স্যাপিয়েন্স : আ ব্রিফ হিস্টোরি অফ হিউম্যান কাইন্ড -ইউভাল নোয়া হারারি

  • বই : স্যাপিয়েন্স : আ ব্রিফ হিস্টোরি অফ হিউম্যান কাইন্ড
  • লেখক: ইউভাল নোয়া হারারি
  • অনুবাদক: আশফাক আহমেদ
  • বইয়ের ধরণ: বিজ্ঞানভিত্তিক ইতিহাস সমৃদ্ধ বই
  • ব্যাক্তিগত রেটিং : ৯/১০

মানুষ নিজেকে চিনতে চায়। কোথায় থেকে, কেমন করে মানুষ তৈরি হল, মানুষ সৃষ্টির ইতিহাস কি- এমন বহু প্রশ্নের উত্তর সবাই জানতে চায়। পৃৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন সংস্কৃতিতে এই প্রশ্নগুলোর বৈচিত্রপূর্ণ উত্তর রয়েছে। এই উত্তরগুলো পরষ্পরবিরোধী। এদের মধ্যে সবচেয়ে যুক্তিনিষ্ঠ ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রামাণ্য ইতিহাস জানায় জীববিজ্ঞান।মানবজাতির আজকের পৃথিবীব্যাপী আধিপত্যের শুরু থেকে বর্তমানের যাত্রার বিভিন্ন ঐতিহাসিক ধাপকে বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে তুলে ধরা হয়েছে ‘স্যাপিয়েন্স: আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব হিউম্যানকাইন্ড’ বইটির পাতায় পাতায়। 

লেখক পরিচিতি: ইয়ুভাল নোয়াহ হারারি (Yuval Noah Harari) জেরুজালেম বিশ্ববিদ্যালয়ের হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক। সামাজিক দর্শন ও বিশ্ব ইতিহাস (Big History) তাঁর আগ্রহের বিষয়।২০০৮ সালে তিনি শ্রেণীকক্ষে বিশ্ব ইতিহাস ও মানুষের বিবর্তন সম্পর্কে ২০টি বক্তৃতা দিয়েছিলেন। এই বক্তৃতাগুলোর আরও পরিমার্জিত ও বিস্তৃত রূপ হল ‘স্যাপিয়েন্স : মানবজাতির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’।  প্রথমে লিখেছিলেন হিব্রু ভাষায় ২০১১ সালে। পরে John Purcell এবং Haim Watzman এর সহযোগিতায় ইংরেজি অনুবাদ করে প্রকাশ করেন ২০১৪ সালে।পর্যন্ত (আগস্ট, ২০২১) এই বই ১ কোটি ৬০ লক্ষ কপি বিক্রি হয়েছে এবং অনূদিত হয়েছে ৬০টি ভাষায়।
বইয়ের সারসংক্ষেপ : বর্তমানের এই আধুনিক মানুষ হোমো স্যাপিয়েন্স (Homo sapiens), অথচ এক লক্ষ বছর আগে এই পৃথিবীতে বিচরণ করেছে হোমো (Homo) গণভুক্ত (Genus) আরো অন্তত ছয়টি মানব জাতিগোষ্ঠী, আর আজ সর্বত্র জয়জয়কার এই আধুনিক প্রজাতিটিরই। লেখক তাঁর বইয়ে মানুষের বিকাশের ইতিহাস ধারাবাহিকভাবে বলে যান। শুরু করেছেন মানুষের শিকারী জীবনের কাহিনী দিয়ে। তখন মানুষ ছিল প্রবৃত্তিচালিত প্রকৃতির সন্তান। নিজের চারপাশে যা কিছু পাওয়া যায়, তাই নিয়েই তারা সন্তুষ্ট ছিল। তখনও তারা প্রাণীজগতে বিশেষ কিছু হয়ে ওঠেনি। প্রকৃতির অংশ হিসেবে, প্রকৃতির সন্তান হিসেবে অন্যান্য প্রাণীদের সাথে মানুষের আলাদা কোন পার্থক্য ছিল না। ২৫ থেকে ৩০ লক্ষ্ বৎসর আগের মানবসদৃশ প্রাণীটি যখন থেকে পরস্পরের সঙ্গে ভাববিনিময় করতে শুরু করল, তখন থেকে শুরু হল মানুষ হয়ে ওঠার এক বর্ণিল ও জটিল অভিযাত্রা। কোন কিছু পর্যবেক্ষণ করা, সেই ঘটনা স্মৃতিতে সংরক্ষণ করে অন্যদের কাছে উপস্থাপন করতে পারা মানুষকে অন্য প্রাণীদের থেকে পৃথক করে তুলল। অতিপ্রাকৃত বা বিমূর্ত কল্পনার সামর্থ্য মানুষকে এনে দেয় সংঘবদ্ধ হবার শক্তি। বিশ্বাস নামক ভাবগত একটি আচরণ মানুষকে করে তোলে অজেয়।
