলিম খালাসির কাছে। ব্যাগের ভিতর থাকা ম্যাপে আঁকা আছে সুলু সমুদ্রে একটা খাড়ির ধারে নিবিড় জঙ্গলের মধ্যে অবস্থিত এক প্রাচীন চম্পা রাজ্যের রাজধানীর ধ্বংসস্তূপ। প্রাচীন এই নগরীর কোনো এক জায়গায় লুকানো আছে প্রচুর ধনরত্ন।
ব্যাগে ছিল আরেকটা মহামূল্যবান বস্তু-পদ্মরাগ মণির উপর খোদাই করা নবম শতাব্দীর সিলমোহর। সিলমোহরে অদ্ভুত সব চিহ্ন খোদাই করা। আর ধারনা করা হয় এসব চিহ্নের সাথে রয়েছে প্রাচীন নগরীর ধনভাণ্ডারের সম্পর্ক। এ যেন আরব্য উপন্যাসের একটা গল্প, কিংবা রূপকথার মায়াপুরী–পাতালপুরীর ধনভাণ্ডার! কিন্তু সেই প্রাচীন সম্পদ পাহারা দেয় বিহ্মমুনির দল। বিহ্মমুনি বড় ভয়ানক অপদেবতা, হিন্দুদের পুরোহিত মারা যাবার পর বিহ্মমুনি হয়।
সেই গহীন অরণ্যে জনমানবহীন পরিত্যক্ত নগরীর অলিতে গলিতে ঝোপঝাড়ে ধূম্রবর্ণ, বিকটাকার, বুভুক্ষু বিহ্মুমুনির দল সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে শিকারের সন্ধানে হাঁক পাড়ে। নগরীর অন্ধকার পাতালপুরীতে পড়ে থাকা নরকঙ্কাল মানুষের দুর্নিবার লোভ, অর্থলিপ্সার ইহকাল ও পরকালের সাক্ষী। যুগযুগান্ত কেটে গেছে, কালের আবর্তে ইতিহাসের চাকা ঘুরে মানুষ উন্নত সভ্যতায় পদার্পণ করেছে কিন্তু চম্পা রাজ্যের ঐশ্বর্য, পুরাকীর্তি, বিশাল ধনভাণ্ডার এখনো পড়ে রয়েছে লোকচক্ষুর আড়ালে।
কাহিনি সংক্ষেপঃ ছোট্ট গ্রাম সুন্দরপুরে একসময় সমৃদ্ধশালী জমিদারি ছিল মুস্তফি বংশের। এই বংশের ছেলে সুনীল ম্যাট্রিক পাশ করে বাসায় অলস সময় কাটাচ্ছে। এক সন্ধায় কলকাতার গড়ের মাঠে মেটেবুরুজের এক খালাসির সাথে তার দেখা হয়ে গেলো। প্রথমে একটু ভয় পেলেও ক্রমশ লোকটার সম্পর্কে সুনীলের কৌতূহল বেড়ে উঠল। মাঝি মাল্লাদের দেশ বিদেশে ঘোরাঘুরির গল্পে গল্পে সেই খালাসি বলতে লাগলো ডাচ ইস্ট ইন্ডিজের এক দ্বীপের কথা। সেখানে তারা মানুষের বসতির সন্ধান করতে গিয়ে জঙ্গলের মধ্যে এক জায়গায় হঠাৎ আবিস্কার করে হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি সম্বলিত বহুকালের পুরানো শহরের ভগ্নস্তূপ।
খালাসির দেখানো অদ্ভুত চিহ্ন আঁকা সিলমোহর, মানচিত্র ও সমুদ্রযাত্রার বর্ণনা শুনে সুনীলের অভিযানের দূর্বার নেশা জেগে উঠে। সুনীল তার ছোট মামাতো ভাই সনৎ,খালাসি জামাতুল্লা ও তার বোম্বেটে বন্ধু মি.ইয়ার হোসেনকে নিয়ে ভারত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে হাজির হয় ভয়ংকর জন্তু জানোয়ারে পরিপূর্ণ সেই নির্জন দ্বীপে। এই প্রাচীন নগরে লুক্কায়িত আছে অমূল্য ধনভাণ্ডার আর পদে পদে রয়েছে বিপজ্জনক সব মরণফাঁদ। তারা কি পারবে বিহ্মমুনির নজর এড়িয়ে এই শ্মশানপুরীর রহস্যভেদ করে বিপুল রত্নভান্ডার উদ্ধার করতে? নাকি অন্য গুপ্তধন অনুসন্ধানকারীদের মত সলিল সমাধিতে নিজেরদের নাম ফলক লেখাবে?
