[পা ঠকদের নিশ্চয় স্মরণ আছে, অ্যালান কোয়াটারমেইন মৃত্যুর কিছু আগে তাঁর ডাইরির একেবারে শেষে অনেকদিন আগে গত হওয়া স্ত্রীর কথা উল্লেখ করেছেন।
তাঁর সাহিত্যিকজীবনের গোড়া থেকেই সাথে আছি বলে মৃত্যুর কথা জানাজানি হবার পরপরই তাঁর সাতিহ্যিকবিষয়ক সমস্ত কাগজপত্র তুলে দেয়া হয় আমার হাতে। সেগুলোর মধ্যে আমি দুটো পাণ্ডুলিপি পাই। একটাতে তাঁর কোন ভূমিকা নেই। জুলুদের নিয়ে লেখা সেই কাহিনী তিনি শুনেছেন এক জুলু বীরের মুখ থেকে। ওই কাহিনী নিয়ে আপাতত আমাদের কিছু করার নেই। অন্য পাণ্ডুলিপিটি প্রকাশ করা হলো।]
Title | স্টেলা |
Author | হেনরি রাইডার হ্যাগার্ড |
Publisher | ঐতিহ্য |
Quality | পিডিএফ ডাউনলোড |
ISBN | 9789847766294 |
Edition | 1st Edition, 2020 |
Number of Pages | 88 |
Country | বাংলাদেশ |
Language | বাংলা |
অনেকবার আমার মনে হয়েছে, (মি. কোয়াটারমেইনের পাণ্ডুলিপি শুরু হলো) বিয়ে এবং প্রিয়তমা স্ত্রীকে কিভাবে হারালাম সেসব ঘটনা লিখে ফেলি। ওই ঘটনার পর অনেকদিন কেটে গেছে। সময় আমার হৃদয়কে বেশ কিছুটা শান্ত করে এনেছে। কিন্তু প্রকৃত দুঃখ কি কখনও শান্ত হয়? আগুনের ওপর বড়জোর ছাইয়ের প্রলেপ পড়ে মাত্র। দু’তিনবার আমি ঘটনাগুলো লিখতেও শুরু করেছিলাম। প্রথমবার লেখা বন্ধ করি সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ায়। তার পরেরবার বাদ পড়ে হঠাৎ করে একটা অভিযান শুরু করায়। শেষবার একটা কাফ্রি ছেলে হাতের কাছে আর কিছু না পেয়ে আমার পাণ্ডুলিপি দিয়েই চুলো ধরানোর কাজটা সারে।
কিন্তু এবার ইংল্যান্ডে আসার পর আমার হাতে অখণ্ড অবসর। তাই চতুর্থবারের মত চেষ্টা করতে যাচ্ছি। যদি সফল হই, তাহলে যখন আমি আর এই পৃথিবীতে থাকব না, তখন হয়তো এটা অনেকের কৌতূহল মেটাবে। আমি চাই না, এই ঘটনা আমার মৃত্যুর আগে প্রকাশিত হোক ।
আমি একজন ধর্মপ্রচারকের পুত্র। আসলে, বাবা ছিলেন অক্সফোর্ডশায়ারের একটা ছোট্ট যাজকপল্লীর ভারপ্রাপ্ত যাজক। ওখানে বসবাস শুরু করার বেশ কয়েকবছর আগেই তিনি বিয়ে করেছিলেন। চার সন্তানের মধ্যে আমি ছিলাম সবার ছোট। যেখানে আমরা ছিলাম, সে জায়গাটার কথা ভাসাভাসা মনে পড়ে। রাস্তার দিকে মুখ করা প্রাচীন একটা ধূসর বাড়িতে আমরা থাকতাম। বাগানে কিসের যেন একটা প্রকাণ্ড গাছ ছিল। গাছটার ভেতরটা ছিল ফাঁপা। আমরা তার ভেতরে ঢুকে খেলা করতাম । রাতে পাশাপাশি ঘুমোতাম আমরা চারজন।