হারারি তাঁর স্যাপিয়েন্স বইকে চারটি প্রধান ভাগে বিভক্ত করেছেন। প্রত্যেক ভাগে রয়েছে একাধিক অধ্যায়।
বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লব: ২৫ থেকে ৩০ লক্ষ বৎসর পূর্বে যে প্রাণীটি সোজা হয়ে দাঁড়াতে শুরু করে, সেই আদিম জীবসত্ত্বাটি বুদ্ধি ব্যবহার করে পরিপার্শ্বের হিংস্র জীবজন্তু ও বিরূপ প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়। বুদ্ধির ব্যবহার তাকে চারপাশের বিরূপ পরিবেশ সম্পর্কে আরও সতর্ক হতে, পরিবর্তিত আবহাওয়াগত পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে, প্রকৃতির অন্যান্য সদস্যদের সাথে মিথস্ক্রিয়া তৈরি করতে সাহায্য করে।
কৃষিবিপ্লব: দ্বিতীয় ভাগে লেখক মানবজীবনে কৃষিকাজের উদ্ভব, বিকাশ ও প্রভাব ব্যাখ্যা করেছেন। কৃষিজীবী জীবন শুরু করার কারণে মানুষ বড় সমাজের গুরুত্ব বুঝতে পারে।এই কৃষিজীবিতা মানুষকে সম্পদের ধারণা তৈরিতে সাহায্য করল। শিকারীজীবন পরিত্যাগ করার কারণে খাবারের নিরাপত্তার প্রতি তারা অধিক মনোযোগী হল। খাদ্যশস্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণের জন্য স্থায়ী পাথুরে কাঠামো তৈরি শুরু করল। শুধু শারীরিক শক্তি নয়, সংঘবদ্ধতার শক্তি দিয়ে তারা পূর্বপুরুষদের চাইতে বেশি কাজ করতে পারল।
মানবজাতির একত্রীকরণ: এই অংশে অংশে লেখক কৃষিজীবী জীবনের ফলে মানুষের মধ্যে যে যুথবদ্ধতা তৈরি হয়েছে তার অভিঘাতের বিশ্লেষণ করেন। মানব সমাজ পারস্পরিক সহমর্মিতা ও সহযোগিতা বৃদ্ধি করতে জন্ম দেয় কতিপয় অপ্রাকৃতিক আচরণের, যার নাম দেয়া হয়েছে সংস্কৃতি। ১০/১২ হাজার বৎসর আগে পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে মানবগোষ্ঠী ছোট ছোট গোত্রে বিভক্ত হয়ে নিজস্ব সংস্কৃতির আশ্রয়ে জীবন যাপন করত। ও শক্তিশালী সংস্কৃতি ছোট ছোট সাংস্কৃতিক এককগুলোকে ধ্বংস করে ফেলে। বিচ্ছিন্ন সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য বিলুপ্ত হয়ে বৃহত্তর সংস্কৃতিতে একীভূত হওয়ার কারণে কিছু কিছু বিষয়ে সাধারণ ঐক্যমত তৈরি হয়। গত ৫০০ বৎসরে রাজনীতি, অর্থনীতি, বিজ্ঞান, মানব অধিকার প্রভৃতি বিষয়ে সারা পৃথিবীর পরস্পরবিরোধী সংস্কৃতিগুলোর ধ্যানধারণায় আমুল পরিবর্তন হয়েছে। অনেক বিষয়েই বিশ্বের বেশিরভাগ মানুষ একই রকম সাংস্কৃতিক চিন্তায় সমর্থন প্রকাশ করেছে। আধুনিককালে যার সুভাষিত নাম রাখা হয়েছে ‘বিশ্বায়ন’।
