হিপোক্রিট book review ll bookpoint24

 

অরুণ কুমার বিশ্বাস বুক রিভিউ প্রতিযোগিতা।

বই- হিপোক্রিট

লেখক- অরুণ কুমার বিশ্বাস

প্রকাশনী- পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

প্রকাশকাল-২০২০

মুদ্রিত মূল্য- ২০০টাকা

ছোটোবেলা থেকে পড়ে এসেছি মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ। কিন্তু বর্তমানে আমরা এমন একটা সময় এবং সমাজের বেড়াজালে বন্দি হয়ে পড়েছি যেখানে মানুষকে বিশ্বাস করাটাই যেন সবচেয়ে বড় পাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুহূর্তের মধ্যেই একটা ভালো মানুষ পরিণত হয়ে যেতে পারে জন্তু জানোয়ারে। আপাতদৃষ্টিতে আমরা যা দেখি, এর বাহিরেও কিছু থেকে যায়; যা দৃশ্যমান হয় না খালি চোখে। কেউ কেউ খুব সচেতনভাবে নিজেকে আড়ালে রাখে। সেই আড়াল হয়ে থাকা মানুষটা কখনো থাকে মুখের ভূমিকায় আবার কখনো মুখোশের ভূমিকায়। তাদেরকে সাধারণ মানুষের চেনার সাধ্য নেই।

 

পড়ে শেষ করলাম বর্তমান সময়ের তরুণ লেখক অরুণ কুমার বিশ্বাসের ‘হিপোক্রিট’। বইটা পাঠ শেষে অনেকগুলো বিষয় চক্রাকারে মাথার ভেতর ঘুরছে। মানুষ ঠিক কাকে বিশ্বাস করবে? মানবতা বলতে কী কিছু আছে দুনিয়াতে? মানুষ এতো নপুংসক হয় কীভাবে?! প্রশ্ন হতে পারে, বইয়ের সাথে এ বিষয়গুলোর সম্পর্ক কী? তাহলে চলুন জেনে নিই বইয়ের আদ্যোপান্ত এবং এই বিষয়গুলোর সম্পর্কের ব্যাখা।

 

আটবছরের দাম্পত্য জীবন রুবা এবং আদনানের। তাদের পাঁচ বছরের একটা ফুটফুটে কন্যাসন্তানও আছে, যার নাম মিমি। আদনান এবং রুবা দুজন একই ছাদের নিচে বসবাস করলেও তাদের মধ্যে আত্মিক যে টান, সেটা একেবারেই নেই। কারণ তারা দুজন দুজনকে পছন্দ করে বিয়ে করেনি, তাদেরকে বিয়ে দেওয়া হয়েছে পারিবারিকভাবে।

 

বড়লোক স্বামীর অনাদর, অবহেলা, সংসারের প্রতি উদাসীনতা; মধ্যবয়সী রুবাকে ক্লান্ত করে তোলে। সে প্রতিনিয়ত স্বামী-সংসার ও একমাত্র মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করে। মুক্তির কোনো পথ খুঁজে পায় না। ঠিক তখনই আগমন ঘটে অল্পবয়সী তূর্যের। যে মিষ্টি কথায় বোকা রুবাকে খুব সহজেই প্রেমের ফাঁদে ফেলে দেয়। রুবা তৃষ্ণার্ত কাকের মতো অপেক্ষা করছিলো একমুঠো ভালোবাসার। এজন্য রুবার জীবনে তূর্যের আগমন অনেকটা মেঘ না চাইতেই বৃষ্টিকে হাতের মুঠোয় পাবার মতো। রুবা সিদ্ধান্ত নিতে খুব একটা দেরি করে না। তূর্য রুবার চেয়ে বছর দশেকের ছোটো, এ বিষয়টাও রুবাকে ছুঁয়ে যেতে পারে না। তূর্যকে সে ভালোবেসে ফেলেছে। তূর্যও তাকে আশ্বাস দিয়েছে বিয়ে করবে। রুবার আর কোনো চিন্তা নেই। এই নিষিদ্ধ প্রেমের খবরটা কাউকে না জানিয়ে শান্তি পাচ্ছিলো না রুবা। এজন্য সে সবচেয়ে কাছের বন্ধু এবং কাজিন অর্নাকে বিষয়টা খুলে বলে। অর্না তাকে হতাশ করে না।

 

সারাক্ষণ তূর্যের সাথে ফোনে প্রেমালাপ, খুনসুটি, মাঝেমধ্যে দেখাসাক্ষাৎ, ঘনিষ্ঠতা; রুবার জীবনের মোড় পাল্টে দেয়। স্বামী আদনান বুঝতে পারে রুবার মধ্যে অনেকটা পরিবর্তন এসেছে, কিন্তু সে স্ত্রীকে কোনো প্রশ্ন করে না। এক পর্যায়ে তূর্য তার মুখোশ খুলে আসল চেহারা নিয়ে আসে রুবার জীবনে। চাটুকার তূর্যের প্রতি রুবার মোহ এবং বিশ্বাস-ভরসা ভেঙে চুরমার হয়ে যেতে খুব বেশি দেরি হয় না। যখন সমস্তকিছু বুঝতে পারে ,তখন রুবার আর কিছু করার থাকে না, বড্ড বেশি দেরি হয়ে গেছে। ইতোমধ্যে সে নিজেকে একেবারে খাদের কিনারে নিয়ে গেছে, যেখান থেকে ফেরার কোনো পথ নেই। একের পর এক মিথ্যে সত্য হয়ে সামনে আসতে থাকে।

 