শোয়ার পর মা এসে আমাদের সবাইকে চুমো খেতেন। প্রায়ই ঘুম ভেঙে যেত আমার । দেখতাম, মোমবাতি হাতে বিছানার ওপর ঝুঁকে আছেন মা। দেয়ালের গা থেকে একটা খুঁটি বেরিয়ে ঝুঁকে ছিল আমাদের বিছানার ওপর। বড়ভাই একবার আমার দু’হাত বেঁধে ওই খুঁটির সাথে ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন। সে ছিল এক ভয়াবহ ব্যাপার। ব্যস পুরানো বাড়ি সম্বন্ধে এটুকুই আমার স্মৃতি। অনেকদিন আগেই ভেঙে ফেলা হয়েছে, তা না হলে একবার দেখতে যেতাম বাড়িটা।
আমাদের বাড়ি থেকে কিছু দূরে ছিল লোহার গেটওয়ালা একটা বিরাট বাড়ি গেটের দু-পাশের থামের ওপর বিকটদর্শন দুটো সিংহমূর্তি। ওগুলোকে খুব ভয় পেতাম আমি। গেটের শিকগুলোর ভেতর দিয়ে উকি দিলে বাড়িটা দেখা যেত। লম্বা ইউ-ঝোপে ঘেরা একটা বিষণ্ণ জায়গা। অবশ্য গরমের সময় কিছু ফুলও ফুটত সেখানে। বাড়িটাকে বলা হত হল। স্কোয়্যার কারসন বাস করতেন সেখানে। বড়দিনের এক উৎসবে হলে এ গেছি আমরা।
উৎসবটা বাবা ওখান থেকে চলে আসার ঠিক আগে হয়েছিল কি না, পরিষ্কার মনে পড়ছে না। যাই হোক, বিরাট এক পার্টির আয়োজন করা হয়েছিল। লাল টকটকে ওয়েস্টকোট পরে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছে ফুটম্যানেরা। কালো ওকের প্যানেল দেয়া ডাইনিং রুমে রাখা হয়েছে ক্রিসমাস-ট্রী, সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন স্কোয়্যার কারসন। ভদ্রলোক ছিলেন লম্বা, গায়ের রঙ তামাটে, খুবই শান্ত প্রকৃতির। ওয়েস্টকোটের ওপর অনেকগুলো রাজকীয় সীলমোহর এঁটেছেন তিনি। আমরা বুড়ো ভাবলেও সেসময় তাঁর বয়স চল্লিশের বেশি ছিল না। পরে জানতে পেরেছিলাম, যৌবনে তিনি একজন বিখ্যাত পর্যটক ছিলেন।
এই ক্রিসমাস উৎসবের ছ-সাত বছর আগে বিয়ে করেছিলেন আধা স্পেনীয় এক মহিলাকে বাবা বলতেন- পেইপিস্ট (পোপের সমর্থক)। মহিলার কথা পরিষ্কার মনে আছে আমার। ছোটখাট গোলগাল, খুবই সুন্দরী। বড় বড় কালো দুই চোখ, ঝকঝকে দাঁত। ইংরেজি বলতেন অদ্ভূত উচ্চারণে। ছোটবেলায় আমার চেহারা নিশ্চয় কিছুটা হাস্যকর ছিল। কারণ, মাথার চুল দাঁড়িয়ে থাকত সবসময়। সেই সময়ে মা-র আঁকা একটা স্কেচ এখনও আমার কাছে আছে। মাথার খাড়া চুলগুলো আঁকতে একটুও ভুল করেননি মা। উৎসবের কথায় ফিরে আসি। লম্বা, বিদেশী চেহারার এক ভদ্রলোকের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন মিসেস কারসন। হাতে ধরা সোনার চশমা দিয়ে ভদ্রলোকের কাঁধে মৃদু টোকা মারতে মারতে তিনি বললেন দেখো, বাদামী চোখের ওই বাচ্চাটা কেমন অদ্ভূত; চুলগুলো কেমন, বলো