বৈজ্ঞানিক বিপ্লব: এই অংশে লেখক মানবজাতির অগ্রগতির পেছনের প্রধান নিয়ামককে চিহ্নিত করেছেন। তিনি গণিত, অর্থনীতি, ইতিহাস আলোচনা করে সমকালীন বিজ্ঞান নির্ভর সমাজ বিকাশের শুরুর সূত্রের কথা বলেছেন। বৈজ্ঞানিক বিপ্লবে অজানা দেশের উদ্দেশ্যে অভিযাত্রা; নতুন জ্ঞান আবিষ্কারের তৃষ্ণা তাড়িত করেছে বৈজ্ঞানিক গবেষণায়। সেজন্য মানুষ উদ্ভাবন করেছেন নতুন বৈজ্ঞানিক সূত্র, নতুন প্রযুক্তির। প্রাপ্ত জ্ঞানের বাইরে আরও অজানা কিছু লুকিয়ে আছে কীনা তা জানতে মানুষ এতটাই উৎসুক যে এখনও তারা অজানা নতুন জ্ঞানের পিছনে অর্থ খরচ করতে দ্বিধা করে না। একই অংশে লেখক অন্যান্য প্রাণীদের উপর মানুষ নিজেদের টিকে থাকার জন্য কি ধরনের নির্দয় আচরণ করে, তার বিশ্লেষণ করেছেন।মানুষ নিজের সুখের সন্ধান করতে গিয়ে প্রাণীজগতের অন্যান্য প্রাণীদের সুখের কথা ভুলে গেছে।  মানুষের নিজের সুখ কি বায়বীয় মানসিক আবেগগত নাকি কিছু রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফল, তা আলোচনা করেছেন রসায়নের দৃষ্টিকোণ থেকে।
কিছু প্রিয় লাইন সমূহ : 
★ আমরা আমাদের প্রতিবেশের উপর প্রভুত্ব করেছি, খাদ্য উৎপাদন বাড়িয়েছি, শহর গড়ে তুলেছি, সাম্রাজ্য স্থাপন করেছি এবং দূরদূরান্তে বিস্তৃত বাণিজ্যিক নেটওয়ার্ক তৈরি করেছি। কিন্তু আমরা কি পৃথিবী থেকে যন্ত্রণা কমাতে পেরেছি? মানুষের শক্তির বারংবার দুর্দান্ত বৃদ্ধি স্যাপিয়েন্সের জন্য কল্যাণ বয়ে আনেনি, বরং প্রায়ই অন্য প্রাণীদের সীমাহীন দুর্ভোগের কারণ হয়েছে।
★ ধর্মে একটি সত্য ও সর্বজনীন অতিমানবীয় নিয়ম থাকতে হবে, যা সবসময় ও সবখানে প্রযোজ্য হবে। আর এই বিশ্বাসকে প্রতিনিয়ত ছড়িয়ে দিতে হবে। সুতরাং এটি হবে সর্বজনীন ও প্রচারমুখী।
ব্যাক্তিগত মতামত : লেখক তাঁর স্যাপিয়েন্স বইয়ে এই বিশেষ মানব প্রজাতিটির জীবন বিকাশের যাবতীয় দক্ষতা, পরিবেশের সাথে শারীরিক ও আচরণীয় খাপ খাইয়ে নেবার সক্ষমতা, রাজনৈতিক, সামাজিক, বৌদ্ধিক উৎকর্ষতা ইত্যাদিকে বিশ্লেষণ করেছেন। ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি হাজার হাজার বৎসরের বিবরণকে কয়েকশো পৃষ্ঠার সীমানায় গ্রন্থবদ্ধ করেছেন। তিনি ইতিহাসকে এক পলকে দেখাতে চেয়েছেন। তা করতে গিয়ে জীবন বিকাশের অনেক খুঁটিনাটি বর্ণনাকে উপেক্ষা করতে হয়েছে। তারপরও তিনি ‘স্যাপিয়েন্স’ বইতে মানব ইতিহাসের যতটুকু উল্লেখ করতে পেরেছেন, তা কৌতুহলী পাঠককে সন্তুষ্ট করার জন্য যথেষ্ট।প্রচলিত ইতিহাস বা জীববিজ্ঞান, নৃবিজ্ঞান, প্রত্নবিজ্ঞান, ভূবিজ্ঞান বইয়ের মত তথ্যবহুল করে নয়, গল্পের মত করে, শ্রেণীকক্ষে পড়ানোর মত করে তিনি বর্ণনা করেন। পাঠককে তথ্যের নিরস উপস্থাপনে ভারাক্রান্ত করতে চান নি। এক্ষেত্রে তিনি সফল হয়েছেন।
ক্রেডিট : খালিদ বিন আলীম 
ভলেন্টিয়ার কন্টেন্ট রাইটার
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?