রুবার অসাড় অসাড় লাগে, সমস্ত পৃথিবীটাকে মিথ্যে মনে হয়। স্বামী আদনান, একমাত্র বন্ধু অর্না, তূর্য সবাই নতুন পরিচয় নিয়ে আসে। খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে থাকা রুবা কেবল একজন প্রত্যক্ষদর্শী। তূর্য, অর্না, আদনান কোন সত্যগুলো নিয়ে রুবার সামনে এসেছিলো পালাক্রমে? মধ্যবয়সী রুবার জীবনের শেষ পরিণতি কী হয়েছিলো? মানুষকে অবিশ্বাস করা কী আসলে পাপ? এসব অমীমাংসিত প্রশ্নের উত্তর নিয়েই রচিত হয়েছে নন্দিত কথাশিল্পী অরুণ কুমার বিশ্বাসের ‘হিপোক্রিট’ নামক আখ্যান।

 

পাঠ প্রতিক্রিয়া লেখা আমার জন্য বেশ জটিল কাজ। ‘হিপোক্রিট’ বইটা পড়ে প্রথমেই যা মাথায় এসেছে তা হচ্ছে, বইয়ের এই প্লটটা আমাদের চারপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোরই আক্ষরিক প্রকাশ। এরকম ঘটনা অসংখ্য ঘটছে বর্তমান সমাজে। কিন্তু এ নিয়ে খুব একটা লেখা পাওয়া যায় না। এজন্য লেখকের এই প্লট নির্বাচনটা প্রশংসার দাবি রাখে। এই বই পাঠে একটা মেয়েও যদি সচেতন হয়, একটা ছেলেও যদি নতুন করে ভালোর পথে জীবনকে যাপন করার চিন্তা করে; তবে এখানেই একজন লেখকের লেখার সার্থকতা।

 

নারী পুরুষ উভয়কে নিয়েই আমাদের সমাজ। কিন্তু কিছু কিছু মানুষ আছে যারা যেকোনো অঘটনের জন্য সর্বাগ্রে পুরুষদেরকে কাঠগড়ায় দাঁড় করায়। আবার অনেকে দাঁড় করার কেবল নারীদেরকে। এর কোনোটাই করা উচিত না। নারী-পুরুষ আলাদা করে না ভেবে সবাইকে মানুষ হিসেবেই ভাবা উচিত। প্রতারিত হয় মানুষ মানুষের দ্বারা, সেই মানুষটা নারী পুরুষ যে কেউই হতে পারে। হিপোক্রিট বইটাতে লেখক সেই চরম সত্যটাকে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে ফুটিয়ে তুলেছেন। অর্ণা, তূর্য, আদনান; আপনি কাকে বিশ্বাস করবেন? আপনার সবচেয়ে কাছের ছেলে বন্ধুটিও যেমন সামান্যতম সুযোগ পেয়ে আপনার সর্বনাশ করতে পারে, ঠিক তেমনি আপনার কলিজার টুকরো মেয়ে বান্ধবীটিও আপনার বিশ্বাস ভেঙে চুরমার করে দিতে পারে মুহূর্তের মধ্যে।

 

যে কোনো বিষয়ে সহজে সিদ্ধান্ত নিতে পারা একটা বিশেষ গুণ। একটা সঠিক সিদ্ধান্ত মানুষের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। যেমনটা হয়েছিলো রুবা নামক মধ্যবয়সী সেই নারীর জীবনে। এ বই পাঠ শেষে কেউ চাইলেও রুবাকে একজন মমতাময়ী নারীর আসনে বসাতে পারবে না। কেননা রুবাও তার নিজের সাথে ঘটে যাওয়া ঘৃণ্যতম এ ঘটনার একজন অণুঘটক। সে যদি আবেগতাড়িত হয়ে এমন একটা ভুল সিদ্ধান্ত না নিতো, তাহলে হয়তো তার জীবনটা এমন বিষিয়ে উঠতো না। তাই বলা যায়, হিপোক্রিট বইটার মাধ্যমে লেখক তাঁর পাঠককে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সচেতন হওয়ার বার্তাটাও পৌঁছে দিয়েছেন সাবলীলভাবে।

 

পছন্দের কয়েকটা লাইন :

 

🌷 “মানুষের অনেক রূপ, হাজারো চেহারা। কোনটা মুখ, আর কোনটা তার মুখোশ কে জানে!”

 

🌷”মনের কথা সবসময় মুখে আনতে নেই। তাতে বিপত্তি বাড়ে। কষ্ট হয়।”

 

🌷 “সম্পর্কগুলো আসলে এমনই। তোয়াজ করো, তেল মারো, ভালো থাকবে। নইলে মাঝপথে চৌপট।”

 

🌷 “মুখভর্তি চুনকাম আর গায়ে দামি ড্রেস চাপালেই স্মার্ট হওয়া যায় না। ওটা ভিতরে থাকতে হয়। ফ্যাশন ও স্টাইল এক নয়। ফ্যাশন সামাজিক, কিন্তু স্টাইল ব্যক্তিক।”

 

🌷”যে মন কবিতা লেখে, বা যে হাত তুলির আঁচড়ে সাজায় বর্ণিল স্বপ্নছবি, সে কখনো খারাপ হতে পারে না।”

 

‘হিপোক্রিট’ ছিল আমার পড়া অরুণ কুমার বিশ্বাসের প্রথম বই। ভাষা ব্যবহারের প্রাঞ্জলতা, বাক্যের সহজবোধ্যতা, কাহিনির সুনিপুণ বুনন, বানান সচেতনতা; সবমিলিয়ে বইটা আমার খারাপ লাগেনি মোটেও। ভবিষ্যতে লেখক যে আরো অনেক ভালো করবেন, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। লেখক এবং লেখা দুটোর জন্যই রইলো শুভ কামনা।

বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?