তো? ঠিক বুরুশের মত। ইস্, কি মজার বাচ্চা!’ গোঁফে তা দিয়ে মিসেস কারসনের একটা হাত নিজের হাতে তুলে নিলেন
ভদ্রলোক। তারপর সেই হাত দিয়ে পালিশ করার চেষ্টা করতে লাগলেন আমার মাথার চুল। হঠাৎ ফিসফিস করে মহিলা বললেন ‘হাত ছেড়ে দাও। টমাসের চেহারা দেখেছ-একেবারে ঝড়ো মেঘের মত হয়ে
উঠেছে।’ টমাসই হলেন মি. কারসন-তাঁর স্বামী।
আমি ছিলাম খুবই লাজুক। এই ঘটনার পর একটা চেয়ারের পেছনে লুকিয়ে লক্ষ্য করতে লাগলাম স্টেলা কারসনকে। স্টেলা মি. কারসনের একমাত্র সন্তান। ক্রিসমাস-ট্রী থেকে খুলে খুলে উপস্থিত ছেলেমেয়েদের উপহার বিতরণ করছে সে। বড় বড় কালো চমৎকার দুটো চোখ-যার চেয়ে সুন্দর কোনকিছু আমি কখনোই দেখিনি। অবশেষে আমার উপহার নেয়ার পালা এল। বড় একটা বাঁদর পড়ল আমার ভাগে। ক্রিসমাস-ট্রী-র নিচু একটা ডাল থেকে বাঁদরটা পেড়ে আমাকে দিয়ে ও বলল
অ্যালান কোয়াটারমেইন, ছোট্টমণি, তোমার জন্যে এটাই আমার বড়দিনের
উপহার।’ আমাকে উপহার দেয়ার সময় হাত নাড়াচাড়া করতে করতে হঠাৎ কেমন করে যেন ওর জামার হাতা একটা মোমবাতি স্পর্শ করল। তৎক্ষণাৎ দপ্ করে জ্বলে উঠল।
আগুন। গলার দিকে আগুন ছুটে আসছে দেখেও একচুল নড়ল না ও। সম্ভবত ভয়ে অসাড় হয়ে গিয়েছিল; চারপাশে ছড়িয়ে থাকা মহিলারা চিৎকার করে উঠল খুবই জোরে, কিন্তু সাহায্যের জন্যে কেউ এগিয়ে এল না। হঠাৎ কি হলো আমার, ঝাঁপিয়ে পড়লাম স্টেলার ওপর। দু’হাতে বাড়ি মারতে লাগলাম আগুনে। সৌভাগ্যের বিষয়, নিবে গেল আগুন ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করার আগেই। গলায় একটু আঁচ লাগা ছাড়া আর কোন ক্ষতি হয়নি স্টেলার। তবে বিশ্রীভাবে দগ্ধ হলো আমার কব্জি দুটো। অনেকদিন পর্যন্ত কব্জি জড়িয়ে রাখতে হয়েছিল পশম দিয়ে।
হল-এ বড়দিনের উৎসব সম্বন্ধে এটুকুই আমার মনে আছে। তারপর কি হয়েছিল-জানি না। তবে স্বপ্নে আজও স্টেলার সেই মিষ্টি মুখ আর কালো চোখের ভয়ার্ত দৃষ্টি দেখতে পাই ।
এর পরের যে ঘটনা আমার পরিষ্কার মনে আছে তা হলো, জ্বরে ভীষণভাবে আক্রান্ত হয়েছিলেন মা ও আমার তিন ভাই। পরে জেনেছিলাম, শয়তান কিছু লোক আমাদের কুয়োতে একটা মরা ভেড়া ফেলে দেয়াতেই এই কাণ্ড ঘটেছিল।
এই সময়ে মি. কারসন এলেন আমাদের বাসায়। আবহাওয়া বেশ ঠাণ্ডা, আগুন জ্বলছে পড়ার ঘরে। সেই আগুনের সামনে বসে পেন্সিল দিয়ে চিঠি লিখছি আমি। আপনমনে কথা বলতে বলতে ঘরের এধার থেকে ওধার পায়চারি করছেন বাবা। আসলে, স্ত্রী ও তিন সন্তানের জীবনরক্ষার জন্যে প্রার্থনা করছিলেন তিনি। এইসময় একজন ভৃত্য এসে হাজির হলো, ‘স্কোয়্যার এসেছেন, স্যার,’ বলল সে, ‘আপনার সাথে দেখা করতে চান।’