লেখক পরিচিতিঃ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘পথের পাঁচালী’ ও ‘আরণ্যক’ উপন্যাসের জন্য বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে আছেন। গ্রাম বাংলার প্রকৃতিকে অন্তর্ভেদী দৃষ্টি দিয়ে উপলব্ধি করা ও গভীর মমত্ববোধে দরিদ্র মানুষের কথা নিজের সবটুকু আবেগ নিংড়ে সাহিত্যে রূপ দেয়ার চেষ্টা করেছেন আমৃত্যু। নাগরিক ব্যস্ততার কৃত্রিমতা, দৈনন্দিন জীবন আর সর্বোপরি মৃত্যুকে অন্তর থেকে উপলব্ধি করেছেন।
পাঠপ্রতিক্রিয়াঃ
★ প্রকৃতিকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি আর উপন্যাসে সেটা শৈল্পিক চিত্রকর্মে রূপ দিতে বিভূতিভূষণ ছিলেন অদ্বিতীয়, অতুলনীয়। ডাচ ওয়েস্ট ইন্ডিজের কোনো দ্বীপ ভ্রমণ না করেও উপন্যাসে জাহাজে করে অসীম সমুদ্র পাড়ি দেয়া, জলদস্যু,ভয়ংকর জন্তু জানোয়ার,প্রাচীন হিন্দু নগরী, গুপ্তধনের হাতছানি ও ট্রপিক্যাল অরণ্যের গা ছমছমে বর্ণনা তাঁর কল্পনার তীক্ষ্ণতার পরিচয় দেয়। উপন্যাসের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিলো ভারতবর্ষের প্রাচীন হিন্দু সাম্রাজ্য, গৌরবময় অতীত ও ঐতিহ্যের ইতিহাস তুলে আনা।
★কম্পাস, ব্যরোমিটারের যুগের বহু পূর্বে ভারতীয়রা দুস্তর সমুদ্র পাড়ি দিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল এমন সব বীরত্বগাথা কাহিনির আলোকে লেখক ব্রিটিশ শাসনে পর্যদুস্ত, পদানত ভারতীয়দের শক্তি সঞ্চারের জয়গান গেয়েছেন। তাহলে শুরু হোক সেই অভিযাত্রা__“পৃথিবীর কত পর্বতে, কন্দরে, মরুতে, অরণ্যে অজানা স্বর্ণরাশি মানুষের চোখের আড়ালে আত্মগোপন করে আছে—বেরিয়ে পড়তে হবে সেই লুকোনো রত্নভাণ্ডারের সন্ধানে—নয়তো আপিসের দোরে দোরে মেরুদণ্ডহীন প্রাণীদের মতো ঘুরে ঘুরে সেলাম বাজিয়ে চাকুরির সন্ধান করে বেড়ানোই যার একমাত্র লক্ষ্য ,তার ভাগ্যে নৈব চঃ নৈব চঃ!”
★উপন্যাসের শুরু হয়েছে সুনীল নামের এক নিষ্কর্মা জমিদার ছেলের বর্ণনায়। কাহিনির বিস্তারের সাথে সাথে সুনীলের চরিত্রের দৃঢ়তা পরিবর্তনের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে আমাদের আলসে জীবন থেকে বের হবার ইঙ্গিত দিয়েছেন লেখক। কিশোর অ্যাডভেঞ্চারের আড়ালে এত সূক্ষ্ণভাবে জীবনদর্শনের প্রলেপ দেয়া একমাত্র বিভূতিভূষণের পক্ষেই সম্ভব।
★ নিম্নশ্রেনীর অশিক্ষিত এক খালাসির–বাবু ম্যাচিস্ আছে–ম্যাচিস্? ডাকে সাড়া দিয়ে সুনীলের মত উচ্চবংশের ছেলের জীবন দর্শন পাল্টে গিয়েছিল। দুআনা পয়সার বিনিময়ে শোনা অচেনা অজানা এক খালাসির অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি সুনীলের জন্য ছিল অমৃত। ধনী গরিবের বৈষম্যের কোনো বিষয় আলোকপাত না করেও সমাজের অসঙ্গতিতে আলপিন ফুটিয়েছেন লেখক।
★ উত্তাল সমুদ্রযাত্রায় মরণের ডঙ্কা বেজে দেখা মেলে ডুবো পাহাড়ের, যার সাথে ধাক্কা খেলেই সলিল সমাধি ঘটবে সবার। এমন রক্তহিম করা বিপদের মাঝেও চীনা কাপ্তেনের মাধ্যমে হাস্যরসাত্নক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছেন লেখক। চীনা কাপ্তেনের ভাষায়__”কোথা দিয়ে জাহাজ চালাচ্ছো গাধার বাচ্চা! পাহাড়ের চুড়ো দিয়ে!”