“বেশ,’ ক্লান্ত স্বরে জবাব দিলেন বাবা । প্রায় সাথে সাথেই ঘরে প্রবেশ করলেন স্কোয়্যার কারসন। ফ্যাকাসে মুখ, খ্যাপাটে চেহারা, ধক্ধক্ করে জ্বলছে দুই চোখ-ভয়ই লাগল আমার।
‘আপনার এই দুঃসময়ে বিরক্ত করার জন্যে ক্ষমা চাইছি, মি. কোয়াটারমেইন, কর্কশ স্বরে বললেন তিনি, ‘কিন্তু আগামীকাল চিরদিনের জন্যে চলে যাচ্ছি এখান থেকে, তাই যাবার আগে আপনার সাথে কথা বলা দরকার। হ্যাঁ, আপনার সাথে কথা আমাকে বলতেই হবে।’
‘অ্যালানকে ভেতরে পাঠিয়ে দেব?’ আমার দিকে আঙুল নির্দেশ করে বললেন
বাবা।
‘দরকার নেই; ও এসব বুঝবে না।’ সত্যিই কিছু বুঝিনি তখন। কিন্তু প্রত্যেকটা কথা মনে থাকায় বুঝতে পেরেছি পরে।
‘আগে বলুন, ওরা কেমন আছে?’ ওপরদিকে বুড়ো আঙুল তুলে বললেন তিনি। আমার আর দুই ছেলের কোন আশা নেই, গুঙিয়ে উঠে জবাব দিলেন বাবা। ‘জানি না, তৃতীয়টার কি হবে। হয়তো ঈশ্বরের ইচ্ছেই পূরণ হবে!’ “ঈশ্বরের ইচ্ছেই পূরণ হবে,’ প্রতিধ্বনিত হলো স্কোয়্যারের কণ্ঠ। ‘এখন শুনুন,
কোয়াটারমেইন-আমার স্ত্রী পালিয়েছে।’ ‘পালিয়েছে।’ বললেন বাবা। ‘কার সাথে?’ ‘ওর সেই বিদেশী কাজিনটার সাথে। যাবার সময় একটা চিঠি লিখে রেখে
গেছে। সেটা পড়ে বুঝলাম, একমুহূর্তের জন্যেও আমার চিন্তা করত না ও, বিদেশীটাই ছিল তার ধ্যান-জ্ঞান। ও আমাকে বিয়ে করেছিল শুধু আমার টাকার জন্যে। সম্পত্তির বেশির ভাগ উড়িয়ে ফুরিয়ে দিয়ে এখন ভেগেছে, জানি না কোথায়। ভাগ্যিস, বাচ্চাটাকে নিয়ে মাথা ঘামায়নি; স্টেলা আমার কাছেই আছে।’
পেইপিস্টকে বিয়ে করলে এরকমই হয়, কারসন,’ বললেন বাবা। ‘তা, এখন কি করবেন, খুঁজবেন?
তিক্ত হাসি হাসলেন স্কোয়্যার।
‘খুঁজব! ওকে কেন খুঁজব আমি? ওকে পেলে হয়তো খুন করে ফেলব, অথবা ওদের দুজনকেই। না, ওর মুখ আমি আর কোনদিনই দেখতে চাই না। ওকে আমি বিশ্বাস করেছিলাম, কিন্তু ও আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। এখন ওর ভাগ্যে যা আছে, তা-ই ঘটবে। চলে যাক ও যেখানে খুশি। অবশ্য আমিও চলে যাব। এ জীবন আর সহ্য হয় না।’
‘কারসন, কারসন,’ বললেন বাবা, ‘আপনি নিশ্চয় বলতে চাইছেন না যে-‘
‘না, না; আপনি ভয় পাবেন না। মৃত্যু এমনিতেই খুব তাড়াতাড়ি আসে, তাকে আর ডেকে এনে কি হবে! আমি ছেড়ে চলে যাব এই মেকি সভ্যতার জগৎ, লজ্জা ঢাকতে বাচ্চাকে নিয়ে সোজা চলে যাব বনে। হয়তো ভাবছেন, কোথায় যাব! জানি না, কোথায়। তবে এটুকু জানি যে, সেখানে কোন সাদা মুখ নেই, নেই কোন শিক্ষিত মানুষের মিষ্টি মিষ্টি কথা
*আপনি পাগল হয়ে গেছেন, কারসন,’ বললেন বাবা। ওখানে আপনি থাকবেন কিভাবে? স্টেলার পড়াশোনার কি হবে? তার চেয়ে একজন পুরুষমানুষের মত অতীত ঝেড়ে ফেলুন।’ “আমি পুরুষও হব, অতীতও ঝেড়ে ফেলব, কিন্তু এখানে নয়,
কোয়াটারমেইন। শিক্ষা ! কেন, সেই মহিলা, আমার স্ত্রী কি উচ্চশিক্ষিতা ছিল না। সে শিক্ষা। কেন এই মহিলা। আমার স্ত্রী না। চালাকও ছিলাম না! না, স্টেলা শিক্ষিত হবে ঠিকই, তবে তার শিক্ষালয় হবে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। যদি প্রয়োজন হয়, সে এমনকি তার নিজের নামটিও ভুলে যাবে। বিদায়, বন্ধু, চিরবিদায়। আমাকে খোঁজার চেষ্টা করবেন না। আজ থেকে আমি আপনার কাছে মৃত, পরিচিত সবার কাছে মৃত ।
চলে গেলেন তিনি। ‘পাগল,’ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন বাবা। দুঃখে মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তবে
নিজের ব্যাপার উনি নিশ্চয় আমার চেয়ে ভাল বুঝবেন।’ এইসময় নার্স দ্রুতপায়ে ঘরে ঢুকে বাবার কানে ফিসফিস করে কি যেন বলল সাথে সাথে সাদা হয়ে গেল বাবার মুখ। টেবিল চেপে ধরে কোনমতে সামলালেন নিজেকে, তারপর টলতে টলতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। মা তখন প্রায় মৃত্যুপথযাত্রী।
ক’দিন পর, ঠিক ক’দিন পর বলতে পারব না, বাবা আমার হাত ধরে নিয়ে গেলেন ওপরতলায়। যে বড় ঘরটা ছিল মা-র শোবার ঘর, সেখানেই তিনি শুয়ে আছেন। তবে খাটে নয়, কফিনে। হাতে ধরে আছেন কিছু ফুল। দেয়ালের গা ঘেঁষে তিনটে ছোট ছোট সাদা বিছানা। একেকটাতে শুয়ে আছে আমার একেকজন ভাই, তাদেরও প্রত্যেকের হাতে ফুল। বাবা বললেন তাদের সবাইকে চুমু খেতে। চুমু খাবার সময় কেন জানি না ভীষণ ভয় পেলাম আমি। পরে আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলেন বাবা।
“ঈশ্বর এদের দিয়েছিলেন,’ বললেন তিনি, ‘আবার তিনিই নিয়ে নিলেন।’ খুবই কাঁদতে লাগলাম আমি। বাবা আমার হাত ধরে নিচতলায় নিয়ে গেলেন। তার পরের স্মৃতি আমার কাছে ভাসাভাসা। কালো পোশাক পরা অনেকগুলো লোক যেন ভারী ভারী বোঝা নিয়ে গেল কবরস্থানের দিকে।
এর পর দেখলাম বিরাট একটা জাহাজ আর বড় বড় ঢেউ ওঠা জলরাশি। প্রায় সব হারিয়ে ইংল্যান্ডের ওপর থেকে মন উঠে গিয়েছিল বাবার। ঠিক করেছিলেন, দক্ষিণ আফ্রিকা চলে যাবেন। সেইসময় বাবার অবস্থা ভাল ছিল না। তার ওপর মা-র মৃত্যুর পর তাঁর হাত প্রায় খালি হয়ে পড়ে। যাই হোক, সাধারণ একটা জাহাজের সবচেয়ে নিচের ক্লাসে উঠে রওনা দিলাম। অবর্ণনীয় কষ্ট হলো পথের মাঝে। অবশেষে জাহাজ একদিন ভিড়ল দক্ষিণ আফ্রিকায়।