★উপন্যাসের শুরুর কিছু বর্ণনা অপ্রাসঙ্গিক লাগলেও বাকী পুরোটা ছিলো রোমাঞ্চকর আর রহস্যের বুনটে ঠাসা। অভিযানের শুরু থেকে অভিযাত্রিক দলের প্রতিটি ঘটনার বর্ণনা এত নিখুঁত যে কোথায় একটুও বিরক্ত লাগবে না। পাতালপুরীর ঘটনার শেষ অংশটুকু আর বিহ্মমুনির আসল পরিচয় যেমন চমকপ্রদ ছিল তেমনি বিষাদময় ছিল পরিসমাপ্তিটুকু।
চরিত্রকথনঃ উপন্যাসের মূল তিনটি চরিত্র সুনীল, সনৎ আর জামাতুল্লা। সুনীল জমিদার বংশের আয়েশি ছেলে। চরিত্রটির চিত্রায়ন ভাল হলেও অভিযাত্রায় তার ভূমিকা তেমন শক্ত বা দৃঢ়ভাবে ফুটে উঠেনি। সনৎয়ের চরিত্রটি দুরন্তর, সাহসী।ভয় বলে কোনো জিনিস নেই তার শরীরে, দুনিয়ার কোন কিছুকেই সে গ্রাহ্য করে না। একাই প্রকান্ড অজগরের সাথে লড়াই করার মত স্পর্ধা দেখিয়েছে। তবে উপন্যাসে দুর্দান্ত চরিত্রায়ন হয়েছে জামাতুল্লার। অবাঙালি জামাতুল্লার সংলাপগুলো ছিল মজার আর কান্ডকারখানা ছিলো কৌতুহলে ভরা। রহস্যময় আতংক সৃষ্টিকরা চরিত্রে ছিল জামাতুল্লার বোম্বেটে বন্ধু ইয়ার হোসেন। সাহেবি পোষাকে দেখতে ভদ্র এই লোক আসলে দুর্দান্ত দস্যু।
পুরো উপন্যাসে অস্ত্রসহ সবার উপর নজরদারি আর মাতব্বরি খাটিয়েছে। আরেকজনের কথা না বললেই নয় সে হলো চীনা কাপ্তেন। রসিক এই বুড়ো প্রবল স্রোত আর উন্মত্ত সমুদ্রে জাহাজ সামলে নিজের অভিজ্ঞতা আর জাত চিনিয়েছে। সব মিলিয়ে উপন্যাসের চরিত্রায়ন বেশ পরিপক্ব ছিল।
প্রোডাকশন কোয়ালিটিও সম্পাদনাঃ সব্যসাচী হাজরার করা প্রচ্ছদটা খুব সুন্দর হয়েছে, তবে রেজুলেশন একটু ফেড মনে হয়েছে। কবি প্রকাশনীর বইয়ের প্রোডাকশন কোয়ালিটি অসাধারণ। সম্পাদনা ও মাখন বলতে হবে, দুএকটা জায়গায় ‘এ’ কার / ‘ আ’ কার ভুল ছাড়া আর কিছু নজরে পড়েনি। এই বইটা পুরাই কালেক্টিবল আইটেম।
রেটিংঃ ৪/৫
উপসংহারঃ বহু বছর আগে যখন পড়েছিলাম উপন্যাসের সমাপ্তি আমার একদম ভালো লাগেনি, তবে এবার মনে হয়েছে এটাই সবচেয়ে পরিণত সমাপ্তি হয়েছে। অ্যাডভেঞ্চারের বই হিসেবে শিশু, কিশোর, বড়রাও পড়ে মজা পাবে নিঃসন্দেহে।তাই ভ্রমণপিয়াসীদের বলবো__“নমঃ নমঃ দিগ্বিজয়ী পূর্বপুরুষগণ, আশীর্বাদ করো–যে বল ও তেজ তোমাদের বাহুতে,যে দুর্ধর্ষ অনমনীয়তা ছিল তোমাদের মনে,আজ তোমার অধঃপতিত দুর্বল উত্তরপুরুষেরা যেন সেই বল ও তেজের আদর্শে আবার নিজেদের গড়ে তুলতে পারে, সার্থক করতে পারে ভারতের নাম বিশ্ব দরবারে।”
credit : Abu Hena Mostofa Farhad