সভ্যতার ছোঁয়া তখনও দক্ষিণ আফ্রিকায় ঠিকমত লাগেনি। বাবা দেশের মধ্যাঞ্চলে গিয়ে কাফ্রিদের মিশরি নিযুক্ত হলেন। ওখানেই বড় হতে থাকলাম আমি। আমরা যেখানটায় ছিলাম, তার পাশেই এখন গড়ে উঠেছে ক্যাডক শহর । প্রতিবেশীদের মাঝে ছিল কিছু বুঅ্যার চাষী। তবে ধীরে ধীরে মিশন স্টেশনের চারপাশে গড়ে ওঠে একটা শ্বেতাঙ্গ উপনিবেশ। একজন মাতাল স্কচ কামার ছিল সেখানকার সবচেয়ে মজার লোক। চাকাওয়ালা গাড়ি তৈরি করত সে। যখন সুস্থ স্বাভাবিক থাকত, স্কচ কবি বার্নস-এর কাব্য এবং তখন সদ্য প্রকাশিত ইনগোল্ডসবাই লিজেন্ডস্ থেকে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা মুখস্থ বলে যেতে পারত। ওর মুখে শুনে শুনেই ইনগোল্ডসবাই লিজেন্ডস্-এর প্রতি আমার একটা চিরকালীন ভালবাসা জন্মায়। তবে বার্নস আমার কখনোই ভাল লাগেনি, সম্ভবত স্কটল্যান্ডের বিরক্তিকর আঞ্চলিক ভাষার জন্যে। পড়াশোনা যেটুকু শিখেছি বাবার কাছেই। কিন্তু বইয়ের প্রতি তেমন কৌতূহল আমার কোনকালেই ছিল না, বাবারও যথেষ্ট সময় থাকত না আমাকে নিয়ে বসার। অপরদিকে, মানুষ ও প্রকৃতিকে বোঝার একটা তীক্ষ্ণ ক্ষমতা জন্ম নিয়েছিল আমার মাঝে। বিশ বছর বয়সেই ডাচ ও তিন-চার রকমের কাফ্রি ভাষা শিখে ফেলেছিলাম নিখুঁতভাবে। তাছাড়া, কাফ্রিদের চিন্তাধারা ও চালচলন গোটা দক্ষিণ আফ্রিকায় আমার চেয়ে ভাল কেউ বুঝত কি না, সে ব্যাপারে আমার সন্দেহ আছে। এসবের সাথে সাথে গুলি ছোঁড়া ও ঘোড়ায় চড়াটা রপ্ত করে নিয়েছিলাম খুব ভালভাবে। আর, পরিশ্রমের ব্যাপারে বেশির ভাগ লোকের চেয়েই আমি ছিলাম ওপরে। তখনও আমি এখনকার মতই ছোটখাট হালকা-পাতলা ছিলাম, কিন্তু কোন পরিশ্রমই আমাকে ক্লান্ত করতে পারত না। অত্যন্ত কড়া সূর্যালোক বা যে কোন ধরনের কষ্ট আমি সইতে পারতাম। সহ্যশক্তির পরীক্ষায় কোন কাফ্রিও আমাকে পরাজিত করতে পারেনি। তবে এখন সবকিছুই অনেক আলাদা, আমি বলছিলাম আমার তরুণ বয়সের কথা।
এ-কথা ভেবে সবাই অবাক হতে পারে যে, ওইরকম পরিবেশে থেকেও আমি বুনো হয়ে গেলাম না কেন। বাবার সঙ্গ আমাকে বুনো হতে দেয়নি। তাঁর মত ভদ্র ও সৎ লোক আমি জীবনে দেখিনি। সবচেয়ে হিংস্র যে কাফ্রি সে-ও তাঁকে ভালবাসত। তিনি বলতেন, পৃথিবীতে তাঁর মত অপদার্থ আর কেউ নেই। আমি ভাবি, ওরকম অপদার্থ যদি পৃথিবীতে আরও কিছু থাকত। প্রত্যেক সন্ধ্যায় কাজ সেরে প্রার্থনা পুস্তক হাতে বসতেন মিশন স্টেশনের ছোট্ট বারান্দায়, আপনমনে পাঠ করতেন সান্ধ্য স্লোত্র। কোন কোন দিন পর্যাপ্ত আলো থাকত না। কিন্তু এটা তাঁর পড়াশোনায় বিন্দুমাত্র অসুবিধে সৃষ্টি করতে পারত না, সব স্তোত্র তাঁর মুখস্থ ছিল। পাঠ শেষ হলে চেয়ে থাকতেন চাষাবাদের জমিগুলোর ওপারে কাফ্রিদের কুঁড়েঘরের দিকে।
আসলে কিন্তু তাঁর দৃষ্টি চলে যেত ধূসর গির্জার দিকে, ইউ গাছের নিচের পাশাপাশি তিনটে কবরের দিকে।
স্টেলা – ওই বারান্দাতেই তাঁর শেষসময় এসে উপস্থিত হলো। শরীরটা ভাল যাচ্ছিল না। এক সন্ধ্যায় আমার সাথে গল্প করতে করতে তাঁর মন চলে গেল অক্সফোর্ডশায়ারের দিনগুলোতে। বললেন, এতগুলো বছর কেটে গেছে, অথচ মা-র কথা তিনি একটা দিনের জন্যেও ভোলেননি। একটা কথা ভেবে তাঁর খুবই আনন্দ হচ্ছে, মা যে দেশে গেছেন, খুব শিগগির তিনিও যারেন সেই দেশে। এরপর তিনি জানতে চাইলেন, যে রাতে স্কোয়্যার কারসন আমাদের বাড়ি এসে তাঁর স্ত্রীর পালিয়ে যাবার কথা বলেছিলেন, সেই রাতটার কথা আমার মনে আছে কি না ।
বললাম, পরিষ্কার মনে আছে। ‘এখনও অবাক হয়ে ভাবি, তিনি গিয়েছেন কোথায়,’ বললেন বাবা, ‘কে জানে, তাঁর মেয়ে স্টেলা এখনও বেঁচে আছে কি না। আর কোনদিনই দেখা হবে না তাঁদের সাথে। কিন্তু জীবন বড় বিচিত্র, অ্যালান । তোমার সাথে হয়তো দেখা হয়ে যেতেও পারে। যদি কখনও দেখা হয়, আমার ভালবাসা জানিয়ো ওদের।’
এরপর উঠে চলে গেলাম আমি। কাফ্রি চোরেরা খুব উপদ্রব করছিল সে সময়। চোর ধরার আশায় কয়েকরাত জেগে কাটিয়েছি। ঠিক করলাম, সেই রাতও পাহারা দেব। এই রাত জাগার অভ্যেসের জন্যেই স্থানীয় অধিবাসীরা আমার নাম দিয়েছিল মাকুমাজন, দায়সারা অনুবাদ করলে যার অর্থ দাঁড়ায় ‘এক চোখ খুলে রেখে ঘুমোনো মানুষ’। রাইফেলটা তুলে নিয়ে চলে যেতে উদ্যত হতেই বাবা ডাকলেন, কপালে চুমু খেয়ে বললেন, “ঈশ্বর তোমাকে শাস্তি দিক, অ্যালান! আশাকরি, মাঝে মাঝে মনে করবে এই বুড়ো বাবার কথা। আর, সুন্দর ও সুখী একটা জীবন গড়ে তুলবে।’
আমি তাঁর কথায় খুব একটা গুরুত্ব দিলাম না। যতই দিন যাচ্ছে, একটা মনমরা অবস্থার শিকার হয়ে পড়ছেন বাবা। ক্রালে গিয়ে বসে পড়লাম পাহারা দিতে। চোরের সাক্ষাৎ পাওয়া গেল না। ভোরের একঘণ্টা আগে উঠে মিশন স্টেশনের দিকে রওনা দিলাম। কাছাকাছি আসতেই দেখি, কে যেন বসে আছে বাবার চেয়ারে। প্রথমে ভাবলাম, মাতাল কোন কাফ্রি, পরে দেখি, বাবা গভীর ঘুমে অচেতন। সত্যিই বড় গভীর সে ঘুম, মারা গেছেন বাবা !
স্টেলা PDF হেনরি রাইডার হ্যাগার্ড
বইপাও থেকে আপনি আর কি কি কন্টেন্ট পেতে চান?